ছবির জগতে ঠিক কী করলেন রবীন্দ্রনাথ? আমূল বদলে দিলেন ছবির সংজ্ঞা, ভেঙে চুরমার করে দিলেন ছবির আঙ্গিকের গভীর কূটকৌশল। চিত্রকলার জন্য সাহিত্যের দুয়ার দিলেন বন্ধ করে। পটে এনে দিলেন প্রতিদিনের দেখা আড়ম্বরহীন সহজ প্রতিমা। তার কিছু চোখে দেখা, কিছু বা দেখা না-দেখায় মেশা। কিছু রইল স্মৃতিতে জড়ানো। সেই সঙ্গে ছবির উপকরণের অহংকার নিমেষে দিলেন খর্ব করে। বিলেতি কাগজ আর রঙের তোয়াক্কা করলেন না। শুরু হল সুশোভন অধিকারী-র কলাম ‘ছবিঠাকুর’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
রবি ঠাকুর, ছবি ঠাকুর। এরকম ভাবতে বেশ লাগে আমাদের। নাকি খানিক উল্টে নিয়ে বলতে হবে, ছবির ঠাকুরই রবি ঠাকুর। হ্যাঁ, শিল্পের আধুনিক প্রেক্ষিতে সেকথা বলতে কোনও বাধা নেই আমাদের। রবি ঠাকুরের হাত ধরেই তো দেশে আধুনিক চিত্রকলার শুরুয়াত। ছবি যে প্রধানত চোখের দেখায়, তা যে দৃষ্টির শিল্প, যাকে আজ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছি ‘ভিসুয়াল আর্ট’ হিসেবে– সে কথা তিনিই প্রথম বলেছেন আমাদের।
কোনওরকম ভনিতা না করে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘আমরা দেখতে চাই– দেখতে ভালবাসি। সেই উৎসাহে সৃষ্টিলোকে নানা দেখবার জিনিস জেগে উঠছে। সে কোন তত্ত্বকথার বাহন নয়, তার মধ্যে জীবনযাত্রার প্রয়োজন বা ভালমন্দ বিচারের কোন উদ্যোগ নেই। আমি আছি– আমি নিশ্চিত আছি এই কথাটা সে আমাদের কাছে বহন করে আনে’। আবার আরেকটু খোলসা করে, ‘ছবি কি– এ প্রশ্নের উত্তর এই যে– সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালমন্দের আর কোনোও রকম যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু– সে অবান্তর–অর্থাৎ সে যদি কোনোও নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান’। কী আশ্চর্য কথা! চিত্রশিল্প বিষয়ে এমন আধুনিক ভাবনা আর কারও কাছে শুনেছি? এমন কি পরেও! অথচ তিনি তো আদতে কবি ঠাকুর, সাহিত্যের আখড়ায় যাঁর বসবাস, প্রতিষ্ঠা, বিশ্বজোড়া খ্যাতি! সেই কবি ঠাকুর কি তবে ছবির পথও দেখালেন? তা কী করে হয়? তাহলে অবন ঠাকুর, যিনি ছবি লেখেন? তাঁকেও কি ছাপিয়ে গেলেন তাঁর এই কনিষ্ঠ পিতৃব্য? না, ছাপিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন এখানে ওঠে না।
অবনীন্দ্রনাথ আমাদের শিল্পের ভগীরথ। ভারতশিল্পের মরাগাঙে নতুন ধারার জোয়ার এনেছেন তিনিই। সেজন্য তাঁকে অনেক কসরত করতে হয়েছে, করতে হয়েছে অসামান্য পরিশ্রম। অবনীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, সেইসময় ‘একটা লম্বা মোটা শক্ত ফোর্স পাম্প দিয়ে জল তুলতে হয়েছিল। নয়তো বেগে জল উঠত না। পড়তও না’। তার কারণ, ‘দেশে তখন জল ছিল না একেবারে। তাই ফোর্স পাম্পের দরকার হয়েছিল। তখন চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কোথায় ইন্ডিয়ান আর্ট, কোথায় ইন্ডিয়ান আর্ট’। ইন্ডিয়ান আর্টের খোঁজ চালিয়েছেন নানা দিকে। আঁতিপাঁতি করে অনুসন্ধান চলেছে লোকশিল্পের ভাঁড়ার থেকে সাহিত্যের ভাঁড়ার, অজন্তা, মুঘল কত কী! কখনও পুরাণের আবরণ ছিঁড়ে ফুটে উঠেছে চিত্ররূপ। প্রকাশ ঘটেছে কল্পনার প্রাকার পেরিয়ে। খেয়াল করলে দেখি, অবন ঠাকুরের ছবির পরতে পরতে জমেছে কত বর্ণিল প্রলেপ, কত না কুশলী পলেস্তারা। সেখানে শিল্পীর ভাবনার একটি রেখা, রঙের সামান্য একটু ঘাটতি হলে চলে না। চিত্রপট উপচে উঠেছে ভাব আর আদর্শের আপন গরিমায়, আঙ্গিকের অভিনব শৈলীতে। অবনের ছবি দেখার সময় দর্শকের অন্তরে সশ্রদ্ধ সম্ভ্রম জাগে। নিজের অজান্তেই মন বলে ওঠে, কী আশ্চর্য! কী অপূর্ব! কী অলোকসামান্য! আঙ্গিকের কোন মায়াবী দক্ষতায় শিল্পী তাঁর ছবিকে পৌঁছে দেন অন্যলোকে– যার নাগাল সহজসাধ্য নয়? সে কি তবে শিল্পীর কল্পনায় সাহিত্যেরই এক চিত্রিত পাঠ? ভাবনা আর আদর্শের বেণীবন্ধনে গাঁথা রং আর রেখার অলৌকিক আলপনা? এ প্রশ্ন তোলা রইল এখন, উত্তর জেনে নেব কোনও শিল্পতাত্ত্বিকের কাছে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
খেয়াল করলে দেখি, অবন ঠাকুরের ছবির পরতে পরতে জমেছে কত বর্ণিল প্রলেপ, কত না কুশলী পলেস্তারা। সেখানে শিল্পীর ভাবনার একটি রেখা, রঙের সামান্য একটু ঘাটতি হলে চলে না। চিত্রপট উপচে উঠেছে ভাব আর আদর্শের আপন গরিমায়, আঙ্গিকের অভিনব শৈলীতে। অবনের ছবি দেখার সময় দর্শকের অন্তরে সশ্রদ্ধ সম্ভ্রম জাগে। নিজের অজান্তেই মন বলে ওঠে, কী আশ্চর্য! কী অপূর্ব! কী অলোকসামান্য! আঙ্গিকের কোন মায়াবী দক্ষতায় শিল্পী তাঁর ছবিকে পৌঁছে দেন অন্যলোকে– যার নাগাল সহজসাধ্য নয়? সে কি তবে শিল্পীর কল্পনায় সাহিত্যেরই এক চিত্রিত পাঠ?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এবারে অবিন ঠাকুরের দিক থেকে চোখ ফেরাই, তাত রবিন ঠাকুরের দিকে। তাঁকে ‘ছবির ঠাকুর’ কেন বলতে চাই, সে একবার দেখে নিই। ছবির জগতে ঠিক কী করলেন তিনি? আমূল বদলে দিলেন ছবির সংজ্ঞা, ভেঙে চুরমার করে দিলেন ছবির আঙ্গিকের গভীর কূটকৌশল। চিত্রকলার জন্য সাহিত্যের দুয়ার দিলেন বন্ধ করে। পটে এনে দিলেন প্রতিদিনের দেখা আড়ম্বরহীন সহজ প্রতিমা। তার কিছু চোখে দেখা, কিছু বা দেখা না-দেখায় মেশা। কিছু রইল স্মৃতিতে জড়ানো। সেই সঙ্গে ছবির উপকরণের অহংকার নিমেষে দিলেন খর্ব করে। বিলেতি কাগজ আর রঙের তোয়াক্কা করলেন না। অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল বিচিত্রসব আকার। অসীম সাদার অপরে সসীম কালো দিয়ে টানা চাপ চাপ অন্ধকার। এমনকী, সেখানে রঙের চেয়ে রেখা ও আকারের দাবি উঠল প্রবল হয়ে। বললেন, কেবল রেখা দিয়েই সম্পূর্ণ ছবি হতে পারে। এ যেন সলমা-চুমকি-রাংতা-জড়ির প্রলেপ খসা খড়ের প্রতিমা। যার অবস্থান মণ্ডপের আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যায় ধূমায়িত আরতির মায়া থেকে বহুযোজন দূরে। সহজ সপাট প্রত্যক্ষ আকারের সেই মহাযাত্রা ধেয়ে এল কবির চিত্রপটে। রইল শুধু প্রত্যক্ষ দেখা আর দেখানোর আনন্দ, কেবল মেতে ওঠা সৃষ্টির খেয়ালে, নাকি রেখার মাতলামিতে। এ কেবল দৃষ্টির জগতে একান্ত দ্রষ্টারূপে চিত্রকরের আপন সত্তার উদ্বোধন। পশ্চিমের আধুনিক শিল্পীরা যখন সবে বলতে শুরু করেছেন ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’– এই হল আধুনিক শিল্পের বড় কথা। তখন সমুদ্রের এপারে কি অবলীলায়, বোধের কোন স্তর থেকে সেই ভাবনার আরেকটি পিঠ অনায়াস কণ্ঠে উচ্চারণ করে বসলেন রবি ঠাকুর। এতকাল পরেও বিস্ময়ের ঘোর, কোন ইন্দ্রজালে এমনটা সম্ভব হল! ভেবে দেখলে, শিল্পের ইতিহাসে এমনটা কখনও ঘটেনি– যেখানে বিশ্ববিশ্রুত কবি তাঁর দেশের শিল্প-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাই নন, দেশের শিল্পভাবনাকে পৌঁছে দিয়েছেন আধুনিকতার আলোকিত ঘাটে।
(চলবে)
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।