কবির প্যারিস একজিবিশন পর্ব কি রোম্যাঁ রোলাঁর কাছে অপছন্দের ঠেকেছিল? তাঁর কি মনে হয়েছিল নিজের দেশের সংকটকালে বিদেশে লেকচার আর ছবির প্রদর্শনী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বড় বেশি ব্যস্ত? রোলার মতো অনেকটা সেইরকম, তাঁর চোখে এ একধরনের পলায়নি মনোবৃত্তি। মনে মনে তিনি কবির ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। যদিও একে রোলার বিচারের ভ্রান্তি, রুচির দীনতা ও হঠকারী মনের পরিচয় বলে অনেকেই মনে করেন। রোলার মনোভাব স্পষ্ট দুয়েকটা ঘটনায়। যেমন, ২ মে তারিখে গ্যালারি পিগাল-এ রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শনীতে নিমন্ত্রিত হয়েও সময়াভাবে রোলা যেতে পারেননি বলে জার্নালে লিখে রেখেছেন।
১৫.
জার্মানির কাগজে রবীন্দ্রনাথের ছবি ঘিরে যে উচ্চকিত প্রশংসা, তার খানিকটাও ফরাসি কাগজে পাওয়া গেল না কেন– এ প্রশ্ন বার বার মনের মধ্যে উঁকি দেয়। পশ্চিমের দু’টি দেশের শিল্পভাবনায় এমন ফারাকের কারণ কী? এ কি একপ্রকার সাংস্কৃতিক রাজনীতি? আধুনিক শিল্পকলায় ফরাসিদের বিপুল প্রভাব-প্রতিপত্তির ব্যাপারটা কি এর নেপথ্যে কাজ করেছে? বিশ্বশিল্পের দরবারে ফ্রান্স এমন এক তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল যে, অন্য দেশ থেকে সকলে এখানে এসে ভিড় করেছে। পিকাসোও তাঁর আস্তানা গেড়েছিলেন প্যারিসে। আজীবন দেশে থাকলে তাঁর এমন উত্তরণ সম্ভব ছিল কি না– বলা সহজ নয়। অন্যদিকে যুদ্ধবাজ দেশ বলে জার্মানির গায়ে একটা তকমা লেগেছিল। যুদ্ধাপরাধী জার্মানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক সে সময় একেবারে তলানিতে। অথচ শিল্পকলায় জার্মানির অবদান কিছুমাত্র কম নয়। আধুনিক শিল্পের প্রেক্ষিতে জার্মান এক্সপ্রেশনিজম একটা জরুরি অধ্যায়। তাদের কাজ, শিল্পচিন্তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। খেয়াল করলে দেখি, বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সামগ্রিকভাবেই শিল্পকলার সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। ভেঙে খান খান হয়েছে শিল্পের সংজ্ঞা, সুন্দরের ডেফিনেশন। শিল্পীর দল এসে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত অ্যাকাডেমিক আর্টের বাইরে। জার্মানিও তার থেকে আলাদা নয়। প্রাচ্যের ‘প্রোফেট’রূপী রবি ঠাকুর পর্যন্ত পরবর্তীকালে এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের দিকেই ঝুঁকেছেন। সে প্রসঙ্গে আসছি।
সময়ের নিরিখে তুলনা করলে দেখি, পূর্ব আর পশ্চিমের শিল্পভাবনায় দুই ভিন্ন অবস্থান। প্রাচ্যশিল্পের পথে আমাদের আর্টের অভিমুখ, বিলেতের দীর্ঘ শাসনে তা পালটে যেতে বসেছে। কিন্তু সেই পর্বের ভাঙা-গড়ায় বিলেতের অধীনে থেকেও নিজেকে বদলাতে চাইছে। চাইছে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে। আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টের অনুশাসন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে তখন সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বদেশি আন্দোলনের চালচিত্রে দাঁড়িয়ে অবন ঠাকুর তাঁর পটে ফুটিয়ে তুলছেন ‘ভারতমাতা’র প্রতিমা। আর ঠিক সেই সময়, এ দেশ থেকে বহু যোজন দূরে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ফোবিজম, এক্সপ্রেশনিজমের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। তাদের মন্ত্রও শিল্পের অ্যাকাডেমিক ভাবনাকে অস্বীকার। এডওয়ার্ড মুংখ, এনসর প্রমুখ এঁদের অন্যতম। বয়সের নিরিখে, মুংখ প্রায় রবীন্দ্রনাথেরই সমবয়সি। তাঁর ছবির প্রধান অবলম্বন হতাশা, আর্তি, মনস্তাপ, ঈর্ষা আর দুঃখবাদের হাহাকার। আবার রবি ঠাকুরের চেয়ে বয়সে সামান্য ছোট এমিল নোলদের ছবিতে উত্তাল হয়েছে রঙের তুফান। ক্যানভাসে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে চিত্রীর আঁতের কথা। আকারকে বাড়িয়ে কমিয়ে অপ্রাকৃত করে গড়ে তুলতে চাইছে শিল্পীরা, অন্তরের অদম্য আবেগে তুলির আঁচড় হয়ে উঠছে রুক্ষ অবিন্যস্ত কর্কশ। উঠে আসছে মনোজগতের গহনতা, কারও ক্যানভাসে আধ্যাত্মিক জগতের নির্লিপ্ত উদাসীনতার আভাস। এক্সপ্রেশনিজমের আধারে এ সবই বুঝি মিলেমিশে একাকার।
কাটাকুটির নিভৃত করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছবিঠাকুর যেন নিজেকে খুঁজে পেলেন এই এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পভাবনায়। জীবনের প্রান্তে এসে তিনিও কি ভেতরে ভেতরে ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন না? ব্যক্তিজীবনের সেইসব তীব্র শোক আর বিচ্ছেদের মুহূর্তমালা তাঁকেও কি ক্রমে চুরমার করে দিচ্ছিল না? তবু বাইরে তাঁর সংযত সংহত রূপটি প্রকাশিত থেকেছে। অন্তরের বেদনা কানায় কানায় ভরে উঠেছে তাঁর গানে, কবিতায়– বাইরের কাউকে বুঝতে দেননি। সেই যন্ত্রণা, সেই শূন্যতার অসহায় দোসর হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক সংকট, বিশ্বভারতীর সমস্যা। ‘কারো কাছে’ না বলা সেই কথা, ‘বুকের তলা’ ভরে ওঠা সেইসব যন্ত্রণা যেন ‘সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে’ছে অন্যদিকে, এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের দুয়ারে। যে ‘ব্যথার পূজা সমাপন’ করতে চেয়েছেন শিল্পশিখায়– সেই আগুনে জ্বলে উঠেছে ছবিঠাকুরের ছবি । তাঁর ছবি জার্মান শিল্পীদের যত কাছের সে দেশের শিল্পীরাও কাছে টেনে নিয়েছে তাঁর কাজ। এরিখ হেকল, স্মিট রটলুফ, কারশনার থেকে এমিল নোলদে, পাওলা মোডারসন বেকার প্রমুখ হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রচিত্রের নিকট প্রতিবেশী। মনে রাখতে হবে, ১৯২২-এর ডিসেম্বরে জার্মানির ‘বাউ হাউস’ থেকে ছবির যে প্রদর্শনী কলকাতার ‘সমবায় ম্যানসন’-এ আয়োজিত হয়েছিল তার নেপথ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কলাভবন তখন সদ্য গড়ে উঠছে, ফলে কলকাতার ‘সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’ ছিল তার আয়োজক। সোসাইটির কর্ণধার তখন গগনেন্দ্রনাথ। সেবারেই একঝাঁক আধুনিক জার্মান শিল্পীর কাজ স্বচক্ষে দেখার সুযোগ ঘটেছে কলকাতাবাসীর। এই জরুরি প্রদর্শনীতে শিল্প-ইতিহাসের শিক্ষিকা হিসেবে কলাভবনে সদ্য যোগ দেওয়া স্টেলা ক্রামরিশের ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল। তবে ১৯২১-’২২ সালে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণে অনুপুঙ্খ জার্মানি সফর এই কাজকে সার্থক আকার দিতে পেরেছিল। অর্থাৎ ছবিঠাকুরের জার্মান কানেকশন তৈরি হয়েছে সেই পর্বে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আন্দ্রে কার্পলেসের গভীর হৃদ্যতা থাকলেও ফরাসি শিল্পীদের ছবি নিয়ে এমনটা ঘটেনি। আগেই বলেছি, সেক্ষেত্রে পুরোভাগে ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।
রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে প্যারিসের নীরবতা প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও মনে হয়। কবির প্যারিস একজিবিশন পর্ব কি রোম্যাঁ রোলাঁর কাছে অপছন্দের ঠেকেছিল? তাঁর কি মনে হয়েছিল নিজের দেশের সংকটকালে বিদেশে লেকচার আর ছবির প্রদর্শনী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বড় বেশি ব্যস্ত? রোলাঁর মত অনেকটা সেইরকম, তাঁর চোখে এ একধরনের পলায়নি মনোবৃত্তি। মনে মনে তিনি কবির ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। যদিও একে রোলাঁর বিচারের ভ্রান্তি, রুচির দীনতা ও হঠকারী মনের পরিচয় বলে অনেকেই মনে করেন। রোলাঁর মনোভাব স্পষ্ট দুয়েকটা ঘটনায়। যেমন, ২ মে তারিখে গ্যালারি পিগাল-এ রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শনীতে নিমন্ত্রিত হয়েও সময়াভাবে রোলাঁ যেতে পারেননি বলে জার্নালে লিখে রেখেছেন। একজিবিশনের পরে জন্মদিনের সংবর্ধনা আর রেডিও-তে ভাষণের শেষে ৭ তারিখে কবি ইংল্যান্ড ফিরেছেন। ইতিমধ্যে জুন মাসের মাঝামাঝি কালিদাস নাগের সঙ্গে রোলাঁর কথোপকথনে উপচে উঠেছে সেই ক্ষোভ। সাহিত্য এবং রাজনীতি– দুটো ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের অবনমন তখন রোলাঁর চোখে পড়েছে। এমন কথাও বলতে ছাড়েননি যে, ‘বলাকা’র পর রবীন্দ্রনাথের রচনায় আর উল্লেখযোগ্য কিছুই তিনি দেখতে পান না। তাই এখন সব ছেড়েছুড়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ভুলিয়ে রাখছেন ছবি এঁকে। আরেকটি ভয়ানক কথা, এখানেই বুঝি রাগের আসল কারণ লুকিয়ে। সে হল, ‘এখন রবীন্দ্রনাথের চিত্তবিক্ষেপের এবং বিস্মৃতির এত প্রয়োজন হয়েছে যে তার ফলে প্যারিসে এখন সব snob-দের সংসর্গ তিনি স্বেচ্ছায় অনুসন্ধান করছেন বা গ্রহণ করছেন। যারা তাঁর মতো ব্যক্তির অযোগ্য। তার ফলে তিনি আমাদের ফরাসী বন্ধুদের সঙ্গত নিন্দাবাদের লক্ষ্য হয়েছেন’।
রোলাঁর এই মত কি সমর্থনযোগ্য? কী আশ্চর্য, কিছুকাল আগেও কবির প্রতি শ্রদ্ধায় আনত দেখেছি তাঁকে। ভিক্টোরিয়া অবশ্য এর জবাব দিয়েছেন সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রকাশিত রবীন্দ্রশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে। রোলাঁর মনের এই পরিবর্তনে আমরা চমকে উঠলেও দেখি, অনেক সময়েই তিনি নানা হঠকারী মন্তব্যের শিকার। এইজন্যে প্যারিসের তথাকথিত বিদগ্ধবৃত্তের কাছে রোলাঁর গুরুত্ব প্রায়ই অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি। এ ছাড়াও বলা দরকার, আধুনিক শিল্পকলা প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা তেমন পরিষ্কার ছিল না। এমনকী, সমসাময়িক শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেকের নাম তাঁর মুখে উচ্চারিত হয়নি। যেমন, প্রুস্ত, মোরিয়াকের মতো ঔপন্যাসিক, আন্দ্রে জিদ, ভ্যালেরির মতো কবি বা চিন্তাশীল সমালোচক, জিরোদু বা ককতোর মতো নাট্যকার এবং মাতিস বা পিকাসোর মতো শিল্পীরা ছিলেন তাঁরই সমসাময়িক। অথচ রোলাঁর সারাজীবনের কাজে এসব কথা জানার কোনও উপায় নেই! যাইহোক, ১৯৩০-এর আগস্ট মাসে জেনিভায় রোলাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সাক্ষাৎ ঘটে, সেইটেই উভয়ের শেষ দেখা। সে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গেও রোলাঁ তাঁর জার্নালে রবি ঠাকুরকে ‘বৃদ্ধ আদুরে খোকা’ বলে ঠাট্টা করেছেন। ছবির প্রদর্শনী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাসকে ‘নিতান্ত ছেলেমানুষি’ মনে হয়েছে তাঁর। হয়তো তার অন্যতম কারণ, সেই মুহূর্তে গান্ধীজিতে ডুবে থাকা রোলাঁর কাছে রবি ঠাকুরের কথায় মহাত্মার প্রসঙ্গ একবারও উঠে না-আসা। এখন বহুদূরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, প্যারিস প্রদর্শনীর নেপথ্যে কত না আলো-ছায়ার খেলা চলেছিল! তবু সব ছাপিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, রবিঠাকুরের চিত্রীসত্তার গভীর urge-কে রোলাঁ হয়তো অনুভব করতে পারেননি।
(চলবে)
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৪: অমৃতা শেরগিলের আঁকা মেয়েদের বিষণ্ণ অভিব্যক্তি কি ছবিঠাকুরের প্রভাব?
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি