রবীন্দ্রনাথ নারী ও পুরুষের সৌন্দর্যের মধ্যে একটা তুলনা করে বসেছেন, আর অবলীলায় সেখানে পুরুষকে দিয়েছেন জিতিয়ে। বললেন, ‘একথা জোর করে বলতে পারি, তাদের (কর্মরত চীনা পুরুষের দল) দেহের চেয়ে কোনো স্ত্রীলোকের দেহ সুন্দর হতে পারে না, কেননা, শক্তির সঙ্গে সুষমার এমন নিখুঁত সংগতি মেয়েদের শরীরে নিশ্চয়ই দুর্লভ। আমাদের জাহাজের ঠিক সামনেই আর একটা জাহাজে বিকেল বেলায় কাজকর্মের পর সমস্ত চীনা মাল্লা জাহাজের ডেকের উপর কাপড় খুলে ফেলে স্নান করছিল; মানুষের শরীরের যে কী স্বর্গীয় শোভা তা আমি এমন করে আর কোনদিন দেখতে পাই নি’। এ কী আশ্চর্য কথা বলছেন তিনি! নগ্ন পুরুষ শরীরের স্বর্গীয় শোভা রবিঠাকুরকে এমন মুগ্ধ করে গেল!
১০.
নগ্নতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার একটা ধারণা আমরা পেয়েছি। তাঁর মতে, সে যেন ‘দেহের স্ফটিক বাতায়নে’ ‘মানব অন্তঃকরণের অনির্বচনীয় চির রহস্যকে’ হঠাৎ দেখতে পাওয়া। তাঁর গুণী ভাইপো বলুর বয়ানে ‘নগ্নতায় সৌন্দর্যের কনক-মিলন’। সেই লাজহীনা পবিত্র সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন ‘নগ্নতা পূর্ণসুন্দরী’। শিল্পে ফিমেল ন্যুড প্রসঙ্গে কাকা-ভাইপোর চিন্তার খানিকটা আঁচ এখানে না হয় খানিক আন্দাজ করা গেল। কিন্তু পুরুষের নগ্নতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কোন পথে চলে? কী বলেন তিনি সে বিষয়ে? প্রশ্নটা এই জন্যই ওঠে, সেবারে লন্ডনের আর্ট-গ্যালারিতে কেবল কি নগ্নিকার ছবিই তাঁর চোখে পড়েছে? সে তো হওয়ার কথা নয়। ডায়েরিতে উল্লেখ না-থাকলেও সম্পূর্ণ নগ্ন বা অর্ধনগ্ন পুরুষের অজস্র ছবি তাঁর চোখে পড়ার কথা। যেমন, গহন অরণ্যে জলের আয়নায় নিজের নগ্ন দেহের দিকে মুগ্ধ চেয়ে থাকা– এ বিষয়ে নার্সিসাসের একাধিক ছবি তাঁর চোখে না পড়লেই নয়। বিভিন্ন সময়ে শিল্পীরা সেই আত্মরতি নার্সিসাসের ছবি এঁকেছেন। ক্লাসিকাল পিকচার গ্যালারিতে এ বিষয়ে ছবির সংখ্যা কম নয়। এছাড়াও ‘ডায়ানা-এন্ডেমিয়ান’, ‘ইরো এবং সাইকি’ ইত্যাদি নানা চিত্রমালার সম্ভারে সাজানো ছবি দু’পা হাঁটলেই নজরে আসবে। যেখানে নগ্নিকার পাশাপাশি ক্যানভাস জুড়ে পুরুষের নগ্নতা সমান দাবি নিয়ে হাজির। কেবল ক্যানভাসে আঁকা ছবিই নয়, পাথরের অজস্র ভাস্কর্য গ্যালারিতে সাজানো– যেখানে নগ্ন পুরুষের দৃপ্ত ভঙ্গি আকৃষ্ট করবে। কিন্তু রবি ঠাকুর সে ব্যাপারে নীরব। অন্তত সেই পর্বে। তবে কি সহজাত সংকোচ সেসব ছবি থেকে সরে গিয়েছেন? হবেও বা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘জাপানযাত্রী’ পর্বে রবীন্দ্রনাথ যেন আশ্চর্য রকমের মুক্তমনা। বলছেন, মেয়ে-পুরুষের মাঝখানে অন্যত্র ‘যে একটা লজ্জা সংকোচের আবিলতা’ দেখা যায়, জাপান নাকি তা কাটিয়ে উঠেছে। জাপানিদের মধ্যে শরীর সম্পর্কিত ‘মোহের আবরণ’ অনেকটা কম। লিখেছেন, ‘জাপানে স্ত্রী-পুরুষেরা একত্রে বিবস্ত্র হয়ে স্নান করার প্রথা আছে। এই প্রথার মধ্যে যে লেশমাত্র কলুষ নেই তার প্রমাণ এই– নিকটতম আত্মীয়েরাও এতে কোনো বাধা অনুভব করে না। এমনি করে এখানে স্ত্রী-পুরুষের দেহ পরস্পরের দৃষ্টিতে কোনো মায়াকে পালন করে না। দেহ সম্বন্ধে উভয়পক্ষের মন খুব স্বাভাবিক।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ভেবে দেখলে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় নগ্ন পুরুষের সৌন্দর্য প্রায় অনুপস্থিত। পরবর্তী প্রজন্মের, বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসুর মতো তিনি পুরুষের নগ্নসৌন্দর্য বর্ণনায় মুখর হতে চাননি। তবুও বলতে হবে, ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে দামিনীর চোখে শচীশকে সুন্দর হতে হয়েছে। শচীশের গায়ের রং, তার চোখ, হাতের আঙুল নিয়ে কীভাবে দামিনীর সামনে তাকে মেলে ধরবেন, এ নিয়ে কবির ভাবনার অন্ত ছিল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শচীশকে দেখিলে মনে হয় যেন একটা জ্যোতিষ্ক– তার চোখ জ্বলিতেছে; তার লম্বা সরু আঙুলগুলি যেন আগুনের শিখা; তার গায়ের রঙ যেন রঙ নহে, তাহা আভা’। শুধু কি গায়ের রং? তার ‘মুখখানি যে দেবমূর্তির মতো সাদা-পাথরে কোঁদা’ ইত্যাদি। প্রকারান্তরে তিনি সাদা পাথরে তৈরি পুরুষের ভাস্কর্যের সঙ্গে শচীশকে বুঝি একাকার করে দিলেন। তবে দেহের কাঠামো, শরীরী আবেদন নিয়ে তেমন সাহসী বর্ণনা উঠে এল না। এখানে শচীশের চেহারার সবটুকুই তার ভিতরের জ্যোতির বহিঃপ্রকাশ। তা সত্ত্বেও বলতে হবে, পুরুষ শরীরের এমন ডিটেল এর আগে রবি ঠাকুরের কলম থেকে বেরোয়নি। এ-ও মনে রাখার, উপন্যাসের শুরুতেই শচীশের দেহের এহেন সৌন্দর্য ধরা পড়েছে শ্রীবিলাসের চোখে। দেখামাত্র তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ঘটে ওঠার আগেই শ্রীবিলাস ‘এক মুহূর্তে তাহাকে’ ভালোবেসে ফেলেছে। কোনও কোনও গবেষক শচীশ-শ্রীবিলাস, গোরা আর বিনয়, মহেন্দ্র-বিহারী বা সন্দীপ লিখিলেশের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মধ্যে সমপ্রেমের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন সে প্রসঙ্গে আসছি না, দেখতে চাইছি, পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের পটে যে একাধিক নগ্নপুরুষের ছবি আমরা পেয়েছি, সাহিত্যে তার নজির আছে কি না। ভালো করে খুঁজলে, ১৯১৬ নাগাদ ‘জাপানযাত্রী’তে হঠাৎ পেয়ে যাই নগ্ন পুরুষদেহের অকুণ্ঠিত বন্দনা। সে কেবল শরীরের সৌন্দর্য নয়, তার সঙ্গে মিশে আছে পুরুষের কর্মময় জীবনের ছন্দে জড়ানো গতির মাধুর্য। সেদিকে একবার তাকানো যাক, ‘প্রথমেই চোখে পড়লো জাহাজের ঘাটে চীনা মজুরদের কাজ। তাদের একটা করে নীল পায়জামা পরা এবং গা খোলা। এমন শরীর কোথাও দেখিনি, এমন কাজও না। একেবারে প্রাণসার দেহ, লেশমাত্র বাহুল্য নেই। কাজের তালে তালে সমস্ত শরীরের মাংসপেশী কেবলই ঢেউ খেলাচ্ছে।… তাদের দেহের বীণাযন্ত্র থেকে কাজ যেন সংগীতের মতো বেজে উঠছে। জাহাজের ঘাটে মাল তোলা নামার কাজ দেখতে যে আমার এত আনন্দ হবে, এ কথা আমি পূর্বে মনে করতে পারতুম না। পূর্ণশক্তির কাজ বড় সুন্দর, তার প্রত্যেক আঘাতে আঘাতে শরীরকে সুন্দর করতে থাকে, এবং সেই শরীর ও কাজকে সুন্দর করে তোলে। এইখানে কাজের কাব্য এবং মানুষের শরীরের ছন্দ আমার সামনে বিস্তীর্ণ হয়ে দেখা দিলে।’
এরপরেই রবীন্দ্রনাথ নারী ও পুরুষের সৌন্দর্যের মধ্যে একটা তুলনা করে বসেছেন, আর অবলীলায় সেখানে পুরুষকে দিয়েছেন জিতিয়ে। বললেন, ‘একথা জোর করে বলতে পারি, তাদের (কর্মরত চীনা পুরুষের দল) দেহের চেয়ে কোনো স্ত্রীলোকের দেহ সুন্দর হতে পারে না, কেননা, শক্তির সঙ্গে সুষমার এমন নিখুঁত সংগতি মেয়েদের শরীরে নিশ্চয়ই দুর্লভ। আমাদের জাহাজের ঠিক সামনেই আর একটা জাহাজে বিকেল বেলায় কাজকর্মের পর সমস্ত চীনা মাল্লা জাহাজের ডেকের উপর কাপড় খুলে ফেলে স্নান করছিল; মানুষের শরীরের যে কী স্বর্গীয় শোভা তা আমি এমন করে আর কোনদিন দেখতে পাই নি’। এ কী আশ্চর্য কথা বলছেন তিনি! নগ্ন পুরুষ শরীরের স্বর্গীয় শোভা রবিঠাকুরকে এমন মুগ্ধ করে গেল! মনে রাখতে হয়, এখানে অন্তরের জ্যোতির প্রকাশ নয়, নগ্ন পুরুষের উন্মুক্ত দেহ-ই সেই ‘স্বর্গীয় শোভা’ রচনা করেছে। এই ‘জাপানযাত্রী’ পর্বে রবীন্দ্রনাথ যেন আশ্চর্য রকমের মুক্তমনা। বলছেন, মেয়ে-পুরুষের মাঝখানে অন্যত্র ‘যে একটা লজ্জা সংকোচের আবিলতা’ দেখা যায়, জাপান নাকি তা কাটিয়ে উঠেছে। জাপানিদের মধ্যে শরীর সম্পর্কিত ‘মোহের আবরণ’ অনেকটা কম। লিখেছেন, ‘জাপানে স্ত্রী-পুরুষেরা একত্রে বিবস্ত্র হয়ে স্নান করার প্রথা আছে। এই প্রথার মধ্যে যে লেশমাত্র কলুষ নেই তার প্রমাণ এই– নিকটতম আত্মীয়েরাও এতে কোনো বাধা অনুভব করে না। এমনি করে এখানে স্ত্রী-পুরুষের দেহ পরস্পরের দৃষ্টিতে কোনো মায়াকে পালন করে না। দেহ সম্বন্ধে উভয়পক্ষের মন খুব স্বাভাবিক।’ এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিতে ইচ্ছে করে। তাঁর মতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করে, শিল্পী যদি তার দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের মায়াকে লালন না করে, তবে সার্থক শিল্প রচিত হবে কীভাবে? তর্ক রেখে এবার তাঁর ছবির দিকে তাকাই।
১৯১৬ সালে ‘জাপানযাত্রী’তে এমন কথা বললেন বটে, তবে রবি ঠাকুরের চিত্রপটে নগ্নপুরুষের অবয়ব আঁকা হয়েছে আরও বছর ১২ বাদে। সব মিলিয়ে তাঁর ছবির ভাঁড়ারে প্রায় গোটা দশেক নগ্নপুরুষের ছবির হদিশ পাওয়া যায়। এই ছবির প্রায় সবই তাঁর প্রথম দিকের ফসল। সন-তারিখের হিসেবে এগুলো বিশের দশকের শেষভাগে আঁকা। উল্লেখ্য, বিষয় নগ্ন পুরুষ হলেও এরা বাস্তবের প্রত্যক্ষ আবেদন থেকে দূরে। বাস্তবের শরীর ছাড়িয়ে এদের দেহাবয়ব গড়ে উঠেছে জ্যামিতিক কাঠামোতে ভর দিয়ে। সাদা-কালো পেপার-কাটের মতো ছবির অধিকাংশই সরলরেখার কৌণিক বিন্যাসে গড়া। অনেকটা কাঠখোদাই ছবির মতো সিলহুয়েট ধর্মী, টোনের আস্তরণ সামান্য, ফিগারে ফ্ল্যাট দ্বিমাত্রিকতাই প্রধান। তবে ফ্রন্টাল ন্যুডের ছবিতেও শরীরের কোনও অংশকে আড়াল করার চেষ্টা নেই। সমস্ত শরীর সেখানে সুস্পষ্ট, প্রত্যক্ষ। অবশেষে আবার তাঁর কথার সূত্র ধরে বলতে হয়– বিকেলের আলোয় দেখা স্নানরত নগ্নপুরুষের যে স্বর্গীয় শোভা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, দৃষ্টির সেই ‘মায়া’ একেবারে মুছে ফেললে তিনি কি এই ছবি রচনা করতে পারতেন?
(চলবে)
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি