স্মৃতি আঁকড়ে থাকা সেই চোখ যদি হুবহু ক্যানভাসে স্থাপন করতে বসি, তখন সে হয় ফোটোগ্রাফের নামান্তর। শিল্পের আসরে তাকে ঠাঁই দেওয়া চলে না। শিল্প হয়ে ওঠে তখন, যখন বাস্তবের অনুপুঙ্খতা ছাড়িয়ে সে আরেকটা স্তরে পৌঁছতে চায়। চাহনির এক মায়াবী ইন্দ্রজাল ভেসে ওঠা চাই শিল্পীর চিত্তপট থেকে চিত্রপটে। তবেই তা ছবির উঠোনে এসে দাঁড়াতে পারে। স্মৃতি আর কল্পনায় সে এক অন্য সত্তা। রেখার চলনে, আকারের কমনীয়তায়, রঙের আস্তরণে তবেই সে ছবি হয়ে ওঠে। সে চোখ নতুন বউঠানের হোক বা আর কারও।
১৭.
রবি ঠাকুরের আঁকা নারীমুখের ছবিতে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়। মুখমণ্ডলের এই সিরিজ, এ কি কাদম্বরী দেবীর স্মৃতিজাত? পটে উদ্ভাসিত আয়তচোখের মেয়েরা কি কবির ‘নতুন বউঠান’? না কি তাঁর কল্পনায় রংতুলিতে গড়া নারীপ্রতিমা? উত্তরটা ভেবে দেখার। সাহিত্য আর ছবির ক্ষেত্রে ভাবনা এবং নির্মাণে বেশ খানিকটা ফারাক। সাহিত্যের পট যতখানি প্রত্যক্ষ, চিত্রের পট বুঝি ততটা নয়। রং-রেখা-আকারের সম্মিলনে সেখানে বিমূর্ত ভাবনার আনাগোনা অনেক বেশি। এই কথা অবশ্য আধুনিক ছবির নিরিখে। তবে কি স্মৃতির প্রত্যক্ষ আঘাত চিত্রশিল্পীকে আন্দোলিত করে না? তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না অতীতের গোপন মুহূর্তমালা? প্রকাশের প্রবল দাবিতে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে আনে না ক্যানভাসের সামনে? নিশ্চয়ই আনে, তবে হয়তো আরেকরকম ভাবে। কী সেই আরেকরকম ভাব, একটু তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। ধরে নিই, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের চোখ দু’টি আমাকে আজীবন আকুল করে রেখেছে। স্মৃতি আঁকড়ে থাকা সেই চোখ যদি হুবহু ক্যানভাসে স্থাপন করতে বসি, তখন সে হয় ফোটোগ্রাফের নামান্তর। শিল্পের আসরে তাকে ঠাঁই দেওয়া চলে না। শিল্প হয়ে ওঠে তখন, যখন বাস্তবের অনুপুঙ্খতা ছাড়িয়ে সে আরেকটা স্তরে পৌঁছতে চায়। চাহনির এক মায়াবী ইন্দ্রজাল ভেসে ওঠা চাই শিল্পীর চিত্তপট থেকে চিত্রপটে। তবেই তা ছবির উঠোনে এসে দাঁড়াতে পারে। স্মৃতি আর কল্পনায় সে এক অন্য সত্তা। রেখার চলনে, আকারের কমনীয়তায়, রঙের আস্তরণে তবেই সে ছবি হয়ে ওঠে। সে চোখ নতুন বউঠানের হোক বা আর কারও।
এ গেল একটা দিক। পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা। আমরা কি সেটাই ধরে নেব? তবে কি প্রথম প্রেমের দাহ জীবনের প্রান্তে স্তিমিত হয়ে এসেছিল? কবিতায় বলেন বটে ‘স্মৃতিরে আকার দিয়ে আঁকা’/ বোধে তার চিহ্ন পড়ে/ ভাষায় কুড়ায়ে তারে রাখা– কতদূর স্মৃতির সে সীমানা, যা কেবল ‘ভাষায় কুড়ায়ে রাখা’ যায়?
তবে কি শেষবেলার রঙে-রেখায় তা মিশ্রিত হয়নি? ‘পূরবী’র পাতা উল্টে দেখি, যা কিনা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ‘বিজয়ার করকমলে’ নিবেদিত। ‘পূরবী’র সবখানেই তবে ওকাম্পোর ছায়া? হবেও বা। চমকে উঠি, ‘কৃতজ্ঞ’ কবিতার দিকে তাকিয়ে– ‘বলেছিনু ‘ভুলিব না’ যবে তব ছলছল আঁখি/ নীরবে চাহিল মুখে। ক্ষমা কোরো যদি ভুলে থাকি।/ সে যে বহুদিন হল। সেদিনের চুম্বনের ‘পরে/ কত নববসন্তের মাধবীমঞ্জরী থরে থরে/ শুকায়ে পড়িয়া গেছে; মধ্যাহ্নের কপোতকাকলি/ তারি ’পরে ক্লান্ত ঘুম চাপা দিয়ে এল গেল চলি/ কতদিন ফিরে ফিরে। তব কালো নয়নের দিঠি/ মোর প্রাণে লিখেছিল প্রথম প্রেমের সেই চিঠি/ লজ্জাভয়ে; তোমার সে হৃদয়ের স্বাক্ষরের ‘পরে/ চঞ্চল আলোকছায়া কত কাল প্রহরে প্রহরে/ বুলায়ে গিয়েছে তুলি, কত সন্ধ্যা দিয়ে গেছে এঁকে…’। ভাবতে ইচ্ছে করে, সলিলকির মতো এমন কনফেসন কার কাছে? কাকে উপলক্ষ করে এই নীরব ক্ষমাপ্রার্থনা? লেখায় ফিরে ফিরে আসে ‘ক্ষমা করো’, ‘ক্ষমা কোরো তবে’ ‘ক্ষমা কোরো যদি ভুলে থাকি’র মতো আকুল আকুতি– এ কি বিজয়ার উদ্দেশ্যে? কিন্তু সেই ‘কালো নয়নের দিঠি’ যা তাঁর প্রাণে ‘প্রথম প্রেমের চিঠি’ লিখেছিল, সে তো ‘বিজয়া’ হতে পারে না। সে যে নতুন বউঠান। তবে কি প্রথম প্রেমের আকুলতা তিনি আজীবন বয়ে বেরিয়েছেন? ২ নভেম্বর, ১৯২৪ তারিখে লেখা এ কবিতা যেন তেমনই আভাস দেয়। তখনও আর্জেন্টিনা পৌঁছননি কবি, দেখা হয়নি ওকাম্পোর সঙ্গে। পথে আন্দেস জাহাজে লেখা হয়েছে এমন বেদনার্ত অক্ষরমালা।
নতুন বউঠানের ইঙ্গিত আরও স্পষ্টতর, যখন লেখেন– ‘তবু জানি, একদিন তুমি দেখা দিয়েছিলে বলে/ গানের ফসল মোর এ জীবনে উঠেছিল ফলে,/ আজও নাই শেষ; রবির আলোক হতে একদিন/ ধ্বনিয়া তুলেছে তার মর্মবাণী, বাজায়েছে বীণ/ তোমার আঁখির আলো। তোমার পরশ নাহি আর,/ কিন্তু কী পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার–…।’ আমরা জানি, কিছুকাল পরেই তিনি ডুব দেবেন রংতুলির জগতে– যার প্রস্তুতি সদ্য শুরু হয়েছে ‘রক্তকরবী’র পাতায়, জান্তব আকারের কাটাকুটিতে। কবিতার অক্ষরে এই ‘চিত্তপটে এঁকে এঁকে’ যাওয়া ‘আপনার স্মৃতিলিপি’ সে মুহূর্তে প্রকৃতই তাঁর খাতা অধিকার করে বসেছে। ক’দিন পরে খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নারীমুখের ছবিতে ভেসে উঠবে স্বতন্ত্র পট, সেখানেও কি দেখা দেবে ‘কালো নয়নের দিঠি’? কেবল এই একটি কবিতা? না। থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া যায় এমন অজস্র উদাহরণ যেখানে নতুন বউঠানের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। গান, কবিতা কি গদ্যাংশ। এমনকী, এই কবিতায় যে ‘হৃদয়ের স্বাক্ষরের’ কথা উঠে এসেছে, তার আড়ালেও কি রয়ে গেল কোনও বিশেষ স্মৃতি? কোনও কোড ল্যাঙ্গুয়েজ? ২২ বছরের রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে হৃদয়ের আকারে পাথর কেটে তার গায়ে খোদাই করেছিলেন চার লাইনের ছোট্ট কবিতা– যা সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল অন্যত্র, তার আভাস কি রইল এখানে? কবিতাটির দেখা মেলে না রচনাবলির কোথাও! কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে নির্মিত সেই ‘হৃদয় পাথর’ উপহারের গোপন বার্তা কি এখানে উঁকি দিয়ে গেল? আর ১৯১৯ সালে রচিত ‘লিপিকা’র ‘কৃতঘ্ন শোক’? টেবিলে রাখা সেলাইয়ের বাক্স, ছাতে ফুলগাছের টব, খাটের উপর নাম-লেখা হাতপাখা ফেলে ভোরবেলা যে বিদায় নিয়েছিল– সেও কি নতুন বউঠান? লেখায় বারবার হানা দেওয়া সেই নারী, সে কি ফিরে আসে ছবিতেও? আয়তচোখের মুখমণ্ডলে বারবার ‘কালো নয়নের দিঠি’র ইশারা কি ‘নতুন বউঠান’? কে দেবে উত্তর।
তবে কি ছবির রবীন্দ্রনাথকে এভাবে দেখতে হবে? চিত্রিত নারীমুখের সঙ্গে তাঁরই জীবনের ইতিহাস, আর অক্ষরের অনুষঙ্গ আঁকড়ে? আর্টিস্ট রবীন্দ্রনাথ ছবির ব্যাপারে কেবল চেয়ে দেখার কথা বলেন। বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই– দেখতে ভালবাসি। সেই উৎসাহে সৃষ্টিলোকে নানা দেখবার জিনিস জেগে উঠেছে’। বলেন, ছবিটা ছবি হয়ে উঠল কি না, সেইটে বিবেচ্য। সঙ্গে ‘‘যদি সে কোনও নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান।… এছাড়া অন্য কোনও ব্যাখ্যার দরকার নেই। এই দৃষ্টির জগতে একান্ত দ্রষ্টারূপে আপন চিত্রকরের সত্তা আবিষ্কার করল। এই যে নিছক দেখার জগৎ ও দেখানোর আনন্দ, এর মর্মকথা বুঝবেন তিনি– যিনি যথার্থ চিত্রশিল্পী। অন্যরা এর থেকে নানা বাজে অর্থ খুঁজতে গিয়ে অনর্থের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে।… চিত্রকর গান করে না; ধর্মকথা বলে না; চিত্রকরের চিত্র বলে ‘অয়ম অহম ভো’– এই যে আমি এই।’’
তিনি কি এখানে কিছু আড়াল করতে চান? তা তো নয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রানী চন্দের কাছে মেলে ধরেছেন নতুন বউঠানের স্মৃতি। বলেছেন চোখ আঁকতে গেলে নতুন বউঠানকে মনে পড়ার কথা। তবে কি ছবিঠাকুরের মন স্ব-বিরোধী দোলাচলে আন্দোলিত হয়েছে বারবার? যামিনী লেখা ওপরের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের মত, যাবতীয় অনুষঙ্গ ছাড়িয়ে ছবিকে দেখতে হবে কেবল দৃষ্টির বৈভবে। সাধারণের পক্ষে দৃষ্টির এমন মহিমা গড়ে তোলা কি নিতান্ত সহজ? এর জন্য আবশ্যক শিক্ষিত চোখের দেখা, শিল্পের বিবর্তিত ইতিহাস বিষয়ে সম্যক ধারণা। বিশ্বশিল্পের আধুনিক গতিপ্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রচিত্রের গভীর বোধ। কীভাবে এমিল নোলদের অদম্য আবেগ, মদিলিয়ানির সরলীকরণ, ব্রাংকুসির আকারমাত্রিক কাঠামো ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে রবি ঠাকুরের ছবিতে– বুঝতে হবে সে কথা। কোন গভীর নির্জনে জীবনব্যাপী অপ্রাপণীয় অনুভব তাঁর নারীমুখের চাহনিতে ‘বড় বেদনার মত’ বেজেছে, সেইটে উপলব্ধি করা চাই। অবশেষে বলতে হয়, নির্দিষ্ট কোনও অভিমুখে ঠেলে রবীন্দ্রচিত্রের নারীমুখগুলিকে শুধুমাত্র ‘নতুন বউঠান’ বা ওকাম্পোর ঘেরাটোপে আগলে রাখা সমীচীন হবে না। সেই সঙ্গে নোঙর ফেলতে হবে বিশ্বশিল্পের বেলাভূমিতে।
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৬: ট্যাক্স না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আটক করেছিল কাস্টমস হাউস
পর্ব ১৫: বাইরে সংযত রবীন্দ্রনাথ, ক্যানভাসে যন্ত্রণাদগ্ধ ছবিঠাকুর
পর্ব ১৪: অমৃতা শেরগিলের আঁকা মেয়েদের বিষণ্ণ অভিব্যক্তি কি ছবিঠাকুরের প্রভাব?
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি