ফণী জ্যাঠার ঘরে নানারকম বাক্স প্যাঁটরা খুঁজেও একটি ঝাপসা রংচটা ফটোও পাওয়া গেল না। হায় কপাল! যে ছবি তোলে তার নিজেরই ছবি নেই। সাধে কি বলে ঘরামির ঘর আলগা। ইচ্ছে করে ইন্টারনেট-এ ফণী জ্যাঠাকে খুঁজলাম। এআই কী করছে? নেটের পেটে কী ঢোকাচ্ছিস ভাই? পাচ্ছি সুপার সাইক্লোন, ‘ফণী’। এটা বেশ, সাইক্লোনই বটে। ফণী খুঁজতে ‘ফোন’ আর পোটো খুঁজতে ‘ফটো’ আসছে। অথচ নেটে থাকতেই পারত। এরকম অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অসাধারণ কৌতুহল নিয়ে আধুনিক একজন মানুষ, তার কথা থাকতেই পারত।
১৭.
মনের মধ্যে দ্রুত ছবি সরে যাচ্ছে। বছর ষাটেক পিছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জন্মস্থান ‘বালতি’। আমার দ্বিতীয় গ্রাম, ‘ধলচিতে’। পূবে ইটিণ্ডা, পানিতর, ঘোজাডাঙা এইসব গ্রাম, পেরোলেই পূর্ব পাকিস্তান। আমাদের নদী– ইছামতী। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের লেখায় ধলচিতের বড়খালের চরে কুমীরের কথা আছে। পাড়ায় তখন বলতে গেলে শৈশবের স্বর্ণযুগ। বন্ধুদের মধ্যে নানা সৃজনশীল কাজে একটা প্রতিযোগিতার উত্তেজনা সবসময়। আর্থিক অবস্থা বেজায় খারাপ প্রায় সবার। পেটে ভাত জোটে না অথচ মেজাজ ফুরফুরে। ইন্দ্রজিৎ একটা রেডিও বানিয়ে ফেলল। হেডফোন দিয়ে শুনতে হয়। প্রায় নিখরচায় সেই রেডিও বানিয়ে সে রাতারাতি পাড়ার বিজ্ঞানী হয়ে গেল। এমনিতে সে মুদির দোকানদার। প্রফুল্ল, বিড়ি বাঁধে, পেনসিলে নয়, কলমে আঁকছে শ্যামল মিত্রের মুখ। কোঁচকানো তার চুল। অনন্ত ঝুলনে যুদ্ধের আয়োজন করছে। সারি সারি সৈন্যের কাটআউট পাহাড়ের গায়ে। অরবিন্দ তুবড়ির মশলা বানায়, কাউকে তার ভাগ বলে না। হারাধন রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ডাকঘরের ‘অমল’ করে নাম কিনেছে। জিতেন, ক্ষিতীশ, জ্যোতিষ, রাখাল দারুণ ফুটবল খেলছে। অন্য পাড়ায় খেলতে গিয়ে হয় মারামারি নয় শিল্ড জিতে ক্লাবের নাম উজ্জ্বল করছে। আমি নড়বড়ে। খেলতে পারি না ভালো। গায়ে জোর নেই। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারের ছেলে। আদর্শ নিয়ে ছ’ভাই বোন আধপেটা খেয়ে, ছেঁড়া চপ্পলে চালিয়ে যাচ্ছি কোনওরকমে। পাড়ার ছোঁয়াচে শিল্প-বিপ্লবে ছবি আঁকা ধরলাম। সরঞ্জাম কেনার সাধ্যি নেই। চার্ট পেপার বা জল রঙের বাক্স কেনার প্রশ্নই নেই। সস্তায় কোনওমতে ক্রেয়ন। রং বেরয় না, শুধুই মোম। ঠাকুর রামকৃষ্ণের একটা ছবি এঁকে দরজার মাথায় সেঁটে দিয়েছি। বাবাকে দেখি চান করে এসে রোজ সেই ছবিটাকে প্রণাম করে।
ফণী জ্যাঠা আমার হিরো। ফণীভূষণ সরকার। মৃৎশিল্পী, পটুয়া, গ্রামের প্রতিমা বানানোর কারিগর। লোকে বলতো ফনিপেটো। পাড়াটাকে ‘পটুয়াপাড়া’ বললেও চলে কারণ কাছাকাছি আরও তিন-চারজন পোটো পরিবারের এই ঠাকুর গড়াটাই জীবিকা। বাড়ির ছোট-বড় সবাই মিলেই হাত লাগায় এই কাজে। কিন্তু ফণী পোটো সবার থেকে একদম আলাদা, অন্য জগতের। বসিরহাটে টাউনে প্রতিমা শিল্পী হিসেবে খুব নামডাক। এদিকে বারাসত, বনগাঁ হয়ে ওদিকে বাংলাদেশের বর্ডার ঘেঁষে টাকি, হাসনাবাদ, সুন্দরবন পর্যন্ত সবাই চেনে। শুনেছি, ছোটবেলায় খেলার ছলে জ্যান্ত বিড়ালের মুখে নরম মাটি চেপে তৈরি করেছিলেন মুখের ছাঁচ। পুতুল গড়া কিংবা প্রতিমা তৈরির চেষ্টা না-করে ছোটবেলায় একটি বিড়ালের হুবহু মূর্তি তৈরি করার কথা যিনি মাথায় এনেছিলেন, তিনি আর যাই হোক শিল্পী নন, গ্রামীণ পরিবেশে একজন শিল্প গবেষক হওয়ার আভাস দিয়েছিলেন বলেই আমার এখন মনে হয়।
প্রতিমা গড়া ছাড়া আরও অনেক মাটির কাজ, কাঠের কাজ এমনকী, মূর্তি গড়া মানে স্কাল্পচারধর্মী কাজ, আজগুবি সমস্ত জীবজন্তু করা, অবসর সময়ে ছাঁচের পুতুল, অচেনা জন্তু-জানোয়ার, পাখি, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি কী না কী করতেন! সেগুলোর চেহারা এবং রঙে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন। কাঠের কাজ অসাধারণ। ছুতোর মিস্ত্রী হার মেনে যায়। দা, বটি, ছুরি-কাঁচি, ছেনি-হাতুড়ি, করাত, কুড়ুল। কাঠের কাঠি, বাঁশের কাঠি, নরুন, লৌহ শলাকা। কতরকম যন্ত্রপাতি! মাটি দেখলাম হরেকরকম। এঁটেল মাটি, বেলে মাটি, দোআঁশ মাটি। খড় মেশানো মাটি, তুষ মেশানো মাটি, পাটের আঁশ, তুলো, ন্যাকড়া মেশানো মাটি, গোলা মাটি। তেঁতুল বিচি। তিসির তেল, শিরিষ আঠা। গর্জন তেল, ভার্নিশ। এরপরেও দেখলাম ভার্নিশ করার সময় রংটা একটু গাঢ় হয়ে যায়, তাই সরস্বতীর মুখে কখনও ভার্নিশ করা যায় না। সেখানে লাক্স সাবান, দুধ ইত্যাদি জিংক অক্সাইডের সঙ্গে মিশিয়ে রং। তারপরে পরিষ্কার পুরনো ধুতির কাপড়, ধবধবে সাদা এবং নরম, তাই দিয়ে সরস্বতীর মুখে আলতো হাতে রং শুকোনোর শেষ ভাগের দিকে হালকা করে ঘষে একটা গ্লেজ, শঙ্খ বা কড়ির মতো সাইনিং! ভাবা যায়?
বড় সাইজের দুর্গা ঠাকুর বানানোর পরিবেশ মানে বিশাল কর্মযজ্ঞ! সুরলোক, অসুরলোক একাকার। কালো কালো খালি গায়ে কর্মচারীরা রঙিন রঙিন ঠাকুরের হাত-পা বাঁচিয়ে, পায়ের ফাঁকে, কনুইয়ের নিচে ঘুরে-ফিরে কাজ করছে, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। তখন আমাদের গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। রাতে মাথার ওপর কেরোসিনের জ্বলন্ত লম্ফ বসিয়ে দু’হাতে কাজ করছেন ফণী জ্যাঠা, প্রতিমার চোখ আঁকছেন। ঠিক যেমন খনির ভেতরে কর্মচারীদের হেলমেটে টর্চ লাগানো থাকে। মাথায় আলোটাকে ব্যালেন্স করা ছাড়া আরও একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল জ্যাঠার, দু’হাতে প্রতিমার চোখ আঁকা। প্রথমত, ডান হাত দিয়ে বাঁ-দিকের চোখ আঁকার সময় আলোর আড়াল। আর ডান হাতটা বাঁ-দিকে থাকলে ডানদিকের চোখটাও দেখা যায় না, তাই দুটো চোখের মণির দূরত্ব ইত্যাদি বুঝতে খুবই অসুবিধা হয়, তাই উনি ডানদিকের চোখটা ডান হাত দিয়ে আর বাঁ-দিকের চোখটা বাঁ-হাত দিয়ে আঁকা রপ্ত করেছিলেন।
সেই প্রাইমারি স্কুলের সময় থেকেই দেখে আসছি, চোখের সামনে তৈরি হয়ে উঠছে মহিষাসুরমর্দিনী। গণেশ ঠাকুরের কী সুন্দর গোলাপি রঙের গা! দুর্গা লালচে হলুদ। কমলা রঙের লক্ষ্মীর মুখখানা ঠিক যেন পাড়ায় চেনা কোনও মেয়ের মতো। সরু করে কার্তিকের গোঁফ, সিংহের ঘাড়ে বাদামি রঙের কেশর আর হাত উঁচু করা মহিষাসুরের বগলে গুঁড়ো গুঁড়ো লোম। সবার হাতের নখও আঁকা হত। মায়ের কাঁধে কোঁচকানো কালো চুলের ঢেউ, শাড়িতে জরি পাড়, দশ হাতে টিনের দশ অস্ত্র। সবার ওপরে মায়ের মাথায় ঝলমলে মুকুট। দেবীর কাঁধে, পিঠে, পেটে, বুকে পা দিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে, কখনও বা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে কাজ করতেন ফণী জ্যাঠা। কাজের শেষে একখানা নতুন ধুতি পরে তার খানিকটা অংশ গলায় জড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতেন নিজের হাতে বানানো দেবীকে। আমাদের চোখ ভিজে উঠত।
ফণী জ্যাঠার কাজ হাঁ করে দেখতে দেখতে একদিন আমি ওঁর চ্যালা বা শিষ্য হয়ে গেলাম। তারপর একদিন, স্কুলে পড়াকালীন কতই বা বয়স আমার, আমাকে সহকারী করে দূরের গ্রাম নবাতকাটিতে বাসন্তী ঠাকুর করতে নিয়ে গেছিলেন বাবার পারমিশন নিয়ে। প্রথম পেশাদারি কাজে অংশ নেওয়া, সেই প্রথম জীবনে বাড়ির বাইরে থাকা। বাসন্তী পুজোয় ওখানে বড় করে মেলা বসত। ম্যাজিক, পুতুলনাচ, নানা রকম খেলনা, আর খাবারের অসংখ্য দোকান। ঠাকুর তৈরির লোকজন, পুজোর সময়ে যাত্রা-নাচ-গান ইত্যাদির লোকজনও কিছুদিন আগে থেকে এসেই রিহার্সাল করত। তারা সবাই পাড়ার কয়েকটা বাড়িতে ভাগে ভাগে ভাগ করে থাকত। আমিও কারও বাড়িতে থাকতাম। বারান্দায় শোওয়া, পুকুরে চান করা আর তাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া, বেশ জীবন। পারিশ্রমিক হিসেবে পয়সাও দিয়েছিলেন ফণী জ্যাঠা, আমি ছোট তাই বাবার হাতে।
অবসর সময়ে জ্যাঠার অন্য ভাইরা সবজি চাষ-বাস করেন। বাড়ির লাগোয়া জমিতে ফল-ফুলও। শিশির ভেজা ভোরের ফুলকপি বাঁধাকপি। সবেদা, আতা, লিচু, জামরুল। মরশুমি ফুল, ডালিয়া-জিনিয়া-দোপাটি-চন্দ্রমল্লিকা। এ বাড়ির সবই সুন্দর কী করে হয়, জানি না। ফণী জ্যাঠার বড় ভাই খুব একটা কথা বলতেন না সবসময়, নিজের মনেই থাকতেন। এই দারুণ চাষবাসটা উনি দেখতেন আর সন্ধেবেলা নিজের হাতে বানানো ছোট্ট এক গুলি আফিম মুখে দিয়ে ঝিম ধরা হয়ে বসিরহাটের টাউন লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তেন। ছোট ভাই ঠাকুরগড়ার কাজেই যুক্ত কিন্তু তেমন শিল্পমনা নন। অর্ডার নেওয়া, হিসেব-নিকেশ, পয়সা আদায় করা আর ফণী জ্যাঠাকে চালনা করার কাজ ছিল ওঁর।
অবসর সময়ে ফণী জ্যাঠা কী না করেন, সেটাই ব্যাপার। অফ সিজনে প্রমাণ সাইজের প্রতিমা করে প্র্যাকটিস করা জীবনে দেখিনি। আমরা কাগজে ছবি আঁকি। প্র্যাকটিস করার পরে পছন্দ না হলে সেগুলো ফেলে দিই যেমন, তেমনই বড় শিল্পীরা যাঁরা বড় বড় ক্যানভাসে কাজ করেন তাঁরাও বড় ক্যানভাসটাই বার বার করছেন, পছন্দ না হলে সেটাকে সরিয়ে দিচ্ছেন। এখন শিল্পী মাতিসের কথা মনে পড়ছে। তাঁর ‘পিংক ন্যুড’ ছবিটাতে মহিলার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোথায় কীভাবে রাখবেন, তা বারবার আঁকছিলেন। হাত পায়ের ভাঁজ খাঁজ কোথায় কেমন হবে, ওপরে যাবে হাত না নিচে, মাথা বাঁকবে কতটা ইত্যাদি বারবার করতে করতে কয়েকটি ক্যানভাস বাতিল করেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে ফণী জ্যাঠাও প্রমাণ সাইজের প্রতিমা তৈরি করে দেখতেন তার পছন্দসই রূপ আসছে কি না, সেগুলো কিন্তু বিক্রির জন্য নয়। বহুকাল ধরে বাড়ির পিছনে একটা ছাউনির তলায় সেরকম অনেক মূর্তি পড়ে থাকতে দেখেছি। একবার একজন শক্তিশালী মানুষ সিংহের সঙ্গে লড়াই করছে– প্রমাণ সাইজের করেছিলেন। মানুষ এবং সিংহ– দু’জনেরই অ্যানাটমি এবং মাস্ল-এর কাজ প্র্যাকটিস। এত নিখুঁত হয়েছিল যে, আমরা তার ধারে কাছে যেতে ভয় পেতাম।
ষষ্ঠী ঠাকুর, শীতলা, মনসা, কালী এমনকী, মাকাল কিংবা বনবিবি, কোনওটাকেও উনি কখনও ছোট করে দেখতেন না। দক্ষিণ রায়ের মূর্তিও উনি করতেন ওঁর মনের কল্পনা থেকে। গল্প বলতেন চমৎকার। সুন্দরবনের বনবিবির সঙ্গে যুদ্ধে বারবার হেরে যেতেন দক্ষিণরায়, অথচ ওঁদের একসঙ্গে পুজো হয়। সেই গল্প শোনাতে গিয়ে বলতেন বনবিবি নাকি আসলে ছিলেন আরবের কন্যা। বনবিবি হলেন বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়াদের এক লৌকিক দেবী এবং পিরানি। বনদেবী, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী, বনচণ্ডী– এমন নামও আছে। এমনিই কত না পুরনো দেব-দেবতাদের গল্প, এমনকী, মানুষের নানা চরিত্র, হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে সিঁধ-কাটা চোর আর চিঠি দিয়ে জানিয়ে আসা ডাকাত, জঙ্গল, পশুপাখির গল্প উনি এমন সুন্দর করে বলতেন যে, ছোটবেলায় সেগুলো আমাদের কাছে রূপকথাকে ছাপিয়ে যেত। পড়াশোনা তেমন করেননি ফণী জ্যাঠা কিন্তু এ সমস্ত কথা-কাহিনি পেতেন কোথায়, সেগুলো আমাদের অবাক করত।
…………………………………………..
কলকাতায় গিয়ে দেখতে যেতেন যাদুঘর আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। ছবি আঁকার ভাবনাটা মাথায় ঢোকে ওখান থেকেই। সেখানে বেশিরভাগ বিদেশি ছবি, সব কিছুই ইংরেজদের। বিশেষ করে তৈলচিত্র নিয়ে গল্প করতেন, বড় বড় ছবি দেখে এসে। একটা কথা উনি মাঝে মাঝেই বলতেন, যেটা ওঁর মাথায় সব সময় ঘুরঘুর করত, সেটা ছবি আঁকার কৌশল। উনি বলতেন, কাছে গেলে দেখবে খাবলা খাবলা রং, কিছুই বোঝা যাবে না, কিন্তু যত দূরে যাবে তত পরিষ্কার গাছপালা, মানুষজন,গরু ছাগল সব দেখতে পাবে। ব্রাশ স্ট্রোকের ব্যাপারটা একটা ম্যাজিকের মতো লাগত ওঁর কাছে। কলকাতা থেকে ফিরে এসে যখন গল্প বলতেন, তখন মনে হতো উনি বোধ হয় বিলেত ঘুরে এলেন।
…………………………………………..
ফণী জ্যাঠা ছবি আঁকার চেষ্টাও করতেন নিজের মতো করে। সে ছবি আবার যে সে ছবি নয়, একেবারে তৈলচিত্র। কাঠের ফ্রেমে পুরনো কাপড় টানটান করে আটকে তৈরি করলেন তৈলচিত্রের ক্যানভাস। ঠাকুর গড়ার মাটির রঙের গুঁড়ো, তিসির তেল দিয়ে আঙুলে মেড়ে তৈরি হল তৈলচিত্রের রং। ফোটোতে খোপ কেটে বড় করে ক্যানভাসে ড্রয়িং করতে দেখতাম ফণী জ্যাঠাকে। প্রতিমার চোখ আঁকার জন্য একটি-দু’টি বিশেষ তুলি ওঁর দরকার। সেটা হতে হবে একেবারে পৃথিবীর সেরা, তাই উনি কখনও-সখনও কলকাতায় যেতেন জি সি লাহার রংয়ের দোকানে, উইনসর অ্যান্ড নিউটন কোম্পানির তুলি কিনতে। অন্যান্য মোটা তুলি কিনতেন সস্তায়। অনেক তুলি নিজে বানাতেন। তার জন্য বিড়াল-কুকুর-শিয়াল-বেজি ইত্যাদির লোম সংগ্রহ করতেন। একবার কোথা থেকে শক্ত তুলির জন্য ঘোড়ার লেজের লোমও যোগাড় করেছিলেন। কলকাতায় গিয়ে দেখতে যেতেন যাদুঘর আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। ছবি আঁকার ভাবনাটা মাথায় ঢোকে ওখান থেকেই। সেখানে বেশিরভাগ বিদেশি ছবি, সব কিছুই ইংরেজদের। বিশেষ করে তৈলচিত্র নিয়ে গল্প করতেন, বড় বড় ছবি দেখে এসে। একটা কথা উনি মাঝে মাঝেই বলতেন, যেটা ওঁর মাথায় সব সময় ঘুরঘুর করত, সেটা ছবি আঁকার কৌশল। উনি বলতেন, কাছে গেলে দেখবে খাবলা খাবলা রং, কিছুই বোঝা যাবে না, কিন্তু যত দূরে যাবে তত পরিষ্কার গাছপালা, মানুষজন,গরু ছাগল সব দেখতে পাবে। ব্রাশ স্ট্রোকের ব্যাপারটা একটা ম্যাজিকের মতো লাগত ওঁর কাছে। কলকাতা থেকে ফিরে এসে যখন গল্প বলতেন, তখন মনে হতো উনি বোধ হয় বিলেত ঘুরে এলেন।
ঠাকুরের পেছনের সিন আঁকা ফণী জ্যাঠার আর একটা কাজ। বড় থান কাপড় কিনে এনে সেলাই করে জুড়ে জুড়ে প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট সাইজের একটা বড় কাপড় টানটান করে বাঁশের ফ্রেমে লাগাতেন প্রথমে। তারপরে রং। সমস্যা হত জল দিয়ে রং করার ফলে যতই ঘন এবং বেশি করে রং লাগানো হোক না কেন, শুকিয়ে গেলে একেবারেই ফ্যাকাশে হয়ে যেত। আকাশ এবং পাহাড়ের প্রধান অংশগুলো বা বড় বড় জায়গাগুলোকে উনি খুব গাঢ় করে রং লাগাতেন শুরুতে। মালসা মালসা রং, বালতি করে রং। বাড়িঘর রং করার মতো পাটের তুলি এবং কখনও কখনও জুতোর ব্রাশ ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। অতি দ্রুততার সঙ্গে এই প্রথম স্তরটা করতে হত। একই নিয়মে নাটকের জন্য সিন আঁকা। শেষপর্যন্ত একেবারে ফটো স্টুডিওতে ছবি তোলার ব্যাকগ্রাউন্ডে সিন। তিনটেই করতে পারতেন। এইখানে ওঁর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখার অভিজ্ঞতা কাজে লেগে যেত।
শহরের ফটো স্টুডিওতে সিন আঁকার কাজে গিয়ে ক্যামেরার কাজটাও লক্ষ্য করতেন। এবং পরে ওদেরই ক্যামেরা নিয়ে এসে আমাদের বাড়ির কোনও দরকারে, পাসপোর্ট সাইজ ছবি ইত্যাদি করে দিতেন উনি। ঢাউস বেলো ক্যামেরার ফোকাস করতে দিন কাবার! বড়োসড়ো একটা কালো কাপড় দিয়ে ক্যামেরা এবং নিজেকেই ঢেকে কী যেন করতেন। যার ছবি তোলা হচ্ছে সে তো মুখে হাসিটি বাঁধিয়ে রেখে, চোখের পলক না ফেলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। কালো কাপড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার নাম নেই। ক্যামেরার পেছন দিক দিয়ে বড়সড়ো একখানা ঘষা কাচের প্লেটে উনি ফোকাস করতেন। ফোকাস মন মতো না হওয়া পর্যন্ত কাপড়ের আড়াল থেকে বের হতেনই না। ঠিক ফোকাস হয়ে গেলে সামনে যিনি বসে আছেন তাকে অন্তিম নির্দেশ, একদম নড়া চলবে না চুপ করে থাকো। এরপর দ্রুততার সঙ্গে উনি ঘষা কাচের প্লেট সরিয়ে কাচের নেগেটিভ প্লেটটি পেছনে ফিট করে দিয়ে, একেবারেই শাটার টিপে বেরিয়ে আসতেন।
জ্যাঠার বাড়িতে দু’টি মেয়ে খুব সুন্দর গ্রামের পালাগানে অভিনয় এবং গান করত। শিশুশিল্পী। বাড়িতে অভিনয় এবং সংগীতের সাধনাও চলত। গানের মাস্টার বাড়িতে এসেই ওদের তালিম দিতেন যাকে আমরা রিহার্সাল বলি। এক আধবার সেটা দেখেছি, এক লোভনীয় ব্যাপার, কিন্তু বাড়ি থেকে সন্ধেবেলা পড়াশোনার সময় বলে এবং অন্ধকারের কারণে আমরা অন্য কারও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগই পেতাম না। জীবনে সেটা একটা সাংঘাতিক ক্ষতি মনে হত। ফণী জ্যাঠার ছোট মেয়ে সুনীতি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। খুব ভালো অভিনয় করত দারুণ গানের গলা। ছোট ছোট পালাগান অপেক্ষাকৃত ধনী বাড়ির উঠোনে। কখনও-সখনও আমাদের বাড়ি থেকে দুটো-তিনটে বা চার-পাঁচটা বাড়ির পরে। পাড়ার ঘন গাছপালা, আম-জাম-কাঁঠালের, তাল-সুপারির ফাঁক দিয়ে পেট্রম্যাক্সের তীব্র আলোর ছটা চারিদিকে বিচ্ছুরিত হতে থাকত। অদূরে কোথাও অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। আলো দেখতে পাচ্ছি দূর থেকে। ক্ল্যারিয়োনেট, কর্নেট, বাঁশের বাঁশি, ওপরের ঢাকনা খোলা হারমোনিয়ামের উচ্চতর আওয়াজে ভেসে আসছে সংগীতের শব্দ আর সুনীতি বা অঞ্জলির গলার তীক্ষ্ণ আওয়াজে গানের কথা– ‘বকুল চাঁপায় ডাক এল সই, দখিন হাওয়ায় ভেসে ভেসে। শিশিরভেজা শিউলি জাগে, ভোরের আলোয় হেসে হেসে।’
একটি ঘটনার কথা জীবনেও ভোলা যাবে না। সুনীতি সেবারে দুর্গা। যাত্রাপালার ভাড়া করা চুমকি বসানো ছোট্ট মুকুট মাথায়। দারুণ দেখাচ্ছে। ঠিক যেন ছোট্ট সত্যিকারের দেবী। সেই দৃশ্যে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত দুর্গা ত্রিশূলে বিদ্ধ করছেন মহিষাসুরকে। অসুর ভূ-লুণ্ঠিত। তার তেরছা ডান থাইয়ের ওপরে দুর্গার বাঁ-পা, হাতের ত্রিশূল বুকে নিয়ে জিভ বের করে মহিষাসুর। পরের দিন সুনীতিকে দেখে ভয় করতে লাগল। আমরা তো আবার সেই পাড়ার বন্ধু, তবুও দুর্গার মুখের ছায়া যেন দেখছি সুনীতির মুখে। তবে কি কাল রাতের মেকআপ ভালো করে মোছা হয়নি? ওকে বললাম, ‘চল আজ বাগানে দুগ্গা-অসুর খেলি।’ ও রাজি হয়েছিল। আমরা ছেলেমেয়েরা সবসময় পালাগানের পরে ক’দিন অভিনয়ের অংশ নকল করে খেলা করি বাগানে। আজ সত্যিকারের দুর্গার সঙ্গে খেলা। পাটকাঠির একটা ত্রিশূল বানিয়ে ওর হাতে দিয়েছিলাম। আমার হাতে খেজুর পাতার ডাঁটা দিয়ে তৈরি অস্ত্র। পালার মিউজিকের তালে মুখে গুনগুন, বড় গোল গোল চোখ করে যুদ্ধ হল খানিক। অবশেষে পরাজিত আমি, ধুলোয় চিৎপাত! আমার গায়ে সুনীতির পায়ের ছোঁয়া আর ওই পাটকাঠি এবং সিগারেটের রাংতার ত্রিশূল বুকে নিয়ে যেন ধন্য হলাম।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………
আজ এই লেখাটার সঙ্গে একটা ছবি দেব বলে তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে। ফণী জ্যাঠার ঘরে নানারকম বাক্স-প্যাঁটরা খুঁজেও একটি ঝাপসা রংচটা ফোটোও পাওয়া গেল না। হায় কপাল! যে ছবি তোলে, তার নিজেরই ছবি নেই। সাধে কি বলে ঘরামির ঘর আলগা। ইচ্ছে করে ইন্টারনেট-এ ফণী জ্যাঠাকে খুঁজলাম। এআই কী করছে? নেটের পেটে কী ঢোকাচ্ছিস ভাই? পাচ্ছি সুপার সাইক্লোন, ‘ফণী’। এটা বেশ, সাইক্লোনই বটে। ফণী খুঁজতে ‘ফোন’ আর পোটো খুঁজতে ‘ফোটো’ আসছে। অথচ নেটে থাকতেই পারত। এরকম অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অসাধারণ কৌতূহল নিয়ে আধুনিক একজন মানুষ, তার কথা থাকতেই পারত। পাড়ায় এখন অনেক নেটের দোকান। রেলের টিকিট, আধার কার্ড, ফর্ম ফিলআপ, পরীক্ষার ফলাফল। দেখলাম শীতলাতলার টিউবওয়েলের কথা পর্যন্ত আছে।
গ্রামের কথা বলতে ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে আর্সেনিকের প্রভাব, পানীয় জল খাওয়ার অযোগ্য– এমনও খবর। গুগল ম্যাপেও দেখলাম নদীর ধারের চর, খেয়াঘাট, স্কুল, বকুলতলা, তেঁতুলতলা এসবও পাওয়া যাচ্ছে। পঞ্চাননতলার পাশে ফণী পোটোর বাড়ি বলে কি কেউ একটা লিখে দিতে পারত না! তাহলে আমিই করব এবার। এই লেখাটার মাধ্যমেই ইন্টারনেটে নাম তুলব ফণীজ্যাঠার।
গুরুর প্রতি এটাই হবে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল