আমির খান ছবিতে অভিনয় করবেন একটি শিল্প-শিক্ষকের ভূমিকায় এবং ওঁর শিল্পমাধ্যম জলরং। এত বড় কাজ, একজনকে পাকা শিল্পী তৈরি করা বা তার খানিকটা করতে গেলেও তো দীর্ঘ সময় লাগবে। সেই সময়টা এখানে হাতে নেই। অতএব আমার মাথায় সিনেমা ব্যাপারটাই ঢুকিয়ে নিলাম। ভেবে নিলাম, মোটামুটি গোটা ছয়েক শট ঠিকমতো পরিকল্পনা করতে পারলেই কাজ হাসিল। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ওঁকে ছবি আঁকা শেখালাম না, কয়েকটি শট এবং সেই শটে ও কী করবে, মানে হাতের কাজ, চোখের মুখের ভঙ্গিমা, দাঁড়ানো ইত্যাদি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।
২১.
সাইলেন্স…সাইলেন্স…সাইলেন্স…!
পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘সাইলেন্স’ শব্দটা। রিলে হচ্ছে একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে। পাহাড়ি শহরে যানবাহন চলাচলের এমনিতেই ছোট্ট রাস্তা। বাড়িঘর কম। শুধু পাহাড়, সবুজ, নদী, পাখি, নীরবতা ইত্যাদিতে ঘেরা। তারই মধ্যে হঠাৎ শব্দটাকে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মেহের আলীর চিৎকার মনে হল, ‘তফাত যাও… সব ঝুট হ্যায়… সব ঝুট হ্যায়।’
মহারাষ্ট্রের পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্যের নগরী পাঁচগনি। যত না জনবসতি তার চেয়ে অনেক বেশি আবাসিক স্কুল। বড় বড় নামীদামি স্কুলে ভরা পাঁচগনি শহর। তারই কোনও এক উপত্যকায় বড়সড় অ্যাম্ফিথিয়েটার। সেখানে এক সিনেমার শুটিং চলছে। সিকোয়েন্স, আর্ট মেলায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। স্থানীয় স্কুলের আর্ট কম্পিটিশনের সিন। জড়ো হয়েছে দু’-তিনশো মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে। যেন সমস্ত শহরের যানবাহন এবং যান্ত্রিক আওয়াজকে চুপ করিয়ে দিয়ে শুধু উপত্যকায় মানুষ পাহাড়ের নীরবতায় সাময়িকভাবে শুনছে পাখির ডাক আর ছবি আঁকছে নিরিবিলিতে একমনে।
ছবির নাম ‘তারে জমিন পর’। মেমরি একদম তাজা। এই তো সেদিনের কথা, এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেসব দৃশ্য, অথচ দেখতে দেখতে কেটে গেল ১৮ বছর!
জনপ্রিয় সিনেমাতে কাজ করলে সেটা যে কত লোকের চোখে পড়ে, ঠিক মতো তার হিসেব করা যায় না। এই যে একটা ছবি আঁকলাম, সেটা দেশ-বিদেশ মিলিয়ে অগুনতি, মানে অনেক কোটি মানুষ দেখল। কত কুইজ কনটেস্ট, কত প্রতিযোগিতা, ছোট বড় মিলিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকিয়ের এই ছবি দেখে আঁকার প্রচেষ্টা। ছোটদের অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে অজস্র অনুষ্ঠান, সংবর্ধনা, কী না কী! এমনকী, কত মানুষের আন্দাজ, এটা হুসেনের ছবি, এটা আমির খান নিজেই এঁকেছেন কিংবা সলমন খান। নানা ভাবে বহু লেখালেখির ইলাস্ট্রেশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ওই ছবির মুখ। সোশাল নেটওয়ার্কে ঝড় বয়ে গেছে বহু বছর ধরে। ছবির আলোচনা, কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ। কেন এই প্রাইমারি কালার, কেনই বা এই ছবিটি সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে গল্পটাকে সম্পূর্ণ করল?
এ আমার গর্ব নয়, এ আমার আনন্দ। আনন্দ এই কারণে, ‘তারে জমিন পর’ সেবারে ৮১তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড মানে অস্কারের সেরা বিদেশি ফিল্মের ভারতীয় অফিসিয়াল এন্ট্রি ছিল। আমি এমন একটি বিশাল কাজে ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র অংশের অংশীদার ছিলাম। কেন আমাকে আজও অন্য দেশ থেকে চিঠি লেখে, পারমিশন চায় ছবিটাকে তাদের প্রবন্ধে কিংবা স্কুলের সিলেবাসে লেখার ইলাস্ট্রেশন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। কেন হাজার হাজার মানুষ তাদের সন্তানের পোর্ট্রেট আমাকে দিয়ে আঁকাতে চেয়েছে? সিনেমা! কেবল সিনেমা থেকেই মানুষের কত না সাধ, কত ইচ্ছে। আমি ওই হাজার হাজার মানুষের কারও ইচ্ছে পূরণ করিনি, একটি ছবিও আঁকিনি পয়সার বিনিময়ে। সে সংবাদ আজ অবধি আমার অতি ঘনিষ্ঠদের কাছেও নেই। ঘোর কাটেনি আজও। সমস্ত ব্যাপারটাই একটা কেমন সিনেমা-সিনেমা মনে হয়! বাস্তবতা হারিয়ে যায়!
আজকের যে মানুষটাকে নিয়ে আলোচনা, গল্প, যা কিছু তিনি বলিউডের চলচ্চিত্র জগতের এক বিখ্যাত মানুষ, আমির খান।
‘তারে জমিন পর’ ছবির রিলিজের দিন থেকে ঠিক ১৭ বছর পুরো হল ডিসেম্বরে। আজ তাই আমিরকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হল। ছবিটাতে কাজ করার শুরুতে আমিরের সঙ্গে কিন্তু আমার আলাপ হয়নি। অমোল গুপ্তের সঙ্গে এই ছবি তৈরির নানা গল্প আর আড্ডা মুম্বইয়ে আমার বাড়িতেই হত। আমি অনেকটাই ছবিটার কাহিনি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম, আমির পিকচারে ছিলেন না। ছবির শুটিং চলাকালীন একদিন হঠাৎ একটা ফোন এল। অচেনা মানুষ, অচেনা গলা। ফোনের কথা এরকম: আপনি কি পেইন্টার সমীর? আমির খান আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। ওপাশে ফোনযন্ত্র হাত বদল হল। ‘হ্যালো, গুড মর্নিং, আমির খান বলছি। আমাকে আপনার সম্পর্কে অমোল অনেক কথাই বলেছে, সেই সূত্রে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত রিকোয়েস্ট, যেখানে শুটিং হচ্ছে, মানে পাঁচগনিতে যদি কিছুদিন আমাদের সঙ্গে থাকেন। আসার ব্যাপারে আপনি যদি একটা দিনক্ষণ বলেন আমাদের। আপনাকে কাজের ব্যাপারটা অলরেডি অমল বলে দিয়েছে। আমি ভীষণ খুশি হব যদি আপনি এসে আমাদের এই কাজে সাহায্য করেন। আর আপনার সময়মতো আমরা মুম্বই থেকে পাঁচগনিতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব।’
কথা হল হিন্দিতে। এখানে বলার দরকার, আমিরের জীবন, কাজকর্ম, মেজাজ, মর্জি, চরিত্র, সংসার, সমাজ ইত্যাদি বলতে পারব না। আমি এই মানুষটির সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক বিষয়ে বলতে গিয়ে ওঁর জীবনের একটি খণ্ডচিত্রই শুধু তুলে ধরব।
অমোল শিল্পী মানুষ, আমার বন্ধু। অমোল গুপ্তের সঙ্গে আলাপ পৃথ্বী থিয়েটারে। সেখানে আমরা শশী কাপুর-কন্যা, সঞ্জনা কাপুরের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভালে কাজ করতাম একসঙ্গে। অমল নিজে আর্টিস্ট, ওরই সন্তান হচ্ছে এই– ‘তারে জমিন পর’। ও মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্য একটা কাজ করছিল। ওর নিজেরও আঁকার স্কুল ছিল। সেখান থেকেই গল্প এবং ফিল্ম করার ইচ্ছে। আমির খানকে ছবির মুখ্য ভূমিকায় রাখতে এবং ওঁর প্রোডাকশন হাউসটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে তখন অমোল। শুরুর দিকে আমার কাছে এমনি আসত গল্প শোনাতে। কখনও-সখনও এই ফিল্মের যে শিল্পনির্দেশনার কাজ করবে, যে এডিট করবে কিংবা সিনেমাটোগ্রাফার– তাদেরও মাঝে মাঝে নিয়ে এসে আমাদের মেঝেতে শুয়ে বসে আড্ডা চলত। আসলে আমাকে ও উত্তেজিত করার চেষ্টা করত, যাতে একটা ছবি এঁকে দিই ওর ফিল্মের জন্য। একটা পেইন্টিং চাই, ব্যস্। ইতিমধ্যে ছবির গল্প শুনে আমির খান রাজি হয়ে গেলেন। অতএব, হিরো আমির খান, চরিত্র– ছবি আঁকার শিক্ষক আর তাঁর কাজের মাধ্যম জলরং। আমি যেহেতু জলরঙে ছবি আঁকি আর ফিল্মের একটি অংশে জলরঙের একখানা ছবির ভীষণ প্রয়োজন, তাই অমোল আমাকেই আঁকড়ে রইল।
মুম্বই থেকে আমার পাঁচগনি যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হল। আমির সময় মতো গাড়ি পাঠিয়েছিলেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না, তাই সঙ্গে আমার ছেলেও যাবে। ও আমাকে সাহায্য করবে টুকিটাকি ব্যাপারে, আর আমি যেহেতু ওখানে একা থাকব, তাই সঙ্গ দেবে।
আমার আঁকার সরঞ্জাম, ড্রয়িং বোর্ড, রং-তুলি-কাগজ আমাদের জুতো-জামা-পোশাক ইত্যাদির সঙ্গে গাড়িতে ঢুকল। পাঁচগনি, পাহাড় ঘেরা, সবুজে ভরা, নদী-আকাশ-মেঘ নিয়ে অসাধারণ একটি শান্ত জায়গা। সেখানেই শুটিং হচ্ছিল ‘তারে জমিন পর’ ছবির। এই জায়গাটার পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের আরেকটি জায়গা যেখানে ভ্রমণপিপাসুরা পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে যায়, সেটা মহাবালেশ্বর। পাঁচগনিতে ভ্যালি, পাহাড়, আকাশ মেঘ ছাড়া আছে একটা অদ্ভুত ধরনের, অন্য রকম ল্যান্ডফর্ম।
পাহাড়ের মাথায় বিশাল আকারের সমতলভূমি। জায়গাটার নাম, টেব্লল্যান্ড। টুরিস্টদের ভিড় লেগেই আছে। সেখানে ঘোড়ায় চড়া যায়, প্যারাগ্লাইড, মানে প্যারাসুটে বেঁধে গাড়ি দিয়ে টেনে আকাশে ঘুড়ির মতো মানুষকে নিয়ে ওড়ানোর ব্যবস্থা। চমৎকার জায়গাটা। তার পাশ দিয়ে সরু গাড়ি চলাচলের রাস্তা। সেই রাস্তা থেকে একটা জায়গায় ছোট্ট গেট দিয়ে আমরা নিচে নেমে গেলাম একসময়। যেতে যেতে সবুজে ঘেরা লতাপাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটি বড় বাংলোর সামনে এসে আমাদের গাড়ি দাঁড়াল। এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। এটা এখন আমির খানের নিজস্ব বাংলো। এই বাংলোটা ভাড়া নিয়ে কিরণের সঙ্গে আমিরের বিয়ে হয় কিছুদিন আগে। সুন্দর বাংলোটা আমিরের পছন্দ হয়ে যায় এবং পরে সম্পত্তিটা কিনেই নেন।
কিরণ রাও, তাঁর নিজস্ব কাজের অর্থাৎ ফিল্ম মেকিংয়র ব্যাপারে পাণ্ডিত্য, বুদ্ধি, খুঁটিনাটি ব্যাপারে যতটা তুখড়, ততটাই সুন্দর তাঁর আতিথেয়তা। প্রথম দিনেই আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন একটি বিশেষ কারণে, কিরণ একেবারেই ডালভাত-মার্কা বাংলা বলতে পারেন। অতএব, কিরণ যে শুধু আমাদের সবকিছু জিনিস ঠিক ঠিক বোঝাতে পারতেন, তাই নয়, মাঝখানে আমিরের সঙ্গেও আমাদের কথাবার্তার কোনও ঘাটতি থাকলে কিংবা অস্পষ্টতা থাকলে সেটার জন্য কিরণ ছিলেন দোভাষী। সেটাতে আমাদের কাজের অনেক ব্যাপারেই খুব সাহায্য হত।
আমাদের থাকার ব্যবস্থা, খাওয়া-দাওয়া থেকে সমস্ত কিছুই দেখাশোনা করার ভার কিরণের ওপর। রোজ ভোরবেলা উঠে নিজের বাগানে, পাহাড়ের কোলে নানা রকমের ফুলগাছের মধ্যে মর্নিংওয়াক করে কিরণ। একদিন সকালবেলা কাজে বসেছি, ঘরে ঢুকে হাত ভর্তি লাল কমলা রং মেশানো ফুলের থোকা নিয়ে আমার পাশে রেখে চলে গেল। বাগানে দু’-তিনটে ভীষণ বুড়ো ওক গাছ ছিল। ঘাড় ব্যথা করে আকাশের দিকে তাকালে সেই ভীষণ উঁচু গাছের পাতাগুলো এত ঝাপসা হয়ে যেত যে, একেবারে মগডালের ফুল দেখতে পাওয়া যেত না। সেদিন দু’-তিন থোকা ফুল গাছ থেকে পড়েছিল মাটিতে, কুড়িয়ে এনে সেই ফুল আমাকে দিয়েছিল কিরণ। খুব কাছ থেকে ফুলের বিস্তারিত রং, রূপ দেখলাম। এই হচ্ছে কিরণ।
চমৎকার এই বাংলোটা ছিল এক উচ্চশিক্ষিতা ধনী পার্সি-বুড়ির। তিন কূলে তার কেউ নেই। এই বাংলোতে গাছপালা-সমেত অনেকটা জমি, আর আছে বেশ কিছু বড় বড় পুরনো দিনের বুড় গাছ। একদিকে অল্প গেলেই উঁচুতে উঠে পাকা রাস্তা, যেখান থেকে আমরা ঢুকেছি, অন্যদিকে পাহাড়ের ঢাল। বহু নিচে নদীর ধারে গ্রাম, সেই গ্রাম থেকে প্রতিদিন লোকেরা পায়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে শহরে আসে কাজে। আবার বিকেলে ফিরে যায়। বিশাল আকাশ, সাদা মেঘ, দূরের পাহাড় নীল হতে হতে ধূসর। বাংলোর ভেতরে ঘরে ঘরে অনেক গল্প। বড় বড় জানালাগুলোকে নানা ভাগে ভাগে ভাগ করে, সেগুলোকে কালো কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা। উইন্ডো পেনগুলো মানে, জানালার অংশগুলো থেকে পাহাড়ি দৃশ্যকে নানা ভাবে এমন দেখায় যেন মনে হয়– এক ঝাঁক পেইন্টিং! ছোট ছোট কালো ফ্রেমে বাঁধানো পাহাড়ি নিসর্গ দৃশ্যগুলো জুড়ে জুড়ে বড় জানালা মিলে কখনও আরেকটি বিশাল নিসর্গ দৃশ্য। আর এক দেওয়াল জুড়ে এই বাড়ির যত ডকুমেন্টারি কাগজ, সেগুলো ফ্রেমে বাঁধানো। বাড়ির অসাধারণ স্থাপত্যের ব্লু প্রিন্ট, দলিল বা প্রমাণপত্র, প্রাথমিক ঘর সাজানোর খসড়া ড্রয়িং।
একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম যে, বুড়ির যাবতীয় কিছু জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমন রেখেই বুড়ি তার এই সম্পত্তি ছেড়ে দিয়েছে, তাই ঘরে ঘরে যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক সেই ভাবেই আছে। আমাদের জন্য যে ঘরটা দিয়েছে সেই ঘরটা বিশাল বড়। পুরনো দিনের কাঠের কাজ করা খাট, মশারি টাঙানোর ছত্রী আর আশপাশে রাখা তাকে নানা জিনিস। ঘরের একটা কোনায় একটি স্ট্যান্ডে, আলনার মতো, সেখানে আছে অনেক রকমের টুপি। আর একদিকে একটি বড় ফুলদানির মতো পাত্রে গল্ফ-স্টিকের মতো করে সাজিয়ে রাখা অনেকগুলো পাহাড়ি পথে চলার জন্য হাতের লাঠি। গায়ে মাথায় নানা রকমের কারুকাজ। ঘরের লাগোয়া টয়লেট। তার মধ্যে প্রথমে ঢুকেই পোশাক ছাড়ার একটা অংশ। তারপরে ভেতরের স্নানঘর। কমোডে বসে হাতের কাছে বাঁদিকে ছোট্ট দেওয়ালে কুলুঙ্গির মতো কেটে কেটে মিনি বইয়ের আলমারি। সেখানে চিন্তাভাবনা এবং কোনও কিছু পরিকল্পনা করার জন্য বইপত্র। এমন সুন্দর শৌখিন টয়লেটের কথা শুনেছি, কিন্তু দেখিনি কখনও।
ফিল্মের যত কাজের লোক, টেকনিশিয়ান, অভিনেতা,ক্যামেরাম্যান সবাই হোটেলে আছে। আমিও তাদের মতোই একজন, কিন্তু আমাকে হোটেলে না রেখে এই বাড়িতে রাখল কেন, কারণ কী? পরে বুঝলাম, আমি কীভাবে ছবি আঁকি, উঠি, বসি ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখার জন্য আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছেন আমির, যাতে সকাল-সন্ধে, আমার মুভমেন্ট, আচার-আচরণ, চলাফেরা দেখতে পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ছোট জাগুলিয়ায় অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাড়ির আশপাশে কিছুদিন একটা কাবুলিওয়ালাকে ঘুরতে দেখে প্রতিবেশীদের মনে হল, ওঁর অর্থনৈতিক অবস্থা বোধহয় খুব খারাপ। তখনকার দিনের কাবুলিওয়ালাদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেওয়া যেত। আসলে তা নয়, ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে অভিনয় করার সময় কাবুলিওয়ালাদের আচরণ চলাফেরা, কথা বলার ঢং ইত্যাদি ঠিক করে শেখার জন্য উনি নিজেই ইচ্ছে করে একটি কাবুলিওয়ালাকে নিয়োগ করেছিলেন তাঁর বাড়ির আশপাশে চিৎকার করে ফেরিওয়ালাদের মতো আওয়াজ করে ঘুরে বেড়াবে আর উনিও তাকে লক্ষ করবেন, দেখবেন তার শারীরিক ভঙ্গি এবং চলাফেরার ধরন।
আমিরের নামেও একটা কথা চালু আছে যে, ও নাকি পারফেকশনিস্ট, যা কিছু করেন পারফেকশনের জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করেন। সে কারণে আমাকে হোটেলে না রেখে ওঁর বাড়িতে রাখা। যাতে চোখের সামনে আমি নড়াচড়া করি। তবে কিরণ আমাকে দু’-একদিন হোটেলে অন্যান্য সহকর্মীর সন্ধেবেলার আড্ডায় নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
আমিরের বাড়িতে একসঙ্গে খেতাম রাতের খাবার, দিনের খাবার শুটিং-এর লোকেশনে। খাওয়ার পাতে বাঙালিদের মতোই হাতের এঁটো শুকিয়ে যেত, কথা আর শেষ হত না। ওঁর খাওয়ার ধরনটা বড় অদ্ভুত। ভাত-রুটি-সবজি-তরকারি-মাছ-মাংস, যা কিছু তা সবটাই একসঙ্গে মেখে একবারে খেয়ে নিতেন। শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য ফুড আর নিউট্রিশন দেখতেন যে ডাক্তার, তাঁর নির্দেশ মতো খাবারের মাপজোক। ভাত এতটা, ডাল এত গ্রাম, মাছ এত গ্রাম, চিকেন এতটা, ওজনের চার লিটার থেকে ছ’লিটার জল। নির্দ্বিধায় এবং নিয়মমাফিক সেসব যেন পেটে ঢুকিয়ে দিতেন আমির। ফিল্মের জন্য শারীরিক গঠন। মাঝারি মাপের, খুব রোগা, ভীষণ মোটা, বলিষ্ঠ, সাংঘাতিক মাস্লম্যান। ঠিক যেন জ্যান্ত স্কাল্পচার। এক অদ্ভুত ধরনের জ্ঞান হল। পছন্দমতো ডিজাইন করা শরীর। ডিজাইনার ডাক্তারের নামটি বড় চমৎকার। ডাঃ ধুরন্ধর!
আমাকে যে কাজের জন্য এখানে ডাকা হয়েছে, তার লিস্টে তিনটে কাজ। প্রথম কাজটা হচ্ছে, যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় একটা ছবি আঁকতে হবে, এ ছবির মূল যে শিশুশিল্পী, তার পোর্ট্রেট। একটা প্রাণখোলা হাসি মুখের ছবি, যেটা লাগবে ছবিটার ক্লাইম্যাক্স মানে শেষ পর্যায়ে তার ওপরে ছবির গল্পের পরিণতি নির্ভর করছে। দ্বিতীয় কাজটা হল, আমিরকে শেখাতে হবে জলরঙের ছবি আঁকতে কীভাবে বসতে হয়, কীভাবে দাঁড়াতে হয়, কেমনভাবে হাত চালাতে হয়, আঁকার সরঞ্জাম ব্যবহার ইত্যাদি। তৃতীয় কাজ; আমাকে ফিল্মে অভিনয় করতে হবে। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হবে– ‘আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন জনপ্রিয় জলরঙের শিল্পী সমীর মণ্ডল, তিনি আসলে আমির খানের ওরফে নিকুম্ভ স্যরের জলরঙের শিল্পগুরু। আজ তিনি এখানে এসেছেন বিচারকের ভূমিকায় এবং পুরস্কার প্রাপকের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।’ এ কথাটাও কখনও বলা হয়নি। কাজটিতে আমি রাজি হইনি। ফিল্মের ক্লাইম্যাক্সে পর্দায় চেহারা দেখানোর চেয়ে আমার আঁকা ছবিটি দেখানো গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই মনে হয়েছিল। কাজটি করেছিলেন ললিতাদি, আর একজন নামী শিল্পী ললিতা লাজমি।
যেটা বলছিলাম, আমির খান ছবিতে অভিনয় করবেন একটি শিল্প-শিক্ষকের ভূমিকায় এবং ওঁর শিল্পমাধ্যম জলরং। এত বড় কাজ, একজনকে পাকা শিল্পী তৈরি করা বা তার খানিকটা করতে গেলেও তো দীর্ঘ সময় লাগবে। সেই সময়টা এখানে হাতে নেই। অতএব আমার মাথায় সিনেমা ব্যাপারটাই ঢুকিয়ে নিলাম। ভেবে নিলাম, মোটামুটি গোটা ছয়েক শট ঠিকমতো পরিকল্পনা করতে পারলেই কাজ হাসিল। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ওঁকে ছবি আঁকা শেখালাম না, কয়েকটি শট এবং সেই শটে ও কী করবে, মানে হাতের কাজ, চোখের মুখের ভঙ্গিমা, দাঁড়ানো ইত্যাদি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।
শটগুলোকে প্র্যাকটিস করাতে শুরু করলাম।
১. জলরং সাধারণত বসে আঁকা হয়, কিন্তু এখানে ফিল্মের খাতিরে দাঁড়িয়ে আঁকা ঠিক হল। যেহেতু স্কুলের মাঠে আর্ট মেলায় আঁকা প্রতিযোগিতা তাই পুরনো একটা ক্লাস রুমের টেবিল বাইরে এনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড় করিয়ে তাতে ড্রয়িংবোর্ডটাকে কাত করে লাগিয়ে দেওয়া হল।আমিরকে একটু ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে দেখানোর জন্যই টেবিল, বড় বোর্ড আর দাঁড়ানো।
২. রঙের টিউবকে ঠিক কীভাবে ধরে তা থেকে টিপে রং বের করে প্যালেটে রাখতে হয়, সে কাজটাই দ্বিতীয় শট।
৩. প্লাস্টিকের ছোট বালতির জলে তুলি ডুবিয়ে সেটাকে কীভাবে প্যালেটে রং মেশাতে হয় সেটা করা এবং আগে থেকে জল বুলিয়ে ভিজিয়ে রাখা সাদা কাগজের ওপর রঙের তুলি ছোঁয়া মাত্রই রং ছড়িয়ে পড়বে একটা অদ্ভুত মজার দৃশ্য দর্শকদের জন্য তৈরি হবে।
৪. রংয়ের তুলি জলপাত্রে ধোঁয়া এবং প্যালেটে রং বদলানো।
৫. ছবি আঁকার মাঝামাঝি অংশে এর পরে কী করতে হবে তার পরিকল্পনা, সেই মতো চোখের, মুখের ভঙ্গিমা। ছবির কাছ থেকে, দূরে গিয়ে ছবিটাকে বারবার দেখা।
৬. প্রায় শেষ ছবিটায় হঠাৎ ওপর থেকে একটি গাঢ় রঙের ধারা নিচে নেমে আসছে ছবির মাঝ বরাবর। বাঁ-হাতের সবসময়ের জন্য ধরে থাকা এক টুকরো ন্যাকড়া দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে খপ করে চেপে রং শুষে নিয়ে ছবিটাকে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো। এই শটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই কাজটা জলরঙের চরিত্র বোঝাবে, বোঝাবে শিল্পীর তৎপরতা।
৭. শেষ পর্যায়ে ভুরুটা সামান্য কুঁচকে, ডান হাতে তুলিটা ঘোরাতে ঘোরাতে এবং বাঁ হাতের ন্যাকড়াটা চটকাতে চটকাতে এক মনে ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবতে হবে যে, ছবিটির কোনও কাজ আর বাকি রইল কি না।
সত্যি কথা বলতে কী, এই ৫-৭টার মধ্যে হয়তো মোটে ৩-৪টে ব্যবহার করা হয়েছিল ছবিতে। তাতেই আমির খান হয়ে উঠলেন সত্যিকারের জলরং শিল্পী। শেষ পর্যায়ে যখন শিশু চরিত্র ঈশান তার মাস্টারমশাই কী এঁকেছেন দেখতে আসে, তখনই কমপ্লিট ছবিটা দেখানো হয়েছিল। ক্যামেরাটা পেছন দিক দিয়ে ঘুরে ছবির সামনে এসে ক্লোজআপ করে পুরো ছবিটা পর্দা জুড়ে দেখানো হল। এইটুকুই দেখানো হয়েছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডে, হয়তো ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড। তারপরে কখনওই কিন্তু এই বোর্ডে আটকানো ছবিটা আর দেখানো হয়নি। অথচ কি অদ্ভুতভাবে ওই অংশটা আজও লোকে মনে রেখেছে। ছবিটা এভাবেই একটা লোকের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার এমন ক্যামেরা চলন এবং সুন্দর সংযত এডিটিং আমি কখনও দেখিনি।
ফিল্মের মানুষদের সঙ্গে ক’দিন বেশ দারুণ মজায় কেটে গেল। আলাপ হল ছবির গীতিকার প্রসূন জোশির সঙ্গে। মাঝখানে দু’-একদিনের জন্য মহাবালেশ্বর গিয়ে পাহাড়ে বৃষ্টি দেখে এলাম আমি আর আমার ছেলে, ওঁদেরই আয়োজনে। এবার বাড়ি ফেরার পালা কিন্তু বাধা দিলেন আমির। আরও একটা বাড়তি কাজ জুটে গেল।
শিশুশিল্পী যে ছবিটি আঁকবে ওই আর্ট কম্পিটিশনে এবং পুরস্কার পাবে সেই ছবিটিকেও আমাকে আঁকতে বলা হল। সে এক মহা বিপদ! আমার এই বুড়ো বয়সে পাকা হাতে কী করে শিশুশিল্প বানাব! অমল যদিও বেশ কয়েকটা ছবি অলরেডি করে রেখেছিল বাচ্চাদের দিয়ে, কিন্তু সেগুলো থেকে কোনওটাই আমির পছন্দ করেননি। শেষমেষ একটা রাস্তা বের হল। আমি একটা ছোটদের দিয়ে ওয়ার্কশপের আয়োজন করলাম। পাঁচগনি থেকে কিছু আর্ট টিচারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাঁচ ছ’টা স্কুলের চার-পাঁচটা করে খুব ভালো হাত যাদের, তেমন ছাত্র জোগাড় হল।
প্রথমে তাদের বোঝানো হল কী আঁকতে হবে। জল মানে জলাশয়, আকাশ, মেঘ, পাখি,ঝোপ-জঙ্গল, গাছপালা এইসব চাই ছবিতে। একটি শিশু একা একা থাকে। সে মাঝে মাঝে সেই জলাশয়ের ধারে এসে বসে। ফড়িঙের, ব্যাঙেদের, মাছের, পাখির সঙ্গে খেলা করে। এমন একটি জায়গা আমির এবং অমোলের দেখে রাখা আছে, আমিও দেখে এসেছি। লোকেশনটা পাহাড়ের ঢালে একটা একখণ্ড জলাধার। পাহাড়ের কোলে, খাদে জল জমে ঘাস গাছপালার ফ্রেম-সমেত ঠিক যেন ডিম্বাকৃতি একখানা আয়না। তাতে নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ছায়া পড়ে। ওই জায়গাটা বর্ণনা দিয়ে ছোটদের দিয়ে আমি চেষ্টা করছি তাদের মনগড়া একখানা ছবি আঁকানোর।
ওরা আঁকল। কেউ দারুণ পাহাড়, কেউ সুন্দর গাছ, কেউ জল আঁকল মেঘের ছায়া সমেত। কিন্তু সব মিলিয়ে পুরস্কার পাওয়ার মত কমপ্লিট কম্পোজিশনের ছবি পাওয়া গেল না। কোনও কোনও ছবির অংশ একেবারে মাস্টারপিস, আবার কোনও কোনও ছবি ড্রইং পর্যায়ে ভালো ছিল কিন্তু রং করার সময় নোংরা হয়ে গেল।
এইখানে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল, আমি একটা কোনও আর্ট টিচারকে নিয়ে ঘোষণা করালাম, এখন ছোট্ট বিরতি। তোমরা যতটা এঁকেছ এখন এই অবধি থাক, পাশের ঘরে চা এবং স্নাক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে তোমরা আস্তে আস্তে বেরিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে চা খেয়ে এসো। সেই বলে ওদেরকে জোরজবরদস্তি ছবি আঁকার মাঝপথে থামিয়ে বের করে দেওয়া হল। ওদের আকার ঘরে আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। শিশুদের মনে আঘাত দিয়ে তাদের ছবি আঁকা থামিয়ে দিয়ে আমি যেটা করলাম, তাতে আমার বড় কোনও সিনেমা বোধ হয়নি, বস্তুত অপরাধবোধে ভুগি আজও।
তারপর আমির আর আমি ওই সমস্ত ছবি থেকে ভালো কিছু ছবি মেঝেতে ফেলে পেনসিলে তাদের অংশগুলো মার্ক করলাম। কারও গাছ, কারও মাছ, পাখি। আকাশ-মেঘ-জল। সেগুলোকে ছোটদের মতো করে কপি করে জুড়ে জুড়ে একটা আলাদা ছবি এঁকেছিলাম। সে ছবিও আমিরের পছন্দ হয়নি। দাদা আপনি নিজের মতো করে আঁকুন, চেষ্টা করুন আপনি পারবেন, বলেছিলেন আমির। আমি করিনি। ফিরে এসেছিলাম মুম্বইয়ে। ঘনঘন আমিরের চিঠি আসতে থাকল, দাদা, প্লিজ চেষ্টা করুন। পরে করেছিলাম ছোটদের মতো করে ছবি, যে ছবি ঈশানের আঁকা হিসেবে ফিল্মে দেখানো হয়েছে।
২০০৭-এর ডিসেম্বরে ‘তারে জমিন পর’ মুক্তি পেল। তারপরের কথা আগেই বলেছি। বেশ কিছুদিন ফিল্মটাকে কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠানে আমিরের সঙ্গে কিরণের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হতে থাকল। আমিরের সঙ্গে মুম্বইয়ের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ওঁর পাপারাজ্জি সামলানোর ব্যাপারটাও খুব মজার লাগত। জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ শিরোনামে আমার একক শোয়ে এসেছিলেন আমির। বাইরে তখন কালাঘোড়া ফেস্টিভ্যাল চলছিল। ভিড় সামলাতে প্রদর্শনীর কক্ষের মূল দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল আমাকে।
ঘরোয়াভাবেও দেখা হত আমিরের সঙ্গে। একবার ওঁর বান্দ্রার বাড়িতে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমির, খুব হাসিঠাট্টা গল্পগুজব হয়েছিল। একটি নাদুসনুদুস বিড়াল মনে পড়ছে, কিরণের পায়ে পায়ে ঘুরছিল। কিরণ হাসি হাসি মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সমীরদা, জানেন এই বিড়ালটার নাম কী?’ আমি বললাম, ‘না’। কিরণ বললেন, “এর নাম ‘কুবলাই’। ‘কেন?’ আমার প্রশ্ন। কিরণ বললেন, ‘কেন আবার, ফ্যামিলি সারনেম তো ‘খান’। ও, তাই তো! কুবলাই খান, মানে চেঙ্গিস খানের নাতি!
আমার ইচ্ছে ছিল তিনটে ছবি যে এঁকেছিলাম, ফিল্মের জন্য সেগুলো নিজের কাছে রেখে দেব। কিন্তু আমিরও জোর করলেন, ওগুলো ফিল্মের অংশ হিসেবে ওঁর কাছেই রাখতে চাইলেন। ওই ছবিগুলোতে সই করার পালা এবার, কারণ শুটিংয়ে ওই ছবিতে কোনও শিল্পীর নাম লেখা হয়নি। ২০০৮ সালে ‘২০০৬’ লিখে সই করেছিলাম ছবিগুলোতে। তারও অনেক পরে টি সিরিজ বের করল ‘তারে জমিন পর’ ছবির ডিভিডি। আমির খান চাইলেন ছোট্ট চৌকো মতো না করে একটু বড় করে বাক্স বানিয়ে তার মধ্যে ডিভিডি ছাড়াও আরও কিছু কিছু জিনিস থাকুক। তাই অন্ততপক্ষে এ-ফোর মতো হওয়া উচিত তার সাইজ। যার মধ্যে থাকবে তিনটে ডিভিডি। আমিরের ছবি আঁকা শেখা এবং আমার পেইন্টিং করার পদ্ধতি ইত্যাদি অনেকটা অংশ জুড়ে আছে সুন্দর সেই মেকিং এর ডিভিডি-তে। তাছাড়া থাকবে দুটো পেইন্টিং-এর প্রতিলিপি, যতটা সম্ভব ভালো কাগজে ভালো ছাপা। আর থাকবে একটা পেনসিল, থাকবে ঈশানের খাতা আর ওর করা ফ্লিপবুক।
আমার ছবির প্রতিলিপি পোস্টকার্ড-মার্কা না করে একটু বড় করে গিফট দিতে চাইছিলেন আমির। বাক্সের খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে আপত্তি জানিয়েছিল টি সিরিজ। কিন্তু আমির নাছোড়বান্দা, ছাড়েননি। যেমনটা চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটা করেই ছেড়েছিলেন। কারণ, আমির যে পারফেকশনিস্ট!
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল