স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিও আঁকতে গেলেন অতুল বাবু। গুরুদেবের প্রতিকৃতি আঁকার ইচ্ছে প্রকাশ করায় তিনি বললেন– গুরুদক্ষিণা চাই। দক্ষিণা কী? না, নন্দলাল বসুর একখানা মুখ এঁকে এনে দিতে হবে আগে। অগত্যা তিনি গেলেন নন্দবাবুর কাছে। শুনে নন্দলাল বললেন– এক কাজ করো, আইভরি ব্ল্যাক খানিকটা ক্যানভাসে গোল করে ঘষে দাও। সেই হবে আমার মুখ, গুরুদেবের দক্ষিণা।
২.
কোনও এক রবিবারে, দোতলা বাসের ওপর তলায় জানলার ধারে বসে, দিব্যি হাওয়া খেতে খেতে কোথায় যেন যাচ্ছি। ১৯৭২ সাল। গভঃ আর্ট কলেজে আমার তখন সেকেন্ড ইয়ার। হস্টেল লাইফ। ছুটির দিনে কাজে-অকাজে কোথাও না কোথাও ঘুরে বেড়াই। আউটডোর স্টাডি করি। হঠাৎ ওই বাসের আর একদিকে দীপককে দেখা যাচ্ছে। উঠে গিয়ে ওর কাছে বসলাম। ও আমাদের কলেজে পড়ে না। দীপকের সঙ্গে আমার কলকাতা আর্ট ফেয়ারে আলাপ। আমরা দর্শকদের মুখ আঁকতাম পেনসিলে, পাঁচ টাকা করে। কলেজ লাইব্রেরিতে বিদেশি শিল্পীদের দারুণ ছাপা সব প্রতিকৃতি দেখেছি। ওরিজিনাল বলতে অসাধারণ কিছু কাজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে দেখে এসেছি। তার মধ্যে একজন বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পী। অতুল বসু। পরে তার আঁকা লেডি রাণুর প্রতিকৃতি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ দেখেছি।
দীপকের কথায় ঘোর কাটল, ‘কোথায় নামবে?’ সত্যি তো, এতক্ষণ কে কোথায় যাব, জানি না। আমিও জানতে চাইলাম, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ দীপক বলল, ‘মাস্টারমশাইয়ের কাছে। আজ ক্লাস আছে।’ ভালো লাগল জেনে ও রবিবার আলাদা করে আঁকা শেখে। জানতে চাইলাম, কার কাছে শেখো? উত্তরটা শোনামাত্র দোতলা বাসের সামনে থেকে মুখে একটা বাতাসের ঝাপটা লাগল। মাথার মধ্যেটাও কেমন গুলিয়ে উঠল হঠাৎ। দীপক যাচ্ছে শিল্পী অতুল বসুর বাড়ি। আজ আঁকার ক্লাস।
বন্ডেল রোডে পুরনো ঢঙের একটি বাড়ি। আধখোলা গেট। গেটটা ঠেলে অনেকটা ঝুলে থাকা মাধবীলতার ফুলসমেত ডালগুলো দুলিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। দু’পাশে অগোছালো আটপৌরে ফুলের বাগান। দালানে প্রৌঢ়, গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী যিনি চেয়ারে বসে, তাঁর পায়ের কাছে ইতস্তত কয়েকটি প্যাস্টেল আর থামের গায়ে হেলান দেওয়া কাঠের পাটায় আঁকা একখানি অসম্পূর্ণ ছবি। দালান থেকে দেখা মাধবীলতার পুঞ্জীভূত ফুল পাতায় আচ্ছাদিত গেট ছবিতে। ঠিক দুপুরের আগে চড়া সূর্যালোকে একপেশে আলো আর ছায়া। ছোট ছবিখানিতে দেখার মতো যেটা, তা হল ফুলের গায়ে আলো ছায়ার যেমন যথাযথ রং তেমনই পুঞ্জীভূত ফুল-পাতার সমষ্টিগত যে ঝোপ তার গায়ে একপাশে আলো, অন্যপাশে ছায়া। একটি চূড়ান্ত বাস্তবতার রঙের মায়া। হবে নাই বা কেন– পশ্চিমি ঢঙে রয়াল কলেজ অফ আর্ট, লন্ডন থেকে শিক্ষালাভের বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ তো থাকতেই হবে। এক্কেবারে জলজ্যান্ত ইম্প্রেশনিজমের উদাহরণ। শিল্পী কিন্তু খুশি নন। চেয়ারে হতাশ-মার্কা এলানো শরীর।
ঘটনাচক্রে অতুল বসু এখন আমারও মাস্টারমশাই। সব মিলিয়ে জনা পাঁচ-ছয় ছাত্রছাত্রী। তাও সময়মতো আসে না সবাই। সেদিন আর কেউ আসেনি তখনও। আমরা দু’জন গল্প করছি। গল্পটাই বেশি হত। জীবনের নানা সময়ের গল্প শোনাতেন উনি। দেশ-বিদেশের নানা অভিজ্ঞতার কথা। একটা কথা প্রায়ই বলতে শুনতাম– ‘জীবনে কিছুই হয়নি’। আসলে ওঁর কথার বেশির ভাগটাই বুঝতে পারতাম না। ভাবতাম আমাকে কেন বলছেন এসব।
–আমি যে তোমাদের ডেকেছি কিছু শেখাবো বলে, তা নিজে কি এখনও আঁকতে পারি? আঁকা ছেড়ে দিয়েছি দীর্ঘদিন। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে আর কোনও দিন ছবি আঁকব না। জানো, আমি আমার সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। হরিলাল সে সময় আমার বাড়িতে আসে এবং কিছু ছবি উদ্ধার করে রেখেছে।
ব্যাপারটা শুনে শিউরে উঠেছিলাম! অতুল বসুর সব ছবি পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভেবে শক্ত হয়ে বসেছিলাম বেশ অনেকক্ষণ। খানিকটা সময় লাগল নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে। ওঁর মুখে তেমন কোনও কষ্টের ছাপ দেখিনি। মুখোমুখি তখনকার দিনের প্রথিতযশা শিল্পী অতুল বসু। সারাজীবনের যা কিছু ভালো-মন্দ, সফল-অসফলতার, নিন্দা-সম্মানের কথা যেন এক শ্বাসে বলার জন্যই বসে আছেন এই প্রাজ্ঞ-বৃদ্ধ কিংবা সরল শিশুটি। প্রতিভাবান প্রবীণরা কখনও হিমালয়ের চেয়ে ভারী আবার ফুলের চেয়ে হালকা। তাঁর বলার অনেক কথা।
–এক জ্যোতিষী বলেছিল আমি ৭২ বছর পর্যন্ত বাঁচব। দ্যাখো, আমি বাহাত্তর পেরিয়ে এসেছি, এখন অন্য মানুষ। আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করছি। আবার আঁকব। সেই জন্য তোমাদের ডেকেছি। তোমাদের সঙ্গে আঁকব। এই যে ছবিটা আঁকলাম এত বয়সে এসে, ওই মাধবীলতার ছবিটা, সেটাও তো হয়নি। চোখে ভাল দেখি না আজকাল। সম্প্রতি চোখ কাটিয়েছি। দু’চোখে দু’রকম দেখছি। চশমাও দুটো। সবসময় পরি একটা আর কাজের সময় পরি আর একটা। আঁকার সময় সমস্যাটা কী হচ্ছে জানো? ঠিক যেখানে প্যাস্টেল-টা লাগাতে চাইছি তার আধ ইঞ্চি দূরে দাগ পড়ছে। বাঁ-হাতের আঙুল দিয়ে প্রথমে জায়গাটা ধরে নিচ্ছি, তারপর ডান হাতের চক-টা ওখানে ঠেকিয়ে তবে চেপে রংটা লাগাচ্ছি। যাই হোক, সেটা চোখের ব্যাপার। তবে ‘হয়নি’টা সারা জীবনের ব্যাপার। আসলে আমার দিদিই ওই ‘হয়নি’ টা মাথায় ঢুকিয়েছে। একসঙ্গে দুজনে পড়তে বসতাম ছোটবেলায়। দিদি আমাকে কিছু লিখতে দিত। আমি শ্লেটে লিখতাম। ওর হাতে থাকতো একটা ভিজে কাপড়ের টুকরো। লেখা হয়ে গেলে দিদিকে দেখাতাম। প্রতিবারই দিদি কাপড় দিয়ে শ্লেট মুছে দিত। বলত– হয়নি, আবার লেখো। সেই থেকে ‘হয়নি’টা পাকাপাকি মাথায় ঢুকে গেছে। আজও যা করি মনে হয়, হয়নি।
এই ‘হয়নি’র মস্ত উদাহরণ অপেক্ষা করছিল বড় অর্থে। আমি গাঁয়ের ছেলে। ছবি আঁকা যদি খুব বড় মাপের কিছু হয়, তাহলে আমি না জেনেই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। শিল্প যদি ‘সৃজনশীলতা’ হয়, যদি হয় সমাজের জন্য মস্ত দায়িত্বের কাজ, আমি হয়তো আসতাম না। শিল্প যদি দলাদলি, পুব-পশ্চিম হয়, যদি হয় জীবন বা মরণ তাহলেও আমি আসতাম না গ্রাম ছেড়ে। শিল্প যদি পৃথিবীতে আমার নিজস্ব কিছু অবদান হয় কিংবা মানুষে মানুষে ভেদাভেদের এক যন্ত্রণা তাহলে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। এখন আমার পরিণত বয়সে পুরনো এসব কথা মনে করলে ভয়ে কুঁকড়ে যাই এই ভেবে যে, কেমন করে অনেকটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি। হিসেব করতে গিয়ে দেখি, কী ভীষণ ভুল পথে এতটা সময় কাটালাম।
মাস্টারমশাই এখন তাঁর ‘হয়নি’ আর ‘পারিনি’র যে যুক্তি দেখাবেন– আমাকে তার জন্য আমার কোন প্রস্তুতি ছিল না। না আমার সেসব বোঝার ঠিক বয়স তখন, না কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা। গল্পের গতিতে ওঁর মানসিক অবস্থার তাল পেতাম না। তিনি আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন তৎকালীন ‘শিল্প আন্দোলন’ কিংবা দলাদলির কথা। ঘরানা বা শৈলী নয়, নয় ইতিহাস অথবা জলহাওয়ায় শিল্পের চরিত্র নির্ধারণের কথা। সাতের দশকের গোড়ায় বাংলায় তখন দলাদলির হাওয়া। কঠোর মতামত, মতবাদের দিন শুরু হয়েছে। শিল্পের ধরনকে, বিশ্বাসকে কঠোর সমর্থন বা বিরোধিতায়, দলগতভাবে শিল্প আলোচনা-সমালোচনার সময় শুরু। নতুন হাওয়া, নতুন বোধ। আমি নির্বাক শ্রোতা। হাঁ মুখ করে বৈদিক যুগের গুরুবাক্য গিলছি। আজ্ঞা গুরুনাং হি অবিচারণীয়া। আমাদের যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক গুরু, অর্থাৎ অধ্যাপক, অধ্যক্ষ ইত্যাদি, তাঁদের সম্পর্কে নানা কথা বলছেন কখনও, তো কখনও বলছেন বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট আর ওয়েস্টার্ন আর্টের গল্প। অ্যাকাডেমিক আর্ট, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। কলেজে হিস্ট্রি অফ আর্ট নেই, কোনও থিওরি পড়ানো হয় না। এরই মধ্যে আসছে শহরের বাম-দক্ষিণ। আসছে সব বিখ্যাত শিল্পীদের নাম। তাঁরা নাকি দূর থেকে ওঁকে নমস্কার করেন। ‘গুরু’ বলে আলাদা করে দূরে সরিয়ে রাখেন। ওঁকে সমগোত্রীয় বা আত্মীয় ভাবেন না। আসছে শহরের শিল্পগোষ্ঠীর কথা।
–এই মানসিকতার মধ্যে একটা ছবি এঁকেছিলাম জানো? পাশের ঘরের টেবিলে দ্যাখো দুটো অ্যালবাম আছে। সবচেয়ে মোটাটা নিয়ে এসো, তোমায় ছবিটা দেখাই। নাঃ, শোনো, তুমি এখানে বোসো আমি নিয়ে আসছি। কেন বলো তো? ওই অ্যালবামে অনেকগুলো ছবি আছে, যার আলাদা গল্প, আমার নানা মানসিক পরিস্থিতিতে আঁকা। তুমি আনতে গিয়ে ফটাফট পাতা উল্টে অন্য ছবিগুলো দেখতে চাইবে। আমি যে প্রসঙ্গে কথা বলছি শুধু সেই ছবিটাই তোমাকে দেখাতে চাই। সারা জীবনের কাজ এক মিনিটে দেখে নেবে সেটা ঠিক নয়। বোসো।
সত্যি সত্যি উনি আস্তে আস্তে নিজেই পাশের ঘরে গেলেন। ভাবছি– কেনই বা আমাকে অবিশ্বাস, আবার কেন বা আমাকেই ছবিটা দেখাবেন। মোটা মহাভারত মার্কা অ্যালবামটি এনে টেবিলে রাখলেন। পাতা উলটে খুঁজে বের করলেন ওঁর সেই ছবিটি। ওঁর দিকে মুখ ঘোরানো অ্যালবামের অন্য পাতাগুলোর ছবি আমি সত্যি দেখতে পাইনি। নির্দিষ্ট ছবিটি এখন আমার সামনে টেবিলে। হাতি-ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক, এমনকী, ডাইনোসরও হতে পারে এমন সব বিশাল বিশাল জন্তু জানোয়ারের কঙ্কালের পাহাড়। ফাঁকা মাঠে আকাশচুম্বী স্তূপীকৃত ওইসব হাড়গোড়ের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে একা একটি নেংটি ইঁদুর। জ্যান্ত। উনি ছবিটি যা ব্যাখ্যা করলেন তা হল– সারা জীবনে জগতের সব বিশাল জানোয়ার শিকার করলেও কেবলমাত্র একটি নেংটি ইঁদুরকে মারতে পারলেন না। অর্থাৎ বিশ্বজয় করা সহজ হলেও বাংলা জয় করা ততটা সহজ নয়। শুনলাম। ভয় বাড়ল। উপলব্ধি হল, ছবি আঁকাটা যত না হাতের কাজ তার চেয়ে অনেক বেশি মগজের।
সত্যি কথা বলতে কী, আমাকে একা পেয়ে এমন ভয়ের গল্প মোটেই ভালো লাগেনি। তার চেয়ে গাঁয়ের ছেলে হিসেবে শহরের লোকজীবন, লন্ডনের নানা গল্পের মধ্যে একটা ছবি ছবি অনুভূতি হত। লন্ডনে থাকাকালীন ওঁর নানারকম খাওয়া-পরার উদ্ভাবনী গল্প শোনাতেন, সেগুলো আমার বেশি ভালো লাগত। এখান থেকে বাড়ির খাবার নিয়ে যেতেন। বড় এক গ্লাস চা বানাতেন। তার মধ্যে ফেলে দিতেন এক মুঠো চিড়ে। অল্প সময়ে গরম চায়ে চিঁড়ে ফুলেফেঁপে একগ্লাস ঝটপট খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলার গল্প আমার কাছে কম সৃজনশীল মনে হত না। ওঁর লঘু গল্পগুলোই আমার স্থূল মস্তিষ্কে বেশি উপভোগ করতাম।
প্রতিকৃতি আঁকা নিয়ে বলেছিলেন কীভাবে একের পর ডাকসাইটে ব্যক্তিত্বের সামনাসামনি হয়েছেন। স্যর আশুতোষ মুখার্জীর পোর্ট্রেট করার ইচ্ছা হল। দেখা করার একটা অনুমতি আর দিনক্ষণও ঠিক হল। আশুতোষ মুখার্জী মানে তখন বাংলার বাঘ। ওঁরও অল্প বয়স। শুনলাম সে কাহিনি।
— ওঁর বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন উনি স্নানের আগে গায়ে তেল মাখছিলেন। ইচ্ছে জানতে চাইলেন। বললাম, আপনার একটা পোর্ট্রেট করতে চাই। আপনার সময়মতো একদিন আসব। উনি বললেন– ‘এখনই আঁকো, এখন হয় না? এই আমি বসে আছি’। আমার সঙ্গে রঙ তুলি আর অন্য সরঞ্জাম ছিল না কিছুই। পরে কখন কী হবে, এখনকার এই সুযোগটা নষ্ট করতে চাই না। স্কেচবুকে কাঠকয়লার পেনসিলে এঁকেছিলাম সেদিন আশুতোষ মুখার্জী। কাঠকয়লার পেনসিলে প্রয়োজনমতো কখনও মোটা কখনও সরু স্ট্রোক। কখনও বা আঙুলের ডগা দিয়ে সামান্য ঘষে কোথাও কোথাও একটু টোন তৈরি। রাবারের কোনা দিয়ে কোথাও এক আধটু হাইলাইট। বুকের লোমের একটু আভাসমাত্র। বাঁ-কাঁধ থেকে শুরু হয়ে বুকের ওপর দিয়ে ওঁর ডান পাশে যাওয়ার পথে আবছা হয়ে যাওয়া পইতে। নগ্ন গায়ের আচ্ছাদনের আয়োজন ওই পইতেটুকুই। দ্যাখো তো, বাংলার বাঘ লাগছে কি না।
ওঁর স্বভাববশত নিজের হাতে অ্যালবাম থকে শুধু সেই পাতাটা খুলে আমাকে দেখিয়েছিলেন। সেই অসাধারণ স্কেচ। দি টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট-এ ছবিটি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর শোক সংবাদে ছাপা হয়। ছবির ক্যাপশনে ছিল ‘বেঙ্গল টাইগার’ কথাটাও। সেই কাজের প্রশংসাতেই অতুল বাবুর স্কলারশিপ জোটে লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমিতে পড়ার। পেনসিলে আঁকা সেই ছবিটি আজও ব্যবহৃত হয় বহু বই, খবরের কাগজ আর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সাদা-কালো, বলিষ্ঠ শরীর, পুষ্ট গোঁফ, বাংলার বাঘ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিও আঁকতে গেলেন অতুলবাবু। গুরুদেবের প্রতিকৃতি আঁকার ইচ্ছে প্রকাশ করায় তিনি বললেন– গুরুদক্ষিণা চাই। দক্ষিণা কী? না, নন্দলাল বসুর একখানা মুখ এঁকে এনে দিতে হবে আগে। অগত্যা তিনি গেলেন নন্দবাবুর কাছে। শুনে নন্দলাল বললেন– এক কাজ করো, আইভরি ব্ল্যাক খানিকটা ক্যানভাসে গোল করে ঘষে দাও। সেই হবে আমার মুখ, গুরুদেবের দক্ষিণা। নন্দবাবু কালো মানুষ। রং বিষয়ে অগাধ জ্ঞানী, শিক্ষক। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল অতুল বসুর মাথায়। আইভরি ব্ল্যাকের টিউবটা নন্দবাবুর পায়ের কাছে রেখে ওঁকেও দিলেন দক্ষিণা। তারপর উনি আইভরি ব্ল্যাক ছাড়া কত কালো হতে পারেন তার পরীক্ষা দিতে ক্রিমসন রেড, ভিরিডিয়ান গ্রিন, প্রাশিয়ান ব্লু ইত্যাদিতে সম্পন্ন করলেন নন্দলাল বসুর প্রতিকৃতি। নতুন জ্ঞান হল কালো জিনিস শুধু কালো রঙে আঁকা যায় না। কালোর মধ্যেও থাকে আরও অনেক রঙ।
অল্প অল্প কাজ আর অনেক অনেক গল্পে কাটছিল সপ্তাহের একটি দু’টি দিন। আর্ট কলেজের বন্ধুদের এসব কিছুই বলি না। আমার একার জগৎ। যাই শুনি, জ্ঞান অর্জন হচ্ছে মনে করে শুনি। কলেজের কাজ দেখাতাম। আলোচনা হত। মাস্টারমশাই হোমওয়ার্ক দিতেন। অদ্ভুত সব বিষয়। কখনও স্টিল লাইফ, কখনও যা খুশি এঁকে আনো। কথাই বেশি। বাস্তব, অতিবাস্তব, পরাবাস্তব। কঠিন কঠিন সব শব্দ। পৃথিবী জুড়ে তখন প্রথাগত আর প্রথা ভাঙার নানা পরীক্ষা। তারই ঢেউ কলকাতার বুকে। কলেজের পাঁচ বছরের সিলেবাসে এসব কিচ্ছু নেই। সদ্য গ্রাম থেকে স্কুল শেষ করে শহরে আসা আমি জগতের খোঁজ রাখি না। একটা বস্তুকে নিখুঁতভাবে আঁকাটা যে শিল্প নয়, সেটা চারিদিক দিয়ে যখন ওঁকে অত্যাচার করেছে, এরকমই সময়ে মাস্টারমশাই একটা অবাক করা হোমওয়ার্ক দিলেন।
–পরের দিন একটা ‘আননোন ফর্ম’ এঁকে নিয়ে এসো।
আননোন ফর্ম? আননোন ফর্ম আমি আঁকতে পারিনি। বেশ কিছুদিন ক্লাস ডুব মারলাম। তারপর আর কোনও দিন ও-মুখো হইনি। অন্যদের কাছে শুনেছিলাম, উনি বারবার জিজ্ঞাসা করতেন– ‘ওই ছেলেটা আর আসে না কেন?’ আসলে আমার গ্রাম্যজীবনের বোধ-বুদ্ধি ওঁকে আকর্ষণ করতো হয়তো। আমার ছিল দেশি গ্রাম্য গল্প, ওঁর বিলেতি। আমার ছিল ছবি আঁকা শিখে কী হবে ভবিষ্যতে, তার অজানা হিসেব। জীবনের শুরুতে উড়ো পাখি। চারদিকে পুরো গাছ নয়, শুধু ডাল খুঁজি। ওঁর ছিল সারা জীবনের শিল্প শিক্ষার, শিল্পচর্চার পর কী ফল হল তার হিসেব মেলানোর অবসর। এখন এই পরিণত বয়সে প্রায়ই ভাবি– আননোন ফর্মটা কি ধরতে পারলাম? আর ভাবি– কী চেয়েছিলেন মাস্টারমশাই হোম ওয়ার্কে?– আননোন ফর্ম!– একটা অজানা আকার, একটা অচেনা অবয়ব!
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল