সিয়াচেন, কার্গিল, অরুণাচল থেকে রাজস্থানে পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর সর্বত্র আধপেটা খাওয়া ভারতীয় জওয়ানদের কাতারেও দেশ-সেবক মহান নেতার সন্তানরা অনুপস্থিত– আছে ওই গরিব, প্রায় নিরক্ষর, ভূমিহীন, কম মাইনেয় বর্তে যাওয়া ভারতবাসী, যাদের বলা হয়েছে– ‘তোরাই যা, তোরাও হিন্দু, কন্ট্রিবিউট কর।’ বাবরি মসজিদ ভাঙতে এদেরকেই পাঠানো হয়েছিল। দূরে বসে অটলবিহারী, আদবানি, উমাভারতী ইত্যাদি ক্রিমিনালরা এ-ওর ঘাড়ে চেপে দাঁত বের করে হাসছিল এই ভেবে যে, করসেবকদের লেলিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া গেল।
১২.
ফের পুরনো মন্তব্যের খেই ধরে শুরু করি। মারামারি বাঁধলে টক্কর নিতে খাটোখোটোরাই বরাবর প্রথম সারিতে হাজির থাকে– কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কালোদের ক্যানন ফডার হিসেবে রপ্তানি শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য পরবর্তীকালে প্রায় সব হলিউডি চলচ্চিত্রেই সাদা ক্লাউনরা পশ্চাদ্দেশের ব্যথা চেপে ভিয়েত কং-এর বিরুদ্ধে অতুল কীর্তি স্থাপনের ভয়াবহ হাস্যকর আখ্যান পেশ করেছে– চণ্ডীদাসের খুড়োদের আত্মসম্মানবোধ কোনও কালেই ছিল না, এখনও নেই। এদেশে দাঙ্গায় মুসলমান কোপাতে নিম্নবর্ণ, দলিত পাঠানো হয়– ‘তোরাই যা, তোরাও হিন্দু, কন্ট্রিবিউট কর।’ নকশালদের খুন করার অছিলায় মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ-সহ গ্রামকে গ্রাম আদিবাসীদের পরিকল্পিত উপায়ে নিকেশের তরে ভাড়াটে খুনিদের সালওয়া জুদুমে ভারতীয় জনতা পার্টির ক্রিকেট খেলানো ছেলেপিলেদের সঙ্গে মোলাকাত হবে না– বরং পথের ধুলো থেকে আনি দু’-আনি খুঁটে তোলা আদিবাসীদেরই দেখা মিলবে। তাদেরকেও বলা হয়েছে– ‘তোরাই যা, তোরাও হিন্দু, কন্ট্রিবিউট কর।’ সিয়াচেন, কারগিল, অরুণাচল থেকে রাজস্থানে পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর সর্বত্র আধপেটা খাওয়া ভারতীয় জওয়ানদের কাতারেও দেশ-সেবক মহান নেতার সন্তানরা অনুপস্থিত– আছে ওই গরিব, প্রায় নিরক্ষর, ভূমিহীন, কম মাইনেয় বর্তে যাওয়া ভারতবাসী, যাদের বলা হয়েছে– ‘তোরাই যা, তোরাও হিন্দু, কন্ট্রিবিউট কর।’ বাবরি মসজিদ ভাঙতে এদেরকেই পাঠানো হয়েছিল। দূরে বসে অটলবিহারী, আদবানি, উমাভারতী ইত্যাদি ক্রিমিনালরা এ-ওর ঘাড়ে চেপে দাঁত বের করে হাসছিল এই ভেবে যে, করসেবকদের লেলিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া গেল। নাগপুর, বোম্বাই, দিল্লি ছাড়াও ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং হালে কর্ণাটকে গণহত্যায় যাদের হাতে মারণাস্ত্র থাকে, যারা ধর্ষণ করার জন্য পয়সা পায়, যাদের বলা হয় একটি মুসলমানকে খুন করতে পারলেই যেটুকু পুরুষাঙ্গ বর্তমান, সেটুকুর দৈর্ঘ্য কনসিডারেবলি বৃদ্ধি পাবে, তারা প্রত্যেকেই নিম্নবর্ণের মানুষ, এবং তাদেরকেও বলা হয়েছে– ‘তোরাই যা, তোরাও হিন্দু, কন্ট্রিবিউট কর।’ শুধু মন্দিরে ঢুকতে চেয়ো না, পুরোহিত হওয়ার বাসনা পোষণ কোরো না, বামুনদের সঙ্গে একাসনে বসে খেতে চেয়ো না অনুষ্ঠান বাড়িতে– তাহলেই খুন করে গাছ থেকে লটকে দেব। এ বছর জুন মাসে মধ্যপ্রদেশের ছতরপুর জেলায় দলিত বর ঘোড়ায় চেপে বিয়েতে গেলে তার ওপর একটানা পাথর বৃষ্টি হয়েছিল। এর আগে বুন্দলখণ্ডেও একই রকম ঘটনা, এমনকী, রাজস্থানের কংগ্রেসকেও বিষ্মিত করে… সত্য সেলুকাস, কেয়া অদা কেয়া জলবে তেরে পারো!
পড়ুন ভয়বাংলা-র আগের পর্ব: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
দিল্লিতে শিখ-গণহত্যা বিষয়ক যে রম্যরচনাটি জাস্টিস নানাবতী কমিশন জুগিয়েছিল, তার মুখবন্ধে বলা হয় দাঙ্গা-পরিস্থিতি তেসরা নভেম্বর থেকে স্তিমিত হয়ে পাঁচ তারিখের মধ্যে সবকিছু ফের দিওয়ানা হুয়া বাদল। এর চাইতে বড় মিথ্যে আর কিছু হতে পারে না! টাইটলার, সিন্ধিয়া, পাইলটদের গুন্ডাবাহিনী কতদিন একটানা দাপিয়ে লুঠতরাজ চালিয়েছে উত্তরভারত জুড়ে, তার কোনও ধারণাই কংগ্রেসের ছিল না– থাকলেও পাত্তা দেয়নি। ইন্দিরাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার সময় জৈল সিং-এর গাড়িতে পাথর ছোড়া হয়, ওর মোটরবাইকারোহী সেপাইদের একজন বাধ্য হয়ে পাগড়ি খুলে ফেলে, এবং প্রেস অফিসার ত্রিলোচন সিং গাড়ির সিট উপড়ে লাঠি এবং পাথর ঠেকিয়ে কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচেন। দিল্লি বহিরাগত সমাজবিরোধীদের হাতে চলে গেছিল, কারণ তখনকার কংগ্রেস এখনকার বিজেপির মতোই সন্ত্রাসের রাজনীতি চালাত– এবং ক্ষমতায় ফিরলে ফের চালাবেও। শিখদের দোকান ঝেড়ে পরাঠেওয়ালি গলিতে প্রায় পঁচিশ কোটি টাকার শাড়ি জামাকাপড় পোড়ানো হয়, শিখদের ট্যাক্সিতে আগুন ধরিয়ে, পাঞ্জাবিদের উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে চলে নির্বিচারে খুনখারাবি। মন্ত্রী-পরিষদের এক উচ্চপদস্থ রসিকের একটি মন্তব্য কানে মধুবর্ষণ করেছিল। তিনি বলেন– ‘… আমরা বরাবরই ভেবেছি এমন গণহত্যা কেবল বহু দূরে অবস্থিত আসাম, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মান্দাই অথবা নেল্লিতেই সম্ভব। অথচ এখানে সবটাই রাষ্ট্রপতি ভবনের দশ কিলোমিটারের মধ্যে ঘটে গেল।’
পড়ুন ভয়বাংলা-র অন্য পর্ব: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
মশাইটি আলটপকা মন্তব্যের ফাঁকে এমন মশলা গুঁজে দিয়েছিলেন, যা সেই সময়কার ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা জননায়কদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। গণহত্যা কেবল বহু দূরে অবস্থিত আসাম, জনসমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন মান্দাই অথবা নেল্লিতেই সম্ভব ছিল তাই নয়, সেরকম জায়গাতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রয়োজনে বরাবর সংঘটিত হত, এখনও হয়, এবং সেটাই এই রাষ্ট্রেরই বুনিয়াদি ব্যবস্থার অংশ। অর্থাৎ তেলেঙ্গানায় কৃষকদের ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলি, ধানবাদ অঞ্চলে মাফিয়া-রাজ, ঘুমন্ত ফুটপাথবাসীর বুকের ওপর দিয়ে এসইউভি থেকে কোভিড পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর প্রতিদিন দেশ-জুড়ে পুলিশের লাঠি চালানো আদতে বিচ্ছিন্ন মানুষদের পরিকল্পিত উপায়ে হত্যার একটিই অবিচ্ছিন্ন বৃহদাখ্যান– রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে, একটু এয়ারপোর্ট-বন্দর-রেলস্টেশন নিলাম, একটু শাড়ি খোলাখুলি, একটু থারুর, থুড়ি, থাই থাবড়ে আজ্জা আজ্জা, ম্যাঁয় হুঁ প্যার তেরা…
আর ওই বহু দূরে অবস্থিত টুকরো টুকরো ‘ভারতবর্ষ’-এর বুক চিরে ‘বন্দে ভারত’ ছুটে চলার সময় লাইন থেকে পাথর তুলে দাঁড়িয়ে থাকে ‘মুচি মেথর আমার ভাইয়ের’ ‘বন্দি ভারত’, বন্ডেড লেবারের ভারত– নো অ্যালাও, শুধু ক্যালাও। এরাই ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের অসামান্য নিদর্শন বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল, এদের দিয়েই মহারাষ্ট্রে শিবসেনা তৈরি হয়ে যাতে এদের মতো মজুরদের খুন করে শ্রমিক আন্দোলনগুলোকে ধ্বংস করা যায়, এরাই দুর্গা বাহিনীর কিশোরীদের উলঙ্গ করে রাস্তায় হাঁটিয়েছে বন্দুক চালানো শিখতে না চাওয়ার অপরাধে, এরাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুট-কাজে গিয়ে ভারতীয় মালিকদের হাতে প্রতারিত হয়ে ভারতীয় জেলখানায় বিনা বিচারে বন্দি, এরাই ভারতীয় ক্রিকেট, ভারতীয় ঠান্ডা পানীয়, ভারতীয় চিপস এবং ভারতীয় হাপ-ন্যাংটো মডেলদের চেটেপুটে জনগণমন গাইবার সময় উঠে না দাঁড়ালে ভারতীয় দাঁত-নখ শানায়। রেলের সাইডিং-এ দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধ্যা ভারত– মাম্মি শান্টিং করে দিয়েছে, সঙ্গে কিছু বুর্জোয়া লিবেরাল। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের না আছে শ্রমিক শ্রেণিকে একজোট করার ক্ষমতা, না আছে কোনও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম– এমনকী, ছোটখাটো কোনও দুরভিসন্ধিও নেই, এমনই হতভাগা অবস্থা!
কেবল ভোট এলে রেললাইনের ধারে পাথর তুলে রেডি লোকগুলো ভাগ হয়ে যায়। তবু সমস্ত পাথরই দেশ তাক করে ছোড়া। সম্প্রতি বন্দে ভারত রেলগাড়িগুলোকে একটি প্রাইভেট কম্পানি বানানোর বরাত পেয়েছে– সরকারি সুযোগ সুবিধেয় মুনাফা লুটে চলে যাবে তারা। এর পরেও ওই ট্রেনের দিকে পাথর ছুড়লে জনগণের ক্রোধের আদত লক্ষ্য কি অপরিবর্তিতই থেকে যাবে– অর্থাৎ রাষ্ট্রই কি আক্রান্ত হবে বারবার? ইন্ডিয়া কি অবিনশ্বর?
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।