মানুষকে ভুলভাল বোঝানোর এত অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল ঋতুদার! ঋতুদার কথার প্যাঁচে মধুছন্দা কার্লেকার ডুবলেন। সারাজীবন বার্গম্যান, তারকোভস্কি করে ছন্দাদি ‘উত্তম ফ্যান ক্লাব’-এ নাম লেখালেন।ঋতুদা বলে দিয়েছে, মহিলাদের পাল্লা যেন ভারী হয়। কেননা পুরুষদের তুলনায় মহিলা ভক্তের সংখ্যা বেশি উত্তমকুমারের।
১২.
উত্তমকুমারকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হবে, ব্যাপারটা মোটেই ভালো ঠেকছিল না। এ ধরনের অনুষ্ঠান তারাই ভালো করবে, যাদের একটা ‘হিরো ওয়ারশিপ’ আছে উত্তমকে নিয়ে, আমার ওসব ছিল না কোনও সময়। ফিল্ম ক্লাব, নিউ ওয়েভ টগবগ করে ফুটছে, সৌমিত্রর ছবিই চোখের সামনে, কিন্তু কী করব, ঋতুদার আইডিয়া, ডিরেক্ট করতেই হবে প্রোগ্রামটা। অনুষ্ঠানের নাম, ‘অচেনা উত্তম’। তৈরি করা হবে ‘উত্তম ফ্যান ক্লাব’। সেই ক্লাবের সদস্যরা উত্তম ঘনিষ্ঠ মানুষদের প্রশ্ন করে জানবে মহানায়কের অজানা সব তথ্য। ঋতুদাকে মুখ ব্যাজার করে বললাম, এত উত্তম ফ্যান পাব কোথায়? ঋতুদার মাথায় হাত। কী বলছিস, ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান। আমি গজগজ করতে করতে ‘তোমার ঢিল তুমি ছোড়ো’ গোছের মুখ নিয়ে বসে রইলাম। ঋতুদার মুখের অভিব্যক্তি অনেকটা, আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো এইসান দিগগজ পক্ব। বিরক্ত হয়ে ঋতুদা নিজেই ফোন করতে শুরু করল। প্রথম ফোন গেল মধুছন্দা কার্লেকারের কাছে। কথাগুলো পরপর কতকটা এই রকমের।
–তুমি তো খুব উত্তমকুমারের ফ্যান, বলেছিলে না?…
–ও, কিন্তু তুমি বলেছিলে আমায়।
–এটা তো মানতেই হবে না, ওই কনট্রিবিউশন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কারও নেই।
–দেখো, আর্ট ফিল্মের ব্যাপার নয় এটা, ওই একটা লোকের কাঁধে এতগুলো বছর…
–সেক্স অ্যাপিলটা তো ছিল। ওরকম দেখতে হিরো এসেছে আর!
–সেটাই বলো, তোমার যেটা মনে হয়। কিন্তু বলো, তোমার জেনারেশনের একটা ভয়েজ থাকা জরুরি। অনিন্দ্য তোমায় ফোন করে নেবে, টেক কেয়ার।
ঋতুদা অত্যন্ত সিরিয়াস মুখ নিয়ে তাকাল। ছন্দাদি করবে। মধুছন্দা কার্লেকর একসময় ঋতুদার বস ছিলেন। অত্যন্ত গুণী, অভিজাত এক মহিলা। ঋতুপর্ণ ঘোষের বহু ছবির সাবটাইটেল ওঁর করা। ঋতুদার কথা বলা শুনে যা বুঝলাম, উনি কোনওমতেই উত্তমকুমারের ডাইহার্ড ফ্যান নন।
–উনি কি আদৌ উত্তম ফ্যান?
–হ্যাঁ, ফ্যান। আর আমি বলে দিয়েছি, করবেন। এই একজনকে আমি দিয়ে দিলাম, বাকি তুই জোগাড় কর।
মানুষকে ভুলভাল বোঝানোর এত অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল ঋতুদার! ঋতুদার কথার প্যাঁচে মধুছন্দা কার্লেকার ডুবলেন। সারাজীবন বার্গম্যান, তারকোভস্কি করে ছন্দাদি ‘উত্তম ফ্যান ক্লাব’-এ নাম লেখালেন।
ঋতুদা বলে দিয়েছে, মহিলাদের পাল্লা যেন ভারী হয়। কেননা পুরুষদের তুলনায় মহিলা ভক্তের সংখ্যা বেশি উত্তমকুমারের। পরদিন সাতসকালে ঋতুদার ফোন।
পড়ুন আগের পর্ব: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
–শোন, দীপান্বিতা হাজারিকে একবার দেখতে পারিস। ওঁর একটা প্রেজেন্স আছে স্ক্রিনে।
তো ফোন করলাম দীপান্বিতাদিকে। প্রচণ্ড ফ্যান! সকালে উঠে উত্তম-উত্তম বলে দাঁত মাজেন টাইপ। তেমনই গ্ল্যামারাস। ফ্যান ক্লাবের নতুন সদস্য মিলল। এবার একটু পুরুষ ফ্যান খুঁজি। সব বাড়িতেই উত্তমকুমার নিয়ে যা আদিখ্যেতা, মাঝবয়সি পুরুষ ফ্যান মিলবে তো! বিজনপথে আমি তখন একটি মুঠো অন্ন দাও মা, একটি মুঠো ফ্যান আউড়ে চলেছি। আমাদের পারিবারিক সুহৃদ, ব্যাঙ্ক অফিসার বিকাশ মুখোপাধ্যায়কে ধরলাম। লেখেন ভাল, বলেন ভাল। খুব ফ্যান না হলেও চলবে, কিন্তু আমায় ভালোবাসেন খুব, হেল্প করবেন রিসার্চেও। বিকাশদার পরে এল দেবুদা। এক সময়ের সহকর্মী, বন্ধু এবং দারুণ স্মার্ট। প্রশ্নকর্তা হিসেবে নতুন কোনও অ্যাঙ্গেল বের করতে সাহায্য করবে। বিকাশদা বা দেবুদা যতটা উত্তমের জন্য এল, তার চেয়ে অনেক বেশি এল আমার পাশে দাঁড়াবে বলে। ঋতুদাকে জানালাম প্রগেস রিপোর্ট। ‘এবার একটা ইয়ং, ডাইনামিক মেয়ে খুঁজে বের কর। তাহলেই ব্যস!’ আমি বললাম, ‘আমাদের মেহেলি বা সঞ্চারীকে বসিয়ে দিলেই তো হয়? খোঁজার কী দরকার?’ ঋতুদা হা-হা করে উঠল, ‘‘না না, ওদের অ্যাসোসিয়েশনটা ‘তারা করছেটা কী’র সঙ্গে। নতুন কাউকে খোঁজ।’’
মেয়ে খোঁজা ব্যাপারটা শুনতে যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবে ততটাই ঝামেলার। টিভিতে দেখাবে, এসব টোপও আর কাজ করে না বিশেষ। শেষমেশ আমি যখন উত্তম-ডিপ্রেশনে জর্জরিত, প্রায় দেবদূতের মতো এল অফিসের রেশমী।
–তোমার মেয়ে চাই? আমার একজন চেনা আছে, নেবে?
আরও পড়ুন: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
রেশমীর মতো মেয়েরা, জীবনে যে কাজই করুক না কেন, আসলে হৃদয়ের অন্তঃকরণে মানুষকে আপ্রাণ সাহায্য করার মিশন নিয়েই এ ধরাধামে বিচরণ করে থাকে। রেশমীর আশ্বাসবাণীতে আমার আশপাশের আলো আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। ঋতুদাকে বললাম, ‘রেশমীর চেনা একজন করবে। মেয়েটি শান্তিনিকেতনে থাকে। নাম মৌ।’
পরদিন অফিসে এল মেয়েটি। খুবই সপ্রতিভ এবং নাকউঁচু তার ভঙ্গি। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ‘তুমি কি উত্তমকুমারের ফ্যান?’
–একেবারেই না, কিন্তু আমার একটু টাকার দরকার, আমি করব প্রোগ্রামটা।
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।