মাঝে-মাঝেই দোকানে আসতেন ‘বেদুইন’ ছদ্মনামে লেখা দেবেশ রায়, বলাই বাহুল্য, ইনি ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর লেখক দেবেশ রায় নন। তাঁকে বাবা বললেন, আমার ছেলে প্রকাশনা শুরু করছে, আপনি একটা বই দিন। তিনি এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কয়েক দিন পরেই জানালেন, এখন লেনিনের জন্মশতবর্ষ চলছে, তোমাকে একটা লেনিনের ওপর বই দেব। তিনি তখন লেনিন, মাও সে তুং-কে নিয়ে বই লিখছেন। প্রকাশিত হচ্ছে ‘হ্যানয় থেকে সায়গন’। ‘মাও সে-তুং একটি নাম’ বইটা তুলি-কলম থেকে বেরিয়েছিল। লেনিনের জন্মশতবর্ষে বাংলায় একটা বইয়ের যে কদর হবে, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। এইভাবে প্রকাশনায় ঢুকে পড়লাম। শুরু হল নতুন কলাম, আজ প্রথম পর্ব।
১.
রামনগর রাও হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পাকাপাকিভাবে চলে এলাম কলকাতায়। সঙ্গে আমারই স্কুলের বন্ধু মনোরঞ্জন সার। ততদিনে আমাদের ‘দে বুক স্টল’ থেকে ‘দে বুক স্টোর’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই স্কুলের পরীক্ষার পর বছরে একবার মাসখানেকের জন্য কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে থাকতাম। উচ্চ মাধ্যমিকের পর পরিবারের রেওয়াজ অনুযায়ী, আমিও কলকাতায় চলে এলাম। আমার দুই দাদা হিমাংশুশেখর আর পরেশচন্দ্র আগেই কলকাতা এসে বাবার সঙ্গে ব্যবসার কাজে পুরোদস্তুর আত্মনিয়োগ করেছেন। আমিও সেই সতেরো-আঠারো বছর বয়সে এসে যোগ দিলাম পারিবারিক ব্যবসায়। তখন মূলত বাবা কিংবা দাদাদের নির্দেশমতো স্লিপ নিয়ে বিভিন্ন দোকান থেকে বই আনতাম। কোনও দিন হয়তো টানা-রিকশায় চেপে ডি এম লাইব্রেরি থেকে বাবার সঙ্গে নিয়ে এলাম নজরুলের ১০০টা ‘সঞ্চিতা’ এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু বই। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পরে কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা আমার নিজের যেমন ছিল, তেমনই বাবা-মাও চাইতেন আমার পড়াশোনা যেন মাঝপথে বন্ধ হয়ে না যায়! দাদাদেরও খুবই উৎসাহ ছিল। কলকাতায় তখন আমি নতুন। ‘বন্ধু’ বলতে মনোরঞ্জন। সে আর আমি একই দিনে কলকাতায় এসেছিলাম। মনোরঞ্জন থাকত তার দাদার কাছে মির্জাপুর স্ট্রিটে আর আমি বাবার সঙ্গে বাদুড়বাগানের ভাড়াবাড়িতে। ২২-এ, বাদুড়বাগান স্ট্রিট। সেই বাড়ির একতলায় অনেকে মিলে থাকতাম। বাবা, বড়দা, মেজদা, কানাইদা, কার্তিকদা, কানুদা, রমণীদাদু, নিরঞ্জনকাকা, প্রফুল্লকাকা ও কাকিমা, সন্তোষদা ও বউদি– আমরা অনেকেই থাকতাম সেই বাসায়। অনেকটা মেসবাড়ির মতো। নিজেরাই নিজেদের কাজ করে নিতাম। রান্নাবান্নাও নিজেদের দায়িত্বে। দেশ আমাদের মেদিনীপুরেই, কলকাতায় বাদুড়বাগানে কাজের জন্য থাকা– এই ছিল তখন আমাদের মানসিকতা।
বাবা একদিন বললেন, সারাদিন দোকানের কাজ করলেই তো চলবে না, কলেজেও ভরতি হতে হবে। আমিও মনে মনে তাই চাইছিলাম। বাবা তখন দাদাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন আমাকে কোনও একটা সান্ধ্য কলেজে ভরতি করবেন। একদিন জিগ্যেস করলেন, কী নিয়ে পড়তে চাই। আমি উচ্চ মাধ্যমিকে বায়োলজি নিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাবার নির্দেশ– এবার কমার্স পড়তে হবে। তাতে হিসেব-নিকেশের সুবিধে হবে, দোকানের অ্যাকাউন্টসটা নিজেই সামলাতে পারব। শেষমেশ ভরতি হয়ে গেলাম শিয়ালদায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজের সান্ধ্য বিভাগে। মনোরঞ্জনও ভর্তি হল আমার সঙ্গে, একই বিষয় নিয়ে একই কলেজে। তবে পরে সে খুব ভালো টাইপ রাইটিং ও স্টেনোগ্রাফি শিখে নেয়। কলেজের পড়া শেষ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইন বিভাগে চাকরিও পেয়ে যায়। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আজও অটুট। তার কথা পরে ফের বলা যাবে। যাইহোক, সকাল থেকে দুপুর-বিকেল পর্যন্ত দোকানে কাজ করি আর বিকেলের পরে কলেজ যাই– তখন এই ছিল আমার রোজকার রুটিন। সারাদিনের কাজ সেরে কলেজ স্ট্রিট থেকে হয়তো একঠোঙা ছোলাভাজা কিনে চিবোতে-চিবোতে হেঁটে পৌঁছে যেতাম কলেজে।
ততদিনে দে বুক স্টোরের ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেছে। দুই দাদাই বাবার সঙ্গে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাবার সজাগ দৃষ্টি ছিল আমার ওপর। একদিন তিনিই কথা তুললেন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে। দাদারা দক্ষতার সঙ্গে দোকান সামলাচ্ছেন। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী হওয়া উচিত? তিনি বললেন, আমাদের নিজেদের তো একটা প্রকাশনা হতে পারে। দোকান ভালো চলছে, এখন একটা পাবলিকেশন তো করাই যায়। দুই দাদাই সায় দিলেন বাবার কথায়। এই হল দে’জ পাবলিশিংয়ের একেবারে গোড়ার কথা।
কিন্তু প্রকাশনা শুরু করব বললেই তো শুরু করা যায় না। ততদিনে বইয়ের ব্যবসা সম্পর্কে আমার কিছুটা জ্ঞান হয়েছে, যদিও প্রকাশনার তখনও কিছুই বুঝি না। বাবা বললেন, শিখে নিতে হবে। একটাই সুবিধা ছিল সেসময় ‘বিশ্ববাণী’ প্রকাশনীর যাবতীয় বই বিক্রি হত আমাদের দে বুক স্টোর থেকেই। ওঁদের বইয়ে প্রকাশকের ঠিকানায় লেখা থাকত, ‘১১/এ বারাণসী ঘোষ স্ট্রীট’। কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি তখনও ওঁদের নিজেদের কোনও দোকান হয়নি।
ব্রজকিশোর মণ্ডল ছিলেন ‘বিশ্ববাণী’র মালিক। ব্রজকিশোরবাবুর বাবা রাসবিহারী মণ্ডল লেখক ছিলেন– ‘শ্রীবাসব’ ছদ্মনামে লিখতেন। তাঁর লেখা ‘গোমতী গঙ্গা’, ‘শ্রীবাস অঙ্গন’ ইত্যাদি আট-দশটা বই দিয়েই বিশ্ববাণীর শুরু। বিশ্ববাণীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় আমি প্রকাশনার কিছু বিষয় শিখেছিলাম। তাছাড়া দোকানেও অনেকেই আসতেন যাঁদের কাছে আমি বহু কিছু শিখেছি। ‘মণ্ডল বুক হাউস’-এর সুনীল মণ্ডলের সূত্রে পরিচয় হয়েছিল ‘দীননাথ বাইন্ডার্স’-এর মালিক কালীপদ ঘোষের সঙ্গে। বিধান সরণির ‘সত্যনারায়ণ প্রিন্টিং ওয়ার্কস’-এর রতিকান্ত ঘোষও দোকানে আসতেন। পরে তো কত জায়গায় কাজ করেছি। কিন্তু এই দু’-জনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। আরেকজন ছিলেন হরিপদ পাত্র– শিয়ালদায় ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ পেরিয়ে সোজা শ্যামবাজারের দিকে গেলে রাস্তার বাঁ-ধারে সেকালের বিখ্যাত থিয়েটার হল প্রতাপ মঞ্চের পাশেই ছিল তাঁর ছাপাখানা। এদিকে আরেক সমস্যা হল, প্রকাশনা চালাতে গেলে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হবে। কিন্তু আমার দৌড় তো বাদুড়বাগান, কলেজ স্ট্রিট আর শিয়ালদা। শহরের বেশিটাই তখনও অচেনা আমার কাছে। সে-সমস্যারও সমাধান বাবা-ই করে দিলেন। আমাদের দোকানে অ্যাকাউন্টসের কাজ দেখতেন কানাইলাল জানা, আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। আমাদের সঙ্গেই বাদুড়বাগানের বাড়িতে থাকতেন। কানাইদা একটা কোম্পানিতে চাকরিও করতেন। কলকাতা শহরটা তাঁর অনেকটাই চেনা ছিল। বাবা বললেন কানাইদার সঙ্গেই এদিক-ওদিক যেতে। কানাইদার কাছে আমি বইয়ের অ্যাকাউন্টস কীভাবে রাখতে হয় সেটা শিখেছি। ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেভারেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরে কানাইদাও বইয়ের ব্যবসায় আসেন। ‘সুপ্রিম বুক ডিস্ট্রিবিউটার’ নামে তিনি একটা দোকান করেন হরিদাস পাল লেনে ‘মডার্ন বুক এজেন্সি’র পাশেই। ওখান থেকে কিছু বইও প্রকাশ করেছেন। বাবা কানাইদাকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে লেখকদের বাড়ি যেতে, কলকাতার রাস্তাঘাট চেনাতে। কানাইদা আমাকে নিয়ে গেলেন আশাপূর্ণা দেবীর কাছে– গড়িয়ার কানুনগো পার্কে, পদ্মশ্রী সিনেমা হলের উলটো দিকে বাটার দোকানের ওপরের বাড়িতে।
বুদ্ধদেব বসুর নাকতলার বাড়িতেও নিয়ে গেলেন। বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি অবশ্য আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন অধ্যাপক স্বপন মজুমদার। শঙ্খ ঘোষের বাড়িও স্বপনদাই নিয়ে গিয়েছিলেন। দোকানে একদিন বাবা-ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন স্বপনদার সঙ্গে। তারপর ওঁর বাড়ি যাওয়া-আসা চলতে থাকে। এদিকে মাঝে-মাঝেই দোকানে আসতেন ‘বেদুইন’ ছদ্মনামে লেখা দেবেশ রায়, বলাই বাহুল্য, ইনি ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর লেখক দেবেশ রায় নন। তাঁকে বাবা বললেন, আমার ছেলে প্রকাশনা শুরু করছে, আপনি একটা বই দিন। তিনি এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কয়েক দিন পরেই জানালেন, এখন লেনিনের জন্মশতবর্ষ চলছে, তোমাকে একটা লেনিনের ওপর বই দেব। তিনি তখন লেনিন, মাও সে তুং-কে নিয়ে বই লিখছেন। প্রকাশিত হচ্ছে ‘হ্যানয় থেকে সায়গন’। ‘মাও সে-তুং একটি নাম’ বইটা তুলি-কলম থেকে বেরিয়েছিল। লেনিনের জন্মশতবর্ষে বাংলায় একটা বইয়ের যে কদর হবে, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। এইভাবে প্রকাশনায় ঢুকে পড়লাম। বেদুইন আমাকে চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই কপি দিতে আরম্ভ করলেন।
কিন্তু আমি তখনও বই ছাপাছাপির সবটা বুঝি না। সে-সময় আমার সবচেয়ে বড় সহায় হয়েছিলেন মণ্ডল বুক হাউসের সুনীল মণ্ডল। তাঁদের বইও আমাদের এখান থেকেই বেশি বিক্রি হত। সুনীল মণ্ডলের বাড়ি ছিল হাওড়ায়। তাঁর সঙ্গে বাবার এবং আমাদের তিন ভাইয়েরই খুব খাতির ছিল। মণ্ডল বুক হাউসে আগে থেকেই যেতাম বই আনতে। তাঁর ওখান থেকেই বেরিয়েছিল শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’। মণ্ডল বুক হাউস তখন ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা থেকে শুরু করে অনেক ডিটেকটিভ বইও করত। সুনীলবাবু একদিন আমাকে তাঁর দোকানে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে ফর্মার হিসেব কীভাবে করতে হয় শেখালেন। তারপর সত্যনারায়ণ প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে ‘মহানায়ক লেনিন’ কম্পোজ হয়ে প্রুফ চলে এল। লেখকই বেশিটা দেখে দিয়েছিলেন। একটা প্রুফ সুনীল মণ্ডলেরই ঠিক করে দেওয়া কোনও একজন প্রুফ রিডার দেখেছিলেন। এক সময় বই ছাপাও শুরু হয়ে গেল। কাগজ কিনেছিলাম ভোলানাথ পেপার হাউস থেকে। সুনীলবাবুই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কতটা কাগজ লাগবে, কীরকম কাগজ কিনতে হবে। বই ছাপা হলে বাঁধাই করে দিলেন দীননাথ বাইন্ডার্সের কালীবাবু। মলাট আঁকলেন গণেশ বসু। তিনি তখন বইপাড়ায় প্রচুর বইয়ের মলাট করেন। দে’জ পাবলিশিংয়ের প্রথম ছাপা বই হল– ‘মহানায়ক লেনিন’। ১৯৭০-এর ২২ এপ্রিল ছিল লেনিনের জন্মশতবর্ষ, সে বছরই এপ্রিলে (পয়লা বৈশাখের সামান্য আগে) প্রকাশিত হল বইটি। বাবা বই হাতে নিয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন।
দে’জ পাবলিশিংয়ের শুরু মোট চারটি বই নিয়ে। বাকি যে তিনটি বই করেছিলাম সেগুলি হল– আশাপূর্ণা দেবীর ‘মনের মুখ’, প্রতিভা বসুর ‘সমুদ্র হৃদয়’ এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কুমারসম্ভবের কবি’। চারটির মধ্যে তিনটিই উপন্যাস। বইপাড়ায় দে’জের প্রথম চারটি বইয়ের ভালো কাটতি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে বছরে মোট ন-টি বই বের করলাম। বাকি পাঁচটি বই হল– শ্রীঅভিজিৎ-এর (অভিজিৎ সরকার) ‘তাইহোকু থেকে ভারতে/ নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য’, সন্তোষকুমার ঘোষের ‘সোজাসুজি’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শৈল-ভবন’, বেদুইনেরই ‘মহারাজের চোখে বাংলাদেশ’ এবং সমুদ্রগুপ্ত ছদ্মনামে পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘ক্ষুদ্রপট রুদ্রপ্রাণ’।
দে’জ-এর বইয়ের জন্য প্রথম থেকেই আমি নামকরা প্রচ্ছদশিল্পীদের সাহায্য পেয়েছি। গণেশ বসু, খালেদ চৌধুরী, অজিত গুপ্ত থেকে পূর্ণেন্দু পত্রী ও সুবোধ দাশগুপ্তরাই মূলত প্রথম দিকের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিতেন। এছাড়াও রবীন দত্ত, সুভাষ সিংহরায়ের আঁকা মলাটও আছে। প্রথম বছরের বইগুলি ছেপেছিলাম মূলত, বিধান সরণিতে অনিলকুমার ঘোষের দি অশোক প্রিন্টিং ওয়ার্কস, রতিকান্ত ঘোষের সত্যনারায়ণ প্রিন্টিং ওয়ার্কস, বিডন স্ট্রিটে নিরঞ্জন বসুর নর্দার্ন প্রিন্টার্স এবং পটুয়াটোলা লেনে অজিত সাউয়ের নিউ রূপলেখা প্রেসে। শুরুতে কিন্তু দে’জ-এর অতি পরিচিত লোগোটিও তৈরি হয়নি। তখনকার বইয়ের স্পাইনে অন্তত তিন রকমের লেটারিংয়ে “দে’জ” কথাটা লেখা হয়েছিল। সেগুলি বিভিন্ন সময়ে বানিয়েছিলেন গণেশ বসু, অজিত গুপ্ত এবং খালেদ চৌধুরী। এর বেশ কিছুদিন পরে পূর্ণেন্দু পত্রীর হাতে ধীরে ধীরে এখনকার লোগোটি নির্মিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, শুরুতে দে’জ পাবলিশিংয়ের ঠিকানাও ১৩ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট ছিল না। তার বদলে লেখা হত আমাদের সেসময়ের বাসস্থানের ঠিকানা– ৩১/১ বি, মহাত্মা গান্ধী রোড। ততদিনে বাদুড়বাগান ছেড়ে শিয়ালদার এই বাড়িতেই উঠেছি আমরা। কলকাতায় সেই আমাদের প্রথম নিজস্ব বাসস্থান।
বছরখানেক যেতে না যেতেই দে’জ-এর বই পেতে শুরু করল দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কারও। আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ বইটি ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে অন্য একটি প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর বইটি প্রকাশের দায়িত্ব পাই আমরা। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’-এর প্রথম দে’জ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। এর মধ্যেই বইটি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছে ১৯৬৯ সালে, আর দে’জ সংস্করণ প্রকাশের ঠিক আগেই বইটি ১৯৭০ সালের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেল। আবার, ১৯৭১ সালে দে’জ থেকে প্রকাশিত সন্তোষকুমার ঘোষের উপন্যাস ‘শেষ নমস্কার, শ্রীচরণেষু মা-কে’ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেল ১৯৭২ সালে।
তখন আমার আঠারো বছর বয়স। কলকাতার ১৯৭০ সাল মানে উথাল-পাথাল রাজনীতির যুগ। তারই মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম কীভাবে প্রকাশনাটা বড় করা যায়। ভালো লেখকের ভালো বই প্রকাশ করা যায়। বাবাকে দেখে শিখেছি পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু ভালো বইও পেতে হবে। তখন প্রায় রোজই বিভিন্ন লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। আমার সেসময়ের ছোট্ট একটা বিবরণ অনেক পরে দেখলাম বুদ্ধদেব গুহ-র ‘সারস্বত’ বইতে লেখা আছে– ‘সত্তরের দশকের গোড়ার কথা। আমি তখন রাজা বসন্ত রায় রোডে পৈতৃক গৃহে থাকি। এক রবিবার সকালে হাফপ্যান্ট পরা একটি ছেলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বাড়িতে হাজির। কথায় মেদিনীপুরিয়া টান স্পষ্ট। ছেলেটির নাম সুধাংশুশেখর দে। দে বুক স্টোর-এর ভগবানচন্দ্র দে-র সেজো ছেলে। আর সঙ্গী যুবকটির নাম ছিল কানাই জানা। তারা এসেছিল বই চাইতে। বই মানে উপন্যাস।’ বুদ্ধদেব গুহ-র সে-বই অবশ্য প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। উপন্যাস নয়, গল্পের বই ‘প্রথমাদের জন্য’। এরকমভাবে অনেকের কাছেই নতুন বইয়ের আশ্বাস পেতে থাকলাম। সেই বইগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকল। পুরোনো চিঠির ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে আমাকে লেখা সবচেয়ে পুরোনো যে চিঠিটা পেলাম সেটি আশাপূর্ণা দেবীর লেখা। ‘মনের মুখ’ প্রকাশ করার পর তাঁর কাছে আবার একটা বই চেয়েছিলাম। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭০-এর সেই চিঠিতে তিনি আরেকটি বই দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯৭১-এর এপ্রিলে রবীন দত্তের আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশ করলাম আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস ‘মধ্যে সমুদ্র’।
লিখনে: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়