একবার আমি চোর হয়ে অন্যদের না খুঁজে নিজেই লুকিয়েছিলাম। বাকিরা কেসটা বুঝতে সময় নিয়েছিল। যারা যারা আমাকে খুঁজে পেয়েছিল, তাদের আইসস্কাইস করে দিয়েছিলাম। এর পর যদি কেউ ভাবে যে, আমি ভাল চোর ছিলাম, তাহলে বলেই ফেলি জীবনে আমি নানারকম যা যা করেছি, তার মধ্যে চুরিও ছিল। হ্যাঁ, আমি চুরি করতাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম উল্টোদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে দশ-পনেরো হাত অন্তর অন্তর জঙ্গল-সবুজ রঙের উর্দি পরে দাঁড়িয়ে আছে মিলিটারি। খুব ফিকে মনে পড়ছে, কোনও একটা সময় আমাদের বড় রাস্তার ওপারে ওরা দাঁড়িয়ে থাকত। চোখে চোখ পড়লে হাসতও। আমার মনে আছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি দাঁত মাজছিলাম, উল্টোদিকের রাস্তায় দাঁড়ানো সেই ভদ্রলোক আমার দিকে চোখ পড়তেই দাঁত বের করে হেসে আঙুল দিয়ে দাঁত মাজার ভঙ্গি করেছিলেন। মা কী একটা বুঝিয়েছিল সেটা শুনে। দিদি বলেছিল, ওরা নাকি দাঁত মাজে না, যুদ্ধ করে তো, সেই জন্য দেখে অবাক হয়েছে। এরকম রানিং ঢপের সংস্কৃতি সমানে চলছে। আমার স্কুলের এক বন্ধু বলেছিল, ওর মামা না কাকা কেউ একটা মিলিটারিতে আছেন, ওরা নাকি ধুলো দিয়ে রুটি খায়, মাখন পায় না তো!
ছোটবেলায় মাখন আমরা মাখনওলার থেকেই কিনতাম। জলে ভেজানো কলাপাতার ভিতরে মাখন আর এক পাউন্ড পাউরুটি কিনতে যেতাম একটু বড় হয়ে। কাঠের চামচে করে যে শ্যামবর্ণ হাসিখুশি লোকটা মাখন বিক্রি করত, তার মুখটা ভেসে উঠল, দেখতে পেলাম পুরো, ভেজা কলাপাতার ওপর মায়াবী নরম সে মাখনের রং। ওখানেই আহিরীটোলার মাখনের দোকানের উল্টোদিকেই বসত ফুলওয়ালা। শালপাতার প্যাকেটে ১০ পয়সার ফুল আর মালা। এক পাউন্ড, এক কোয়ার্টার পাউন্ডেই আমাদের ফাস্ট ব্রেক করা হয়ে যেত। যদি না বড়কাকু রেগে যেত। বড়কাকুর একটা সমস্যা ছিল। বড়কাকু রেগে গেলে অনেক কিছুই করত। কিন্তু সেগুলো বদরাগীরা করেই থাকে, গায়ের জোরে এটা-সেটা ভেঙে দেওয়া– এগুলো তো টুকটাক ছিলই। ঠাকুমা গলায় পাতলা সোনার হার পরতে পারতেন না। বড়কাকু ছিঁড়ে দিত একটানে। তা সেই জন্য ঠাকুমাকে একটা ভারী সোনার চেন গড়িয়ে দিয়েছিলেন দাদু। সোনা দামী হলেও তখন সস্তা ছিল তাও। আজকের ডেটে আমার দাদু থাকলে নিশ্চয়ই পাঁচ ভরির হার করাতে দিতেন না। সে ঠাকুমা যতই বলুন গায়ে একটা সোনা পরে থাকতে হয়। সেই সোনার হার ঠাকুমা গঙ্গাস্নানে গিয়ে খুইয়েছিলেন। ছিনতাই হয়েছিল সে হার। বড়কাকু যা ছিঁড়তে পারেনি, সেই ছুঁটকো ছিনতাইবাজ সেটা শিল্পের মতো খুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল ঠাকুমার গলা থেকে। এসব আমি দেখিনি, শুনেছি। আমার যখন এক-দু’বছর বয়স, তখন নাকি বড়কাকু একবার রেগে গিয়ে সবার লাঞ্চ খেয়ে নিয়েছিল, শুধুমাত্র মায়ের খাবারটা খায়নি অন্যের বাড়ির মেয়ে বলে ছাড় দিয়েছিল।
যে বয়সে আমি বাড়ি থেকে ছাড় পেয়েছিলাম রাস্তা ক্রস না করে সোজা বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে আহিরীটোলা থেকে মাখন, পাউরুটি, ফুল, মালা কেনার, সেই সময় আমার বাপের বাড়ি গড়গড়িয়াতে বা মা-এর বাড়ি কোড্ডেতে ফুল তুলতাম, ফুল কিনতে হত না। ভোরবেলা আমরা ভাই-বোনেরা মিলে বেরিয়ে পড়তাম ফুল তুলতে, শিশিরে ভেজা ফুল তুলে সাজি ভরে বাড়ি ফিরতাম আমরা।
বেড়াতে যাওয়া মানে ছিল দেশের বাড়ি বা মামার বাড়ি বীরভূম। পুজো বা গরমের ছুটিতে। পুজোর সময়টা পাড়ার দুয়ের পল্লির পুজোতেই বেশি কাটলেও, মামার বাড়ির পুজো ছিল অন্যরকম। বিরাট গুষ্টি। ন’টা মামা, ছ’টা মাসি। মামাতো দিদি-বোনদের দু’খানা ফুটবল টিম হয়ে যেত। ভাইদের তো ছেড়েই দিলাম। পিঠোপিঠি ভাই-বোনেরা মিলে আইসস্পাইস খেললে যে চোর হত, তার সেদিনটা চোর হয়েই কাটত, রায়বাড়ি তো নয়, প্রায় একটা পাড়া। ন’টা বাড়ি, চার-পাঁচটা মন্দির, খামার, এটা-সেটা, জনা পনেরো-ষোলো ভাই-বোনেরা কে কোথায় লুকিয়ে আছে, সবাইকে খুঁজে পাওয়ার আগে কেউ না কেউ ধাপ্পা দিয়ে দিত চোরকে। একবার আমি গুনতিতে চোর হয়ে অন্যদের না খুঁজে নিজেই লুকিয়েছিলাম। হেব্বি মজা লেগেছিল উল্টো খেলা খেলে। বাকিরা কেসটা বুঝতে সময় নিয়েছিল। যারা যারা আমাকে খুঁজে পেয়েছিল, তাদের আইসস্পাইস করে দিয়েছিলাম। এর পর যদি কেউ ভাবে যে, আমি ভাল চোর ছিলাম, তাহলে বলেই ফেলি জীবনে আমি নানারকম যা যা করেছি, তার মধ্যে চুরিও ছিল। হ্যাঁ, আমি চুরি করতাম। দাদুর ওয়ালেট থেকে টুকটাক দশ-বিশ পয়সা চুরি আমি করেছি। ছোটকাকু, সেজকাকুর পকেট থেকে কোনও দিন চুরি করিনি, ওদের কাছে পয়সা থাকত না। থাকলেও গোনাগুনতি। ধরা পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। আমি স্মার্ট চোর ছিলাম, ওয়ালেট বুঝে চুরি করতাম। বাবার পকেটেও বিশেষ কিছু পেতাম না। পেতাম বড়কাকুর পকেট থেকে। দাদুর কাছে রংবাজি করে বড়কাকুর পকেটমানি চিরকাল টুংটাং করত। কোনও কোনও সময়ে একটু হিসাবের বাইরেও থেকে যেত, বড়কাকুর থেকে টাকাও চুরি করেছিলাম আমি, কিন্তু এসব চুরি বড়ই গৃহপালিত। জীবনের প্রথম বড় চুরি আমার বাড়ির বাইরে এবং সে চুরি এবং ধরা পড়া– সে বিভীষিকা এখনও মনে পড়ে আমার, ওটাই আমার শেষ চুরি।