দীপা মেহতার ‘সালাম বম্বে’, তপন সিংহ-র ‘এক ডক্টর কি মওত’, ফরিদা মেহতা-র ‘কালি সালোয়ার’, অঞ্জন দত্তর ‘বড়া দিন’ বা গুলজারের দূরদর্শন ধারাবাহিক ‘কিরদার’ দেখে যাদের মনে ছিল ইরফান খান নামে এক বিস্ময়কর অভিনেতার নাম, তাদের কাছে ‘হাসিল’ ও পরে ‘মকবুল’, ইরফানের এক অন্য প্রস্থান এনেছিল। বলিউডের নানাবিধ অভিনয়ের ধারায় ইরফান নিয়ে এলেন এক বৃহৎ বিচ্যুতি। আবার মনোজ বাজপেয়ী, কে কে মেনন, শেফালি শাহ, তিলোত্তমা সোম, টাবু-রা বলিউডের প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে বার্তা দিলেন নতুনদের। হয়তো থিয়েটার করে খরচ জোগাতে না পারা ছেলেমেয়েদের মুখ লোকাল ট্রেনে বসে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, কেবল ইরফানের জন্যই, কে বলতে পারে?
৪০.
ডবলিউ ডবলিউ ডবলিউ, ডট কম ইত্যাদি শব্দগুলো তখন জলভাতের মতো। এফএম তখন ঘরে ঘরে। ওয়াকম্যান থেকে সিডি প্লেয়ারে এসে বাসা বাঁধছে গান, ‘ছুঁ কর মেরে মন কো’ থেকে ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’, বিগ বি থেকে কিং খান। ‘…আধুনিক কিংখাব, কিংসাইজ ভজনে শিবের গাজন’, কবীর সুমনের গানের লিরিক চিনিয়ে দিয়েছিল আধুনিক শ্রোতামনকে। শনিমন্দিরের পাশে আধুনিক হিন্দি গানের সুরে বাজে ভক্তিগীতি। যেসুদাস যেমন শ্রুত হচ্ছেন, তেমন অনেকেরই মনে দোলা দিতে শুরু করেছেন ফাল্গুনী পাঠক, যাঁর আসল লিঙ্গ-পরিচিতি নিয়ে তখন অনেকের মনে তোলপাড়। বাংলা গানে ব্যান্ড-ঝড়ের মধ্যেই শিলাজিৎ-এর ‘প্রেম যেন ওয়েসিস’ শুনে কৈশোর-তরুণ উত্তাল হয়ে উঠছে। ‘দিনে রাতে নেই চোখে ঘুম’, অঙ্ক থেকে ভূগোল টিউশনের আবহসংগীত। শিলাজিৎকে বেসুরো বলে দাগিয়ে দেওয়া বাংলা সংগীতজগৎ তখনও বোঝেনি, আর এক দশকে একটা গোটা প্রজন্মের কাছে চোরাগোপ্তা ঘটনা হয়ে উঠলেন শিলাজিৎ। পটলডাঙার রোয়াকের চারমূর্তিকে পেরিয়ে গিয়েছে নতুন রোয়াক। এই রোয়াক তারা ঢাকা মেঘ, মেঘে ঢাকা তারাদের নিয়ে মশগুল, তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো। পাড়াতুতো মন আর একসূত্রে বাঁধা থাকবে না। রূপঙ্করের ‘বন্ধু দেখা হবে’ থেকে শুভমিতার ‘দেখেছ কি তাকে’, প্রতীক চৌধুরীর ‘মুখোশ’ থেকে গৌতম ঘোষালের ‘রোদ্দুর’, একের পর এক বেসিক ডিস্কের গান বাংলা গানকে তখনও মাচা থেকে বৈঠকি শ্রুতিতে ঝলমলে করে রেখেছে।
তার মধ্যেই মুক্তি পেয়েছিল সুব্রত সেনের ‘নীল নির্জনে’। সমপ্রেম থেকে শুরু করে বিছানারঙিন নানা দৃশ্য সেই ছবিকে বাংলা ছবির আলোচক-তাত্ত্বিকদের ভাষায় ‘সাবালক’ করে তুলল বটে, কিন্তু ‘নীল নির্জনে’-র আগেও সুব্রত সেন এই নিষিদ্ধর বেড়াজাল টপকেছিলেন ‘এক যে আছে কন্যা’-তে। ‘ডর’ বা ‘বাজিগর’-এর সেই অবসেসড ও ভয় ধরানো শাহরুখের প্রতিলিপি একেবারে অন্য ধারায় তৈরি হল কঙ্কনা সেনশর্মার অভূতপূর্ব, শিরদাঁড়া হিম করিয়ে দেওয়া অভিনয়-সূত্রে। ‘নীল নির্জনে’-তে রাইমা সেনের সঙ্গে সঙ্গেই মৌ সুলতানার নামও ভাসতে লাগল হাওয়ায়। জুন মালিয়া-অয়ন মিত্রর আত্মহত্যার চেষ্টার আগে সঙ্গমদৃশ্যের অভিঘাত নেহাত কম হল না। বাংলা সিনেমা যে ছুঁৎমার্গিতার ধার ধারছে না আর, তা বোঝা গেল। কিন্তু সব ছাপিয়ে বৃহৎ বুদবুদের মতো ভেসে উঠল ক্যাকটাসের অ্যালবামটি। মন, নীল নির্জনে, নোয়ার নৌকো মুখস্থ হয়ে গেল অনেকের। শৈশবে দেখা সেই উন্মাদনা কিছুটা নিজেরা টের পেলাম, ২০১০ পরবর্তী সময়ে যখন আমরা, মাধ্যমিক পাশ ক’জন উত্তরের শ্যাম পার্কে বসে, বা রামধন মিত্র লেনের টিউশন থেকে ফিরতিপথে কোরাসে ‘আরও একবার’ গেয়ে উঠতাম, ‘নীল রং ছিল ভীষণ প্রিয়’-র লিরিক লিখে রাখতাম অঙ্কের খাতার পিছনের পাতায়। রূপম ইসলাম আমাদের মনে-মননে তখন রাজা। ‘রূপম অন দ্য রকস’ পড়ে অনেকেই ভাবছে, হাতে তুলে নেওয়া যায় কি না গিটার। কেউ কেউ হঠাৎ বিষাদে আঁকড়ে ধরছে ‘একলা ঘর আমার দেশ’। ‘বাইসাইকেল চোর’ গাইতে গিয়ে বিপ দিয়ে দিচ্ছি, যাতে বাড়িতে, স্কুলে কেস না খাই। তাও এসব ধাতব সংগীতধারা নিয়ে নানাবিধ তেরচা চোখ, তির্যক টিপ্পনি তখন ছিলই।
হিন্দি গান তার মতো করেই মগজে টোকা মেরে যাচ্ছিল। কৃষ্ণকুমার কুন্নথ ওরফে কেকে-র গলা ‘মাচিস’-এর ‘ছোড় আয়ে হাম’-এ হয়তো মিশে ছিল, কিন্তু ওই শতাব্দীর শেষের ‘পল’ অ্যালবাম ছিল এক নরম ও চুপিসার ধূমকেতু। কেকে নিয়ে তখন এমনই উন্মাদনা তৈরি হল, যা টিকে রইল অনেকদিন। ব্যান্ড করার ভূত চেপেছে একবার, চাঁদনি চকে কী একটা কারণে মাইক কিনতে যাওয়া হল, দোকানদারের সঙ্গে সদালাপের পর তার নাম জানতে চাইলে সে কলার তুলে বলেছিল, ‘কেকে!’ আমাদের তখন সে কী বিস্ময়! তার পরে পরেই ‘রকফোর্ড’ এসেছিল। তার অনেক পরে, ‘ইয়ারো দোস্তি বড়ি হি হাসিন হ্যায়’ গুনগুন করতে করতে শ্যামপুকুর থেকে বাড়ি ফিরতাম যখন, যখন চেনা বইখাতার দোকান থেকে কিনতাম জ্যামিতি বাক্স, বিকেলের খেলাধুলো শেষ হয়ে যেত, এই গান সেই অজানা বিষাদ নিয়ে আসত, যা বুঝতে স্কুলের দরজা বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করতে হল, অপেক্ষা করতে হল বেঞ্চের মায়া ছাড়ার জন্য। কিন্তু ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট… এক এক করে ক্লাসরুম পেরিয়ে যাচ্ছে জীবন, আর তত বিচ্ছিরি বিচ্ছেদের বোধ, ডিপারচারের বেদনা জেঁকে বসছে। আমরা তবু অত বুঝি না। দিনের শেষে পার্টি অফিস, রোলের দোকান পেরিয়ে ফিরতে ফিরতেও জানি, কাল তো স্কুলে দেখা হবে। কিন্তু তাও, ‘ইয়ে না হো তো, কেয়া ফির, বোলো ইয়ে জিন্দেগি হ্যায়’ শুনেই হু হু করে উঠত বুকটা।
কিন্তু সেই মনখারাপের মেয়াদও ফুরত। পরেরদিনই স্কুলে এসে আবিল ঠাট্টায় উড়ে যেত সব। তখন ‘কলযুগ’-এর ‘তুঝে দেখ দেখ সো না’ বিপুল হিট। মুখে মুখে ঘোরা গান। একজন বন্ধু বলে বসল, “ভাব, ‘তুঝে দেখ দেখ সো না, তুঝে দেখ কর হ্যায় জাগ না’, রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগেও দেখতে পাবে, আবার সকালে উঠেও! চম্পা কেস!” তার উত্তরে এক বন্ধু ওই বয়সেই গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘ওসব হানিমুন অবধিই ভাল লাগে।’ কী করে অমন গভীর কথাটা তখনই বলে ফেলেছিল, কে জানে! যাই হোক, ‘ম্যায়নে ইয়ে জিন্দেগানি/ সঙ্গে তেরে বিতানি’ বললে একটু হলেও বুক দুরুদুরু করত তখন।
তখন রিয়েলিটি শো-এর জমানা পুরোদমে শুরু হয়েছে! ‘সারেগামাপা’ তো সেই নব্বই থেকেই হত, তার জমক বাড়ল নতুন শতাব্দীর গোড়ায়। সঙ্গে জুড়ল ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর মতো অনুষ্ঠান। সোনু নিগম, ইসমাইল দরবার, বিশাল শেখররা জাজ হয়ে বসলেন সেসব অনুষ্ঠানে। আর বেহালা থেকে বান্দ্রা, জোকা থেকে জলন্ধর- সর্বত্র বাথরুম থেকে ছাদের একাই আসর মাতানো বা বন্ধুদের জলসা তাতানো গায়ক-গায়িকারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। এ এক নতুন মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষার জন্ম হওয়া যেন।
এই আকাঙ্ক্ষা কিন্তু কেবলই গানবাজনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। হ্যান্ডিক্যাম থেকে ছোটখাটো ডিএসএলআর হাতে হাতে এসে যাচ্ছে। ফিল্ম ভরা ক্যামেরায় তখনও ছবি উঠছে, সেসব প্রিন্ট হয়ে আসছে স্টুডিও থেকে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই ডিজিটালও জেঁকে বসছে। সমিরা মখমলবাফ শতাব্দীর শুরুতেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ডিজিটাল বিপ্লব বদলে দেবে সিনেমার ভবিষ্যতের খোলনলচে। অন্যদিকে, আগের শতাব্দীর শেষ থেকেই এমটিভি-র ক্যামেরা কার্যত চুরি করে ধার করে, ‘স্টার বেস্টসেলারস’ সিরিজের জন্য নিজের প্রথম পরিচালনা, ‘লাস্ট ট্রেন অফ মহাকালী’ তুলে ফেলেছিলেন অনুরাগ কাশ্যপ। ‘পাঁচ’ মুক্তি পেল না, কিন্তু মুক্তি পেল ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, তার আগে ‘শূল’-এর মতো ছবির চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি, যেখানে মূল চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ীর মতো ছকভাঙা অভিনেতা। স্টার বেস্টসেলার্সে হনসল মেহতা, শ্রীরাম রাঘবন, তিগমাংশু ধুলিয়ার মতো পরিচালকরা উঠে আসছেন। হনসল ততদিনে ‘জয়তে’ বা ‘দিল পে মত লে ইয়ার’-এর মতো ছবি বানিয়ে ফেলেছেন, তিগমাংশু ধুলিয়া ‘হাসিল’ বা ‘চরস’-এর মতো ছবি দিয়ে বানাচ্ছেন নিজের বলিউডি ব্যাকরণ, শ্রীরাম রাঘবন শিগগিরই বানাবেন ‘এক হাসিনা থি’, এবং তার কিছুদিন পরেই ‘জনি গদ্দার’, যা ভারতীয় থ্রিলারের ধারা তো বদলে দেবেই, বলা যেতে পারে প্রায়, ‘বম্বে নিউ নুয়া’-র জন্ম দেবে।
অন্যদিকে, ‘মাখরি’, ‘ব্লু আমব্রেলা’-র মতো, এক অর্থে ‘ছোটদের ছবি’-র পরে পরেই বিশাল ভরদ্বাজ হাত দিলেন ভারতের নিজস্ব আখ্যানে শেক্সপিয়রের বিনির্মাণে। ইতিহাস তৈরি করল ‘মকবুল’, ‘ওমকারা’, ‘হায়দার’ এল যদিও অনেকটা পরে। সিনেবোদ্ধামহলে হিন্দি সিনেমা নিয়ে বিশেষ তর্ক হত না, কিন্তু এইসব ছবি সলতে পাকাল। অনুরাগের ‘নো স্মোকিং’ বা ‘গুলাল’ দেখে অনেকেই নড়েচড়ে বসল। সাইকেডেলিক ছবি বা অত রক্তাক্ত রাজনৈতিক থ্রিলারের বাস্তবতা হজম করতে অনেকেরই কষ্ট হল। কিন্তু ঘাবড়েও গেল অনেকে, এসব ছবি বলিউডে হচ্ছে? ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘তিতলি’ বা ‘চোখের বালি’ থেকে বাংলা অন্যধারার ছবিতেও এক মূলধারা তৈরি করেছিলেন, সেখানে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বা শেখর দাসরা আরও অন্যভাষের সন্ধানে যেতে চাইলেন। কিন্তু এঁদের ‘কাঁটাতার’, ‘কাল’, ‘মহুলবনির সেরেঞ’, ‘ক্রান্তিকাল’ বা ‘কালের রাখাল’-এর মতো ছবি যে আলোড়ন তুলল না, তা তুলল বিশাল ভরদ্বাজের ‘কামিনে’, বা দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খোসলা কা ঘোসলা’। ‘জনি গদ্দার’ নুয়া ঘরানায় যেমন উল্লেখযোগ্য কাজ, তেমনই ‘কামিনে’ একান্ত বলিউডি পাল্প ফিকশনের আমদানি ঘটাল।
এই নতুন পরিচালকদের ঢল একেবারে নতুন ভারতীয় নববসন্ত নিয়ে এল, যার মধ্যে সে অর্থে কোনও আন্দোলন নেই, কিন্তু সমান্তরাল নৈরাজ্য রয়েছে পুরোমাত্রায়। এসব ছবি বেশিদিন পাওয়া যেত না কলকাতার হলে। মিউজিক ওয়ার্ল্ড বা সিমফনি-তেও চট করে সেসব সিডি-ডিভিডি চোখে পড়ত না, তা আসত পাইরেটেড সিডির বাজারে, আর টরেন্ট নামক গেরিলা আখড়াতে। আবার অন্য স্বপ্নের বুননও তৈরি করছিলেন ইরফান খান, মনোজ বাজপেয়ীর মতো অভিনেতারা। দীপা মেহতার ‘সালাম বম্বে’, তপন সিংহ-র ‘এক ডক্টর কি মওত’, ফরিদা মেহতা-র ‘কালি সালোয়ার’, অঞ্জন দত্তর ‘বড়া দিন’ বা গুলজারের দূরদর্শন ধারাবাহিক ‘কিরদার’ দেখে যাদের মনে ছিল ইরফান খান নামে এক বিস্ময়কর অভিনেতার নাম, তাদের কাছে ‘হাসিল’ ও পরে ‘মকবুল’, ইরফানের এক অন্য প্রস্থান এনেছিল। বলিউডের নানাবিধ অভিনয়ের ধারায় ইরফান নিয়ে এলেন এক বৃহৎ বিচ্যুতি। আবার মনোজ বাজপেয়ী, কে কে মেনন, শেফালি শাহ, তিলোত্তমা সোম, টাবু-রা বলিউডের প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে বার্তা দিলেন নতুনদের। হয়তো থিয়েটার করে খরচ জোগাতে না পারা ছেলেমেয়েদের মুখ লোকাল ট্রেনে বসে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, কেবল ইরফানের জন্যই, কে বলতে পারে?
দীর্ঘদিন আগে, অপর্ণা সেন ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ম কালচার’-এর একটি সংখ্যায় বলেন, মহিলা চলচ্চিত্রকাররা ভারতীয় সিনেমার মেজাজ বদলানোর ক্ষমতা রাখেন, এবং তা কেবলই ফেমিনিস্ট ভাষ্যে নয়। দীপা মেহতা বা মীরা নায়াররা বা ফরিদা নায়াররা বিতর্কও তৈরি করছেন। ‘ফায়ার’-এর পর ‘ওয়াটার’-ও কম আগুন জ্বালায়নি। আবার মীরা নায়ার ‘মনসুন ওয়েডিং’-এর মতো ছবি বানিয়ে ভারতীয় বিবাহ প্রতিষ্ঠানটার রক্তমাংস চিনতে চাইলেন, আর তার কিছু বছর পরেই বানাবেন বাঙালি ডায়াস্পোরার গল্প ‘দ্য নেমসেক’, যার লেখক ঝুম্পা লাহিড়ী নিজেও প্রবাসী। ঝুম্পা লাহিড়ীর স্মৃতিকথা ‘ইন আদার ওয়ার্ডস’ ডায়াস্পোরারও ডায়াস্পোরার সংকট তুলে ধরেছিল, তাতে বোঝা গিয়েছিল, ভাষার বহমানতার মধ্যেই তিনি বাঁচছেন। যে ভারতীয়র জীবনও বহমান, তার কথা তো করণ জোহররা একভাবে বলছিলেনই, আবার ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’, ‘কাল হো না হো’ বা ‘কহো না পেয়ার হ্যায়’-এর মতো ছবিও।
‘দ্য নেমসেক’ কিন্তু বাঙালি ডায়াস্পোরার গল্প সর্বভারতীয়, এমনকী, আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরেছিল। সেই ছবিতে ইরফান খান-টাবু অভিনীত অসীমা আর অশোক তাই ওই একই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কভি আলভিদা না কহেনা’-র দেভ (শাহরুখ খান) বা মায়া (রানি মুখোপাধ্যায়) বা রিয়া (প্রীতি জিন্টা) বা ঋষি (অভিষেক বচ্চন)-র থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। ‘কভি আলভিদা…’ বা ‘কঙ্ক’-এর অ্যালবাম আমাদের মাথা খেয়ে ফেলেছিল। ‘মিতওয়া’ বা এই ছবির টাইটেল ট্র্যাক হোক বা ‘তুমহি দেখো না’-র সুর আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল কালীপুজোর পর পর। উত্তুরে হাওয়া কী সহজেই বেপথু হয়েছে সেসব গানে! কিন্তু ‘দ্য নেমসেক’-এর প্রেম, বিরহ, বেদনা ও সন্তানের সঙ্গে বোঝাপড়ার দ্বন্দ্বের থেকে দূরে থেকেও, কঙ্ক-এর ডায়াস্পোরায় উঠে এল পরকীয়ার সংকট, এবং বৃদ্ধ সমরজিতের তাই দেখে ভিরমি যাওয়ার জোগাড় হওয়ার গল্প। বস্তুত, দুই ছবিতেই প্রেক্ষিত হয়ে উঠল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং এই দুই ছবিতেই দেখা দিল ভারতীয়ত্বের সঙ্গে এই প্রবাসমননের এক অবধারিত টানাপোড়েন।
অনুরাগ বসুর ‘গ্যাংস্টার’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’-র মতো ছবিও বলিউডের মধ্যে তাজা বাতাস এনেছিল কিছুটা। শাইনি আহুজা, ইমরান হাশমির পাশাপাশি গ্যাংস্টার পরিচয় ঘটিয়েছিল কঙ্গনা রানাওয়াতের সঙ্গেও। সরষেখেত থেকে বিদেশের মাটিতে দু’হাত খুলে দাঁড়ানো শাহরুখ-কাজলরা যদি বলিউডের রাজপথ হয়ে থাকে, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’-তে ইরফান-কঙ্কনা জুটির রোমান্টিকতা বলিউডি প্রেমের মনকেমনিয়া গলিপথ। আবার ‘পাঁচ’, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ বা আরেকটু পরের সেই কেকে-র কণ্ঠেই ‘তু হি মেরি শব হ্যায়, সুভা হ্যায়, তু হি দিন হ্যায় মেরা’ শুনলে এখন তখনকার ছোটবেলার ছবি ভেসে উঠবে অনেকের মনেই। আবার, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘আবার বছর কুড়ি পরে’-র বিখ্যাত গান ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ তখন ক্রসউইন্ডস-এর মতো ব্যান্ডের সূত্রে নতুন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠছে, ‘গ্যাংস্টার’-এ জেমস-এর ‘ভিগি ভিগি সি হ্যায়’ শুনে তাই বাংলা ব্যান্ডের সেই আগুনখেকো প্রজন্ম খেপে উঠল। আবার জুবিন গর্গের গলায় ‘ইয়া আলি’ গাইতে গাইতে ফুটবল খেলাফেরত আমরা ফিরি, কখনও কোচিংয়ে গুনগুন করলে অচেনা বান্ধবী সুরে সুর মিলিয়ে দেয়, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে কান। ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’-র ‘ইন দিনো, দিল মেরা’ বা ‘আলভিদা’ আমাদের বয়ঃসন্ধির অ্যান্থেম হয়ে রয়ে গেল।
নয়ের দশকের শেষে অমর্ত্য সেনের নোবেল পাওয়ার ঘটনা যে তুলকালাম গর্বের সোপান তৈরি করেছিল বাঙালির, তা খুব সারস্বত ছিল না। অর্থাৎ, অর্থনীতি নিয়ে অমর্ত্য সেন কী বলছেন, সেসব খবর অবশ্যই ক্লাবে ক্লাবে রবীন্দ্রনাথের পাশে তাঁর ছবি টাঙানো রথী-মহারথীরা টের পাননি, অর্থনীতি-সমাজনীতির অ্যাকাডেমিয়াতেই মূলত তাঁর চলাচল ছিল। কিন্তু জঁ দ্রিজের সঙ্গে মিলে ‘ইন্ডিয়া: ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল অপরচুনিটি’-তে তিনি যে উন্নয়নের বেলুনের আড়ালে অনুন্নয়নের অন্ধকারের কথা বলছিলেন, তা বলিউডের এই ধারাপাত দেখলে স্পষ্ট হয়। কাদামাখা ‘নায়ক’ অনিল কাপুর যতই দক্ষিণী অনুসরণে রাষ্ট্র বদলের আভাস দিন, আর বাংলায় যতই ‘তুলকালাম’ বা ‘ফাটাকেষ্ট’-র মতো ছবি সরাসরি নিচুতলার অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র সংস্কারের গল্প বলুক, বলিউডে তখন ক্রমে আইটি বিপ্লবের ছাপ স্পষ্ট হচ্ছিল, প্রবাস সেখানে কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ‘হিন্দুস্তানি দিল’-এর সঙ্গে বোঝাপড়ায় যাচ্ছিল, আবার তার পাশাপাশি, অনুরাগ, শ্রীরাম রাঘবন, তিগমাংশু, বিশালদের সমান্তরাল সেইসব ছবিতে তখন প্রদীপের নিচের অন্ধকারটাই উঠে আসছিল।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৯। ‘মস্তি কা পাঠশালা’ পাল্টে গেল বিদ্রোহে
পর্ব ৩৮। শাহরুখের পাশেই শরৎচন্দ্রর তাসা! গ্ল্যামারে কেউই কম যাননি
পর্ব ৩৭। টুইন টাওয়ার ভাঙছে, ভাঙছে পরম্পরা, প্রতিষ্ঠা, অনুশাসনও…
পর্ব ৩৬। একদিকে মনকেমন, অন্যদিকে খুনখারাপি! বলিউডের আলো-অন্ধকারে ফুরল শতাব্দী
পর্ব ৩৫। অ্যাংরি ইয়ংম্যান থেকে বিলেতফেরত মাচো নায়ক, বদলাচ্ছিল নব্বইয়ের হিরোরা
পর্ব ৩৪। বিস্ফোরণ আর বিভেদের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন মহব্বত ম্যান
পর্ব ৩৩। অমর চিত্রকথা, চাচা চৌধুরী ও ইরোটিকার পৃথিবীতে এসে পড়ল তরুণ বেপরোয়া নায়কদের দিন
পর্ব ৩২। নব্বইয়ের শুরু থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড ঢাকা পড়ল বলিউডের তাজমহলে
পর্ব ৩১। ফুলন দেবীর বন্দুক ও ‘মির্চ মসালা’-র প্রতিরোধ
পর্ব ৩০। স্কুল থেকে শ্মশান, সর্বত্র শোনা গেছে ‘মোগাম্বো খুশ হুয়া’
পর্ব ২৯। ‘ক্যায়ামত’ না আসুক, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ঠিক বুঝেছে এসটিডি বুথ, একা অ্যান্টেনা
পর্ব ২৮। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দিন জনশূন্য কলকাতায় পকেটমারি
পর্ব ২৭। মাস্টারমশাইরা কি আজও কিচ্ছু না দেখেই থাকবে?
পর্ব ২৬। ‘হাওয়া হাওয়াই’য়ের আপত্তি জোটেনি কিন্তু ‘উরি উরি বাবা’ নাকি অপসংস্কৃতি
পর্ব ২৫। চুল কাটলেই মাথার পিছনে জ্যোতির মতো বাজবে ‘শান’-এর গান!
পর্ব ২৪। মরণোত্তর উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন সিরিয়াল কিলার
পর্ব ২৩। স্কুল পালানো ছেলেটা শহিদ হলে টিকিট কাউন্টার, ব্ল্যাকাররা তা টের পেত
পর্ব ২২। ক্যাবলা অমল পালেকরের চোস্ত প্রেমিক হয়ে ওঠাও দর্শকেরই জয়
পর্ব ২১। বন্দুকধারী জিনাতকে ছাপিয়ে প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠলেন স্মিতা পাতিল
পর্ব ২০। হকার, হোটেল, হল! যে কলকাতার মন ছিল অনেকটা বড়
পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল