Robbar

‘ডিডিএলজে’-র যুগ পেরিয়ে এসে নতুন প্রেমের গল্প বলল ‘জব উই মেট’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 29, 2024 9:39 pm
  • Updated:November 29, 2024 9:39 pm  

অনুরাগ কাশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-তে ইয়াকুব মেমনের চরিত্রে একঝলক দেখা যখন তিনি দিয়েছিলেন, তখন কে জানত, তাঁর আস্তিনের তলায় কী লুকনো! ভদ্রলোকের নাম ইমতিয়াজ আলি। ২০০৭ সালে মুক্তি পেল শাহিদ কাপুর ও করিনা কাপুর অভিনীত, ‘জব উই মেট’। আদিত্য এবং গীতের সেই গল্প ‘ডিডিএলজে’-র রোমান্টিকতা থেকে এক প্রস্থান নিল। নতুন প্রজন্মের নতুন প্রেমের সৌধ তৈরি হল ‘তুম সে হি’ বা ‘আওগে যব তুম’-এর সুরে।

প্রিয়ক মিত্র

৪১.

স্টার মুভিজে তখন অস্কার দেখানো হয় লাইভ। আর অস্কারের অনুষ্ঠান ব্যাপারটা, নিদেনপক্ষে বাঙালির কাছে, ফিল্মফেয়ার, আইফা ইত্যাদির চেয়েও একটু বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল সম্ভবত, ১৯৯২ সালের পর থেকে। বাঙালির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে সেই মাথাব্যথার– শুরু নয় মোটেই, কিন্তু অড্রে হেপবার্ন, যিনি কি না সেই স্বাধীন দেশের গোড়ার দিকের বাঙালি হলিউড দর্শকদের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক তাঁর মৃত্যুর আগের বছর যখন অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, সত্যজিৎ রায়ের নাম ঘোষণা করেছিলেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের পুরস্কার প্রাপক হিসেবে (সত্যজিৎ মৃত্যুশয্যায় গ্রহণ করলেন সেই পুরস্কার), তখন বাঙালি অস্কার নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসেছিল বটে। প্রখ্যাত এক বাংলা দৈনিক পত্রিকায় তাদেরই এক বিশেষ ইভেন্টের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন লিখেছিলেন এক প্রোথিতযশা ফিচার লেখক, সম্পাদক তাঁকে বলেছিলেন, লিখুন, অস্কারের মহিমা আজকের অনুষ্ঠানের পর থেকে ম্লান হয়ে গেল। অর্থাৎ, অস্কার তখনও পর্যন্ত গ্ল্যামারে ততটাই অটুট। কিন্তু সেই দুঁদে সম্পাদকের কথা ক্রমেই সত্য হয়ে উঠবে, এই সম্ভাবনা তখনও টের পাওয়া যায়নি।

সে-বছর অতিরিক্ত উত্তেজনা। তখনও রহমান ‘জয় হো’-র জন্য পুরস্কার পাননি, ‘নাটু নাটু’ অস্কার মঞ্চে পৌঁছে যায়নি তখনও, আর মধ্যবিত্তর কাছে হলিউড-বিরোধিতা, এবং অস্কার আদতেই পিপুফিশু পুরস্কার জাতীয় তত্ত্ব তখনও খুব পরিচিত নয়। সেই অবস্থাতেই অস্কারের দৌড়ে নাম লিখিয়েছিল, আশুতোষ গোয়ারিকরের ‘লগান’ (২০০১)।

Lagaan - Aamir Khan - Hindi Movie Poster - Canvas Prints

২০০৩ সালে ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা নানাভাবে সামাজিক গুরুত্ব বহন করেছিল। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের দু’দশক পরের ওই ঘটনার মাঝে একটা অর্থনৈতিক সংস্কারের কিস্সা আছে, বিশ্বায়ন অথবা গোলকায়নের ভূত আছে। ফলে, এক অর্থে মিডিয়া তখন নিয়ন্ত্রণ করছে ক্রিকেটের ‘স্পেকটেকল’। বিবিধ বিজ্ঞাপনে আকাশি রঙের ইন্ডিয়া টিমের জার্সি পরা ক্রিকেটারদের দেখছে যে দর্শক, সে যখন মাঠে, হেলমেট ও প্যাড পরা বা ফিল্ডিংয়ে দাঁড়ানো ক্রিকেটারদের দেখছে কিছুটা দূরত্ব থেকে, তাদের যতটা না অ্যাড্রিনালিন রাশ ঘটেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি ঘটেছে টিভিতে ক্রিকেট সম্প্রচার দেখে। সেঞ্চুরির পরে বা একটুর জন্য সেঞ্চুরি ফসকে যাওয়ার পরে ব্যাটারের মুখ, অভিব্যক্তি সেখানে জরুরি হয়ে ওঠে। ক্যাচ ধরার পর বা বোল্ডের পর বোলার-ফিল্ডারদের উল্লাস সেখানে দেখা যায়। কাপ হাতে ধরে অধিনায়কের হাসিও চোখে পড়ে সেখানে। এইভাবে ক্রিকেটাররা রোজকার ড্রয়িংরুমের অতিথি হয়ে উঠছিলেন। বিশেষ বিশেষ টেস্ট বা ওয়ান ডে ম্যাচের ডিভিডিও তখন মিলত। বড়পর্দার বলিউডের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার এই উত্তেজনার কোথাও একটা যোগাযোগ-সেতু তৈরি হয়েছিল আমির খান অভিনীত ‘লগান’-এর সূত্রে। তার সঙ্গেই জুড়ল ঔপনিবেশিকতার ভাবনাও। এডওয়ার্ড সাইদ ‘ওরিয়েন্টালিজম’-এ, পাশ্চাত্যের ক্যাননে প্রাচ্যের যে সাংস্কৃতিক ধারণা নির্মাণের কথা বলেছিলেন, গোলকায়ন ও গ্লোবাল ভিলেজ নির্মাণের পর থেকে তার ধারাপাত বদলাচ্ছিল। কিন্তু ‘লগান’ সচেতনভাবেই ঔপনিবেশিক ও ভদ্রলোকের খেলাকে ‘রিক্লেম’ করার আখ্যান তুলে ধরতে চাইল, পাশ্চাত্যের দেখার চোখের বিরুদ্ধে গিয়েই, কিন্তু দিনের শেষে, গ্লোবাল ভিলেজে ভারত নামক দেশটির এক নতুন ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের প্রকল্প মাথায় রেখেই। লগানের ক্লাইম্যাক্সে যখন ছ’রান বাকি থাকার আবহে দেখা যায় উদ্ধত সাহেব ফিল্ডার বল ক্যাচ করেছে, এবং পর মুহূর্তেই বাউন্ডারি লাইনের ওপর তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, তখন যে কোনও ম্যাচ জয়ের আনন্দর মতোই তা এসে পৌঁছেছিল। অস্কারে লগান শেষত হয়তো দাগ কাটতে পারেনি, কিন্তু যে স্বাজাত্যবোধ ওই ছবির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল, তা ক্রিকেটের সঙ্গে মিশে যেতে সময় লাগল না। তাই দু’বছর বাদে বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে রিকি পন্টিংয়ের দুর্দম অস্ট্রেলিয়ার কাছে হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসা সৌরভ গাঙ্গুলীর টিম ইন্ডিয়া সেই দেশচেতনার প্রকল্পেই ধাক্কা দিল। অস্ট্রেলিয়ার ওপর আমাদের হাড়-রাগ তৈরি হল। তাই বাংলা খবরের কাগজে দুই মডেল ও শেন ওয়ার্নের রগরগে কেচ্ছা পড়ে অনেকে আনন্দও পেয়েছিল, ওই সময়ের আশপাশেই। ঘটনাচক্রে, সে কেচ্ছা খবরে এসেছিল এক রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনে।

Ponting's epic 2003 World Cup final ton | cricket.com.au
২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে শচীনের আউট হয়ে ফেরা

এর চার বছর পর, অন্য আরেকটি বিশ্বকাপের বছরেই, মুক্তি পেয়েছিল ‘চক দে ইন্ডিয়া’। শাহরুখ খানের নায়িকা নেই, তেমন গানবাজনা নেই, মেয়েদের হকি খেলা নিয়ে সিনেমা, ফ্লপ করতে বাধ্য- ইত্যাদি নানা বুকনি তখন কান পাতলে শোনা যেত। কিন্তু সীমিত আমিনের ওই ছবি অপ্রত্যাশিত আলোড়ন ফেলে দিল। মজার বিষয়, যে হকি কোচ এই ছবির নেপথ্যের মূল কাহিনির নায়ক, মির রঞ্জন নেগি, তাঁর চরিত্রের নাম হয়ে উঠল এই ছবিতে, কবির খান। নেগির মতো কবির খানকেও ‘গদ্দার’ অপবাদ হজম করতে হয়। এবং পাকিস্তানের কাছে হেরে জোটা সেই অপবাদ ঘোচায় কবির খান ও তার মহিলা-বাহিনী, অস্ট্রেলিয়ার হকি টিমকে হারিয়ে। ২০০৩-এর বৃত্ত এই ছবিতে সম্পূর্ণ হয় এভাবে। এরপর শেষ দৃশ্যে কবির খানের বাড়ির বাইরের দেওয়াল থেকে গদ্দার লেখাটা মুছে দেয় এক শিখ বালক। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দুই গোষ্ঠীর দুই প্রজন্মের প্রতিনিধি মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। অন্যদিকে দেখা যায়, হকি টিমের মেয়েরা পুরুষনির্ভরতা, চেনা পারিবারিক ক্ষমতাতন্ত্রকেও অস্বীকার করছে সহজেই।

জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে এমন বিচ্যুতি সহজে ঘটে না। কিন্তু তা ঘটা সত্ত্বেও ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ভারতীয় ক্রীড়ামনের স্লোগান হয়ে উঠল সাবলীলভাবেই। আমাদের যদিও তখন ক্রিকেট খেলা থেকে মন একটু একটু সরছে। গলিতে খেলা থেকে সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে এপাড়া-বেপাড়া ঘুরছি আমরা তখন। ফুটবলও আমাদের নেশাগ্রস্ত করছে তখন। ইএসপিএন, স্টার স্পোর্টসের সুবাদে তখন ইপিএল, চ্যাম্পিয়নস লিগ দেখা যাচ্ছে সহজেই। রোনাল্ডিনহোর পোস্টার সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে এক সদ্য তরুণ, লিওনেল মেসি। মেসি আলাভোলা, বল পায়ে পেলে চিতা। রক্তাক্ত হয়েও রাগী নয়। আমাদের মন তখন মেসির দিকে ঝুঁকে গেছেই। একের পর এক হ্যারি পটার রিলিজ করে, নোলান ডার্ক নাইট ট্রিলজি তুলছেন, সেসবের মধ্যে আসলি জাদুকর, আসল সুপারহিরোকে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম যেন বার্সেলোনা আর আর্জেন্টিনার জার্সিতে। ফুটবলের আরেক গরমাগরম তারকা বেকহ্যাম ততদিনে একটু পুরনো হয়েছেন। ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’-এর মতো ছবি সেই উন্মাদনাকে ছুঁয়েও ফেলেছে। এর কিছু পরে বলিউডে বিবেক অগ্নিহোত্রী নামে এক পরিচালক ‘ধন ধনা ধন গোল’ নামে এক আশ্চর্য স্পোর্টস থ্রিলার বানাবেন, যার চিত্রনাট্য ও সংলাপ যৌথভাবে লিখেছিলেন বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে ও অনুরাগ কাশ্যপ। এমন ত্র্যহস্পর্শ ভাবলেও এখন অবাক লাগে। তবে এই স্পোর্টস ডায়াস্পোরার নেপথ্যে সেইসময় বিদেশি ফুটবলের প্রতি আগ্রহকেও খানিক উসকে দেওয়ার চেষ্টা ছিল বটে। বিবেক এরপর পানু থেকে প্রোপাগান্ডা নানা রাস্তায় হাঁটবেন যে, সেসব ইঙ্গিতও তখন পাইনি।

Chak De! India Turns 13; Writer Jaideep Sahni Reveals What Went Into The Making Of The Shah Rukh Khan Starrer
চক দে ইন্ডিয়া

 

বলিউডও অন্য পথে হাঁটতে শুরু করেছে। চেনা ডায়াস্পোরার ছক মেনে হয়ে চলেছে ‘সালাম নমস্তে’, ‘নমস্তে লন্ডন’-এর মতো একের পর এক ছবি। এর মধ্যে ‘সালাম নমস্তে’-র পোস্টারে সইফ আলি খান ও প্রীতি জিন্টার খোলামেলা ছবি দেখে একটু গলা খাঁকরানি, চোখ টেরিয়ে তাকানো ইত্যাদি ইত্যাদির মাঝেই আমরা বড় হওয়া প্র্যাকটিস করছি তখন। ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এর শর্মিলা ঠাকুরের বিকিনি পরা নিয়ে উৎসাহী প্রজন্মও সন্দিহান ও বিরক্ত হয়ে পড়ল এই পোস্টার দেখে। স্কুলের বেঞ্চে ফিসফিসানি, ও নানা আলোচনা চলে। আরেকটু পরের দিকে মুক্তি পেয়েছিল ‘রেস’। গানের লিরিকে সরাসরি ‘জারা জারা টাচ মি টাচ মি টাচ মি, জারা জারা কিস মি কিস মি কিস মি’ জাতীয় কথা, তার মধ্যে গানের দৃশ্যায়নে সইফ-বিপাশার অমন ঘন দৃশ্য, সহজে তো তা দেখা যাবে না। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হত নাইনএক্সএম বা জুমের মতো চ্যানেল। ততদিনে এসে গেছে ইউটিউব-ও। সেখানে যতবার চাইব, সেসব গান ও তার সঙ্গের নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখা যায়। সিনেমা হলে গিয়ে তো এসব দেখা হয়ে উঠবে না!

A Styling Review Of Bollywood Movie Salaam Namaste
সালাম নমস্তে

হলে গিয়ে দেখা যেত অবশ্য, যেসব ছবি নিতান্তই নিরামিষ। টিভিতেও সে ছবি দেখার স্বাধীনতা থাকত। বিশাল ভরদ্বাজের ‘মাখরি’ এবং ‘ব্লু আমব্রেলা’ যদিও হলে এসে কবে উঠে গিয়েছিল, জানতেও পারিনি আমরা। বহু পরে আফসোস হয়েছে, কেন যে দেখা হল না ছোটবেলায় এই ছবিগুলো? ‘কোই মিল গয়া’, ‘কৃশ’, অনুরাগ কাশ্যপের ‘রিটার্ন অফ হনুমান’ দেখেছি আমরা সেসময়। কিন্তু মনমেজাজ তখন বেশ বেয়াড়া। সেই গোত্রের ছবিতে তখন আমরা আর ভুলে থাকব না, বোঝাই যাচ্ছে। তাও সেসব ছবি সম্বল ছিল ওই শৈশবের শেষবেলায়।

এসবের মধ্যেই সেই স্টার বেস্টসেলার্সে আত্মপ্রকাশ করা এক পরিচালকের ছবি মুক্তি পেল। অনুরাগ কাশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-তে ইয়াকুব মেমনের চরিত্রে একঝলক দেখা যখন তিনি দিয়েছিলেন, তখন কে জানত, তাঁর আস্তিনের তলায় কী লুকনো! ভদ্রলোকের নাম ইমতিয়াজ আলি। ২০০৭ সালে মুক্তি পেল শাহিদ কাপুর ও করিনা কাপুর অভিনীত, ‘জব উই মেট’। আদিত্য এবং গীতের সেই গল্প ‘ডিডিএলজে’-র রোমান্টিকতা থেকে এক প্রস্থান নিল। নতুন প্রজন্মের নতুন প্রেমের সৌধ তৈরি হল ‘তুম সে হি’ বা ‘আওগে যব তুম’-এর সুরে। আদিত্য আর গীত নয়া কর্পোরেট ভারতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই যুগল, যারা প্রেমকে দেখতে শিখবে এক নতুন অ্যাডভেঞ্চারের দৃষ্টিতে, যা ততটাও বৈষয়িক নয়। কিন্তু সঞ্জয় লীলা বনশালী-র ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ যেমন চেনা রোমান্সের সমীকরণ একটু হলেও বদলে দেয়, এখানেও গীত অংশুমানের জন্য ঘরছাড়া হয়েও শেষে ঘরের নিরাপত্তায় ফেরে, আদিত্যর সঙ্গে মিলনও হয় তার, মধুরেণ সমাপয়েৎ।

Prime Video: Jab We Met

ইমতিয়াজ এরপর যখন ‘লাভ আজকাল’ বানাবেন, বা বহু পরে ‘তামাশা’, তখন কখনও রুমি এসে ভর করবেন, কখনও ভারতীয় কথনধারা। ‘হাইওয়ে’-তে পৌঁছে অন্য এক ডিপারচার দেবেন তিনি। এসবের মধ্যিখানে ছিল ‘রকস্টার’, যা তখন সদ্য ব্যান্ড গড়ে তোলা আমাদের বন্ধুদের হঠাৎই চমৎকৃত করেছিল। তবে সেই ২০০৮ সালের মিউজিক্যাল ‘রক অন’ আমাদের প্রকৃত প্রস্তাবেই প্রেরণা জুগিয়েছিল। তার পরে পরে অঞ্জন দত্ত বানাবেন ‘ম্যাডলি বাঙালি’, আমাদের উন্মাদনা আরেকটু বাড়িয়ে। একুশ শতকীয় তারুণ্যের আগুনে আরও কাঠকয়লা জুগিয়েছিল সেসব ছবি।

Watch Rockstar on JioCinema

তবে যেভাবে ‘রং দে বাসন্তী’ একসময় এক বিদ্রোহী ফাগুনের আভাস দিয়েছিল, তার চেয়ে খানিক অন্য মোকামে সুধীর মিশ্র এনেছিলেন তাঁর ‘হাজারো খোয়াইশহি অ্যায়সি’। শাইনি আহুজা, চিত্রাঙ্গদা সিং, কে কে মেনন, শিল্পা শুক্লা অভিনীত সেই ছবি ছিল সাতের দশকের প্রেক্ষাপটে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্য ভাষ্য নির্মাণের সময় সেই ছবি ফিরে দেখেছিল তিন দশক আগের আগুন প্রজন্মকে, যা গণস্মৃতিতে তখনও টাটকা ছিল। সুধীর মিশ্রর আগের ছবি ‘চামেলি’ (পরিচালক অনন্ত বালানির মৃত্যুর পর দায়িত্ব নিয়ে শেষ করেছিলেন) করিনা কাপুরকে অভিনেত্রী হিসেবে আবিষ্কার করেছিল তো বটেই, একই সঙ্গে ‘ভাগে রে মন’-এর মতো গান সেই ছবিকে গণমনের সিনে-নস্টালজিয়াতেও অমলিন করে রেখেছে। ‘হাজারো…’-তে সাওয়ান্দ কিরকিরে-র ‘বাভরা মন’-ও একই স্মৃতির উপাদান দিয়েছিল।

Chameli
চামেলি

এর ফাঁকে এসেছে মধুর ভান্ডারকরের ‘চাঁদনি বার’ বা ‘ফ্যাশন’, যা বম্বের উজ্জ্বলতায় খানিক চিড় ধরিয়েছে, প্রদীপের নিচের অন্ধকার দেখাতে চেয়েছে। অন্যদিকে রামগোপাল ভার্মাও ‘ডি কোম্পানি’-র পাশাপাশি ‘সরকার’ ট্রিলজি বানিয়েছেন। বাল ঠাকরেও যে দাউদের মতোই অন্ধকারের রাজা, তা বুঝিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি।

সেসব বোঝাপড়ার মধ্যিখানেই ড্যানি বয়েলের ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’ অস্কার মাতাল। জয় হো-র সূত্রে আমাদের প্রিয় রহমান উঠলেন অস্কারের স্টেজে। এই শতাব্দীর শুরুর দিকেই যখন মণিরত্নমের ‘গুরু’ বা ‘যুবা’ রিলিজ করল, তখন ‘বরসো রে মেঘা মেঘা’ বা ‘কভি নিম নিম’ শুনতে শুনতে আমরা সত্যিই তো ভেবেছি, এসব গান বিদেশিরা মিস করে যায়। তবে জয় হো সেই মাত্রায় পৌঁছেছে কি না তাই নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকল। তার চেয়েও বেশি বিতর্ক দানা বাঁধল, এই ছবিতে ভারতের প্রতিচ্ছবি নিয়ে। কৌন বনেগা ক্রোড়পতি নিয়ে গণউত্তেজনাকে হাতিয়ার করে, সেই সাইদ কথিত ওরিয়েন্টই অন্যভাবে দেখা দিল এই ছবিতে। ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ সিটকমে ভারতীয় চরিত্র রাজ বারবার নিজেকে এই ছবির সঙ্গে মেলাতে থাকে, বোঝা যায়, পশ্চিম ভারত চিনছে এই ছবি থেকেই। ওই একই সময় ভারতীয় ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি, আইপিএল-এর অনুপ্রবেশ। বিশ্বায়নের চক্র পুরোপুরি বোঝা যেতে শুরু করল এই সময় থেকেই।

Watch Yuva | Netflix

২০০৮ সাল। ২৬ নভেম্বর। ভারতের বুকে ঘটে গেল একুশ শতকের অন্যতম দীর্ঘ ও ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। ভুললে চলবে না, ওই বছরেই রিসেশনের ঢেউ লাগছে। ভারতীয় স্বপ্নে অত বড় দু’টি ধাক্কা আগামী অনেককিছুই বদলে দিয়েছিল ধীরে ধীরে। ভারতের নিউক্লিয়ার চুক্তি, টাটার ন্যানো গাড়ির প্রস্তাবনা- সব মিলিয়ে বিভ্রান্তি বাড়তে লাগল। আমরাও হয়তো সিনেমার বুদবুদ এড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম না, শিগগিরই অন্য এক ভারতে বাঁচার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের।

…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ৪০। থিয়েটারের লড়াকু ছেলেমেয়েদের চোখে স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলেন ইরফান খান

পর্ব ৩৯। ‘মস্তি কা পাঠশালা’ পাল্টে গেল বিদ্রোহে

পর্ব ৩৮। শাহরুখের পাশেই শরৎচন্দ্রর তাসা! গ্ল্যামারে কেউই কম যাননি

পর্ব ৩৭। টুইন টাওয়ার ভাঙছে, ভাঙছে পরম্পরা, প্রতিষ্ঠা, অনুশাসনও…

পর্ব ৩৬। একদিকে মনকেমন, অন্যদিকে খুনখারাপি! বলিউডের আলো-অন্ধকারে ফুরল শতাব্দী

পর্ব ৩৫। অ্যাংরি ইয়ংম্যান থেকে বিলেতফেরত মাচো নায়ক, বদলাচ্ছিল নব্বইয়ের হিরোরা

পর্ব ৩৪। বিস্ফোরণ আর বিভেদের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন মহব্বত ম্যান

পর্ব ৩৩। অমর চিত্রকথা, চাচা চৌধুরী ও ইরোটিকার পৃথিবীতে এসে পড়ল তরুণ বেপরোয়া নায়কদের দিন

পর্ব ৩২। নব্বইয়ের শুরু থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড ঢাকা পড়ল বলিউডের তাজমহলে

পর্ব ৩১। ফুলন দেবীর বন্দুক ও ‘মির্চ মসালা’-র প্রতিরোধ

পর্ব ৩০। স্কুল থেকে শ্মশান, সর্বত্র শোনা গেছে ‘মোগাম্বো খুশ হুয়া’

পর্ব ২৯। ‘ক‍্যায়ামত’ না আসুক, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ঠিক বুঝেছে এসটিডি বুথ, একা অ্যান্টেনা

 পর্ব ২৮। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দিন জনশূন্য কলকাতায় পকেটমারি

 পর্ব ২৭। মাস্টারমশাইরা কি আজও কিচ্ছু না দেখেই থাকবে?

 পর্ব ২৬। ‘হাওয়া হাওয়াই’য়ের আপত্তি জোটেনি কিন্তু ‘উরি উরি বাবা’ নাকি অপসংস্কৃতি

পর্ব ২৫।  চুল কাটলেই মাথার পিছনে জ‍্যোতির মতো বাজবে ‘শান’-এর গান!

পর্ব ২৪। মরণোত্তর উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন সি‌রিয়াল কিলার

পর্ব ২৩। স্কুল পালানো ছেলেটা শহিদ হলে টিকিট কাউন্টার, ব্ল‍্যাকাররা তা টের পেত

 পর্ব ২২। ক‍্যাবলা অমল পালেকরের চোস্ত প্রেমিক হয়ে ওঠাও দর্শকেরই জয়

পর্ব ২১। বন্দুকধারী জিনাতকে ছাপিয়ে প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠলেন স্মিতা পাতিল

পর্ব ২০। হকার, হোটেল, হল! যে কলকাতার মন ছিল অনেকটা বড়

পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও

পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল

পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত

পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ

পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাত‍রা এল কোথা থেকে?

পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?

পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে

পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী? 

পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল

পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ‍্যানের স্মৃতি

পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে

পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না

পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা

পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?

পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প

পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা

পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!

পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?

পর্ব ‌১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল