কমরেড ব্রহ্মার হামলার কথার প্রেক্ষিতে প্রতিমা হাততালি দিয়ে লোকজনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, ‘মেরেছে বেশ করেছে। আমাকেও তোমরা বন্দুক দাও। আমি বড়লোকদের মারব, পুলিশকে মারব।’
একাধিক টিপার রাহুলকে বলেছে, মহিলা যতটা পাগলামির ভাব করেন, ততটা পাগল নন। তলায় তলায় মাওবাদীদের খবরাখবর পাচার করেন। কিন্তু ক’দিন নজর রেখে আর ভাবগতিক দেখে রাহুলের তেমন কিছু মনে হয়নি। মহিলা একাই ঘোরাফেরা করেন। কখনও সখনও তাঁর এক মাসতুতো বোন এসে কিছু চাল, ডাল, কাপড় দিয়ে যায়।
১৫.
মহিলাটি সম্পর্কে যা যা শুনেছিল রাহুল, তাতে তাঁর মাওবাদী বা যেকোনও ধরনের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতেই পারে। যেসব ক্ষোভের কথা তিনি বলেন, তাতে সেই ধারণা স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর জীবনের যা গল্প, তাতে বিদ্রোহ এসে পড়ারই কথা!
মহিলার নাম প্রতিমা। বেশ কিছু বছর আগে তাঁর পরিবার খবরের শীর্ষে ছিল। তারপর মহিলা হারিয়ে যান। তাঁকে যে এখানে এই কুসুমডিহাতে এসে আবিষ্কার করা যাবে, রাহুল স্বপ্নেও ভাবেনি।
একসময়ে এখান থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরের গ্রামে তাঁদের সুখের সংসার ছিল। বর পরঞ্জয় কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করত। একদিন হঠাৎ অভিযোগ, ওখানকার একটা ফ্ল্যাটের কিশোরী ছাত্রী হৈমন্তী পারেখকে ধর্ষণ এবং খুন করে পালিয়েছে পরঞ্জয়। পুলিশ তাকে ধরল। বিচার হল। শেষে ফাঁসি। প্রতিমার জীবন তখন থেকেই বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা হয়েছিল পরঞ্জয়কে বাঁচানোর। কিন্তু বড়লোকের টাকা আর লবির সঙ্গে পেরে ওঠেনি এই গরিব পরিবার।
পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কতরকম কথাই তখন কানে যেত প্রতিমার। শহরের অনেক লোকই বলত। হৈমন্তী মেয়েটার সঙ্গে ওর স্কুলের এক বান্ধবীর দাদার লটরপটর চলছিল, সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যায়। মেয়েটার মা তাকে খুব মেরেছিল। সেই সময় মাথায় লেগে সে মরে যায়। তারপর এই কেলেঙ্কারি ঢাকতে পরঞ্জয়ের মতো গরিব ছেলেকে বলি দেওয়া হয়। বড়লোকের কথায় আসল ঘটনা আড়াল করে পরঞ্জয়কে ফাঁসিয়ে মামলা সাজিয়েছিল পুলিশ।
লোকটা প্রতিমার হাত ছুঁয়ে চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘তুই বিশ্বাস কর, আমি ওসব কিছু করিনি। আমি বাঁচতে চাই।’ প্রতিমা একা বসে ভাবেন, কাঁদেন, হাসেন। অনেকে পাগল বলে।
প্রথমে বাপের ঘর চলে গিয়েছিলেন প্রতিমা। তারপর কী হল কে জানে, এই কুসুমডিহাতে একা থাকেন। পুলিশের নাম শুনলে গালমন্দ করেন। একটা ছোট ঘর, কাজ করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে। সবাই সহানুভূতির চোখে দেখে।
রাহুল নিজে দেখেছে কমরেড ব্রহ্মার হামলার কথার প্রেক্ষিতে প্রতিমা হাততালি দিয়ে লোকজনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, ‘মেরেছে বেশ করেছে। আমাকেও তোমরা বন্দুক দাও। আমি বড়লোকদের মারব, পুলিশকে মারব।’
একাধিক টিপার রাহুলকে বলেছে, মহিলা যতটা পাগলামির ভাব করেন, ততটা পাগল নন। তলায় তলায় মাওবাদীদের খবরাখবর পাচার করেন। কিন্তু ক’দিন নজর রেখে আর ভাবগতিক দেখে রাহুলের তেমন কিছু মনে হয়নি। মহিলা একাই ঘোরাফেরা করেন। কখনও সখনও তাঁর এক মাসতুতো বোন এসে কিছু চাল, ডাল, কাপড় দিয়ে যায়। তাকেও এবার এলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, সেসব নজরদারির ব্যবস্থা করে রেখেছে রাহুল। পুলিশ পরিচয় না দিয়ে একদিন কথা বলতে গিয়েছিল সে প্রতিমার সঙ্গে, সুবিধে হয়নি। বড় বেশি অসংলগ্ন কথা। এই মহিলা ঠান্ডা মাথায় কোনও প্লটে জড়াবেন, তার সম্ভাবনা তেমন দেখা যাচ্ছে না।
পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
রাহুলের বাড়তি সমস্যা, উপরমহল থেকে চাপ আসছে। ধরপাকড় চাই। ব্রহ্মাকে চাই। লিঙ্কম্যানদের চাই। গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাচ্চা-বুড়ো– প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে রাহুল। এলাকায় নবাগত আবিষ্কারের কাজও চলছে। রাহুল মনে করছে, দুম-দাড়াম করে গ্রেপ্তার চালালে গোটা এলাকা পুলিশের শত্রু হয়ে যাবে। তার বদলে একটু সময় নিয়ে এগনো ভালো। যদিও ত্রিপাঠীসাহেব বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রেজাল্ট চাই।
বিকেল গড়িয়ে গোধূলি। লালমাটির জঙ্গলমহলে গোধূলির আকাশ যেন আরও রং ঝরায়। এক কাপ চা খেয়ে এক রাউন্ড বেরনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাহুল। থানার সেপাই এসে বলল, ‘পোস্টমাস্টারমশাই এসেছেন। বললেন, আপনি নাকি দেখা করতে খবর পাঠিয়েছিলেন।’
রাহুল বলল, ‘আসতে বলো।’
একটা সুন্দর হাসি নিয়ে ঢুকল সুমিত।
( চলবে)