‘এখন থেকে তুমি আমার মনোঠাকুরপো। আর আমি তোমার মেজবউঠান। বুঝলে মনোঠাকুরপো? আর এই প্রথম আলাপের রাত্তির থেকেই, আমরা দুই বন্ধু। স্বামী আইসিএস, বন্ধু ব্যারিস্টার। আমাকে রোখে কে? ঠাকুরবাড়ির সেন্টার স্টেজ আমার। জ্ঞানদা ইজ রিয়েলি লাকি! কী বলো?’ বলছেন জ্ঞানদানন্দিনী।
১২.
বন্ধু সত্যেন্দ্রর শোওয়ার ঘরে ঢুকেই মনোমোহন ঘোষের চোখ পড়ে প্রায় অর্ধেক ঘরজোড়া, মশারি-আচ্ছাদিত, স্বল্পালোকিত পালঙ্কের দিকে। পালঙ্কে উপবিষ্ট সত্যেন্দ্রর স্ত্রী জ্ঞানদা। জ্ঞানদা সরাসরি তাকিয়ে দরজার দিকে। এত রাত্রে অপরিচিত পুরুষমানুষকে ঘরে ঢুকতে দেখে জ্ঞানদা চিৎকার করে উঠলেও, মনোমোহনের আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। শীতল এবং স্পষ্ট কণ্ঠে জ্ঞানদা প্রশ্ন করল, ‘কে আপনি?’
–আমি!
মনোমোহনের যতটা বিস্মিত, ততটাই থতমত। আমি, আমি, আমি সত্যেনের ব্যারিস্টার বন্ধু মনোমোহন, মনোমোহন ঘোষ। নিজের এই পরিচিতি যথাসম্ভব নিচু গলায় দিতে-দিতে মনোমোহন পালঙ্কের দিকে এগোতে থাকেন।
–আলাপ কি অত দূর থেকে হয়? তাছাড়া, আপনার এবং আপনার বন্ধুর পায়ের শব্দ একরকম হলেও, কণ্ঠস্বর এক নয়। এ-বাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে। অতদূর থেকে কথা বললে দেওয়ালও বুঝতে পারবে, আমার ঘরে পরপুরুষ এত রাতে! অতএব মনোঠাকুরপো, আপনি মশারির মধ্যে চলে এসে চুপিচুপি আলাপটা সেরে ফেলুন।
এ কী স্বপ্ন না সত্যি! ইংল্যান্ডেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। আর ঘটছে কিনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে!
ততক্ষণে ফিনফিনে রেশমের মশারির বাহারি দরজা ফাঁক করে জ্ঞানদার ঘন কালো আয়ত আঁখি দু’টি মনোমোহনকে আহ্বান জানিয়ে হাসছে!
–কী হল, আসুন। বলে জ্ঞানদা।
মনোমোহন মশারির মধ্যে প্রবিষ্ট হন। এবং যতদূর সম্ভব লাজুক, দ্বিধান্বিত এবং বিস্মিত দূরত্ব বজায় রাখেন।
–বুঝতে পারছেন তো, কেমন মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে? আপনাকে আমার বিছানায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে বারান্দায় বসে সিগার ধরিয়েছে। গন্ধ পাচ্ছেন না?
–পাচ্ছি বউঠান! দু’টি শব্দ কী অনায়াসে বেরিয়ে আসে মনোমোহনের কণ্ঠ থেকে।
–বাঃ কী সুন্দর! ‘পাচ্ছি বউঠান!’ দ্বিধা কাটছে, আড়ষ্ঠতা গলছে, স্বাভাবিকতা ফিরছে।
–এখন থেকে তুমি আমার মনোঠাকুরপো। আর আমি তোমার মেজবউঠান। বুঝলে মনোঠাকুরপো? আর এই প্রথম আলাপের রাত্তির থেকেই, আমরা দুই বন্ধু। স্বামী আইসিএস, বন্ধু ব্যারিস্টার। আমাকে রোখে কে? ঠাকুরবাড়ির সেন্টার স্টেজ আমার। জ্ঞানদা ইজ রিয়েলি লাকি! কী বলো?
শোবার ঘরের অস্পষ্ট আলোয় জ্ঞানদার হাসি যেন অলীক স্বপ্ন। কী সৌভাগ্যবান সত্যেন! ভাবেন মনোমোহন।
–তোমার বন্ধুটি মনোঠাকুরপো দেখতে যত ভালমানুষ, যেন ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না, রসবোধে ততটাই বিপজ্জনক!
– ঠিক ধরেছেন আপনি, বলেন মনোমোহন।
–উঁহু, ‘ঠিক ধরেছেন আপনি’ নয়। ঠিক ধরেছ তুমি। তোমার-আমার বন্ধুত্বের মাঝখানে কোনও ‘আপনি’-র আড়ষ্টতা আমার সহ্য হবে না।
আগের পর্ব: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
–এবার বুঝছি সত্যেন কেন ‘জ্ঞানদা’ বলতে অজ্ঞান! বিলেতে ওর বেপরোয়া ভাব এবং সেন্স অফ হিউমার নারীমহলে বেশ সাড়া ফেলেছিল– একথা সত্যি। কিন্তু আরও বড় সত্যিটা হল, ওর মধ্যে তোমার কাছে ফিরে আসার তাড়না। এখন দেখচ্ছি, সত্যেনের মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলের বউ হওয়ার যোগ্যতা তোমার সত্যিই আছে বউঠান।
–তোমরা তো একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু, তাই না মনোঠাকুরপো?
–ঠিক তাই।
–আজকের রাত্তিরে যে-ব্যাপারটা তোমার বন্ধুটি ঘটাল, এই বাংলায় আর কোনও বাড়িতে কোনও পুরুষ ভাবতে পারত?
–পাগল হয়েছ বউঠান? বাংলার, কিংবা বলা চলে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, আর কোনও রাত্তির স্ত্রী স্বাধীনতাকে এমন মহিমময় রূপে প্রকাশ করেনি। আজকের রাত কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের প্রকাশে ঐতিহাসিক। ও তুলনাহীন।
–তোমার বন্ধুটি কি বরাবরই এমন বেপরোয়া? কখন কী করে বসে ঠিকঠিকানা থাকত না? তাই তো?
–তাহলে বলি শোনো। ইংরেজরা কী এমনি-এমনি বলে, মর্নিং শোজ দ্য ডে! একেবারে ছেলেবেলার কথায় যাই। তখন সত্যেনের ন’বছর বয়স। সবে পইতে হয়েছে। তখন কিন্তু বউঠান তোমার শ্বশুরবাড়ির চেহারাটা একেবারে অন্যরকম ছিল। যেমন আর পাঁচটা হিন্দুবাড়ি বা পরিবার হয়, প্রায় সেরকম। একেবারে নিষ্ঠাবান ধনী ব্রাহ্মণবাড়ি বলতে যা বোঝায়, তাই! একদিকে পরম বৈষ্ণব। আবার অন্যদিকে শক্তিপুজোও হচ্ছে। দুর্গা, জগদ্ধাত্রী– সব কিছু। মূর্তিপুজোর ছড়াছড়ি। এই রকম একটা পরিবারে ন’বছর বয়সে সত্যেন হয়ে উঠল আইকনোক্লাস্ট!
–আইকনোকক্লাস্ট! মানে?
–মানে, মূর্তিপুজোর বিরোধী। আইসিও এনওসি এলএ এসটি। এই হল গিয়ে শব্দটার বানান। আর মানে হল, মূর্তিপুজো দেখলেই আঘাত করো।
–কী সর্বনাশ! দু’টি শব্দের উচ্চারণে মিশে থাকে জ্ঞানদার মনের আদর, মনে হয় মনোমোহনের।
–এবার শোনো কী হল বউঠান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে খুব জাঁক করে সরস্বতী পুজো হচ্ছে। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সরস্বতীবন্দনা পর্যন্ত লিখেছেন। জ্ঞানের দেবীর প্রতি পুজো প্রার্থনা উথলে উঠছে চারিদিকে।
–তার মধ্যে আমার আইকনোক্লাস্ট বর কী করল গো ঠাকুরপো?
–ভাগ্যি ভাল, সে-দৃশ্য তোমাকে দেখতে হয়নি। বছর ন’-এর সত্যেনের হাতে ছিল দেবী-দক্ষিণার কিছু কয়েন। সেই রূপোর টাকা সে হঠাৎ ছুড়ে মারল সরস্বতীর মূর্তিতে সজোরে।
–তারপর? আঁতকে উঠে জ্ঞানদা মনোমোহনের হাতে হাত রাখল।
–তারপর সেই আঘাতে সরস্বতীর মুকুট পড়ল ভেঙে। বোঝো ব্যাপার!
–বাবামশায়! তিনি যখন জানলেন? জ্ঞানদা মনোমোহনের হাত থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করে। তার কণ্ঠে আতঙ্ক।
–দেবেন্দ্রনাথ আদেশ করলেন, সত্যেনকে আমার কাছে নিয়ে এসো। সত্যেন কিন্তু অপকর্মটি করার পর নিজেই মাথা নিচু করে গিয়ে দাঁড়াল তার বাবামশায়ের সামনে। দেবেন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাছে এসো।’ তিনি ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। সত্যেন কাছে গেল। দেবেন্দ্রনাথ সস্নেহে তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তুমি মূর্তি পূজায় বিশ্বাস যদি না করো, না-ই করলে। আমিও বিশ্বাস করি না। কিন্তু অন্যের বিশ্বাসে এই রকম রূঢ়ভাবে আঘাত করার অধিকার তোমার নেই সত্যেন। মূর্তিপূজার বিরোধী হতে হলে অকাট্য যুক্তিই হতে পারে তোমার শানিত অস্ত্র। এবং সেই যুক্তি তোমাকে আহরণ করতে হবে উপনিষদ থেকে। উপনিষদ বলছে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু তিনি সর্বব্যাপী এক অদৃশ্য শক্তি। তাঁর কোনও মূর্তি নেই। উপনিষদ না পড়লে তুমি এই ঈশ্বর-ধ্যানে পৌঁছতে পারবে না সত্যেন।
–কিন্তু বাবামশায়, আমি তো আপনার মতো সংস্কৃত জানি না, বলল সত্যেন।
–তারপর? খুব মিষ্টি মিহি ঈষৎ কম্পমান কণ্ঠে প্রশ্নটি করে আবার মনোমোহনের হাতে হাত রাখল জ্ঞানদা। ঠিক সেই সময়ে ঘরে প্রবেশ করলেন সত্যেন্দ্র!
(চলবে)
পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা।