সত্যেন্দ্র ঘরে মাথা নীচু করে পায়চারি করতে-করতে বলেন, বাবামশায় বললেন, সত্যেন, এ-ব্যাপারে তোমার মত থাকুক না থাকুক, কিছু এসে যায় না। তুমি জ্যোতিকে রাজি করাও এ-বিয়ে করতে। ওকে মনে করিয়ে দাও, আমরা মুসলমানের জলছোঁয়া, একঘরে, পিরালি ব্রাহ্মণ। তাছাড়া আমি আবার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়ে প্রায় সমাজচ্যুত হয়েছি। সুতরাং কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে আমার পুত্রের বিয়ে হওয়াটা সহজ কাজ নয়। জগমোহন এবং শ্যামলাল আমাদের কর্মচারী। ওদের আপত্তি করার সাহস হবে না। অতএব জ্যোতি যেন রাজি হয়ে যায়।
১৮.
‘নতুন তো সবে উনিশে পড়েছে। আর এরই মধ্যে তার বিয়ে?’ বিস্মিত এবং বিধ্বস্ত জ্ঞানদা প্রশ্ন করে স্বামী সত্যেন্দ্রকে।
‘আর আমি যে সতেরো বছর বয়সে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলুম, তার বেলা?’ দুম করে বলে ফেলেন সত্যেন্দ্র।
‘বাধ্য হয়েছিলে?’ ফুঁসিয়ে ওঠে জ্ঞানদা। পরক্ষণেই বলে, কিছুদিনের মধ্যেই তো ‘আইসিএস’- হতে তোমাকে বিলেত পাঠান হল। বাবামশায়ের আর মা-র মনে ভয় ছিল, পাছে বিলেতে গিয়ে তুমি মেম বিয়ে করে ফেল। নতুনকে কি বিলেতে পাঠান হচ্ছে?
‘সেটা হলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হত না। ভাইদের মধ্যে সবথেকে গুণী কিন্তু নতুন। ইউরোপে গেলে ওর গুণের আদর হত। এবং ঠিক পথে ওর গুণাবলির প্রকাশ ঘটত। তা নয়, তড়িঘড়ি ওর বিয়ের জন্যে বাবামশায় উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছেন। এবং আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন নতুনকে রাজি করতে।’
‘তুমি নতুনের বিয়ে দিতে কলকাতায় এসেছ? আর কাল রাত্তিরে বললে, আমাকে ছেড়ে থাকতে পারছিলে না, তাই এসেছ।’ জ্ঞানদার কথায় মিশে যায় রাগ, অভিমান, বিষাদ। ‘তা নতুনের পাত্রীটিকে? ঠিক হয়েছে?’ যেন তার সমস্ত মনখারাপ নিংড়ে প্রশ্নটি করে জ্ঞানদা।
–বাবামশায় আর মেয়ে পেলেন না? বলেন হতাশ সত্যেন্দ্র।
–‘মেয়েটা কে?’ জ্ঞানদার প্রশ্নটা আর্তনাদের মতো শোনায়।
– ‘কে আবার, আমাদের বাজার সরকার শ্যামলালের মেয়ে।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মেজবউঠাকরুণ। পর্ব ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
–শুধু বাজার সরকারের মেয়ে নয়, আমাদের দারোয়ান জগমোহন গাঙ্গুলীর নাতনি, সেটাও বলো। বিদ্রুপ এবং ঘৃণা ঝরে পড়ে জ্ঞানদার উচ্চারণে।
–আমি নিশ্চিত, এ-মেয়ে কখনও নতুনের যোগ্য হতে পারে না। আমি হলে কক্ষনো এই বিয়ে করতেম না। আমার খুব ভয় করছে জ্ঞানদা, এই বিয়ে কক্ষনো সুখের হবে না। ঠাকুরবাড়িতে ঘোর অমঙ্গল নিয়ে আসবে ওই মেয়ে।
–আমারও তা-ই মত। এই বিয়ে হতে পারে না। তুমি একটা কথা বাবামশায়ের কানে তোলো। যদি বিয়েটা বন্ধ করতে চাও।
– কী কথা জ্ঞানু?
–বাবামশায়কে বলো, শ্যামলালের মেয়ে তো হাড়কাটাগলির মেয়ে। ওই মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলবেন না। ওই মেয়ে সংসারে অমঙ্গল ডেকে আনবে।
জ্ঞানদার কথায় পাথর হয়ে যান সত্যেন্দ্র। তারপর সেই পাথরের মূর্তি ফেটে পড়ে রাগে, ‘ছিঃ ছিঃ জ্ঞানু। তুমি এতদূর নীচে নামতে পারলে! মেয়েটা জন্মাতেই পারে হাড়কাটা গলিতে। কিন্তু বড় হয়েছে আমাদেরই এই বাড়িতে, আমাদের গরিব আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে, এ-বাড়ির কোনও একটা পায়রার খোপের মধ্যে। তাছাড়া, মেয়েটা যদি হাড়কাটা গলিতে জন্মেও থাকে, সেখানেই তো তার বাপ-ঠাকুরদার বাড়ি। এবং সেই বাড়ি ওদের দিয়েছিলেন আমার ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ। জ্ঞানদা, তুমি জানো কি না জানি না, জগন্মোহনের সঙ্গে দ্বারকানাথের আত্ময়ীতার জন্যই হাড়কাটাগলির সম্পত্তির একটি ভাগ্যে জুটেছে জগন্মোহনের। এবং সেই আত্মীয়তার সূত্রেই জগন্মোহন এবং শ্যামলাল, বাপ-ছেলে দু’জনেই চাকরি পেয়েছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।’
–তাহলে বিয়েটা তুমি আটকাতে পারবে না? জ্ঞানদার এই প্রশ্নে ফুটে ওঠে গভীর হতাশা, সেটা কান এড়ায় না সত্যেন্দ্রর।
–বাবামশায়কে বলেছি, এই বিয়েতে আমার মত নেই।
–বলেছ! তোমার সাহস আছে সত্যি! জ্ঞানদার মুখে ঈষৎ হাসি।
–আমার কথা শুনে বাবামশায় কী বললেন, ভাবতে পারবে?
জ্ঞানদা কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে সত্যেন্দ্রর দিকে। তার চোখে মুখে উদগ্রীব প্রতীক্ষা।
সত্যেন্দ্র ঘরে মাথা নীচু করে পায়চারি করতে-করতে বলেন, বাবামশায় বললেন, সত্যেন, এ-ব্যাপারে তোমার মত থাকুক না থাকুক, কিছু এসে যায় না। তুমি জ্যোতিকে রাজি করাও এ-বিয়ে করতে। ওকে মনে করিয়ে দাও, আমরা মুসলমানের জলছোঁয়া, একঘরে, পিরালি ব্রাহ্মণ। তাছাড়া আমি আবার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়ে প্রায় সমাজচ্যুত হয়েছি। সুতরাং কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে আমার পুত্রের বিয়ে হওয়াটা সহজ কাজ নয়। জগমোহন এবং শ্যামলাল আমাদের কর্মচারী। ওদের আপত্তি করার সাহস হবে না। অতএব জ্যোতি যেন রাজি হয়ে যায়।
–নতুনের মতামত নেওয়ার সত্যি কি কোনও প্রয়োজন আছে?
–কেন, প্রয়োজন নেই কেন? গভীর বেদনায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে জ্ঞানদা। তারপর বললে, তুমিই তো এইমাত্র বললে, তুমি হলে কক্ষনো এই বিয়েতে মত দিতে না। নতুনও তো ‘না’ বলতে পারে। পারে না?
–না পারে না, বলেন সত্যেন্দ্র।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মেজবউঠাকরুণ। পর্ব ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
–কেন, পারে না কেন?
–কারণ, নতুন তার প্রতিদিনের হাত খরচের জন্য বাবামশায়ের ওপরেই নির্ভরশীল। তার সৌখিনতার সমস্ত খরচ আমাদের জমিদারি থেকেই আসে, ফাইনালি অ্যাপ্রুভড্ বাই বাবামশায়। একমাত্র আমি বাবামশায়ের অর্থের উপর নির্ভর করি না। তা-ই তাঁর মুখের উপর আমার মত প্রকাশের কিছুটা স্বাধীনতা অন্তত আমার আছে।
এই চরম সত্যের সামনে জ্ঞানদা একেবারে চুপ। হঠাৎ সত্যেন্দ্র প্রশ্ন করে, মেয়েটাকে দেখেছ তুমি?
–রোজ দেখি। রোগা, কালো, টিংটিঙে, বছর নয়ের খ্যাংরাকাঠি, খুব যে গরিব ঘরের অযত্নে থাকা মেয়ে বোঝা যায়। রবি বারান্দায় দাঁড়ালে উঠোন থেকে রবির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, বন্ধুত্ব করার খুব ইচ্ছে।
–হতেই পারে। ন’বছর বয়স যখন, রবির থেকে বছর দুয়েকের বড়। রবির সঙ্গে হয়তো খেলা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওপরে আসতে সাহস পায় না। কী নাম মেয়েটার?
–কাদম্বরী, বলে জ্ঞানদা।
–কাদম্বরী! বেশ অবাক সত্যেন্দ্র।
–একরত্তি মেয়ে। কিন্তু নাম দ্যাখো! বলে জ্ঞানদা।
–কাদম্বরী মানে জানো? প্রশ্ন করেন সত্যেন্দ্র।
–না তো! কী মানে?
–বাণভট্টের লেখা খুব বিখ্যাত একটি বইয়ের নাম কাদম্বরী। কিন্তু শব্দটির অর্থ বিপজ্জনক, বলেন সত্যেন্দ্র।
–কী অর্থ? কেন বিপজ্জনক?
–কাদম্বরী এক ধরনের প্রাচীন মদ। এ-বাড়িকে এই মেয়ে কার নেশা ধরাবে, কে জানে!
(চলবে)