মেসবালক মাত্রই জানে, একদা ঠেকা-দেওয়া জীবনের সাদামাটা পোশাকখানা ছেড়ে রাখার জায়গা আর মেস নয়। হ্যাঁ, অগোছালোপনা কিছু থাকে বইকি! দেওয়ালে খানিক অগ্রাহ্যের নোংরা-ঝুল। তবে সাড়ে চুয়াত্তরীয় মেদুরতা এই মেসের কপালে নেই। ছেঁড়া-ফাটা জীবন সত্ত্বেও আনন্দ করে হইহই গানের জন্য নয় এই মেস। রিফুর দিন শেষ। জীবনের ফুটোফাটায় সেলাই চলবে না আর। চাইলে তুমি নিজেকেই বাতিল করে নতুন তোমাকে বিকিয়ে দিতে পারো বাজারে। অতএব এই মেস যেন অনেকখানি গুপ্তসমিতি, যা কি না আগামীর পৃথিবীকে সাপ্লাই দেবে নতুন মানুষ, নতুন নতুন এমপ্লয়ি আইডি। এই সব আইডি-র কোনও দেশ নেই, তার কাছের মানুষ নেই। আছে বলতে এক অলীকসুখের খোঁজ। সেই মহাশূন্যে ভেসে থাকার আগের স্টেশন আমাদের মেস।
১৮.
একটা মরা সাপ শুধু লেগে রইল বেসিনের নিচে স্যাঁতসেতে অন্ধকারে নোনা-ধরা-দেওয়ালে। আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া মেসজীবন। খুঁজে চলা মেসযাপন। আমাদের আহ্লাদ আর আফসোস। যে-আমরা ভাবতেই পারিনি মেস কখনও শেষ হতে পারে, একদিন দেখলাম, জীবনের বয়ামে সে তলার দিকে পড়ে আছে। অনেক চেষ্টা করে আঙুল বাড়িয়েও আর তাকে ছোঁয়া যায় না। একজীবন টানা যে মেসমর্জিতে চলা যায় না, অগত্যা বুঝে নেওয়া গেল ‘শেষ-মেস’।
আমরা রইলাম। মেস-ও রইল। তবে মেস আর আমাদের রইল না। ‘রহ’ আর ‘বিরহ’ যে একসঙ্গেই থাকে, একে অন্যের কোলে মাথা রেখে, এই আশ্চর্য সরল সত্যিকে খুঁজে পেলাম জয়দীপ রাউতের কবিতা-বইয়ের বিভাব-পাতায়। দুটো মাত্র শব্দে যেন এক জীবনের শ্বেত-পত্র। সাদা পাতা জুড়ে অঢেল বেঁচে থাকা। সেখানে কে কাকে খুঁজে মরে! রহ বিরহকে, নাকি বিরহের অঙ্গেই থেকে যাওয়ার সাধ মেটায় রহ। যে থাকে না, সে থাকে। যে থাকে, সে হয়তো না-ও থাকে। সেই না-থাকাও বসত হয়ে ওঠে। পূর্ণতা, অথবা শূন্যতা। অথবা আলাদা কিছু নয়। শূন্যতাও এক রকমের পূর্ণতাবোধ। মেস না-থাকা আসলে মনে মনে মেসে থাকা। সেই যাপনের ভিতর আপনগান। অথচ টিকিট কাটতে গিয়ে যারা জায়গার নাম ভুলে যাই, বলে ফেলি, দশের দিন কিংবা পনেরোর; নিজেদের কাছেও ভুল করে আমরা চেয়ে ফেলেছি ওই দশ কিংবা পনেরোর জীবন। তাতে যতদূর যাওয়া যায়! সে তবে গন্তব্য নয়; নেহাত যাওয়া; যেতে যেতে খেয়াল হয়, স্মৃতির কাছে আমাদের যে টিকিট কাটা, তাতে সেইসব মানুষের কাছে ফিরে যাওয়াই আমাদের গন্তব্য। দেশ কি আর মানচিত্র শুধু! মেস-ও তো নয় তেমন ইট-কাঠ। আসলে মানুষ। যাদের সঙ্গে ছিলাম। যাদের জীবনের সিকি-আধুলি মিশে আছে আমার সঙ্গে। আমার দু’-চার আনা গচ্ছিত আছে যাদের কাছে। সেই দেওয়া-নেওয়া যত সুদে-আসলে বাড়তে থাকে, মেস তত ফুরোয় না। মোকাম বদলে যায়। এই যে মেসের গপ্প ফেঁদে বসা, এ আসলে মেসের অছিলায় সেই মানুষগুলোকেই ছুঁতে চাওয়া। যারা একদিন ছিল একসঙ্গে, এখন সাধের বয়াম ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে জীবন। সেই সব টুকরো কুড়োতে এসে দেখা গেল, আজীবন একটা মেস গড়ে তোলা ছাড়া মেসবালকের আর দ্বিতীয় কোনও ভূমিকা নেই।
–পুরনো কথা সব মনে পড়ে গেল।
–দেখ নিজেকে চিনতে পারিস?
–দুটো দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের যে অবনতি, তার ভিতর আমাদের বন্ধুত্ব হয়তো খানিক ভালোবাসা ছড়াতে পারবে।
–আমিও তো এক রকম মেসবালক, মনে পড়ে যাচ্ছে সেই কথা।
এই সব রঙিন কথা। আলগোছে রাখা থাকে। সাজানো শপিং মলের বাইরে যেমন রঙচঙে বেলুন। বিকিকিনির এত বিপুল আয়োজন। তবু ওই বেলুনের লোভে কে যেন হাত বাড়ায়! ওই বেলুন আকাশের খোলা মন চেনে, সেদিকেই যেতে চায়। সিলিং-এ তার মাথা ঠেকে না। কথায় কথা বাড়িয়ে এখন কথার যে-দোকান সাজানো, মনের কথার সেখানে ঘাড়ধাক্কা। মেসবালক কুড়িয়ে নেয় তাই ওই রঙিন কথার দু’টুকরো। সে দেখে, এই কথার গায়ে এখনও পথ আছে। সে-পথ এমন একটা কোথাও যায়, যেখানে মানুষ কেবল সবুজ আলো নয়। মেসে থাকতেই আমরা জানতাম যে, এই জীবন আমাদের নিয়ে লোফালুফি শুরু করেছে। পড়া শেষে ছড়িয়ে পড়া অবধারিত। বিশ্বায়ন যে-প্রজন্মকে হাতে ধরে মানুষ করেছে, তাদের কাছে মেস এসেছিল শূন্য দশকের যাবতীয় বিষ ও বিস্ময় নিয়েই।
……………………………………………..
জীবনের রতি আর আরতি থেকে দূরের এই মেস আসলে দ্বন্দ্ব আর দণ্ড-জীবনের আগের দু’দণ্ড বনলতা। অনেকখানি মায়া-প্রকল্প। যা আসলে ঘাম-শ্রমের মানুষগন্ধ বেঁচে থাকাকে সাপটে ধরতে চায়, ভাত আর মাংসের গন্ধকে ফুলের গন্ধের থেকে জরুরি হিসাবেই জানে, তবু এক বিবিক্ত বেঁচে থাকার ভিতরই তাকে ঢুকে পড়তে হবে।
……………………………………………..
মেসবালক মাত্রই জানে, একদা ঠেকা-দেওয়া জীবনের সাদামাটা পোশাকখানা ছেড়ে রাখার জায়গা আর মেস নয়। হ্যাঁ, অগোছালোপনা কিছু থাকে বইকি! দেওয়ালে খানিক অগ্রাহ্যের নোংরা-ঝুল। তবে সাড়ে চুয়াত্তরীয় মেদুরতা এই মেসের কপালে নেই। ছেঁড়া-ফাটা জীবন সত্ত্বেও আনন্দ করে হইহই গানের জন্য নয় এই মেস। রিফুর দিন শেষ। জীবনের ফুটোফাটায় সেলাই চলবে না আর। চাইলে তুমি নিজেকেই বাতিল করে নতুন তোমাকে বিকিয়ে দিতে পারো বাজারে। অতএব এই মেস যেন অনেকখানি গুপ্তসমিতি, যা কি না আগামীর পৃথিবীকে সাপ্লাই দেবে নতুন মানুষ, নতুন নতুন এমপ্লয়ি আইডি। এই সব আইডি-র কোনও দেশ নেই, তার কাছের মানুষ নেই। আছে বলতে এক অলীকসুখের খোঁজ। সেই মহাশূন্যে ভেসে থাকার আগের স্টেশন আমাদের মেস। জীবনের রতি আর আরতি থেকে দূরের এই মেস আসলে দ্বন্দ্ব আর দণ্ড-জীবনের আগের দু’দণ্ড বনলতা। অনেকখানি মায়া-প্রকল্প। যা আসলে ঘাম-শ্রমের মানুষগন্ধ বেঁচে থাকাকে সাপটে ধরতে চায়, ভাত আর মাংসের গন্ধকে ফুলের গন্ধের থেকে জরুরি হিসাবেই জানে, তবু এক বিবিক্ত বেঁচে থাকার ভিতরই তাকে ঢুকে পড়তে হবে। নতুন পৃথিবীর তালে ঘুরতে থাকা সেই স্পেসক্রাফট, সামান্থা হার্ভ জানবেন না, আমরা তবু ‘so together, so alone, that even their thoughts, their internal mythologies, at times convene.’ সেই সব সময়ই মনে পড়ে যাবে মেসের কথা। এক জীবন, এক মেস। মনে পড়ে যাবে, দৌড়জীবনের ক্লান্তির ওপারে এখনও যেন আছে সেই বিবর্ণ ধূসর বিন্দু, আমাদের ঘর, আমাদের জিজীবিষা।
অথচ এমন মহার্ঘ তো কিছু নয়। মাহাত্ম্যহীন সেই সব সংস্কার, আজ ফিরে দেখলে নস্ট্যালজিয়ায় অ্যাডেড সুগারে এক্সট্রা জিএসটি বসারই কথা। বাথরুমের হাল আহামরি কিছু ছিল না। অন্যের সাবান গায়ে মেখে ফেলার ভিতর আর যা-ই থাক, স্বাস্থ্য নেই। অন্যের বডি-স্প্রে গায়ে ঢেলে নিজের ঘামকে আর কতদিন গোপন করা যায়! এ এক ধরনের চলতি ব্যবস্থা। যা এই সব কিছুর উপরই ভবিষ্যতে দখল নিতে শেখাবে। বস্তু-জীবনের সেই দখল নেওয়া সম্পূর্ণ হলে জেগে থাকবে এক রকম ভাবের ঘরে চুরি। স্মৃতি নিয়ে মৃদু মৃদু অপেক্ষার মোমবাতি। অতএব মেসবালক, তুমিও তাহলে স্মৃতির ঘরে ভাবের রাখাল মাত্র! উদয়নদার চালু করা রসুন ভাজা, রামানুজ-চম্পকদের সিদল শুঁটকি, কিংবা মেসের অরণ্যের দু’-চার প্রাচীন প্রবাদ তোমার সঙ্গে থেকে গিয়েছে। তবে তুমি খেয়াল করে দেখবে, হরেক মাল তিরিশের জীবন কোনওকালেই ছিল না তোমার। তুমি যে মাটি চিনেছ সেই মাটিতেই বুকে হেঁটে চলেছ। যেমন সে এসেছিল। তখন তোমার মেস ভেঙে গেছে। লাইফ-লাইন কর্ড আর মেনের হিসাব কষে যেদিকে সিগনাল পেয়েছে তাতে মেসে আর থাকার সম্ভাবনাও নেই। সকলেই প্রত্যেকে ব্যস্ত। ভুবনেশ্বর, বেঙ্গালুরু, ঝাড়খণ্ড, শিকাগো যাদের মেস থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে, তাদের আর ফেরত দেবে না কোনও দিন। এর মধ্যে শহরের প্রেত যে শহরেই থেকে যাবে, তার সম্বল আস্ত এক পোড়োবাড়ি। আর স্মৃতি দিয়ে বিস্মৃতির যুদ্ধ জিততে চাওয়া প্রতিদিন। প্রতিদিন তার কফি হাউস, হইহল্লা, আড্ডা আর ফিরে আসা সেই এক প্রাচীন গর্তে। সে প্রত্যাশা করে শীতঘুম। যদিও জাড় নেই, কাঁটা নেই। উষ্ণায়ন তাকে গিলে ফেলে। যাপিত সকল ভ্রমণ তাপিত বটে, এবার তাই-ই বুঝে নেওয়ার পালা। যে-পথে যেতে হবে, সে-পথে তুমি একা।
আর সেদিন তুমি দেখবে সে এসে বুকে হেঁটে বসে আছে তোমারই গর্তের ভিতর। মেসবালক ততদিনে আর পড়ুয়া নেই। তার বেকারত্বে পর্দা পড়েছে। উনিশ শতকের লিগ্যাসির ছেঁড়া কাঁথা গায়ে টেনে সে এখন চাকুরিজীবী। মায়বন জীবনে সে এখন হরিণীর জন্য একক। আর তখন এক মস্ত শখে সে মজেছে। যে-মেস তার হাতছাড়া, সেই বাড়িটাকেই সে বসত বানিয়েছে। বাড়তি ভাড়ায়। এক চৌকির জীবনে এতখানি জায়গা যে কী কাজে লাগে! তুমি বিস্ময়ে দেখো। দেখো, জানলা থেকে যে রোদ এসে রোজ মেঝেতে হুটোপুটি করে সেখানে তোমার বন্ধুরা বসে আছে। মেঝেতে ডিম ভাগ করে সকলকে তুমি খেতে দিচ্ছ, যেমন তুমি দিতে আজীবন। দেখো, যে চৌকিগুলো বিদেয় হয়ে গিয়েছে, সেগুলোর ছায়া এখনও লেগে আছে ঘরের কোনায় কোনায়। ফাঁকা বাড়ির ষড় ব্যর্থ করে দিব্যি মেস ঘনাইছে ছায়ায় ছায়ায়। তোমার সঙ্গে আছে সেই রান্না-মাসি, যে-মাসি তোমার আর তোমার বন্ধুদের সঙ্গে ছিল গত কয়েক বছর। যে-মাসি তোমার সঙ্গে থেকে যাবে ঘটমান বর্তমানে। এইসব বিলাসে বাড়তি কিছু টাকা দরকার। চাকরির চেক-কে মাস চেকমেট করে দেয় দিন বারো পেরোতে না পেরোতেই। অতএব সহায় রবি ঠাকুর। তুমি তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে থাকার একটা কাজ পেয়ে গেলে। গড়িয়াহাট ফুটপাথে যে ভদ্রলোক তাঁর গীতবিতান বিক্রি করেছিলেন, আর যা তুমি কিনেছিলে মেসে থাকতে থাকতে, সেই ভদ্রলোককে আর একবার মনে মনে ধন্যবাদ দাও। খুঁজে খুঁজে কিনে ফেল শঙ্খ ঘোষ, রবীন্দ্র অনুষঙ্গ- খণ্ড ৫, ৬; আইয়ুব, মুজতবা আলী, প্র-ণা-বি ইত্যাদি। তুমি ভাবো, মানবজমিন কেন তুমি থাকবে পতিত! অতএব, কৃষিকাজ, সামান্যই। আর চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে চলছে খানিক চাকরি-জীবন। একদিন সেই চাকরিতে বেরোতে গিয়েই দেখলে বাথরুমের কোনায় সে এসে বসে আছে। এত বছরে সে কোনও দিন আসেনি, যখন কাছে তোমার বন্ধুরা ছিল। সে কি মূর্তিমান বিপদ! তা তো বটেই। তার কাছে আছে বিষ। কিন্তু মেসবালক, এই যে এখন বন্ধুবিহনে তুমি ভয় পাচ্ছ, এই যে বিচলিত হয়ে ভাবছ, কাকে ডাকব, কোথায় পালাব– এইটেই তোমার উপলব্ধি। মেস আর না-মেসের তফাত। বাড়ি তো মেস নয়, ছায়া দিয়ে কায়া আঁকা খেলা হতে পারে, বাস্তবিক অবাস্তব। বুঝি এটুকু বোঝাতেই সে এসেছে, যে নির্জনতাপ্রিয়। একাকী লুকিয়ে কোনায় বেঁচে থাকা, তোমারই মতো কেউ একজন। সে ক্ষতি করছে না। ক্ষতি হয়তো চাইছেও না। সম্ভাব্য ক্ষতির ভয় অথচ তোমাকে কিছুতেই ছাড়ছে না। তুমি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলে বাথরুম থেকে।
হাততালি হুস্ দিতে সে-ও বেরিয়ে এল। বাইরেই বেসিনের নিচে গিয়ে থিতু হল। তুমি আন্দাজ করলে, বেসিনের নল যে-পথে বাইরে গেছে সেই পথেই হয়তো সে এসেছে কোনওক্রমে। এখন আর কিছুতেই যেতে পারছে না। চাইছেও না। অতএব ওই বেসিনের তলাতেই কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়ে আছে। নাহ্, এখনও সে ক্ষতি করছে না। এমনকী, নিজেও ত্রস্ত নয়। এবার তুমি কী করবে? তাকে ছেড়ে রেখে বাইরে চলেও যেতে পারছ না। এত বড় ঘরে কোথায় সে চলে যাবে, তুমি জানো না। চোখের আড়াল করা যায় না। গলা উঁচিয়ে অতএব তুমি ডাক দাও। আর ওপর থেকে নেমে আসেন সেই বাড়ির দিদি। অনেক চেষ্টা করেন। তাকে নড়ানো যায় না। ততক্ষণে আসেন আর এক দাদা। আবার চেষ্টা। আবার না চলে যাওয়ার পণ। অগত্যা বাড়ি থেকে খানিক অ্যাসিড জোগাড় করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তার গায়ে। ধারণা ছিল, অ্যাসিডের গন্ধে সে চলে যাবে, যেদিকে দু’চোখ যায়। আদতে তা হল না। সে যেতেই পারল না কোথাও। একটু একটু করে জলজ্যান্ত পুড়ে গেল। অনেক পরে তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হল দূরের ঝোপে। আর কুণ্ডলী পাকানো একখানা অ্যাসিড-জ্বলা শরীরের ছাপ লেগে রইল বেসিনের তলায়। থেকে গেল অনেক দিন। তুমি তার কাছাকাছি যেতে পারো না। ভয়ে নয়, অপরাধে।
এই বাড়ি অতএব তুমি ছেড়ে দেবে এবার। এই মেস। আপাতত আর তোমার মেসে ফেরা হবে না। আর তখন তুমি তোমার বহমান বর্তমানেই একটা করে মেস গড়ে তুলতে চাইবে। যখন যেখানে, তখন সেখানে। জীবনের জ্যাকেট যদিও এতদিনে পাল্টে গেছে। পুস্তানিতে ছাপা নতুন নামজীবন। তুমি জানো, যে-আখ্যানের ব্যাক কাভার অবধি তোমাকে এবার পৌঁছতে হবে, সেখানে মেস গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেননা প্রতি পরিচ্ছেদের আলাদা ডিমান্ড। তারা তাদের মতো করে গুছিয়ে নিতে চায় নিজেকে। তাও তোমার চেষ্টার ত্রুটি নেই। তুমি ভাবো, ভালো ব্যবহার দিয়ে নিশ্চিতই একটা অমরাবতী গড়ে তোলা যায়। আদতে তো চারপাশে সকলে মানুষ-ই। প্রতি পরিচ্ছেদে তার যে পরিচয়, যে চরিত্রনাম দেওয়া হোক না কেন, সে কি বন্ধু হতে পারে না! হতে পারে না কমরেড! মানুষ চায় কী! তোমার মেস শিখিয়েছে, সে চায় স্বাধীনতা, ভালোবাসা আর এমপ্যাথি। তুমি তা দিয়েই তোমার চারপাশ জড়িয়ে ধরতে চাও। তুমি জানো, যাবতীয় তত্ত্বের বহুদূরে পড়ে আছে একখানা সোনার তরী। সে তোমার জীবন। তোমাদের জীবন। যদি এক আনা তত্ত্ব জীবনে ফলাতে পারো, তাহলে বুঝবে আবাদ আর সোনার সম্পর্ক! তুমি হাত বাড়াও। আর সাপুড়ে জীবন ভাবে, তুমি দুর্বল। তোমার স্বর নেই। ফোঁস নেই। তোমার মৃদুতা আসলে আত্মবিশ্বাসের অভাব। সে তোমাকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে যেতে চায় কেন্দ্রের কাছাকাছি। তুমি যেতে চাও না। না তা তোমার উদ্দিষ্ট, না তুমি হতে চাও উচ্ছিষ্ট। তুমি অনড় থাকো। আর তোমার সেই কুঁকড়ে যাওয়া মার্জিনের জীবনে তখন কারা যেন ভালোবেসে ছিটিয়ে দেয় অ্যাসিড।
তথাপি তোমার কীই-বা করার আছে, মেসবালক! অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ। ওই নির্জন পোড়োবাড়িটার কাছে তোমাকে এক জীবনে বারবার ফিরতেই হয়। যে-কোনও এক ছিদ্রপথে তুমি সেখানে ঢুকে পড়ো। বুকে হেঁটে, চেনা মাটিতে। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে দৈনন্দিন দ্রোহে তোমার এই অতর্কিতে ঢুকে পড়াটুকুই সম্বল। কোথায় পালাবে, কোন সন্ন্যাসে! নখ বিঁধে গেছে তোমার বল্কলে। তুমি মেস গড়ো। কমিউন। আর সে-মেস ভেঙে যায়। ভেঙে দেয় তোমারই প্রতিবেশ। যৌথতা এখানে বিষ। আর এই সুখ-শখের মনোহারি জীবন বিষহরি। মেস তাহলে তুমি আর পাবে কোথায়! চকচকে লোভের বিন বাজে। যারা বাজায় তাদের তুমি চিনতে পারো শুরুতেই। তবু মেসের অভ্যাসে তুমি ভাবো, পাশাপাশি চৌকিতে কে আর কার সর্বনাশ ভাবতে পারে! তুমি মনে মনে ভাবতে শুরু করো মেস। পাবে না জেনেও জেদ ধরে থাকো বলেই তোমাকে রোজ সহ্য করতে হবে অ্যাসিড। আর জ্বলতে-জ্বলতে পুড়তে-পুড়তে অঙ্গার-জীবন হয়ে তুমি ক্রমশ লেগে থাকবে এক অলৌকিক মেসবাড়ির বেসিনের তলায়, স্যাঁতসেতে অন্ধকারে।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
এই তোমার স্মৃতি-বিস্মৃতি। এই তোমার মাধুকরী। এই তোমার পুড়ে-খাক বেঁচে থাকা। এ থেকে তোমার মুক্তি কোথায়, মেসবালক? সেই মুক্তি কি তুমি আদৌ চাও! চাও যদি তবে কেন-ই বা একদিন লিখতে বসলে–
মেস মূলত নাছোড়বান্দা বদভ্যেস, কারও কারও থাকে…
………………………… সমাপ্ত …………………………
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭। যেখানে কল নেই শহরের সেখানেও কলতলা
পর্ব ১৬। তুমি তো তেমন ফেরিওলা নও, চাকরি হবে কী করে!
পর্ব ১৫। বেকারদের মেসে বিশ্ব এসে মেশে
পর্ব ১৪। বেকারদের মেসে বিশ্ব এসে মেশে
পর্ব ১৩। মেস আমাদের শিখিয়েছে, দেশ অনেক রকম
পর্ব ১২। মেসবাসীর হিসাবশাস্ত্র এমন কুটিল যে স্বয়ং কৌটিল্যও তল পান না
পর্ব ১১। ছেড়ে যাওয়া ঘরে মেরা কুছ সামান থেকেই যায়
পর্ব ১০। বই বন্ধ করলেও, বন্ধ হয় না কিছু কিছু বই
পর্ব ৯। বোবার শত্রু নেই, বন্ধু তো আছে
পর্ব ৮। মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক!
পর্ব ৭। যে ভাতের হোটেলে মাছকে ‘তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া’ বলতে হবে না, সেখানেই রোজের বেঞ্চি বুক করতাম
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না