বিয়ের পরপরই মিসেস ওয়াড়িয়া হাতে নিলেন ঘরের কোম্পানি, বম্বে ডাইং। পুরো বিজ্ঞাপন বিভাগটাই দেখতে শুরু করলেন নিজে। প্রিয় মডেল করণ কাপুর, অভিনেতা শশী কাপুরের ছেলে, আর সুন্দরী মডেল লিজা রে-কে নিয়ে উনি করলেন অদ্ভুত, নতুন ধরনের বিজ্ঞাপনের ঢং। তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন এসেছে। এরপর শুরু করলেন ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘গ্ল্যাডর্যাগস’ এবং নিজেই এডিটর। অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সে ম্যাগাজিন। পাতা সাজানোর একটা ছোট সহকারী শিল্পীর দল ছিল। মিসেস ওয়াড়িয়া খুঁজছিলেন সম্পূর্ণ ম্যাগাজিনটা সাজানোর এবং আধুনিক রূপ দেওয়ার একজন নির্দেশক ডিজাইনার। সেই কাজটার জন্য প্রীতীশদা আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন ওঁর সঙ্গে।
৭.
শুধু আমার নয়, জীবনে যাপনে সবার কপালে থাকে নানা পাকদণ্ডি। আর ভালো বাংলায় যাকে বলে অপ্রত্যাশিত ছিন্ন কক্ষপথ। প্রায় বছর কুড়ি সরকারি অফিস, বিজ্ঞান মিউজিয়ামে কাজ করে বাঁধা ছন্দে চলছিল জীবন। হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল, পুরো সময়ের জন্য ছবি আঁকতে চাই। ছাড়া পাখির মতো উড়ে বেড়াতে চাই। অনেকটা উঁচু পদে থাকা সত্ত্বেও সাহস করে ছেড়েই দিলাম সরকারি চাকরি। তেমনই একটা টার্নিং পয়েন্টে আমি যেন বিশাল ক্যারমবোর্ডের মাঠে ক্যারমের ঘুটি। অদ্ভুত অদৃশ্য কারও আঙুলের জোর ধাক্কায় অগোছালো এই অধম দ্রুত চারিদিকে দেয়ালে দেয়ালে ঠোক্কর খেতে খেতে, নানা রকমের অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আবার যেন কুয়োর মধ্যেই এসে পড়লাম। মানে উত্তর-দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে, দেশ-কাল-পাত্র, শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ হয়ে যেমন ছিলাম তেমনই হয়ে গেলাম। কী না ছিল দিকে দিকে, দেওয়ালে দেওয়ালে। কখনও বিস্কুট, রেসের মাঠে ঘোড়া কিংবা উড়োজাহাজ। কখনও আবার আমাদের অনেক চেনা-অচেনা অতীব সুন্দরী মেয়েদের মুখ, হাইভোল্টেজ সুন্দরী তারা, দুনিয়ার সেরা মেধাবীরা। মধ্যমেধার আকর্ষণীয় পুরুষালী শরীর কিছু কিছু। দিনে, রাতে কাজে বেরয় মেয়েরা, তাই মেয়েদের রাতের কথা। এছাড়া হাই-ফাই ফোটোগ্রাফি, ছাপাখানা, যুদ্ধ-জাহাজ বানানো থেকে কলকারখানার মালিক। এই পাত্রপাত্রীরা কখন যে কোথায় কোন শহরে, ঠিক নেই। খানিকটা মন্তাজের মতো, কোলাজের মতো অ-সাধারণ মানুষের মুখের ভিড়। ‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে’ মার্কা আমার কপালে এসব কেন জুটল, ভেবে অবাক হই এখন।
ঠাট্টা করে বিস্কুটও আছে আবার উড়োজাহাজও বলছিলাম, কিন্তু সত্যিকারের ব্যাপারটা তাই। বিস্কুট বলতে আমাদের প্রত্যেকে পরিচিত ‘ব্রিটানিয়া’, একশো বছরেরও বেশি বয়সের কোম্পানির মালিকের কথা এখানে বলছি। ওঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন শিপ্ বিল্ডার্স, জাহাজ বানানোর লোক। বাবা জাহাজ বানাতেন, তাও আবার ব্রিটিশ নেভির জন্য, আর ছেলে ‘গো এয়ার’ উড়োজাহাজের কারবারি। তিনি বম্বে ডাইং-এর চেয়ারম্যান, বনেদি পারসি পরিবারের মানুষ, বণিক, উদ্যোগী, ইন্ডিয়ান টাইকুন, নাসলি ওয়াড়িয়া। ওঁর আরও বড় পরিচয়, মা, দিনা ওয়াড়িয়া জিন্না, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নার কন্যা। অর্থাৎ নাসলি, জিন্নার নাতি। এহেন বিশাল মাপের মানুষটার সঙ্গে শুধু আলাপ নয়, ওঁর বসবাসের ঘরের মধ্যে প্রবেশের অধিকার। মেঝেতে অবর্ণনীয় সুন্দর কার্পেট, দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি আর ট্যাপেস্ট্রি। প্রসঙ্গত, উনি আমার ছবিও সংগ্রহ করেছিলেন। শুধু ছবি আঁকি এইটুকু গুণের জন্যই আমি ওঁর ঘরে। এটাকে ভাগ্য বলব নাকি দুর্ঘটনা! সেদিন আমাদের দু’জনের হাতে চায়ের কাপ। আমায় যত্ন করে দেখাচ্ছেন ওঁর সংগ্রহের সম্ভার আর শোনাচ্ছেন তাদের সংগ্রহের কাহিনি। এমন একজনকে সূত্র ধরে বলব অন্য আর একজনের কাহিনি।
জেদের বশে চাকরি তো ছেড়েছি কিন্তু ঘরে মন টেকে না। বম্বের লোকাল ট্রেন। কোলাহল। বন্ধুবান্ধব, দশটা-পাঁচটা, মাস পয়লা মাইনে– এসবই মাথায় চেপে বসে আছে। ছবি আঁকা শিকেয় উঠল। সবাই কেমন কাজের নেশায় ছুটছে আর আমি গৃহবন্দি হয়ে বসে আছি মনে হচ্ছে। এইভাবে কাঁহাতক? শেষে প্রীতীশদা মানে প্রীতীশ নন্দীর হাত ধরে যার সামনে এসে দাঁড়ালাম তিনি আমার বিপত্তারিণী, মিসেস মরিন ওয়াড়িয়া। নাসলি ওয়াড়িয়ার সহধর্মিনী। জেদি, আত্মসম্মানী নারী। বলতেন, ‘আমি নাসলির রূপসী বউ হয়ে ঘরে বসে থাকতে চাই না। আমি যা আমি তাই, আমাকে কী হতে হবে অথবা আমার কী হওয়া উচিত তাতে কারও ধার ধারি না।’ এটা তাঁর কথার কথা নয়, সত্যিকারের কিছু করে দেখানোর অদম্য উৎসাহ। প্রথম জীবনে মডেলিং এবং পরে এয়ার ইন্ডিয়ায় বিমান সেবিকার কাজে নিযুক্ত ছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া।
গ্ল্যামার জগতের সঙ্গে ওঁর আসল প্রেম-প্রীতি শুরু হয় এয়ার ইন্ডিয়ার কাজ ছাড়ার পর থেকে। স্বামী, নাসলি ওয়াড়িয়া কখনও তাঁর কাজে এবং ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বিয়ের পরপরই মিসেস ওয়াড়িয়া হাতে নিলেন ঘরের কোম্পানি, বম্বে ডাইং। পুরো বিজ্ঞাপন বিভাগটাই দেখতে শুরু করলেন নিজে। প্রিয় মডেল করণ কাপুর, অভিনেতা শশী কাপুরের ছেলে, আর সুন্দরী মডেল লিজা রে-কে নিয়ে উনি করলেন অদ্ভুত, নতুন ধরনের বিজ্ঞাপনের ঢং। তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন এসেছে। এরপর শুরু করলেন ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘গ্ল্যাডর্যাগস’ এবং নিজেই এডিটর। অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সে ম্যাগাজিন। পাতা সাজানোর একটা ছোট সহকারী শিল্পীর দল ছিল। মিসেস ওয়াড়িয়া খুঁজছিলেন সম্পূর্ণ ম্যাগাজিনটা সাজানোর এবং আধুনিক রূপ দেওয়ার একজন নির্দেশক ডিজাইনার। সেই কাজটার জন্য প্রীতীশদা আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন ওঁর সঙ্গে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। তবে আর্ট কলেজের শিক্ষার পরে ততক্ষণে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। গোটা পঁচিশেক বছর বিজ্ঞাপন জগতে, বই পাড়ায়, সিনেমা-থিয়েটারে এবং মিউজিয়ামের জগতে নানা জায়গায়, দেশে এবং বিদেশে ঘুরে কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারই ওপর ভরসা করে কাজটা নিলাম। পার্ট টাইম কাজ, দিনে ঘণ্টা তিনেক।
গ্ল্যাডর্যাগস-এর অফিসের জায়গাটা ভারি চমৎকার, সমুদ্রের ধারে মুম্বইয়ের প্রভাদেবী-তে। কাছাকাছি রবীন্দ্র নাট্যমন্দির আর খুব জাগ্রত দেবতা সিদ্ধিবিনায়কের মন্দিরটাও ওই পাড়ায়। কিস্মত টকিজ স্টপেজ থেকে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে সরু গলি। সেই গলিতেই বিখ্যাত টাটা প্রেস আর বাঁদিকে ওই অঞ্চলেই আরেকটি নামকরা কাগজ স্টারডাস্ট-এর অফিস। গলির শেষে সমুদ্রের কাছাকাছি গিয়ে বিচ টাওয়ারে গোটা চার-পাঁচেক ঘর জুড়ে গ্ল্যাডর্যাগস-এর অফিস। সমুদ্রের দিকে লাগোয়া বিল্ডিং বিচ হাউস, ওয়াড়িয়া পরিবারের বসতবাড়ি। তাই মিসেস ওয়াড়িয়া যখন তখন একবার বাড়ি, একবার অফিস করতে পারতেন। বাড়ির কাজে তিনি ঘুরে এলেন, অফিসে ডাক পড়লে আবার ছুটে চলে এলেন। এভাবেই সংসার এবং অফিস একসঙ্গেই করতেন। মজার ব্যাপার, অফিসের টিফিনে খাওয়ার জন্য বাড়ি যেতেন না মিসেস ওয়াড়িয়া, টিফিন কৌটোয় করে খাবার আনতেন। অফিসে বসে সেটা খেতে পছন্দ করতেন। আমরাও কখনও কখনও ওঁর টিফিন কৌটোর খাবারে ভাগ বসাতাম।
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে। সেটা বুঝলাম এই বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে এসে। সারা দেশের সিংহভাগ বেডশিট কিন্তু বম্বে ডাইং-এর। ডিজাইন স্টুডিও-তে আমাদের কলকাতা আর্ট কলেজের পুরনো কিছু শিল্পীদের দেখলাম। আমাকে পাঠানো হল ওদের সঙ্গে ডিজাইনের আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা করতে আর ছবি, অর্থাৎ আধুনিক পেইন্টিং থেকে কীভাবে ডিজাইন করা যায় বিছানার চাদর বা পর্দার সে ব্যাপারেও পরামর্শ দিতে। করেছিলাম বম্বে ডাইং-এর ক্যালেন্ডার ডিজাইন। মডেল, জনপ্রিয় লিজা রে। লিজার ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল আমার পেইন্টিং। ৮০ বাই ৬০ ইঞ্চি সাইজের বড় বড় জলরঙের ছবি এঁকেছিলাম। মডেল, ছবি, আলো মিলিয়ে তৈরি হল আর এক ছবি। ফোটোগ্রাফার, অশোক সেলিয়ান।
ফ্যাশন ফোটোগ্রাফার অশোক সেলিয়ান। কোনও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিত ফোটোগ্রাফার নয়। প্রচণ্ড পরিশ্রম এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পাগলের মতো কাজ করে তাঁর একটা নিজস্বতা তৈরি করেছেন খুব কম সময়ে। অশোক বলতে গেলে তার তরুণ বয়সে ফটোগ্রাফি শুরু করেন আর গ্ল্যাডর্যাগস-এর হাত ধরে পরবর্তীকালে একজন সেলিব্রিটি ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠেন। নিজের ছবি সম্পর্কে এবং মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা বোঝার অদ্ভুত গুণ ছিল ওঁর। অশোকের ধারণা, ফ্যাশন ফটোগ্রাফার আসলে একজন সাইকোলজিস্ট। মানুষ নিয়ে কারবার, তাই মানবিক কারণগুলোকে অবজ্ঞা করা বা ভুলে গেলে চলবে না। ফিল্মে শুটিংয়ের দিন তখন, ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। পোলারয়েড ক্যামেরাতে প্রথমে খসড়ার মতো আলো করে দেখে নেওয়া হত, তারপরে সেই অনুযায়ী আলো ফাইনাল করা। মডেলদের পোশাক-আশাকের রং, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র, দাঁড়ানো বসার ভঙ্গিমা, হাত কোথায় থাকবে, উঁচুতে-নিচুতে ঘাড় কোথায় ঘুরবে, মুখের এক্সপ্রেশন ইত্যাদি আমাকে দেখতে হত। ছবি আঁকা থেকে খানিকটা, মঞ্চে অভিনয় থেকে এবং নাচের অল্প জ্ঞান মিলিয়ে আমার এই ডাইরেকশনের কাজটা করতে বেগ পেতে হয়নি তেমন। এই কাজে শিল্পী বা ফটোগ্রাফার যেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে, অন্যদিকে মডেল বা হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিত্ব তারাও প্রভাব খাটাতে পারে। অশোকের মন বলত মডেল-এর সঙ্গে ঠিক ঠিক কমিউনিকেট করতে পারলেই চরিত্রটি ভালোমতো ধরা পড়বে এবং তখনই কাজের শেষে ছবিটি কথা বলবে।
সময়টা নয়ের দশকের গোড়ার দিক। বিচ হাউসে যাতায়াত করে আর টিফিনের খাবার খেয়ে-দেয়ে মোটামুটি স্বচ্ছন্দ পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং মিসেস ওয়াড়িয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য কাজের পরিবেশটাও এগোচ্ছে আর অদ্ভুতভাবে আমার ডিজাইন ওঁকে পছন্দ করাতে এবং ওঁর সায় নিতে সহজ হয়ে আসছে। অনেক অনেক সুন্দরী মেয়ে বাছাই, তার প্রতিযোগিতা, এমনকী, ছেলেদের ক্ষেত্রে ম্যানহান্ট প্রতিযোগিতাও উনি করছিলেন সে সময়। এটা ওঁর খেয়াল, খেলা বা একটা চ্যালেঞ্জ। এসবই যখন দেখছি, বুঝছি, বোঝার চেষ্টা করছি তখন কাজের পরিধিটা গেল বেড়ে। মুম্বইয়ের ছোট ক্ষেত্র রইল না আর, রাজ্যেও নয় একেবারেই চলে গেল দেশের এবং পৃথিবীর খেলায়। অনেককে অবাক করে সুস্মিতা সেন নামে এক দলছাড়া বাঙালি মেয়ে ‘মিস ইন্ডিয়া’ হয়ে গেল হঠাৎ। মিস ইন্ডিয়া জিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিস ইউনিভার্স কিংবা মিস ওয়ার্ল্ডের জন্য কম্পিটিশনে যায়। সুস্মিতা সেনকে নিয়ে আমার ভালো লাগার আর মমতার শেষ নেই। বম্বের লোক শুরুতে আপন করে নিতে পারেনি সুস্মিতাকে।
প্রস্তুতি শুরু হল, সুস্মিতার পৃথিবীর বাজারে নামার পালা। যেতে হবে মিস ইউনিভার্স-এর প্রতিযোগিতায়। সুস্মিতার তো ভীষণ আনন্দ । কিন্তু একটা গোলমাল ঘটে গেল! ওর কর্মকর্তাদের হাতে রাখা পাসপোর্টটা হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যিকারের হারিয়ে গিয়েছিল নাকি পাসপোর্টটা পাওয়া যাচ্ছিল না– সেটা নিয়ে একটা ধাঁধা। অর্গানাইজাররা বলছিল, তুমি যদি না যেতে পারো কোনও কারণে তাহলে রানার আপ যেতে পারে। পরেরটা অর্থাৎ মিস ওয়ার্ল্ড-এর বেলায় তুমি যেও। খুব কান্না পেয়ে গেল সুস্মিতার, বাবার কাছে গিয়ে বললেন, যে আমি এইখানে ছাড়া কোথাও যাব না। সেবারে মিস ইন্ডিয়ার রানার আপ, মানে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ঐশ্বর্য রাই। ঐশ্বর্য রাইকে পাঠানোর ইচ্ছেটাই বেশি হবে বম্বের লোকদের। আমি এই সবগুলো দেখছিলাম গ্ল্যাডব়্যাগ্স-এর অফিসে কাজ করার সময়। কারণ ফ্যাশন ম্যাগাজিনে এই বিউটি কনটেস্টের সমস্ত খবর যেতেই হবে। সুস্মিতার কান্নাকাটি দেখে ওর বাবা রাজেশ পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং শেষপর্যন্ত পাসপোর্ট এর ব্যবস্থা হয়। এই প্রথম ভারতীয় হিসেবে মিস ইউনিভার্স খেতাব জিতে নিয়ে আসেন সুস্মিতা সেন। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, আগেকার দিনে সমস্ত সুন্দরী মেয়ের প্রতিযোগিতায় তাদের যে জিনিসটা দেখা হত সেটা শারীরিক সৌন্দর্য। এই মিস ইউনিভার্স-এর বেলা থেকে আমরা দেখলাম, মেয়েদের শুধু দেহ সৌন্দর্য নয়, তাদের মগজের, মেধার পরীক্ষাও নেয়া হচ্ছিল। তাদের বুদ্ধিমত্তার বিচার কখনও মৌখিক, কখনও লিখিত রচনা-নির্ভর।
ঐশ্বর্য রাই সেবারে পরপরই মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় জিতলেন। ঐশ্বর্যকে প্রথম দেখি রেসের মাঠে। তখন অবশ্য ঐশ্বর্য রাই বচ্চন নন, মানে অমিতাভ বচ্চনের পুত্রবধূ হওয়ার কোনও নামগন্ধ ছিল না। বম্বের মহালক্ষ্মী রেসকোর্সের অন্দরের দৃশ্য চাক্ষুষ করাও প্রথম। জীবনে সেই প্রথম রেসের মাঠে যাওয়া। মিসেস ওয়াড়িয়া ঠিক করলেন যে, এবারে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে পারিবারিক ‘ওয়াড়িয়া গোল্ড কাপ’ ঘোড়দৌড় শুরু হওয়ার আগে সেখানে একটা মঞ্চের অনুষ্ঠান হোক বিনোদনের জন্য। সুন্দরী মডেলদের দিয়ে উনি ফ্যাশন প্যারেড করালেন রেসের মাঠে। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে বিচিত্র সব মানুষের মেলা। গল্প-উপন্যাস সিনেমার মতো ধনীরা শখে, নির্ধন তার ভাগ্য ফেরানোর আশায়। একদিনেই অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয়েছিল খুব কাছ থেকেই। কারণ ঘোড়দৌড়ে ওয়াড়িয়া গোল্ড কাপ। অর্গানাইজারদের সঙ্গে আমরা গেছি, আয়োজকদের একটা অংশ আমরা। আমাদের অবাধ বিচরণ আনাচে-কানাচে। সেখানে মনে আছে রেসের আগে ঘোড়াগুলোর তাদের নামসমেত এবং তাদের জকিদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন দর্শকদের সঙ্গে। খুব কাছ থেকে দেখলাম, কম ওজনের ছোট ছোট সাইজের মানুষ হতে হয় এই জকিদের। আর সেইখানে প্যারেডে হাঁটায় গ্ল্যাডর্যাগস-এর মডেলদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন ঐশ্বর্য রাই, ঘোড়দৌড়ের মাঠে।
পরিশেষে, শুরুর কথা টেনে বলি, ক্যারমের ঘুঁটির মতো অগোছালো ঠোক্কর খেতে খেতে এই যে ফিরে এলাম এর কয়েকটা ক্ষেত্রে ছিল আমার হাতেখড়ি আর নতুন অভিজ্ঞতা। সহানুভূতিশীল মানুষগুলোর জন্যই আমার এই যাত্রায় জার্নি ছিল সহজ সুন্দর সচল সচ্ছল। সময়টা অল্প দিনেই কেমন বদলে যাচ্ছে। এ তো সেই সেদিনের কথা, বছর তিরিশেক। স্লো মোশনে ফিরে দেখছি… শিল্প আর ফ্যাশন, একটি জটিল সৃজনশীল সংলাপের মতো। শিল্পকর্ম সাধারণত অনুপ্রেরণার একটি ফর্ম হিসাবে কাজ করে, যখন ফ্যাশনটি তার সঙ্গে যোগদান করে তখন মানুষ আনন্দে তাকে অঙ্গে ধারণ করে।… রেসের দ্রুতগামী ঘোড়াগুলো যখন ফিনিশিং পয়েন্টে একটি ক্যামেরার সামনে দিয়ে যায় তখন মনিটারে সেগুলোকে দেখে বিচার করা হয় যে কে প্রথম কে দ্বিতীয় ইত্যাদি।… ভারতীয় বিজ্ঞাপন শিল্পের গোঁড়ামি ভেঙে একটি সাহসী বিজ্ঞাপন চালু করা মরিনের পক্ষে কোনও কেকওয়াক ছিল না।… মিসেস ওয়াড়িয়া মনে করতেন, যে কোনও আকর্ষণীয় নারীর গ্ল্যামারের পেছনে বুদ্ধি আছে, তা প্রমাণ করা খুবই কঠিন।… জাহাজ বানানো আর সমুদ্রে দ্বীপের মধ্যে তার মিউজিয়াম নিয়ে কিছুই বলা হয়নি।… রাতবিরেতে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার কথাও উঠে আসছে বারবার। সে দিনগুলোতে কাজ করার সময় সর্তকতা ছিল, কিন্তু অতি সচেতনতা কখনও দেখিনি। যেখানে পোশাক-আশাক, দেহ সৌষ্ঠব, শারীরিক সৌন্দর্য, মেকআপ ইত্যাদি যৌন আবেদনের সরঞ্জাম, সেখানে দিনরাত, এমনকী, সারারাত ধরে কাজ হলেও কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি, সবটাই ঠিক ঠিক চলছিল। কাজে এসেছে, টেনশনে ও আনন্দে কাজ করেছে, সময়মতো নিরাপদে ঘরেও ফিরেছে সবাই।… ওদের সাফল্য উদযাপন করতে ‘মি’ সিরিজ, ‘শক্তি’ সিরিজ। বছর পাঁচেক শুধু বিলবোর্ডের মেয়েদের ছবি এঁকেছিলাম নয়ের দশকের শেষভাগে।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৫: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল