নাগরাজ মন্ত্র শিখিয়েছেন বারাণসীরাজকে। কীসের মন্ত্র? কীট-পতঙ্গদের ভাষা বুঝতে পারার। কিন্তু সেই মন্ত্র যদি কাউকে শেখান, তাহলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটবে তাঁর। রানির খেয়াল হয়, সেই মন্ত্র তিনি শিখবেন। তারপর?
১০.
বারাণসীরাজ সেনক সেদিন রাজসভার ব্যস্ততার মাঝে সামান্য অবসরে অন্দরমহলে গিয়ে পিঠে খাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর পায়ের কাছে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ঝুঁকে দেখেন, খেতে খেতে মেঝেতে কয়েক ফোঁটা গুড় পড়ে গিয়েছিল, এক পিঁপড়ে সেটা দেখতে পেয়ে মহা উল্লাসে তার সঙ্গীদের ডাকছে– ওরে শিগগির আয়, রাজবাড়িতে নির্ঘাৎ গুড়ের কলসি ভেঙে গেছে।
রাজা হো হো করে হেসে উঠলেন।
এমন অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম হল। প্রাণ বাঁচানোর পুরস্কারস্বরূপ কৃতজ্ঞ নাগরাজ সদ্য সদ্য তাঁকে মন্ত্রটি শিখিয়েছেন। এর বলে প্রাণীজগতের সমস্ত ভাষা বুঝতে পারা যায়।
–কীট-পতঙ্গ সকলের?
নাগরাজ স্মিত হেসে ঘাড় নেড়েছিলেন, সেই জন্যই এই মন্ত্র অমূল্য। কিন্তু মহারাজ, এই মন্ত্রের হস্তান্তর বড় বিপজ্জনক।
–হস্তান্তর?
অর্থাৎ, এই মন্ত্র আপনি অন্য কাউকে শেখাতে পারবেন না। সে চেষ্টা করতে গেলেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে আপনার মৃত্যু ঘটবে।
বেশ। তবে আমি আর কাকেই বা শেখাতে যাব!
তা সেই মন্ত্র এই প্রথম প্রয়োগ করলেন মহারাজ। আর তাতেই এমন অবাক আনন্দ!
পিঠে খেতে খেতে মহারাজকে এমন প্রাণ খোলা হাসতে শুনে রানি ভাবলেন, কোনও মজার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়েছে। তিনি বললেন, ‘আজ রাজসভায় কি কোনও কৌতুককর ঘটনা ঘটেছে, মহারাজ?’
সেনক তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে রাজসভায় ফিরে গেলেন।
কিন্তু কয়েক দিন পরেই আবার তিনি ধরা পড়ে গেলেন রানিমার কাছে। সেদিন দুপুরে স্নানের পর রাজা পালঙ্কে এসে বসেছেন। দেখেন এক মৌমাছি-দম্পতি শয়নকক্ষে উড়ছে। কৌতূহলী হয়ে মন্ত্র প্রয়োগ করতেই তিনি পুরুষটির আবেগ-ঘন কথা স্পষ্ট শুনতে পেলেন, ‘এসো ভদ্রে, আজ অসময়ে কেলি করি।’
স্ত্রী-মৌমাছি বলছে, ‘‘স্বামী, একটু ধৈর্য ধর। মহারাজকে এখনই চন্দনচূর্ণ মাখানো হবে। সেই সুগন্ধে আমোদিত পরিবেশে আমরা দু’জন দু’জনকে স্পর্শ করব।’’
মহারাজের ঠোঁটে প্রশ্রয়ের চপল হাসি দেখে রানি আর স্থির থাকতে পারলেন না। বললেন, ‘মহারাজ, ইদানীং আপনার কিছু আচরণের আমি তল খুঁজে পাচ্ছি না; আপনি মনে হয় আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছেন।
নব জাতক-এর পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
সেনক কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রধানা মহিষীর অভিমানী চাউনির কাছে হার মানলেন। তিনি নাগরাজের কাছ থেকে মন্ত্রলাভের কথা সবিস্তার জানালেন।
সব শুনে উত্তেজিত রানি বললেন, ‘আমাকে মন্ত্রটি শিখিয়ে দিন, মহারাজ।’
সেনক বললেন, ‘হস্তান্তর’-এর যে বিপদের কথা শেষে বললাম, তা বোধহয় চিত্তচাঞ্চল্য হেতু তুমি খেয়াল করলে না!
–আমি সব শুনেছি। হোক বিপদ। ও মন্ত্র আমার চাই।
বজ্রাহত সেনক তাঁর প্রিয়তমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বেশ, তা-ই হবে।’
মহারাজের এই অপরিণামদর্শী উচ্চারণে কেঁপে উঠল দেবরাজ শক্রের আসন। তিনি ভাবলেন, রাজাকে অবিলম্বে সচেতন করা দরকার। তিনি দ্রুত অসুরকন্যা সুজাকে সঙ্গে নিয়ে ছাগল দম্পতির ছদ্মবেশে বারাণসী নেমে এলেন।
রাজা সেনক রাজধানী পরিক্রমণে বেরিয়েছেন– বুঝি জীবনে শেষবারের মতো। হঠাৎ এক ছাগ আর ছাগী আমোদ করতে করতে তাঁর রথের সামনে এসে পড়ল। রাজরথ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সিন্ধুদেশের বলশালী গর্দভ। সে তার স্বভাবজ প্রতাপে চিৎকার করল, ‘মূর্খ, রাজপথ কি তোদের কেলি করার জায়গা? সংযম শিখিসনি?’
ছাগরূপী শক্র বললেন, ‘সংযম শেখা তোর মূর্খ সওয়ারিকে।’
নব জাতক-এর পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
শক্র জানেন মন্ত্রবলে তাঁর সব কথাই রাজা বুঝতে পারছেন। তাই আরও স্পষ্ট করে তিনি বললেন, ‘নিকট জনের অন্যায্য আবদারে যে রাজধর্ম বিস্মৃত হয়, নিজের সঙ্গে গোটা দেশের বিপদ ডেকে আনে, তাকে মহামূর্খ ছাড়া আর কী বলা যায়?’
সেনক রথ ঘুরিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন। দেখতে পেয়ে রানি মহোল্লাসে দৌড়ে এলেন, ‘মহারাজ, এবার তাহলে মন্ত্র শিখিয়ে দিন?’
–নিশ্চয়ই, তবে উপচার প্রস্তুত করি।
–উপচার?
–মন্ত্রশিক্ষার আগে শতবার কশাঘাত নিঃশব্দে সহ্য করতে হবে।
দুই ভৃত্য এল চাবুক হাতে। রাজার নির্দেশে সেই কর্কশ কশা প্রবলভাবে নেমে আসতে লাগল রানির মসৃণ, সোনা-রং পিঠে। তার সপাং সপাং শব্দ ছাপিয়ে রাজমহিষী আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘দোহাই মহারাজ, আমার ভুল হয়েছে। মন্ত্র আমার চাই না।’
মহারাজ সেনক রাজসভার দিকে পা বাড়ালেন। সেখানে অনেক কাজ বাকি।
ঋণ: খরপুত্র জাতক
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।