অভিনেতার নিজস্ব একটা জীবন আছে। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র অভিনয়ের হাত ধরে সেই জীবনও প্রভাবিত হয়। আচ্ছন্নের মতোই সে অভিনীত চরিত্রকে আত্মস্থ করতে থাকে। তখন অভিনেতার মধ্যে অয়দিপাউসের সত্তা উঁকি মারে, উঁকি মারে ঔরঙ্গজেবের সত্তা, কিংবা প্রকাশ পায় সিমলেপাড়ার বিলে অর্থাৎ বিবেকানন্দ। পরবর্তীতে তাঁর মধ্যে শিশিরকুমার ভাদুড়িও উঁকি মারবেন। গিরিশ ঘোষ আসবেন। এই আসা-যাওয়াগুলো শুধু পাঠ মুখস্থ করা, সংলাপ মনে রাখা, বা সোনালি আলোর নিচে দাঁড়ানো নয়। তা এমনকিছু, যা অভিনেতাকে বিশ্বাস করতে শেখায়, নিজের জীবনেও সে ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’-এর অংশ।
১১.
অভিনয় বলতে রং মাখা, আলোর নিচে দাঁড়ানো, সংলাপ বলা, সংলাপের মধ্যে হ্রস্ব, দীর্ঘ– এগুলোকেই আমরা আশ্রয় করি। অনেকটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লাইনগুলোর মতো– ‘মন-ভালো-করা রোদ্দুর কেন/ মাছরাঙাটির গায়ের মতন?/ হ্রস্ব-দীর্ঘ নীল-নীলান্ত/ কেন ওর রং খর ও শান্ত?’ এই যে নানা রঙের যে অবয়ব তৈরি করা হয় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে, সেটাই ধরার চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু এর একটা সমস্যাও আছে। অভিনেতা অভিনয় করার সময় একটা বিপদে পড়েন। দর্শকও নিশ্চয়ই পড়ে, তবে অভিনেতার বিপদের থেকে সেটা আলাদা। আজ অভিনেতার বিপদ নিয়ে লিখব। লিখব অভিনেতার একান্ত ব্যক্তিগত বিপদ নিয়ে।
আমার কথা দিয়েই শুরু করি। আমার অভিনয়ের পরম্পরা দেখলে মনে হবে, আমি শুধু বড় মাপের চরিত্রেই অভিনয় করি। বড় মাপ অর্থাৎ, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, যাকে আমরা দেখিনি, কিন্তু যার কথা শুনেছি। যেমন ধরা যাক, ঔরঙ্গজেবের চরিত্র। আমি দু’বার ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে অভিনয় করেছি। একবার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘শাহজাহান’ নাটকে, আরেকবার ইন্দিরা পার্থসারথির লেখা, যেটা মোহিত চট্টোপাধ্যায় বাংলা করেছিলেন, যে নাটকটার নামই ছিল ‘ঔরঙ্গজেব’। এই নাটকটির প্রথমার্ধে ঔরঙ্গজেবের চরিত্র ছিল না, দ্বিতীয় অংশে আমি প্রবেশ করতাম। এই ঔরঙ্গজেব প্রাত্যহিক চরিত্র নয়, কিন্তু তবু রোজকার জীবনের ছাপ তার জীবনে এসে লাগে।
এই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি, নির্দেশকরা বা নাট্যকাররা এই চরিত্রের নির্মাণের মধ্যে কোথাও প্রতিদিনকার জীবনযাপন, খাচ্ছিদাচ্ছি-ঘুমিয়ে পড়ছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকে এসে মিশছে– এর বাইরে একটা বড় জীবনের আভাস দিচ্ছেন। সে ভুলও বড়ভাবে করে, সে ভালোবাসেও বড়ভাবে, বিশ্বাসঘাতকতাও করে বড়ভাবেই, প্রায়শ্চিত্তও বড়ভাবেই করে। আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে তা মেলে না। মেলে না বলেই দর্শক দেখতে আসে মঞ্চে।
এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করলে, এর অভিঘাতে আরও এমন অমন ধরনের চরিত্র অভিনেতার সঙ্গে বাসা বাঁধতে থাকে। এই যেমন আমি রাজা অয়দিপাউসের চরিত্রে অভিনয় করেছি। রাজা অয়দিপাউসের ঘটনা তো রোজকার ঘটনা নয়। সেই চরিত্রের প্রকাশের মাত্রা বা ডিগ্রি এত তীব্র, এত বড় মাপের যে মনে হয়, এ আমাদের জীবনের সংলগ্ন কেউ নয়। মনে হয়, এ আমাদের মাঝে থেকেও সম্পূর্ণভাবে আলাদা। আমি যখন সেই চরিত্রে অভিনয় করছি, সেই চরিত্রের প্রকাশের মধ্যে ওই যে রোজকার সম্পর্কগুলো, কারও ছেলে-বাবা-মা, তার মধ্যে থেকেও এ আলাদা এক মানুষ। এই আলাদাটুকু অভিনেতাকে বুনে দিতে হয়, গড়ে দিতে হয়। আমার কণ্ঠস্বরে, প্রকাশভঙ্গিতে সেই চরিত্রের বিশেষত্বকে ধরার চেষ্টা করি। দর্শকের তা কখনও পছন্দ হয়, কখনও পছন্দ হয় না। কিন্তু মনে মনে আমি এবং দর্শক উভয়েই জানি, এই চরিত্র আসলে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। এক বিরাট, বড় চরিত্র।
………………………………………………………………………………..
‘ঔরঙ্গজেব’ নাটকে যখন ঔরঙ্গজেব নিজের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে প্রকাশ করছে, কিংবা নিজের মনের দৃঢ়তার কথা বলছে, সংশয়কে জয় করার প্রত্যয় দেখাচ্ছি, তখন সেই আত্মবিশ্বাস অভিনেতার হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে সেই দৃঢ়তার সঙ্গে আমিও মিলেমিশে যাই। আমার মধ্যেও ঔরঙ্গজেবের মতো মেরুদণ্ড তৈরি হয়। যে পরবর্তীকালে অন্য কোনও নাটকে অন্য কোনও বড় চরিত্র অভিনয়ে আমাকে সাহস জোগায়।
………………………………………………………………………………..
এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে করতে দর্শক আমার কাছ থেকে ওই ধরনের চরিত্র-অভিনয় প্রত্যাশা করে ফেলেন। এমনকী আমি, অভিনেতাও ক্রমান্বয়ে এমন চরিত্রে অভিনয়ের অভিলাষী হয়ে উঠি। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে তো একটা চরিত্রে আটকে থাকলে হয় না, তাকে নানা চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। দর্শকও জানে, একজন অভিনেতা তিনি নানা চরিত্রে অভিনয় করবেন। কিন্তু কোথাও, অজান্তে ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ সত্তার অনুসন্ধান সেই অভিনেতার মধ্যে করে চলে দর্শক, তাকেই যেন তারা দেখতে চায়। সিংহভাগ দর্শকের সঙ্গে সেই চরিত্রের পরিচয়ের ডাকপিওন ওই অভিনেতা, সেই প্রত্যাশা তাদের কথায়, অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়ে।
এমন অবস্থায় আমি যদি কোনও সাধারণ চরিত্রে, যে কি না রাজা-বাদশা অর্থাৎ ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যারেকটার নয়, তাতে অভিনয় করি, তখনই হয় মুশকিল। আসলে আমি যখন ‘বিলে’ নাটকে বিবেকানন্দ চরিত্রে অভিনয় করছি, সে যেমন সিমলেপাড়ার বিলে। আবার সে কেবলই সিমলেপাড়ার বিলে নয়, সে শিকাগোর স্বামীজিও বটে। যাঁকে আমরা ঘরের তাকে, বইয়ের আলমারিতে, ভক্তিতে-বিশ্বাসে-প্রজ্ঞায় ঠাঁই দিয়েছি, সে কী করে শুধু আমাদের ঘরের ছেলে হবে! এই ধরনের ধারণা যখন শক্তপোক্ত হয়ে মনে বাসা বাঁধে, তখন তার মনের মধ্যে অভিনেতাকে নিয়ে একটা প্রত্যয় তৈরি হয় দর্শকদের, যে এই অভিনেতা এই চরিত্রগুলো সবার সামনে এনে এমন এক সত্যকে উপস্থাপিত করবেন, যেটিকে তারা মান্যতা দেবে।
একইভাবে অভিনেতার মধ্যেও কিন্তু সেই চরিত্রের বিশেষ দিকগুলো স্পর্শ করে। ধরুন, ‘ঔরঙ্গজেব’ নাটকে যখন ঔরঙ্গজেব নিজের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে প্রকাশ করছে, কিংবা নিজের মনের দৃঢ়তার কথা বলছে, সংশয়কে জয় করার প্রত্যয় দেখাচ্ছি, তখন সেই আত্মবিশ্বাস অভিনেতার হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে সেই দৃঢ়তার সঙ্গে আমিও মিলেমিশে যাই। আমার মধ্যেও ঔরঙ্গজেবের মতো মেরুদণ্ড তৈরি হয়। যে পরবর্তীকালে অন্য কোনও নাটকে অন্য কোনও বড় চরিত্র অভিনয়ে আমাকে সাহস জোগায়।
আসলে অভিনেতার নিজস্ব তো একটা জীবন আছে। এই চরিত্র অভিনয়ের হাত ধরে সেই জীবনও প্রভাবিত হয়। আচ্ছন্নের মতোই সে অভিনীত চরিত্রকে আত্মস্থ করতে থাকে। তখন অভিনেতার মধ্যে অয়দিপাউসের সত্তা উঁকি মারে, উঁকি মারে ঔরঙ্গজেবের সত্তা, কিংবা প্রকাশ পায় সিমলেপাড়ার বিলে অর্থাৎ বিবেকানন্দ। পরবর্তীতে তাঁর মধ্যে শিশিরকুমার ভাদুড়িও উঁকি মারবেন। গিরিশ ঘোষ আসবেন। এই আসা-যাওয়াগুলো শুধু পাঠ মুখস্থ করা, সংলাপ মনে রাখা, বা সোনালি আলোর নিচে দাঁড়ানো নয়। তা এমনকিছু, যা অভিনেতাকে বিশ্বাস করতে শেখায়, নিজের জীবনেও সে ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’-এর অংশ।
এই মজার খেলা শুরু হয় তখনই যখন অভিনেতা এই ধরনের চরিত্র ছেড়ে অন্য ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেন, এমন চরিত্র যে ক্রমাগত ভুল করে। যে পরাজয় এবং পরাজয়ের অবমাননার ভিতর দিয়ে নিজেকে নির্মাণ করে, সে তখন আর নিজেকে ‘বড় চরিত্র’রূপে প্রতিভাত করতে পারে না। এই ছোট চরিত্র, ভিন্ন মেরুর অবয়ব, যার মধ্যে নায়কোচিত সংলক্ষণ নেই, সেই চরিত্রের ঘৃণ্য, সংকীর্ণ যাপনের ছোট ছোট পদক্ষেপ, ক্লেদ মেখে যখন অভিনেতা মঞ্চের সামনে আসেন, তখন তা সবসময় দর্শকের পছন্দ হয় না। তারা অভিনয় দক্ষতার প্রশংসা করেও বলেন, অভিনয় ভালো হয়েছে, কিন্তু আপনার কাছ থেকে না অন্য রকম চরিত্র আশা করি।
…………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………………
এই যে প্রত্যাশা অনুযায়ী না পাওয়ার আক্ষেপ, সেই উপলব্ধি অভিনেতার মধ্যেও জন্মায়। হাততালি কুড়িয়েও তার মনে হয়, তার চলনের মধ্যে একটা চরিত্র বিশেষরূপে বিন্যস্ত হয়েছিল। এখন নানা বাধ্যবাধকতায় সে তাকে আর প্রকাশ করতে পারছে না। এই আক্ষেপ থেকেই একটা অসুবিধার জন্ম হয় অভিনেতার মধ্যে। তৈরি করে এক দ্বন্দ্বের পৃথিবী, এক দ্বিধার জগৎ। আদৌ সে ঠিক করছে, নাকি ভুল– সেই সংশয়ের জন্ম হয় অভিনেতার মধ্যে। একান্ত নিভৃতে তখন ঠিক-ভুলের বিচারসভা বসে অভিনেতার অন্তরে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
স্কুল গড়ার কাজে উমাদির সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্কুল নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হত খুব। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতেন স্কুল নিয়ে কতখানি প্যাশন ছিল দু’জনের মধ্যে সেসব তর্কে। স্কুলের কাজে চিনুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি, কিন্তু তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।