জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে। কিন্তু মঞ্চে অভিনয়কালে জন্ম-মৃত্যুর সরল সমীকরণ মেনে চরিত্র চলে না। মঞ্চে একটা চরিত্রের যেমন এন্ট্রি আছে, তেমনই আছে এগজিট। নাটকের দাবি মেনে অভিনেতা স্টেজ ছেড়ে বেরিয়ে যান নির্দিষ্ট সংলাপ বলে, বেরিয়ে যান রঞ্চমঞ্চের উইংস ধরে। কারণ, সেই চরিত্রের মৃত্যু হয় না। হয়তো চরিত্রটি তার বলা সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা গল্পকে এগিয়ে দিয়ে বা নিজের বলা সংলাপ বলে চলে গেল। এই নিষ্ক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রটার কথাও ফুরিয়ে গেল, কিন্তু দর্শকদের কাছে অধরা থেকে গেল ওই চরিত্রটির মৃত্যু।
১৫.
অভিনয় জীবনের শুরু থেকেই, অর্থাৎ মঞ্চে ওঠার শুরু থেকেই দুটো শব্দের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের আলাপ। তা হল ‘এন্ট্রি’ ও ‘এগজিট’। অর্থাৎ, নাটকে যাকে বলে ‘প্রবেশ’ ও ‘প্রস্থান’। থিয়েটার বা নাটকের ক্ষেত্রে যা আমরা দেখে থাকি, অবধারিতভাবে একটা ক্যারেক্টর বা নাটকের চরিত্র স্টেজে দর্শকের সামনে এন্ট্রি নেয়। কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পর্দা উঠে গেলে দর্শক দেখতে পায়, স্টেজে কেউ একজন, অর্থাৎ একটা চরিত্র বসে আছে। বসে আছে মানে এই নয় সে নিঃপ্রাণ, বসেই থাকল, স্টেজ ছেড়ে বেরল না, এমনটা হয় না। নাটকের ঘটনা পরম্পরা অনুযায়ী, মাঝে মাঝেই তার প্রস্থান ঘটে এবং একইভাবে প্রবেশও ঘটে। সেটা ঘটে স্রেফ নাটকের প্রয়োজন অনুসারে। নাটকের কোনও চরিত্রের এই প্রবেশ ও প্রস্থান আমার খুব ভাবায়। চিন্তার গভীরে নিয়ে যায়।
এন্ট্রি অর্থাৎ প্রবেশ। কোথায়? না, স্টেজে। এই প্রবেশের মাধ্যমে আমাদের বোঝানো হত, একটা চরিত্রকে, যে চরিত্রে অভিনেতা অভিনয় করছেন, তাকে দর্শকের সামনে এসে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাকে দর্শক চিনবে। চিনবে অভিনেতা হিসেবে নয়, যে চরিত্রে অভিনেতা অভিনয় করছেন, সেই চরিত্র হিসেবে।
আমি যখন স্টেজে প্রবেশ করছি, তখন সেই অভিনীত চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমায় চিনতে শুরু করে দর্শক। আমার অভিনীত চরিত্র একটা বিশেষ ভঙ্গিমা নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করছে, তার একটা সুনির্দিষ্ট চলন আছে। তার সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা স্পিচ প্যাটার্ন বা বাচনশৈলী এবং একইসঙ্গে সেই চরিত্রের স্বরপ্রক্ষেপণে কতটা জোর বা কমজোর আছে, তা দর্শক খেয়াল করতে শুরু করে। এবং সেই পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই অভিনেতাকে একটা চরিত্রের খাঁচায় বা ধাঁচে ফেলতে তারা চেষ্টা করে।
দর্শকের এই মূল্যায়ন অভিনেতার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁকে যেভাবে দর্শক দেখছে, বা মাপার চেষ্টা করছে, সেভাবেই সেই ধাঁচের মধ্যে থেকে চরিত্রটির প্রকাশ ঘটিয়ে অভিনেতা আনন্দ পান। সেই ধাঁচটিকে অভিনেতা সযত্নে লালন করেন। কিন্তু এই প্যাটার্ন বা ধাঁচটি অভিনেতার জীবনের পরম সত্য নয়। মাঝে মাঝে তিনি ওই খাঁচার দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। তখন তিনি হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেন, সন্তানের আচরণে তিতিবিরক্ত হয়ে চিৎকার করেন, অথবা সন্তানের কোনও অবিমৃশ্যকারী আচরণে মানসিক আঘাত পেয়ে হাহুতাশ করেন, রূঢ় ভাষা প্রয়োগ করেন কিংবা কুঁকড়ে যান, তখন তিনি অন্য মানুষ। তাঁকে তখন আর সেই স্টেজের চরিত্রের সঙ্গে মেলানো যায় না। এই যে চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা, এটাই একজন অভিনেতার জীবনের পরম বা চরম সত্য।
আসলে মানুষের নিজস্ব যে পরিচয়, সেই পরিচয়টাকে সে ভীষণভাবে আঁকড়ে থাকতে চায়। কিছু কিছু পরিস্থিতি আসে, নাটকের ভাষায় যাকে আমরা বলি– ‘নাটকীয়তা’। সেই নাটকীয় পরিস্থিতিতে পরম সত্যের উপলব্ধিকে আঁকড়ে ধরেই অভিনেতা দর্শককে একটা চেতনার স্তর থেকে পৌঁছে দেন চেতনার আরেক স্তরে। শুধু তাই নয়, অভিজ্ঞতার অন্য স্তরে উন্নীত করেন নিজেকেও। সেই উপস্থাপনের জেরে তখন তাঁকে অন্যরকম বলে মনে হয়। ‘বিশেষ’ বলে মনে হয় দর্শকের চোখে। আসলে নাটকের বিশেষ মুহূর্ত সেই পরিস্থিতির জন্ম দেয়, যা দর্শকের মনে প্রশ্ন তৈরি করে, এই যে চরিত্রটা একরকমভাবে বাঁচছিল, নাটকীয়তা বা ঘাত-প্রতিঘাতের জেরে সে কি এবার অন্যরকমভাবে বাঁচতে শুরু করবে? সেটা না হলেও দেখা যায়, অভিনয়ের ওই মুহূর্তটা ক্ষণজন্মা হয়ে রয়ে যায় চিরকালের জন্য। এইরকম অনেক অনেক মুহূর্ত জমে তৈরি হয় স্মরণীয় মুহূর্ত। কবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, মুহূর্তেরা মুহূর্তের কাছে ঋণী। অভিনেতা হিসেবে আমরাও বহু নাটকে, চরিত্র উপস্থাপনে, তার ভালো-মন্দ– সব দিক থেকেই সেই আকাঙ্ক্ষা বোধ করি। আমরা চাই, অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করতে। এই ধরনের মুহূর্তের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, একটি নাটকে কিংবা চরিত্রায়নে, তত সেটি দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দর্শক তত আগ্রহ বোধ করে। চরিত্রটিকে আরও বেশি করে দেখতে চায়, বুঝতে চায়।
আমরা জানি, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে। এই যে জন্মালে মরতে একদিন হবেই, এটা সত্য– তা আমাদের কাছে অনস্বীকার্য। কিন্তু মঞ্চে অভিনয়কালে সেই জন্ম-মৃত্যুর সরল সমীকরণ মেনে চরিত্র চলে না। মঞ্চে একটা চরিত্রের যেমন এন্ট্রি আছে, তেমনই আছে এগজিট। নাটকের দাবি মেনে অভিনেতা স্টেজ ছেড়ে বেরিয়ে যান নির্দিষ্ট সংলাপ বলে, বেরিয়ে যান রঞ্চমঞ্চের উইংস ধরে। কিন্তু ওই প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, তা নয়। কারণ, সেই চরিত্রের মৃত্যু হয় না। হয়তো চরিত্রটি তার বলা সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা গল্পকে এগিয়ে দিয়ে বা নিজের বলা সংলাপ বলে চলে গেল। এই নিষ্ক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রটার কথাও ফুরিয়ে গেল, কিন্তু দর্শকদের কাছে অধরা থেকে গেল ওই চরিত্রটির মৃত্যু। অজানাই থাকল চরিত্রের শেষ পরিণাম। দর্শক হয়তো ওই চরিত্রের মৃত্যু নিয়ে ভাবিত নয়। কিন্তু নাটকের নিয়ম মেনে পঞ্চম দৃশ্যের পর চরিত্রটি বেরিয়ে গেল স্টেজ ছেড়ে, ষষ্ঠ দৃশ্যে আর ফিরল না। নাটক হয়তো শেষ হল না, তার অগ্রগতি স্টেজে দর্শকদের চোখের সামনে চলতে থাকল, কিন্তু ওই চরিত্রটি চলার পথ ওখানেই শেষ হয়ে গেল। তার আর কোনও ভূমিকা অবশিষ্ট থাকল না। এই চরিত্রে যে অভিনেতা অভিনয় করছেন, তাঁর শেষ সংলাপ, সে ছোট হোক কি মাঝারি বা বড়, তা বলে যখন স্টেজ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন সাজঘরের দিকে, সেই অভিনেতা কিন্তু মনে মনে জানেন, আজকের মতো তার এগজিট ঘটল, যাকে বলে ইটার্ন্যাল এগজিট। মৃত্যু বলব না একে, বলব অবশ্যম্ভাবী প্রস্থান।
ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অভিনেতার মনে কী চলে? নাটক তো চলছে, জীবনও আরও একটু এগোচ্ছে। কিন্তু সেই জীবনে, সেই নাটকের বর্ধিত অংশে সেই অভিনেতা নেই, তার চরিত্র নেই। সে ফুরিয়ে গিয়েছে নাটকের দাবি মেনে। অথচ স্টেজে অন্যান্য চরিত্র তাকে নিয়ে কথা বলছে। ওই মুহূর্তে একজন অভিনেতা, যিনি প্রস্থান করেছেন, তিনি ভাবেন, আমার তো আর কিছু করার নেই। এখন এ দৃশ্যে দর্শকের মনোরঞ্জনের ভার বাকিদের ওপর, যা করার তাঁরা করবেন।
সাজঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তখন হয়তো অভিনেতা তাঁর সাজপোশাক খুলে রাখেন, ঘামে ভিজে যাওয়া জামা, যা তাকে অন্য একটা পরিচয় দিয়েছিল স্টেজের ওপর, তা খুলে রাখেন, আর তা রাখতে রাখতেই অভিনেতার কানে আসে স্টেজের ওপরে চলতে থাকা সংলাপ। হয়তো সেই সংলাপ তাঁকে কেন্দ্র করে। তাঁর নিষ্ক্রমণ নিয়েই। কিন্তু তাঁর সেখানে কোনও ভূমিকা নেই, তিনি তখন স্রেফ শ্রোতা, অন্তরালে থাকা এক দর্শক মাত্র। এটাও এক দারুণ অনুভূতি– আমি নেই, অথচ আমাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দূর থেকে তিনি যখন তা জরিপ করেন, অভিনেতা হিসেবে এক আক্ষেপমিশ্রিত অনুভব তাঁর মধ্যে তৈরি হয়। পাশাপাশি আরও একটা অনুভূতি তিনি বোধ করেন। যেন তাঁর চরিত্রটি শেষ হয়েও শেষ না-হওয়া এক চিরন্তন বোধ নিয়ে তাঁর সামনে উপনীত হয়। মনে হয়, স্টেজে না থেকেও সে আছে, প্রবলভাবে আছে। বাকি চরিত্রের কথায়, ভাষ্যে, চিন্তায় স্মৃতিতে কেমন যেন অমর হয়ে তিনি রয়েছেন। দর্শকও নিশ্চয়ই তাই করছে। চরিত্রটিকে অমর করে তুলছে মনে মনে। অভিনেতার মনে তখন প্রশ্ন জাগে, যদি স্টেজে থাকতাম, এর চেয়ে বেশি কি অমরত্ব পেতাম? বেশি প্রাণবন্ত হত চরিত্রটা? তার চেয়ে এই নিষ্ক্রমণই ভালো। যা আমায় অমরত্ব দান করেছে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
একজন বিজ্ঞানী জীবন বিপন্ন করে কর্পোরেট চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের গোয়েন্দা বাহিনী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, তারা দেশাইকে ফেরায়নি। না ফেরানোর জন্য জবাবদিহি করেনি। এবং নানা কারণের সংযোগে আজ ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র আজ সাগর জলে।