অভিনেতার একটা অ্যাডভান্টেজ আছে। একটা চরিত্র, যার পার্ট নাটকে শেষ, সেই চরিত্রের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময়ও কিন্তু মঞ্চের আড়াল থেকে তাকে নিয়ে যে চর্চা চলে, তা শুনতে পান অভিনেতা। এ এক অনন্য অনুভূতি। আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর আর অন্য কোনও পেশায় কিংবা শিল্পমাধ্যমে এমনটা ঘটে না। আসলে অভিনয়ে আমরা মুহুর্মুহু মরি। ‘মরি নাই, মরি নাই, আবার আসিয়াছি ফিরিয়া’ বলে চরিত্র ফিরে আসে, মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে।
১৬.
মার্কিন নাট্যকার আর্থার মিলারের একটি বিখ্যাত নাটক– ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’, আমরা সেই নাটক ‘নান্দীকার’-এ অভিনয় করেছিলাম ‘এক ফেরিওয়ালার মৃত্যু’ নামে।
এক বৃদ্ধ সেলসম্যান, উইলি লোম্যান– তার জীবনের গল্প জুড়ে এই নাটক। জীবন ও কর্মক্ষেত্র– উভয় পরিসরে সে নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে করে। একটা অপরাধবোধ তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। সেই অপরাধ করার সময় সে ধরা পড়ে গিয়েছিল ছেলের কাছে। সন্তানের চোখে সে ছোট হয়ে গিয়েছিল এক নিমিষে। পিতা-পুত্রের সম্পর্কের এই ভাঙন শত চেষ্টা করেও সে মেটাতে পারেনি। বাবা হিসেবে সন্তানকে বোঝাতে পারে না, সে তাকে কত ভালোবাসে। ছেলেটাও বোঝাতে পারে না যে, সে-ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার বাবাকে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে বৃদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়, সে এমন একটা কাজ করে যাবে, যার জন্য গর্ব করবে তার পরিবার, তার সন্তান। ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন– এরপর সেই বৃদ্ধ আত্মহত্যা করবে! তার আত্মহত্যার পর নানা ঘটনা পরম্পরায় প্রচুর অর্থ পাবে তার সন্তান ও পরিবার। বৃদ্ধের এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তার সন্তান অনুভব করবে পিতার প্রকৃত ভালোবাসাকে। এই পরিস্থিতিতে নাটকে দেখা যায় বৃদ্ধের এক বন্ধু, সে স্বগোতোক্তি করে– উইলি, একবার মারা গেলে মৃতব্যক্তি নিজে আর কোনও কিছু ফেরত পায় না।
বাস্তব জীবনেও আমাদের সঙ্গে তাই ঘটে। অভিনেতার যখন ইটার্নাল এগজিট ঘটবে, তার পক্ষে জানা সম্ভব হবে না, তাকে নিয়ে অভিনয় জগতে কী আলোচনা চলছে। আমরা যারা অভিনেতা, জীবিতকালে এই ভেবে আত্মশ্লাঘা বোধ করি, মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই আমাদের কাজ নিয়ে, সৃষ্টি নিয়ে স্মৃতিচারণা হবে। বাস্তব হল, মৃত্যুর পর আমরা কেউ এই প্রশস্তি শোনার জন্য থাকব না। আমরা শুনতেও পারব না।
মঞ্চে কিন্তু তা হয় না। সেখানে অভিনেতার একটা অ্যাডভান্টেজ আছে। একটা চরিত্র, যার পার্ট নাটকে শেষ, সেই চরিত্রের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময়ও কিন্তু মঞ্চের আড়াল থেকে তাকে নিয়ে যে চর্চা চলে, তা শুনতে পান অভিনেতা। এ এক অনন্য অনুভূতি। আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর আর অন্য কোনও পেশায় কিংবা শিল্পমাধ্যমে এমনটা ঘটে না। আসলে অভিনয়ে আমরা মুহুর্মুহু মরি। ‘মরি নাই, মরি নাই, আবার আসিয়াছি ফিরিয়া’ বলে চরিত্র ফিরে আসে, মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে। হয়তো কাহিনি অনুযায়ী চরিত্রের মৃত্যু ঘটল, তারপর স্টেজে আলো নিভতেই সে উঠে দাঁড়াল, অথবা উইংস ধরে হাঁটতে হাঁটতে অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেল। এই মৃত্যু অভিঘাতহীন। এতে অভিনেতার কিছু যায়-আসে না, দর্শকেরও কিছু যায়-আসে না। সেই মৃত্যু সত্য না হলেও আমরা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সেই বিয়োগব্যথা অনুভব করতে পারি। সেই মৃত্যু মিথ্যে হলেও বিশ্বাসযোগ্য দর্শকের সামনে।
‘একনায়কের শেষরাত’ বলে নাটকের কথা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। নাটকটির শেষে আমার অভিনীত চরিত্রটির গুলিতে মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনা পরাম্পরা অনুযায়ী আমি গুলি খেয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছি ডাউন স্টেজে, মানে ঠিক দর্শকদের সামনে, কোল ঘেঁষে। আমাকে যারা গুলি করেছে, তারা আসতে আসতে পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে, মিউজিক হচ্ছে। আমি স্টেজে শুয়ে তা অনুভব করতে পারছি। তারপরেই নাটক শেষ। আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি। দর্শকের অভিবাদন কুড়োচ্ছি। কিন্তু তার আগের ওই নাটকীয় মুহূর্তটুকুর যে সময়, তখন কিন্তু দর্শকও বিশ্বাস করছে আমি মৃত। এবং আমিও বিশ্বাস করছি, আমি বেঁচে নেই।
এমন বিশ্বাস কেন করি? আসলে প্রাজ্ঞের মতো আমরা বিশ্বাস করি, মৃত্যু বলে কিছু হয় না। উল্টোটাও বলা যায়। মৃত্যু এতটাই সত্য যে, তাকে আমরা সবসময় আগলে আগলে রাখি। অভিনেতা জানে, তার অভিনয় সত্তা মৃত্যুঞ্জয়ী। এই প্রবহমান জীবনে সে না থাকলেও তার অভিনয় সত্তা বেঁচে থাকবে। তাই মৃত্যুর পরেও জীবন আছে, জেগে ওঠা আছে– একজন অভিনেতা তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তা বিশ্বাস করাতে চায়।
মনে পড়ছে ‘ফেরা’ বলে একটি নাটকের কথা। সেই নাটকে আমি অভিনয় করেছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ঘটনাচক্রে নাটকটিতে বাকি যে চরিত্রগুলো রয়েছে, তারা আমার অভিনীত চরিত্রটিকে আত্মহননের পথে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। নাটকে দেখা যায়, গাঁয়ের রানিমা, তিনি ঘোষণা করেন, যে ওই চরিত্রটিকে মারতে পারবে, সে বিরাট আর্থিক পুরস্কার পাবে। সেই লোভে গ্রামের সবাই নানা কৌশলে, প্ররোচনার মাধ্যমে তাকে মারার চেষ্টা করে। মৃত্যুর আশঙ্কায় ক্রমশ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে চরিত্রটি। ফল হয় উল্টো। মৃত্যুভয়কে সঙ্গী করে বেঁচে থাকতে থাকতে একটা সময় সে সেই ভীতিকে জয় করে।
এই পরিস্থিতিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্রটি, গাঁয়ের অভিভাবকতুল্য, সে এসে তার হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে বলে– চুপিচুপি তুমি নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলো। এতে তোমারও ভালো, আমাদেরও মঙ্গল। মজার ব্যাপার, সেই মানুষটি কিন্তু তা পারে না। সে নিজের মৃত্যুর ভার তুলে দেয় গ্রামবাসীর ওপর। বলে– আপনারাই আমার বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিন। আমাকে মেরে ফেলার যন্ত্রণা আপনারা ভোগ করুন, সেটাই আমি চাই। মৃত্যু নদীর ওপারে যে জীবন-উপত্যকা, তার হদিশ সে পায় বলেই চরিত্রটি এমনটা উপলব্ধি করতে পারে।
এই চরিত্রে অভিনয় করার সময় অনুভব করেছিলাম, একবার মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারলে জীবন কত সহজ হয়ে যায়। ‘মরার আগে মরব না ভাই, মরব না’ সেই অনুভব মনে জাগে। নাটকে অভিনেতা মরে গিয়েও স্টেজে ফের উঠে দাঁড়িয়ে একথা প্রমাণ করতে চায়, অভিনয়ে শুধু বাঁচা আছে, মরা নেই। নাটকে চরিত্রের মৃত্যু আসলে মৃত্যুকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকা। ‘লিপিকা’র ‘কৃতঘ্ন শোক’ লেখায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, একজনের প্রিয় মানুষটি মারা গিয়েছে। তার জন্য শোক করছে সবাই। মন ক্রমাগত সান্ত্বনা দিচ্ছে প্রয়াতের সবচেয়ে নিকট মানুষটিকে। তবু বিলাপ থামছে না। ছোট ছেলে যেমন রাগ করে মাকে মারে, তেমনই করেই সেই সন্তপ্ত ব্যক্তি নিজের আশ্রয়-সম্বলে মাথা কুটতে লাগল। সংসার যেন বিশ্বাসঘাতক! আচমকা মনে হল তার– কে যেন বলল, ‘অকৃতজ্ঞ!’ জানলার বাইরে চোখ গেল হঠাৎ। সে দেখল ঝাউগাছের আড়ালে তৃতীয়ার চাঁদ উঠছে, যেন বিগতের হাসি লুকোচুরি ধরা পড়ছে সে ম্লান-আলোয়। তারা-ছিটিয়ে-দেওয়া অন্ধকারের ভিতর থেকে আচমকা ভর্ৎসনা ভেসে এল, ‘ধরা দিয়েছিলেম সেটাই কি ফাঁকি, আর আড়াল পড়েছে এইটেকেই এত জোরে বিশ্বাস?’
তাই মনে হয়, অভিনয়ে ধরা দেওয়া আছে। আড়ালকে অস্বীকার করতে চায় দর্শক, অভিনেতার মন। অভিনয়ে তাই বাঁচা আছে, মরা নেই।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৫। মঞ্চ থেকে প্রস্থান মানেই অভিনেতার মৃত্যু ঘটল, এমন নয়
পর্ব ১৪। অভিনয়ে নতুন রং লাগে অভিজ্ঞতার স্পর্শে
পর্ব ১৩। অভিনয়ের বয়স প্রভাবিত করে অভিনেতার যাপনকে
পর্ব ১২। অভিনয় যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই তৈরি করে আশঙ্কা
পর্ব ১১। অভিনেতার বিপদ লুকিয়ে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে
পর্ব ১০। ‘উইংকল-টুইংকল’-এর ১০০তম শো-এ আমি কি তাহলে ভুল সংলাপ বলেছিলাম?
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?