নির্দ্বিধায় আজ বলতে পারি, হুঁ, সহবাস করেছি আমি লন্ডনের সঙ্গে। সাময়িক সংসার পেতেছি। সুখ-দুঃখ-মনখারাপ-বন্য প্রেমে কী কথা যেন হয়েছে তার সাথে, তাহার সাথে। কখন যেন বেঁধেছি আমার প্রাণ লন্ডন-বন্ধনে। কখনও আবার সে অভিমানী প্রেমিকা। রাগিয়ে দিয়েছে আমায়। দুম করে তখন মনে পড়ে গিয়েছে আমার প্রথম ও শেষ প্রেমিকাকে। যার নাম কলকাতা। তুল্যমূল্য আদালত বসিয়েছি তখন। যেখানে আমি বাদী, আমি বিবাদী, আমিই ও দয়াল বিচার করো। টেমসের পাড় ধরে একাকী হাঁটতে-হাঁটতে ভিজে চোখে ভেবেছি, এর চেয়ে আমার গঙ্গাই ভালো।
১৩.
স্মৃতি যদি মিশে থাকে সত্তায়, তবে স্মৃতি চিরে দেখলেও কি গড়িয়ে যায় খানিক লাল-আভাস! জানা নেই। তবে স্মৃতির ভিতর যার বাস, তার গল্পেই সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ। সেই লালিমায় ফিরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে বারবার।
ছোটবেলায় একটা গল্প শুনতাম। বাবার মুখে। দাদুর মুখেও। একখানা বাসের গল্প। লাল টুকটুকে সে বাস। দোতলা। পিছনে পাকদণ্ডী সিঁড়ি। রূপসী সে যখন ডাক দিত ভ্রুচন্দনে, এ শহরের চিত্রার্পিত যুবকদের দেখা হয়ে যেত চন্দনের বনে। কল্লোলিনীর কুহকিনী সে। বাসটার নাম ছিল একখানা। যতদূর মনে পড়ে, এল নাইন। নিবাস, গোলপার্ক। যার দোতলার সিটে বসলে ঘিসাপিটা শহরটাকেও মনে হত আশ্চর্যময়ী। এখন তার বাস কেবল স্মৃতিতেই।
গল্পখানা ছোটবেলায় শুনে বড় রোমাঞ্চ হত। কেবল মনে হত, আহা যদি অমন একখানা পক্ষীরাজে চড়তে পারতাম! দোতলার সিটে বসে দেখতে পারতাম নিচের শহরটাকে। বাজপাখি-দৃষ্টিতে। ভাবিনি, সে শখ মিটবে বাইশে এসে! সত্যি, জীবন বড়ই বিচিত্র। সময় সময় অবিকল পি সি সরকারের জাদুঘর!
দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল লন্ডনে আমার। পড়াশোনা করতে এসেছিলাম। পড়াশোনা শেষ। এবার ফেরার পালা। তা, বাক্স-প্যাঁটরায় রাজ্যের জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে হিসেব করছিলাম, স্মৃতির কোন জড়োয়া ফেলে যাচ্ছি আমি? কিছু ভুলছি না তো? লন্ডনের কোন ছবিটাই বা এরপর থেকে যাবে আমৃত্যু? ক্যালেন্ডারে লাল কালিতে দাগিয়ে রাখা দিনের মতো?
শুনলে হাসবেন হয়তো, স্মৃতিতে ঘাইহরিণী সেই লাল টুকটুকে দোতলা বাস!
লন্ডনে আসা এই প্রথম নয়। আগেও এসেছি। হয়তো পরেও আসব। কিন্তু সাত-দশ দিনের ফুড়ুৎ-সফর এক জিনিস। আর তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ধরে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকা আর এক। নির্দ্বিধায় আজ বলতে পারি, হুঁ, সহবাস করেছি আমি লন্ডনের সঙ্গে। সাময়িক সংসার পেতেছি। সুখ-দুঃখ-মনখারাপ-বন্য প্রেমে কী কথা যেন হয়েছে তার সাথে, তাহার সাথে। কখন যেন বেঁধেছি আমার প্রাণ লন্ডন-বন্ধনে। কখনও আবার সে অভিমানী প্রেমিকা। রাগিয়ে দিয়েছে আমায়। দুম করে তখন মনে পড়ে গিয়েছে আমার প্রথম ও শেষ প্রেমিকাকে। যার নাম কলকাতা। তুল্যমূল্য আদালত বসিয়েছি তখন। যেখানে আমি বাদী, আমি বিবাদী, আমিই ও দয়াল বিচার করো। টেমসের পাড় ধরে একাকী হাঁটতে-হাঁটতে ভিজে চোখে ভেবেছি, এর চেয়ে আমার গঙ্গাই ভালো। ইচ্ছে হলেই কেমন হলুদ ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাওয়া যায়! বাতাসে ভেসে আসা হটডগের উদাসী সুবাস যেন বরুণার বুকের মাংসগন্ধ- ক্লান্তিকর। বরং লাল টেলিফোন বুথে ঢুকে ০৩৩ ডায়াল করতে প্রবল ইচ্ছে করেছে।
আবার পরে, অনেক পরে, রাগ কমেছে যখন, লন্ডন যখন উন্মত্ত প্রেমিকার মতো তার অধরসুধায় বাদল নামিয়েছে আমার ঠোঁটে, সেই টেমসের দূরান্তে লন্ডন ব্রিজকেই হাওড়া ব্রিজ বলে বিভ্রম হয়েছে! ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে দাঁড়িয়ে এসপ্ল্যানেডের অশীতিপর ‘গোথিক’ কাঠামোর বাড়িগুলোকে তখন চোখ বন্ধ করে দেখতে পেয়েছি। পিকাডেলি সার্কাসের উৎসবের মাদকতায় খুঁজে পেয়েছি একফালি পার্ক স্ট্রিট। হাইড পার্কে বসে মন বলেছে, এটাও তোরই। তোর বিলিতি গড়ের মাঠ!
তবু সেরা ও-ই, লন্ডনের কোহিনুর, দরিয়া-ই-নুর, ও-ই। লাল মিঠে দোতলা বাস!
লন্ডনে মেট্রোকে বলে ‘টিউব’। স্পাইডারম্যানের মতো জাল বিছিয়ে ভূগর্ভ থেকে পুরো শহরটাকে যে হারকিউলিসের মতো কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ‘টিউব’ আমার বিশেষ পোষায়নি। খুব গতানুগতিক। গলগলিয়ে লোকে উঠছে, নামছে, গজল্লা করছে। তার ওপর আবার বিলিতি আদব-কায়দার রকমারি ফ্যাকড়া। এসকেলেটর দিয়ে ওঠার সময় বাঁদিক ধরে উঠতে হবে। সামান্য ভুলচুকে এমন কড়া দৃষ্টি ধেয়ে আসবে যে, নিজেকে মনে হবে নেটিভ-চন্দর! তার চেয়ে বাবা, দোতলা বাস অনেক ভালো, অনেক সুখের। ওঠার সময় ট্রাভেল কার্ড পাঞ্চ করো, করে সিট খুঁজে নিশ্চিন্তে বসে পড়ো। দুলুনিতে চোখ কখন লেগে আসবে, টেরও পাওয়া যাবে না। বাবার কাছে শুনেছি, কলকাতার দোতলা বাসের আবার এক জ্ঞাতি ভাই ছিল। তার আবার নাকি ধড়-মুণ্ডু জোড়া লাগানো থাকত তার-টার দিয়ে। রাস্তা জুড়ে চলত সে, লগবগিয়ে। লন্ডনে সেই জ্ঞাতি ভাইয়ের খোঁজ পাইনি।
তবে বিলেতে দোতলা বাস দ্বৈত কার্যে ব্যবহার হয়। একদল যাত্রীবাহী। বিভিন্ন জায়গা থেকে সওয়ারি তুলে সারা শহর টহল দেয়। আর একদল অতিথি-বাহী। পর্যটকদের চাপিয়ে শহর চক্কর দেয়। শুধু সে বাসের ছাদ খোলা। নাম, ‘হো হো’। বাসজুড়েও তাই চলে। হি-হি-হো-হো। গাঁটের কড়ির অনুপাতে তেল। অর্থাৎ, যত বেশি রেস্ত, তত বেশি শহরের টুরিস্ট স্পট বরাদ্দ তোমার জন্য। সিটের সামনেই একটা হেডফোন রাখা থাকে। যেখান থেকে এক যন্ত্র-মানবী সুরেলা গলায় তোমায় নানা স্পটের ঐতিহাসিক ফিরিস্তি শোনাবে। আমার দিব্য লাগত ‘হো হো’। ছুটিছাটার দিন টইটইয়ের সঙ্গী ছিল ও আমার। আমার পক্ষীরাজ। দুদ্দাড়িয়ে বেরিয়ে পড়তাম। ইচ্ছেমতো নেমে যেতাম কোনও এক ‘পয়েন্ট’-এ। কখনও লেবানিজ রেস্তোরাঁয়, কখনও বা ‘ওয়েদারস্পুন’-এ। দশ-এগারো টাকায় ভরপেট মধ্যাহ্নভোজ (আরে বাবা, বাঙালি তো দিন শেষে। যতই ওটা দশ-এগারো পাউন্ড হোক, আমাদের কাছে একটাই মুদ্রা চলে– টাকা!)।
আর তাই, ব্যাগ-পত্তর গোছাতে-গোছাতে কখন যে এক পশলা মনখারাপ তুলে নিয়েছি, খেয়াল করিনি। খেয়াল করিনি, কখন ব্যাগের অন্দরমহলের গুমোট বাতাসে মিশে গিয়েছে আমারই দীর্ঘশ্বাস। ভালো থেকো আমার নিষিদ্ধ প্রেম, ভালো থেকো লন্ডন, আমার অবৈধ প্রেমিকা। ভালো রেখো আমার টুকটুকে রাঙা বাসকে। জেনো, কেউ মানুক বা না মানুক, তুমি আমাদের এক অপূর্ব ‘ওপেন সিক্রেট’।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
সরি, সরি, আমাদের এক এবং অদ্বিতীয় ‘ওপেন অ্যান্ড শাট সিক্রেট’। দশ কোটি বাঙালির রূপকথার কলকাতা, প্রেমিকার বুকের গোপনে যত্নে তুলে রাখা সেই সুগন্ধী রুমাল। সময় তাকে কেড়ে নিলেও স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে তার বাস, সুবাস।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে