বাড়িওয়ালার মূক ও বধির মেয়ে, আমার দিদিস্থানীয়া, এক সন্ধেয় বারান্দা থেকে পড়ে গেলেন উঠোনে। একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে এল। তখন ঘন কালো লোডশেডিং। আমাদের একতলার দালানে একটিমাত্র মোমবাতি জ্বলছে। আমি দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখলাম উনি পড়ে আছেন। অন্ধকারে রক্তের রং বোঝা গেল না। দিদি আমার দিকে কাতর চেয়ে আছেন আর আমি পাথরের ভগবানের মতো স্থাণু।
বাবা যখন ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতেন কলকাতা থেকে আরামবাগ, তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ উনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় কোনও কোনও দিন ঘুম ভেঙে যেত। রাত দশটা নাগাদ সদর দরজায় আওয়াজ হলে বুঝতাম উনি ফিরেছেন। যদিও নিয়ম অনুযায়ী আমি রাত সাড়ে ন’টার আগেই বিছানায়, তবু চোখ বন্ধ করে জেগে থাকতাম যতক্ষণ না খিল দেওয়ার শব্দ কানে আসে। মাঝে মাঝে আরও রাত হত। মূলত ট্রেনের গন্ডগোলে। সেই সময়ে মোবাইল দূরে থাক, ল্যান্ডলাইন চালু থাকাও ভাগ্যের ব্যাপার! ফলে মা-দাদার উৎকণ্ঠা ছাড়া আর কোনও অবলম্বন ছিল না। রাত বেশি হলে প্রতিবেশীরা সেই চিন্তায় যোগ দিতেন এবং তাঁদের মুখেই হয়তো, ‘অ্যাকসিডেন্ট’-এর আশঙ্কার কথা শুনেছিলাম একবার। সেইসব রাতে, ব্যক্তিগত ঈশ্বর, পাশবালিশে মুখ গুঁজে আমি দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরতাম। হালকা কাঁপুনির মধ্যে কখন যে ঘুম ঢেকে দিত চোখের পাতা, সকালে উঠে মনে থাকত না। পরের দিন বাবার অফিস যাওয়ার তোড়জোড়ে আবার নিশ্চিন্ত ভোর।
পাল্টি পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
একটু বড় হয়েছি, দাদা সন্ধেবেলা গেছে মানিকতলা স্ট্রিটে। কলেজের এক অধ্যাপকের বাড়ি। ওদিকে রাস্তা ব্ল্যাক আউট করে বেমক্কা বোমাবাজি। সঙ্গে সোডার বোতলের রাস্তা ঠোকরানোর ঝনঝন আওয়াজ। বাবা বেরিয়ে গেলেন। আমি, মা অজানা আশঙ্কায় চুপ হয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর দাদাকে নিয়ে এলেন সঙ্গে করে, অক্ষত অবস্থায়। যে সময়ের কথা, সরকারি ইমারজেন্সি শেষ হয়েছে সবে বছরখানেক।
বাড়িওয়ালার মূক ও বধির মেয়ে, আমার দিদিস্থানীয়া, এক সন্ধেয় বারান্দা থেকে পড়ে গেলেন উঠোনে। একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে এল। তখন ঘন কালো লোডশেডিং। আমাদের একতলার দালানে একটিমাত্র মোমবাতি জ্বলছে। আমি দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখলাম উনি পড়ে আছেন। অন্ধকারে রক্তের রং বোঝা গেল না। দিদি আমার দিকে কাতর চেয়ে আছেন আর আমি পাথরের ভগবানের মতো স্থাণু। কয়েক মিনিট পরেই দোতলা থেকে ‘পড়ে গেছে, পড়ে গেছে’ চিৎকার কানে এল। তারপর সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ। আমাকে পাশ কাটিয়ে দু’-তিনজন দিদিকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেলেন। মাসখানেক পর সন্ধেবেলা দেখলাম উনি আবার ওই বারান্দায় বসে চুল আঁচড়াচছেন।
পাল্টি পর্ব ১৫: পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক
মা’র কিন্তু সুস্থ হতে অনেক দিন লেগেছিল অপারেশনের পর। পুরুলিয়ায়, বাবার কোয়ার্টারের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি সিলিং ফ্যান যখন ভেঙে পড়ে, উনি সবে পাশ ফিরেছেন বিছানায়। আলবাট্রসের ডানা ওনার কনুই ভেঙে দেয়। আর পাখার হাঁড়ি ভাঙে সরকারি মেঝে, খাটের পায়া।
মাদ্রাজের গোল্ডেন বিচ থেকে ফেরার সময় কৃষ্ণেন্দুর বাইক থেকে উল্টে পড়ি, পিলিয়ন আমি । হাইওয়ের পাশে একটি জনপদে বাসস্ট্যান্ড। সন্ধে পেরিয়ে রাত নামছে। সামনে দাঁড়ানো বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে পপাত চ। যখন জ্ঞান ফিরল, ফুটপাথে বসে আছি। এক মহিলা মাথায় জল ঢালছেন। আরেক ভদ্রলোক দৌড়ে গিয়ে পাশের ওষুধের দোকান থেকে একটি পেইন কিলার এনে খাইয়ে দিলেন। কৃষ্ণেন্দুর হাঁটুতে চোট, আমার মাথায়। এলাকার লোকজন তামিল ভাষায় কুশল জিজ্ঞেস করছেন আর আমরা বাংলায় উত্তর দিচ্ছি। পিছনে কোনও বাস ছিল না তাই প্রাণে বেঁচেছি, বোঝা গেল।
পাল্টি পর্ব ১৪: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
কর্পোরেট স্যুট-টাই পরতে শেখায়। আর শেখায় ভোরবেলা ফ্লাইট ধরতে বেরনোর সময় ঘুমন্ত স্ত্রী-পুত্রের দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দেওয়ার কায়দা। শীতের ভোরে আলো ফোটেনি তখনও। ভিআইপি রোডে , লেকটাউনের আগেই প্রবল জ্যাম। শম্বুক গতিতে গাড়ি চলেছে একটু বাঁদিক চেপে। অনেক গাড়িতে হ্যাজারড ব্লিঙ্কার জ্বলছে। একটু বিরক্ত হই। এয়ারপোর্ট পৌঁছতে না দেরি হয়ে যায়। গাড়ি একটু এগোতে দেখি ডানদিক ঘেঁষে একটি বিশাল ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে আর নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তার পেটে ঢুকে আছে একটা আপ ক্যাব। বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পাই ক্যাবের যাত্রীকে। রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছেন। নাক-মুখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছে। আমার ড্রাইভার বললেন, ‘ওই দেখুন স্যর, এখনও ধুকপুক করছে। আর কয়েক মিনিট।’ চমকে ডানদিকে তাকাই। গাড়ির স্টিয়ারিং-এর ওপর মাথা রেখে কোথায় চলেছেন আপ ক্যাবের ড্রাইভার? তোবড়ানো বনেট, ভাঙা উইন্ডশিল্ড। এয়ার ব্যাগ নেই? থাকলেও খোলেনি বোধহয়। সিট বেল্ট পরে আছেন দেখছি, তাহলে কি চান্স আছে কোনও? এই দুই যোদ্ধাকে দু’পাশে রেখে আমাদের কর্পোরেট কনভয় এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে যায়। কাগজে খবরটা পড়ি দিন দুই বাদে। জানতে পারি আমার বাবা, আমার দাদা কিংবা আমার মতোই ওই ক্যাব ড্রাইভারও একজন পিতা… ছিলেন।