যে আমি এবং আমার বন্ধুরা বাংলায় গালাগাল দিলাম, প্রেম নিবেদন করলাম, ঝগড়া করলাম, সুমন শুনলাম অষ্টপ্রহর, প্রতুল মুখুজ্জেকে ‘গুরুদেব’ বলে জড়িয়ে ধরলাম, ইন্টারভিউতে ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তর বাংলায় ভেবে নিয়ে তরজমা করে কোনরকমে উগরে দিলাম, সেই আমরাই আমাদের পরের জেনারেশন-কে জন্ম থেকে শিক্ষা দিলাম বাংলাকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে গোল দিতে হয় সাকসেস নামক তেকাঠির ফাঁক দিয়ে। আর কী কাণ্ড! একটা আস্ত ভাষা তালগোল পাকিয়ে ফেসবুকে লিখল– পুরী বা দিঘায় সি দেখতে পাওয়া যাবে এমন কোনও স্পটে চিপ হোটেল আছে?
এককালে বাঙালি সাধারণ বাক্যালাপ বাংলাতে করত আর ঝগড়া করত ইংরাজিতে। শুনেছি, ব্রিটিশ আমলে বাংলাতে ডাক্তারিও পড়া যেত। আমার বাবা-মা’র জেনারেশন যেহেতু ওই আমলে বড় হয়েছেন, তাই ‘বাংলা মিডিয়াম’ নামক শব্দবন্ধর সম্ভাব্য অভিঘাত তাঁদের মগজে ঢোকেনি। সে আমলে দুই ভাষাই প্রায় একই দক্ষতায় পড়ানো হত। তাই ছোটবেলায় অগ্রজদের দেখেছি, বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক গর্ব করতে। যে ‘বাংলা’-র গুষ্টি উদ্ধার করতেন তাঁরা, সেটি মদ। তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, দশটা-পাঁচটার বাঙালি, বাংলা মদকে একটি ‘সাবঅল্টার্ন দুর্ঘটনা’ বলে দাগিয়ে দিতেন। অবিশ্যি খালাসিটোলায় কমলকুমার, সুনীল, শক্তি বাংলায় যে রস সৃষ্টি করেছেন, তা ঢকঢক করে পান করতে তাঁদের কোনও সংকোচ হয়নি। আমার ছোটবেলার পাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতার শিক্ষা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাংলা মদ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও আলোচনা হত না। তবে ধরে নেওয়া হত ভোরবেলা যে সিনিয়র সিটিজেনকে নর্দমার ধারে খুঁজে পাওয়া গেল আলুথালু বেশে ঘুমন্ত অবস্থায়, অথবা মাঝরাতে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় যে মাঝবয়সি মদ্যপ ব্যক্তি পাইপ বেয়ে ছাদে উঠতে গিয়ে পড়ে মারা গেলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বাংলা খেয়েছিলেন। কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু চূড়ান্ত নেশার সঙ্গে বাংলা মদ-কে জড়িয়ে নেওয়া পাড়া কালচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মনে আছে, কৈশোরে এক সন্ধের ঘটনা। আমাদের বাড়িতে সেজোমামা এসেছেন। কোনও কারণে বাবার সঙ্গে তুমুল তর্ক শুরু হল। এবং একটু পরেই তাঁদের মধ্যে যে কলোনিয়াল হ্যাংওভার পরিলক্ষিত হল, কয়েক বোতল বাংলা খেলেও সেই টলমলে অবস্থায় পৌঁছনো যেত না। ভাবগতিক সুবিধের নয় দেখে আমি উল্টোদিকে পিঙ্কুদের বাড়ি চলে যাই এবং ক্যারম খেলতে থাকি। জানলার ফাঁক দিয়ে আমার দুই পরমাত্মীয়র ইংরেজি বাক্যবাণ মাঝে মধ্যেই খেলায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। পিঙ্কু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার বাবা আর মামা দু’জনেই দেখছি সাহেবের গু মাড়িয়েছেন।’
বাংলা মদ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও আলোচনা হত না। তবে ধরে নেওয়া হত ভোরবেলা যে সিনিয়র সিটিজেনকে নর্দমার ধারে খুঁজে পাওয়া গেল আলুথালু বেশে ঘুমন্ত অবস্থায়, অথবা মাঝরাতে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় যে মাঝবয়সি মদ্যপ ব্যক্তি পাইপ বেয়ে ছাদে উঠতে গিয়ে পড়ে মারা গেলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বাংলা খেয়েছিলেন। কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু চূড়ান্ত নেশার সঙ্গে বাংলা মদ-কে জড়িয়ে নেওয়া পাড়া কালচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই প্রথম যখন মদ ঠেকাই জিভে, সেটা বাংলা ছিল না। তারওপর এক ব্যাচমেটের হাফ বোতলেই এমন অ্যালার্জি বের হল সারা গায়ে, মিসলস ভেবে কেটে পড়লাম। অথচ এমন অ্যালার্জি বিলিতি খেয়েও বের হতে পারে, পরে সেই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। শুধু একদিন, পাড়ার রকে, মদের সঙ্গে কী ধরনের চাট খাওয়া যায়– এই নির্বিষ আলোচনা যখন প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়, তখন এক দাদাস্থানীয় বলে ফেলেছিলেন, ‘যা যা, ওইসব ডালমুট-ফালমুট শোনাস না। আমরা তোদের বয়সে আপেল দিয়ে বাংলা খেতাম।’ একটু ঝটকা লেগেছিল! যাঁর কোলে-পিঠে বড় হয়েছি, তিনিও তাহলে ওই অচ্ছুত মদ খেতেন।
অনির্বাণ যখন আলমবাজারের সরকারি দোকান দেখিয়ে বলেছিল, সেখানে কলকাতার সবচেয়ে সেরা কালিবাবু পাওয়া যায়, আর তাও মাত্র আট টাকা বোতল, তখন আমার কলেজের বাংলার প্রফেসর কালিবাবুর কথা মনে পড়ে যায়। উনি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ক্লাসটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতেন। ৪৫ মিনিট পর মনে হত, যে নেশা ধরালেন তা আট কেন, আটশো টাকাতেও জুটবে না। ক্লাসের শেষে, যেকোনও মেয়েকে ওই বাংলায় প্রস্তাব দিলে, সে রাজি হয়ে যাবে নির্ঘাত। আর যদি প্রত্যাখ্যাত হইও, ব্রিটিশ আমলের থামগুলোকেই না হয় প্রপোজ করে দেব। তাই আমার কাছে কালিবাবু সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমার পদাবলি হয়ে রয়ে গেলেন, বোতল হতে পারলেন না। তবু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কখন যে ছোটবেলার ‘সাহেবের গু’ গায়ে মাথায় মেখে গেল, বুঝতেই পারলাম না। যে আমি এবং আমার বন্ধুরা বাংলায় গালাগাল দিলাম, প্রেম নিবেদন করলাম, ঝগড়া করলাম, সুমন শুনলাম অষ্টপ্রহর, প্রতুল মুখুজ্জেকে ‘গুরুদেব’ বলে জড়িয়ে ধরলাম, ইন্টারভিউতে ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তর বাংলায় ভেবে নিয়ে তরজমা করে কোনরকমে উগরে দিলাম, সেই আমরাই আমাদের পরের জেনারেশন-কে জন্ম থেকে শিক্ষা দিলাম, বাংলাকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে গোল দিতে হয় সাকসেস নামক তেকাঠির ফাঁক দিয়ে। আর কী কাণ্ড! একটা আস্ত ভাষা তালগোল পাকিয়ে ফেসবুকে লিখল– পুরী বা দিঘায় সি দেখতে পাওয়া যাবে এমন কোনও স্পটে চিপ হোটেল আছে? অথবা অটোতে সহযাত্রীর ফোনালাপ– টেবিলের ওপর ইয়েলো ব্যাগের পাশে যে ফুড প্যাকেটটা রাখা আছে, সেটা ফরগেট করিস না প্লিজ।
এই সেদিন এফ.এল.অফ শপের কাউন্টারে যখন দোটানায় রয়েছি , হুইস্কি না ভদকা– কাঁধের ওপর থেকে মুখ বাড়িয়ে এক বৃদ্ধ বললেন, ‘একটা বাংলা দেবেন।’ ঝকঝকে বোতল নেমে এল তাক থেকে। মনে হল ভাষাটাকেও যদি কালিবাবুর মতো কোনও পাত্রে রেখে দিতে পারতাম বিলিতির দোকানে, তাহলে প্রতি সন্ধ্যায় সেটাই হয়ত দু’-এক পেগ টানত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
…পাল্টি-র অন্যান্য পর্ব…
পাল্টি পর্ব ২১: সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো
পাল্টি পর্ব ২০: যে কারণে বুলাদির মর্তে আগমন
পাল্টি পর্ব ১৯: আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?
পাল্টি পর্ব ১৮: ‘আসল হিজড়ে’ কথাটা সোজা মাথায় আঘাত করে
পাল্টি পর্ব ১৭: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
পাল্টি পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
পাল্টি পর্ব ১৫: পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক
পাল্টি পর্ব ১৪: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
পাল্টি পর্ব ১৩: আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়
পাল্টি পর্ব ১২: টিবি হয়েছে বলে আড়ালে বন্ধুটির নাম দেওয়া হয় ‘কিশোর কবি’
পাল্টি পর্ব ১১: ডোমেরা জানে, আগুনের তর সয় না
পাল্টি পর্ব ১০: আমেরিকায় খুন হওয়ার থেকে স্বদেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ভাল
পাল্টি পর্ব ৯: মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে?
পাল্টি পর্ব ৮: খোকাবাবু, ম্যাডাম স্যুইটে আছেন, এক ঘণ্টায় ৪০০ দেবেন বলছেন
পাল্টি পর্ব ৭: ও তো সন্ধে থেকেই গিরিশ ঘোষ
পাল্টি পর্ব ৬: যে দোকানের বেবিফুডে বেড়ে উঠলাম, সেখান থেকেই বীরদর্পে কন্ডোম কিনেছি
পাল্টি পর্ব ৫: প্রায়শ্চিত্ত রোল অ্যান্ড কর্নার
পাল্টি পর্ব ৪: দু’অক্ষর কথা, চার-অক্ষর কথা
পাল্টি পর্ব ৩: ‘টুকলি’ ঈশ্বরের দয়ার শরীর
পাল্টি পর্ব ২: পাগলি তোমার সঙ্গে
পাল্টি পর্ব ১: প্যান্টি যেন বদ্বীপ, লাজুকলতা নরম কাপড় জুড়ে যাবতীয় গোপনীয়তা