দিল্লি-লখনউ-এর তুলনায় কলকাতা যে খোকা শহর, একথা আমরা চট করে খেয়াল না রাখলেও ফেলুদা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে গোরস্থানে ঘোরাঘুরির সময়ে। আমাদের নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ইংরেজ কোম্পানি আসার পর, কখনও তাঁদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে, কখনও তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে, বাংলার পল্লিজীবনের আদলে।
১৩.
‘আবার ফেরাও সহজ শহরে/ যেখানে দশটা-পাঁচটার পর/ ক্লান্ত লোকেরা অন্তত নিঃশঙ্ক বাড়ি ফেরে;/ সূর্যাস্তের সিঁদুর পশ্চিমে,/ ঘরে ঘরে গৃহিণীরা গা ধোয়,/ আর গা-ঢাকা অন্ধকারে ঘরছাড়া বাবুরা/ চকিতে বেপাড়ায় ঢোকে।’
বা
‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব/ বলেছে পাড়ার দাদারা/ অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই’
পাড়া-বেপাড়া-অন্য পাড়া এইসবই কলকাতার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। পাড়ার মেয়ে, পাড়ার দাদা, পাড়ার মাতাল, পাড়ার নতুন বউ থেকে শুরু করে মিষ্টির দোকান, পুজোর প্যান্ডেল, ক্লাবঘর, মোড়ের বাড়ি– সব মিলিয়ে কলকাতার নগর জীবনের একটা বড় বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পাড়াতুতো দিনযাপন। সেখানে যেমন পাড়ার নেড়ির জন্য রয়েছে আদর, বেপাড়ার কুকুরের তেমনই জোটে খ্যাঁকানি। বাংলা সাহিত্য, সিনেমা, গানে নানাভাবে উদযাপন করা হয়েছে কলকাতার পাড়াকে। পটলডাঙার চাটুজ্যেদের রোয়াকের চারমূর্তি, ‘তিন ভুবনের পারে’র বখাটে ছোঁড়াদের ট্যুইস্ট, বা রবি আর ছেনো মস্তানের হাতাহাতি– পাড়ার ছেলেদের সরব উপস্থিতি আমাদের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। একুশ শতকে যে আর ‘সেই আমাদের সময়ের’ পাড়া নেই শহরে, এই বলে হা-হুতাশও হু হু করে বেড়ে চলেছে। তবে যে কোনও আক্ষেপ বা উদযাপনেই ঢাকা পড়ে থাকে অন্য নানা স্বর, অন্য নানা জীবন। সেই ভিন্নতাকে বুঝতে চাইলেই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে বহুমাত্রিকতা।
দিল্লি-লখনউ-এর তুলনায় কলকাতা যে খোকা শহর, একথা আমরা চট করে খেয়াল না রাখলেও ফেলুদা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে গোরস্থানে ঘোরাঘুরির সময়ে। আমাদের নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ইংরেজ কোম্পানি আসার পর, কখনও তাঁদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে, কখনও তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে, বাংলার পল্লিজীবনের আদলে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বা সুবল মিত্রের অভিধানে ‘পাড়া’ খুঁজলে দেখা যাবে যে এই ধারণা মূলত গ্রাম বাংলায় ছিল, সেখান থেকে কলকাতা শহরে আগমন। বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনীতেও দেখা যায় গ্রামীণ জীবনে জাতিগত পরিচিতির নিরিখে পাড়ার বিন্যাস। গ্রাম বাংলার এই ‘স্থানিক বর্গ’ কলকাতার নগরায়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায় উনিশ শতক থেকে, যদিও নাগরিক আবহাওয়ায় নতুন আঙ্গিকে এর আত্মপ্রকাশ। জাতি বা পেশাগত গোষ্ঠীর সমষ্টি হিসেবে বেশ কিছু পাড়া ছিল আদি কলকাতায়। কিন্তু এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল মিশ্র সংস্কৃতির পাড়া, মূলত আধুনিক মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীর হাত ধরে। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সূত্র ধরে শুধু জাতি বা পেশা নয়, অন্য নানা বৈশিষ্ট্য নতুন শহরে এক নতুন গোষ্ঠীজীবনের সূচনা করে। এবং তাতে জড়িয়ে থাকে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা, পাড়া-বেপাড়ার চাপানউতোর, এলাকা মেপে নেওয়ার নিত্য নতুন কারসাজি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কিন্তু এই ‘নাগরিক জীবনের’ অংশ সকলে একইরকমভাবে হয়ে উঠতে পারেনি কখনওই। পাড়ার ‘অন্দর-বাহির’ ছিল, মধ্যবিত্ত মহিলাদের নজর দিয়ে দেখলে পাড়ার জীবন অনেকাংশেই সীমায়িত, বাড়ির ছাদ-বারান্দা-জানালা দিয়ে তৈরি হত তাঁদের পাড়ার জগৎ, রাস্তা বা রোয়াকে নয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১৮৮৩ সালে রাজবল্লভ স্ট্রিটে চালু হয় বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি। গৌরহরি সেন আর তাঁর বন্ধু কুঞ্জবিহারী দত্ত থাকতেন কাছেই, বিডন স্ট্রিটে। কিন্তু তাঁদের মনে হল চার পা হেঁটে বই দেখা বা ঘরে নিয়ে আসার বদলে নিজেদের এলাকাতেই একটা বন্দোবস্ত করা দরকার। চেয়েচিন্তে টাকা ধার নিয়ে আর কিছু লোক জুটিয়ে ১৮৮৯ সালে বিডন স্ট্রিটে খুলে ফেললেন চৈতন্য লাইব্রেরি। এইসব লাইব্রেরি (এবং আখড়া, ব্যায়াম সমিতি, বা খানিক পরে ছোট ছোট ক্লাব) ধরে পাড়াগুলির নিজস্ব একটা পরিচিতি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, যা কলকাতার নাগরিক জীবনে এক বিশেষ ছাপ ফেলেছিল উনিশ-বিশ শতকে।
কিন্তু এই ‘নাগরিক জীবনের’ অংশ সকলে একইরকমভাবে হয়ে উঠতে পারেনি কখনওই। পাড়ার ‘অন্দর-বাহির’ ছিল, মধ্যবিত্ত মহিলাদের নজর দিয়ে দেখলে পাড়ার জীবন অনেকাংশেই সীমায়িত, বাড়ির ছাদ-বারান্দা-জানালা দিয়ে তৈরি হত তাঁদের পাড়ার জগৎ, রাস্তা বা রোয়াকে নয়। যেমন আশাপূর্ণা দেবীর লেখা থেকে জানা যায় চৈতন্য লাইব্রেরি থেকে বই পড়ার কথা:
‘চৈতন্য লাইব্রেরির সঙ্গে আমার বাল্যস্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। আমার মা এই লাইব্রেরি থেকে বরাবর বই আনিয়ে পড়তেন। তখনকার দিনে অবশ্য মেয়েদের পক্ষে নিজে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নির্বাচন করে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ক্যাটালগ থেকে নাম নিয়ে বাড়ির ছেলেদের দিয়ে বই আনিয়ে নেওয়া হত। মায়ের দৌলতে আমরাও চৈতন্য লাইব্রেরির বই-এর পাঠিকা ছিলাম।’
ভদ্রলোক পাড়ায় তেমনই নিচু জাতের আনাগোনা সন্দেহের চোখে দেখা হত। রাস্তা, পুকুর, মাঠ, বা রেললাইনের মতো নির্দিষ্ট চিহ্নের পাশাপাশি অনেক সময়েই পাড়ার সীমানা নির্ধারিত হয়ে যেত পাকা বাড়ি আর বস্তির ভেদরেখায়। তিনের দশকে বাগবাজারের ‘গৌরব’ নিয়ে কিরণচন্দ্র দত্ত লিখছেন,
‘কলিকাতা মহানগরীর এই বাগবাজার পল্লিতে যতগুলি হিন্দু পরিবারের ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও নবশায়কগণ বাস করেন, এতগুলি সংঘবদ্ধ হিন্দু পরিবার আর কোনো পল্লিতে নাই। কলিকাতার অন্যান্য অংশে যান, প্রতি স্থলেই প্রায় হিন্দুর সহিত অন্যান্য জাতিরা একত্র বাস করেন দেখিতে পাইবেন। ছাঁকা হিন্দুর উচ্চ জাতিগণের একত্র বাস এই বাগবাজারে। মুখুজ্যে পাড়া, গোঁসাই পাড়া, বসু পাড়া, রাজবল্লভ পাড়া প্রভৃতি নামই তাহার সাক্ষ্য দিবে।… দু-একটি অনুন্নত ও ভিন্নশ্রেণির জাতিও এখানে বাস করে। কিন্তু উচ্চবর্ণের সহিত তাহারা ঘনিষ্ঠ ভাবে সংশ্লিষ্ট। হিন্দুগণের প্রধান খাদ্য দুগ্ধ, এজন্য গোয়ালা পাড়া বাগবাজারে আছে, হিন্দুরা মতস্যপ্রিয়, মাংসে ততটা অভ্যস্থ নহে, এই জন্য ইলিশ বা তপস্যা মৎস্যধারী জেলিয়া পাড়া আছে। বিচালি ও ঘাসের (গাভী ও অশ্বের খাদ্যের) মহাজন হিসাবে কয়েক ঘর মাহিষ্য জাতির বাসও আছে।’
বোঝাই যাচ্ছে, ‘ছাঁকা হিন্দুর’ সঙ্গে কিছু নিচু জাতের বা ভিন্ন শ্রেণির মানুষ তখনই বাস করতে পারেন একই পাড়ায়, খানিক তফাতে, যখন তাঁরা উচ্চবর্ণের দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় খাদ্য বা শ্রম সরবরাহ করতে পারতেন। পাড়ার ‘কল্পিত’ পরিবারে এঁদের ঠাঁই হত না। গত শতকের তিন-চারের দশকে কলকাতার সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া দ্রুত বদলাতে থাকে। ধর্মীয় পরিচিতির নিরিখে বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত হতে শুরু করে। দাঙ্গার সময়ে হিন্দু পাড়া/ মুসলমান পাড়া ভাগাভাগি হয়ে যায়। দাঙ্গা ও দেশভাগ পরবর্তী সময়ে মেলামেশার পথ আর খোলে না। পাড়া/বেপাড়ার ধারণা নতুন ভাবে আঁকা হতে থাকে শহরের বুকে। সেই ধারণা নিয়ে এখনও আমরা বয়ে চলেছি। ‘হিন্দু’ পাড়ায় মুসলমান বাড়ি ভাড়া পান না, দশটার পর পার্ক সার্কাসের দিকটা ঠিক ‘সেফ’ লাগে না, জনপ্রিয় সিনেমায় খিদিরপুরকে ‘অন্য দেশ’ বলে অভিহিত করা হয়, ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না’ বলতে হয় বাংলায় ৭০ পাওয়া মুসলমান ছেলেটিকে।
স্মৃতি সততই সুখের! পাড়ার জীবন নিয়ে নস্টালজিয়া আক্রান্ত বাঙালি মনে রাখে না যে যে কোনও পরিবারের মতোই এখানেও চাপা বেদনা আছে, ক্ষোভ আছে, রাগ আছে। পাড়ায় পরিচিতি যেমন আরাম দেয়, আনন্দ দেয়, স্থিরতা দেয়, তেমনই ‘দলে যোগ দিতে না পারার’ লাঞ্ছনাও দেয়। কার চোখ দিয়ে দেখছি তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অনেক সময়ে। ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমরা যে কোনও শহরের কোলাজ তৈরি করি। সেখানে যেমন উচ্ছ্বাস থাকে, ভালোবাসা থাকে, তেমনই থাকে পদে পদে ঠোক্কর, ক্ষমতার চোখ রাঙানি, অপরিচিতির গ্লানি।
সমর সেনের চার লাইন দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। বাগবাজার নিয়ে তাঁর মন্তব্য দিয়ে শেষ করি। কিরণ দত্তের প্রায় বিপরীত মেরু থেকে উঠে এসেছে এই কয়েক লাইন:
‘নানা কারণে বাগবাজারের নানা খ্যাতি ছিল। শিবের মন্দিরে গাঁজার আড্ডা, অনেক ব্যায়াম সমিতি, বোস-বাড়ির বিরাট মাঠে বারোয়ারি দুর্গা পুজো, প্রদর্শনী, মেলা ও ব্যায়ামবীরদের কসরৎ; পাড়ায় পাড়ায় সিদ্ধির কুলপি; প্রসিদ্ধ মিষ্টান্নের দোকান; অমৃতবাজার পত্রিকা, কাছেই যামিনী রায়ের বাড়ি। সকালে গঙ্গাতীরে নানা বিচিত্র দৃশ্য– নিতম্বিনীদের মুক্তকেশ লঘুবেশ স্নান ও ঢলানি। আবহাওয়া ভালো থাকলে আকাশ ভরে যেতো ঘুড়ি ও নানা ধরনের পায়রাতে। ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া রীতিমতো আর্ট ছিল।… কালীপ্রসন্ন সিংহের কলকাতার কিছুটা রেশ ছিল বাগবাজার শ্যামবাজারে।’
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট