একবার আমাদের পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের অনুরোধে পালমশাই হাঁসের পাশে কালিদাসকে বসিয়ে দেন। খড় বাঁধা কালিদাস দুপুরে উধাও হয়ে যায়। বিকালে শুধু ঠাকুর আর অর্ধভুক্ত হাঁস পাওয়া গিয়েছিল। কালিদাস-সমেত আধা হাঁস পাড়ার মাস্তান ভোলাদার (ষাঁড়) পেটে গিয়েছিল।
৮.
সরস্বতীর বাহন হাঁস। জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে এই প্রাণীটির অবাধ বিচরণ। প্রধানত সাদা রঙের শরীর, কমলা রঙের ঠোঁট, চ্যাপ্টা পায়ের পাতা যুক্ত পাখি হল হাঁস। এরা বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন। ব্রহ্মারও। হাঁস পবিত্রতা, ন্যায়, প্রজ্ঞা ও সত্যের প্রতীক। সরস্বতী বিদ্যার দেবী।
ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা। বাহন হাঁস এদের পিঠে বসিয়ে টহল দেয় সর্বত্র। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের লেখায় পাওয়া যায়– “মানস সরোবর হংসের স্থান। পুরাণাদিতে আছে যে সরস্বতী মানস সরোবর হইতে উৎপন্না। কাজেই হংসের সঙ্গে সরস্বতীর সংযোগ থাকা বিচিত্র নয়। কল্হন রাজতরঙ্গিণীর প্রারম্ভে কাশ্মীরের বর্ণনা দিয়াছেন। এই বর্ণনায় পাওয়া যায় যে সরস্বতী হংসরূপে ভেড়গিরিশৃঙ্গের সরোবরে দর্শন দিয়াছিলেন। দক্ষিণ ভারতের গদগে, হংসবাহনা দ্বিভুজা সরস্বতী আছে তার পাদপিঠে দু’টি করিয়া হংস। পাদপীঠের উপরে পদ্মপিঠে সমাসীনা দেবী সরস্বতী।” ফলে এটা জানা যায় যে সারা ভারতেই সরস্বতীর একমাত্র বাহন বলে হাঁসই স্বীকৃত।
আমাদের কুমোরপাড়ার পাল মশাইরা হাঁসের পিঠে সরস্বতীকে ভালো করে সেট করতে পারতেন না। শাড়ি পরে হাঁস আর বাইকের পিঠে দু’দিকে পা দিয়ে বসা যায় না। তাই তারা হাঁসটাকে ডানা মেলা অবস্থায় এক সাইডে সেট করতেন। তার পিঠে ঠাকুর একদিকে কাৎ হয়ে বসে বীণা বাজান। বেশ ব্যালেন্সিং বিমের মতো। একবার আমাদের পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের অনুরোধে পালমশাই হাঁসের পাশে কালিদাসকে বসিয়ে দেন। খড় বাঁধা কালিদাস দুপুরে উধাও হয়ে যায়। বিকালে শুধু ঠাকুর আর অর্ধভুক্ত হাঁস পাওয়া গিয়েছিল। কালিদাস-সমেত আধা হাঁস পাড়ার মাস্তান ভোলাদার (ষাঁড়) পেটে গিয়েছিল। সরস্বতীর সাথে আলাদা করে হাঁস বানালে ঝামেলা অনেক। হাঁস সবসময় কাঠামোয় সাইড অর্থাৎ প্রোফাইল দেখিয়ে থাকে। তার একদিকে চোখ আঁকলেই হয়।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটা কবিতা ছিল। ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল…’। গোটা কবিতাটা প্রশ্নবাণে জর্জরিত। শুধু শেষের দিকে ধুয়ো দেবার মতো বারবার আসে ‘সেই আমাদের বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে’। সেখান থেকেই জানি, হাঁসের আরেকটা নাম ‘মরাল’। ‘কোথায় জলে মরাল চলে মরালি তার পাছে পাছে’।
বাংলায় হাঁস শিল্প, সাহিত্য থেকে শুরু করে দামি কল, বই প্রকাশনা সংস্থার নাম– সর্বত্রগামী। হাঁসকে প্রতীক করে নিয়ে সবচেয়ে ভালো ব্রান্ড ডাকব্যাক। হাঁসের তৈলাক্ত পাখায় যেমন জল দাঁড়ায় না, রেনকোটও তেমন জল প্রতিরোধ করে। অপূর্ব মিল। সবচেয়ে মজার হল এই ডাকব্যাকের লোগোতে কোনও হাঁসের ছবি নেই। শুধুই নামের ওপর বিন্দুচারেক জলের ফোঁটা।
প্রজ্ঞার প্রতীক হাঁসকে কেন্দ্র করে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের লোগো ডিজাইন করেন।
সারা ভারতের শিল্পকলায় হাঁসের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
অজন্তার ফ্রেস্কো থেকে শুরু করে কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরের সারিবদ্ধ হাঁসের দল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ভারতশিল্প চিরকাল জীবজগতকে উন্নততর স্থান দিয়ে এসেছে। অনুভূতি, বিবর্তনের ধারা, প্রতীক সবখানেই হাতি, ঘোড়া, পেঁচা, হাঁস, সিংহ, শকুন, হনুমান ইত্যাদি জীবজন্তু স্থান পেয়ে এসেছে।
অজন্তা, মুঘল, রাজপুত থেকে শুরু করে একেবারে বেঙ্গল স্কুলের অবন ঠাকুরের আঁকা ‘হাঁস ও কিশোরী’-র ছবি– সর্বত্রই পাখপাখালি জীবজন্তুর উপস্থিতি লক্ষণীয়।
ইন্দ্রের পাণি-প্রার্থনায় প্রেরিত হাঁস যখন নিষাদ নল-এর শুশ্রূষায় প্রাণ ফিরে পেয়ে বিদর্ভের রাজকন্যা দময়ন্তীর কাছে ইন্দ্রের পরিবর্তে নলের বীরগাথা প্রচার করা শুরু করল, তখনই দময়ন্তী নলের প্রেমে পড়ে গেল। সেই প্রেমগাথার ছবি আঁকলেন রবি বর্মা। ভারতশিল্পের প্রেমের প্রতীক। জীবজগতের সাথে সখ্যতার চূড়ান্ত নজির তা আজও।
ঠিক উল্টোদিকে পশ্চিমি ইতিহাসে ‘লিডা ও হংস’ ভাস্কর্যটিও অমলিন হয়ে রইল শিল্পের ভূখণ্ডে। হংসরূপধারী জিউস মিলিত হয়েছিল স্পার্টার রানির সঙ্গে আর কালক্রমে তার ফলশ্রুতি হলেন ‘হেলেন অফ ট্রয়’। রচিত হল মহাকাব্য ইলিয়াড।
হাঁস তাই শিল্পের বাহন, সাহিত্যের বাহন, মহাকাব্যেরও বাহন।
… পড়ুন বাহনকাহন-এর অন্যান্য পর্ব …
৭. দেবতার চেয়ে মানুষের বাহন হিসেবেই কুকুর বেশি জনপ্রিয়
৬. বিশ্বকর্মার বাহন, রাজারও বাহন
৩. বাহন বিড়ালের ভার লাঘব করতে হয়েছিল স্বয়ং ঠাকুরকেই
১. মন্দিরের লাগোয়া তার আসন, তার কানে মনের বাসনা জানালে সরাসরি পৌঁছে যায় বাবার কাছে
বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদের শিল্পী হ্যারল্ড শ্যাপিনস্কিকে আবিষ্কার করেছিলেন এ দেশের আকুমল রামচন্দ্র। আকুমলের বহু চেষ্টার পর লন্ডনে প্রথম প্রদর্শনী হয় শ্যাপিনস্কির। বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ এই আবিষ্কারের গল্প নিয়ে ২০ পৃষ্ঠা জুড়ে বিশাল লেখা প্রকাশ করে।