পরে নিজের ভুল বুঝতেও পেরেছিলেন তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন ঐক্যের ধুয়ো তুলে বিবিধের নিজস্ব আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করলে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’-এর মূলধারাকে অমান্য করা হবে। যেখানে বৈসাদৃশ্য আছে, সেখানে বৈসাদৃশ্যকে মেনে নিয়েই স্থাপন করতে হবে সামঞ্জস্য। দেখতে হবে বৈসাদৃশ্য যেন উৎকট হয়ে উঠে অপরকে আঘাত করতে উদ্যত না হয়।
আসামের সাহিত্যিক বেনুধর রাজখোয়া ঘোষণা করেছিলেন অসমিয়া কবি পুরুষোত্তম গজপতি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ। ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে এমন ঘোষণা শুনে অনেকেই অবাক। শেষ অবধি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানাতে হল তাঁর আত্মপরিচয়। রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত সে-সময় আসামের শাসন পরিষদের সদস্য। তাঁর কন্যা অমলা দত্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রী, রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন। কবি ‘কুইনী’ বলে ডাকতেন। চিঠিতে (৭ এপ্রিল, ১৯৩৫) রবীন্দ্রনাথের কৌতুক ঝলসে উঠেছে। ‘একবার পোর্টুগীজ কাগজে রটিয়েছিল যে, আমাদের কোনো পূর্ব্ব পিতামহ ছিলেন পোর্টুগীজ। পারস্যের রাজা আমাকে দেখে আন্দাজ করেছিলেন আমার ধমনিতে পারস্য রক্ত আছে। ফ্রান্সের একজন ইহুদী ধনী নিশ্চয় স্থির করেছিলেন আমি ইহুদীবংশীয়।’
সত্যি দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের ঘর! ঘর থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এতগুলি পরিচয় বহন করবেন কেমন করে? তাই লিখলেন সে চিঠিতে, ‘আমাকে নানা দেশের নানা জাতের লোক আপন আপন স্বগোত্র বলে কল্পনা করেছে এ সংবাদ তোমাকে দেবার তাৎপর্য্য এই যে সবকটাই সত্য হতে পারে না।’ এটুকু লিখেই কিন্তু থেমে গেলেন না। এই যে নানা জাতের নানা দেশের মানুষ তাঁকে যে স্বগোত্রীয় বলে কল্পনা করছেন এ কি অপর একজন মানুষকে আপন করে নেওয়ার স্বাভাবিক দরদ? না কি এর মধ্যে নিহিত আছে পৃথিবীখ্যাত এক ব্যক্তিকে স্বগোত্রীয় বলে দাবি করে স্বজাতের গরিমা বৃদ্ধির বাসনা? সে সময়ের ভারতবর্ষে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি নানা কারণে প্রবল হয়ে উঠেছে। নিজেদের ধর্মীয় কিংবা ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে অন্যদের সেই পরিচয়ের চাপে খাটো করার, অপর করে তোলার রাজনীতি তৈরি করছে ভেদ ও বিভেদ। এই ভেদ-বিভেদের রাজনীতিকে ঔপনিবেশিক প্রশাসকেরা সুবিধেমতো নিজেদের কাজে লাগাচ্ছেন। তাঁরা জানেন এই আত্মপরিচয়ের রাজনীতির প্রয়োগে যদি ভারতীয়দের মধ্যে ভেদ-বিভেদ তৈরি করা যায় তাহলে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে পারবে না। কুইনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির মধ্যে আপাত কৌতুক ছিল। চিঠির শেষে তিনি লিখেছিলেন তাঁকে এই স্বগোত্রে টানাটানির বিড়ম্বনা থেকে তিনি মৃত্যুর পর একরকমভাবে মুক্তি পেতে পারেন। ‘যমালয়ে যদি জাত বাঁচিয়ে চলার নিয়ম থাকে তাহলে সময় উপস্থিত হলে আমার পাত পড়বে কোন্ পঙ্ক্তিতে এ নিয়ে বিবাদ উঠতে পারে। আমার জন্যে আসন পাতা হবে সব জাতের বাইরে, ফাঁকায় থাকতে পারব।’ এই যে সব জাতের বাইরে ফাঁকায় থাকতে পারার বাসনা এ নিতান্ত রসিকতা নয়– এর মধ্যে যে গভীর এক সত্য আছে তা রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবন দিয়েই বুঝেছিলেন।
নিজেও একবার বিশেষ এক পরিচয়কে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি, সেই পরিচয়ের প্রকাশে বিপন্ন করেছিলেন অপরকে। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ নামে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি তাতে অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষার আত্মপরিচয় অস্বীকার করতে বলেছিলেন। বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই ছিল তাঁর দাবি। অসমিয়া আর ওড়িয়া– এই দুই ভাষাকে তখন রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র ভাষাভেদরূপে মানতে পারছেন না, ভাষাদু’টি যেন বাংলা ভাষারই উপরূপ। তাহলে কী হবে আর নিজস্বতা বজায় রেখে? বাংলা ভাষার ছাতার তলায় চলে এলে গড়ে উঠবে বৃহৎ ঐক্য যেমন গড়ে উঠছে ইংল্যান্ডে। অপরাপর দ্বীপের অধিবাসীরা ইংরেজিকে তাদের ভাষা বলে মেনে নিয়ে নিজেদের ভাষিক অধিকার খর্ব করে এক হয়েছে। অনিবার্যভাবেই প্রতিবাদ করেছিলেন ওড়িয়া আর অসমিয়ারা। লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পরে মেনে নিয়েছিলেন তাঁর ভুল। বুঝতে পেরেছিলেন ঐক্যের ধুয়ো তুলে বিবিধের নিজস্ব আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করলে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’-এর মূলধারাকে অমান্য করা হবে। যেখানে বৈসাদৃশ্য আছে সেখানে বৈসাদৃশ্যকে মেনে নিয়েই স্থাপন করতে হবে সামঞ্জস্য। দেখতে হবে বৈসাদৃশ্য যেন উৎকট হয়ে উঠে অপরকে আঘাত করতে উদ্যত না হয়।
উদ্যত অবশ্য হচ্ছিল। আর এই উদ্যত হওয়ার জন্যই ঘোষণা করছিল নিজেদের গোত্রগত কৌলীন্য। সেই কৌলীন্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হচ্ছিল নানা পূর্বজকে নিজেদের বলে দাবি করা। ভাবখানা হল এই আমার গোত্রের আদিতে রয়েছে অমুক বিখ্যাত ব্যক্তি কিংবা তমুক সুখ্যাত সাংস্কৃতিক উপাদান। তাই আমার গোত্র অপরের চাইতে মহান। এ এক আশ্চর্য জিনিওলজিক্যাল ফ্যান্টাসি– বংশগৌরবের কাল্পনিক অহমিকায় নিজেকে বড়ো করে তোলা। সে উদ্দেশ্য নিয়েই কি রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের বলে দাবি করা! সময়ের কী পরিহাস! যে রবীন্দ্রনাথ একদিন কৃত্রিম ঐক্যের বন্ধনে ভাষাগুলিকে এক করতে চেয়ে অসমিয়া ভাষাকে বাংলার উপরূপ হিসেবে বাংলার মধ্যে লীন করে দিতে চেয়েছিলেন ও পরে বুঝতে পেরেছিলেন নিজের যুক্তির ভুল সেই রবীন্দ্রনাথকেই এবার আসাম সংস্কৃতি দাবি করছে তাদের বলে। আর তখন রবীন্দ্রনাথকে জানাতে হচ্ছে তাঁর বংশগত স্বাতন্ত্র্য। বলতে হচ্ছে, এই স্বাতন্ত্র্য এ-জগতের তবে এ-জগতের বাইরে যদি যমালয় বলে কিছু থাকে আর সেখানে থাকে জাতের পাঁতি তাহলে তিনি বসবেন ফাঁকা জায়গায়।
তাহলে আত্মপরিচয়ের এই সংকীর্ণতার বাইরে যেতে পারাই কি ভাল?
১৮ বৈশাখ, ১৩৪৩। রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন যে কবিতাটি, তা সংকলিত হয়েছিল ‘পত্রপুট’ কাব্যের ১৫ সংখ্যক কবিতা হিসেবে। চেনা কবিতা, বহুশ্রুত– রবীন্দ্রনাথের যে কবিতাগুলি আবৃত্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত, এটি তার মধ্যে অন্যতম। কবিতায় লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,
‘হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ,
পরিত্রাণ করো
ভেদচিহ্নের-তিলক-পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান্ পুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা’
সেদিনের সেই সংকটের কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি উঁকি দিচ্ছে। এক দেশ এক ভাষা এক ধর্মের ঐক্যের নামে মানুষের নিজস্বতাকে, বিভিন্নতাকে মুছে ফেলার এই চেষ্টা। যদি মুছতেই হয় তাহলে ফিরতে হবে শুধু মানুষ এই পরিচয়ের কাছে– সে পরিচয়ই সনাতন, তাকেই রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করেছিলেন ‘সকল মানুষের মানুষ’ বলে। তিনিই সনাতন– কোনও ধর্ম বা ভাষা সনাতন নয়। তা একটি ব্যবহারিক ভেদ– তা বজায় রাখার অর্থ অপরের ধর্ম ও ভাষাকে সমান গুরুত্বে বজায় রাখা। যেন ভুলে না যাই।