ঋতুদা আমাদের সঙ্গে বসবে ব’লে বেশ একটা হইহই পড়ে গেল। টেকনিক্যাল টিম সবাই হাজির, পরিচালক শৌভিক মিত্র সেট ও আলোর ব্যাপারে সজাগ, কারণ খোদ ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের অতিথি! সেই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত পরিচালক যাতে কোনও কিছুতে রেগে না ওঠে, তা নিয়ে সকলেই শশব্যস্ত! এপিসোডটায়, ঋতুদা জিন্স আর কুর্তা পরেছিল বলেই মনে পড়ছে। ওই সময়টায় একটু সাধারণ পোশাকই পরত ঋতুদা।
৮.
প্রথম দিকে ‘তারা করছেটা কী’ যখন করতাম, তখন অফিসের ভিতরের গনগনে আঁচ আমাদের কাছে এসে পৌঁছত না, কিন্তু জয়েন করার পর ব্যাপারটা অন্যরকম ঠেকল। দেখা গেল, কেউই নিজেদের সমালোচনাকে ভালভাবে নিতে পারছে না। সে সময়ের প্রোডাকশন হেড, একটা মিটিংয়ে জোর গলায় বললেন, এমন প্রোগ্রাম ‘তারা চ্যানেল’-এর জন্য ক্ষতিকর, বন্ধ করে দেওয়া হোক। নতুন চাকরিতে ঢুকেই এমন একটা চাপান উতোরের মুখে পড়লাম! ঋতুদাকে জানালাম অফিসের অসন্তোষ। ঋতুদা কর্ণপাত করল না, বলল, ‘যেমন চলছে চলুক। আমাদের আরও অজস্র অনুষ্ঠান ভাবতে হবে, নইলে এমনিই তারা মুখ থুবড়ে পড়বে।’
নতুন অনুষ্ঠানের মধ্যে আমার দায়িত্বে পড়ল, তারাদের কথা বলে একটি অনুষ্ঠান করার। প্রতি এপিসোডে বিশিষ্ট এক তারকার দিনযাপন। নিজের নাম পরিচালক হিসেবে দেখতে পাওয়ার সুযোগ এই প্রথম। প্রোগ্রামের প্ল্যানিং চলতে থাকল, পাশাপাশি শুটিং চলতে লাগল, ‘তারা করছেটা কী’-র। ফরম্যাটে একটু বদল ঘটল। এখন ‘তারা করছেটা কী’-তে মাঝেমাঝেই গেস্ট আসতে শুরু করলেন। আমরা চারজন মিলে তাঁর সঙ্গে কথা বলব। অনুষ্ঠানটি যে কারণে দর্শকমহলে একটু সাড়া ফেলেছিল, দেখা গেল সেই রেয়াতহীন, বেপরোয়া অ্যাপ্রোচ বড়কর্তারা একটু দমিয়ে দিতে চাইছেন। আমাদের ভুরু কুঁচকানো দেখে ঋতুদা হাসল।
–এত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমিই গেস্ট হয়ে বসব। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর তার চ্যানেলের নতুন প্রোগ্রাম নিয়ে কী ভাবছে, তাই নিয়ে কথা বলব’খন।
ঋতুদা আমাদের সঙ্গে বসবে ব’লে বেশ একটা হইহই পড়ে গেল। টেকনিক্যাল টিম সবাই হাজির, পরিচালক শৌভিক মিত্র সেট ও আলোর ব্যাপারে সজাগ, কারণ খোদ ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের অতিথি! সেই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত পরিচালক যাতে কোনও কিছুতে রেগে না ওঠে, তা নিয়ে সকলেই শশব্যস্ত! এপিসোডটায়, ঋতুদা জিন্স আর কুর্তা পরেছিল বলেই মনে পড়ছে। ওই সময়টায় একটু সাধারণ পোশাকই পরত ঋতুদা।
শুটিং শুরু হল। চন্দ্রিল ঋতুদাকে তারা চ্যানেলের বাইরে সিনেমা সংক্রান্ত অন্য আলোচনাতেও টেনে আনল। খানিকক্ষণ কথা বলার পর ঋতুদা কেমন একটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল, কাটতে বলল শটটা। সচরাচর ‘তারা করছেটা কী’ একদানে হত। দুটো ব্রেকের জায়গায় শুধু থামতাম। নইলে গড়গড় করে চলত। ঋতুদা থামাল কেন? ব্যাপারটা কী? শৌভিকদা ছুটে এসেছে সেটে।
–কী হয়েছে ঋতু?
–তুমি তো বলোনি ওইখানে একটা ক্যামেরা আছে।
–ফোর ক্যাম শুট, বরাবরই তো ওখানে আছে ক্যামেরা।
–না, ওখানে থাকলে চলবে না।
শৌভিকদাও একটু রগচটা ছিল। বলল, ‘তাহলে তুমি শুটিং করো, আমি নেই।’ বলে সিগারেট খেতে বাইরে চলে গেল। লে হালুয়া! এবার কী হবে? ‘তারা করছেটা কী’-তে কখনও এতক্ষণের বিরতি হয়নি। আরও কিছুক্ষণ কাটল, ঋতুদা অনড়। ওই ক্যামেরাটা অপছন্দ। শৌভিকদার যুক্তি ক্যামেরাটা সরালে, আলো ভাঙতে হবে। আর আলো ভাঙা মানে লাঞ্চের আগে আর শুটিং হবে না। গোটা ঘটনাটায় আমরাও বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। নিশ্চয়ই টেকনিক্যাল কোনও ফল্ট ঋতুদার চোখে পড়েছে। সেইজন্য এমন বখেড়া। চন্দ্রিল বলল, ‘‘না, এর’ম তো কিছু হওয়ার কথা নয়, আর সবচেয়ে বড় কথা এইভাবে এতদিন হয়ে আসছে।’’ ঋতুদা নিজস্ব মেকআপ রুম-এ, আমরা পা ছড়িয়ে গপ্প করতে লাগলাম। সত্যি সত্যি লাঞ্চ ব্রেক-এর পর শুরু হল শুটিং। এপিসোড তরতর করে এগোতে থাকল, মনে রাখার মতো একখান আড্ডা! পরবর্তী সময়ে বেশ ভাল টিআরপি-ও পেয়েছিল এই এপিসোড। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে সমানতালে চার অচেনা নতুন ডায়লগবাজি করছে, চিত্রনাট্যে এমন দৃশ্যের অবতারণা সেই প্রথম।
পড়ুন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
এই পর্বের কোনও একদিন অতিথি হয়ে এলেন ছন্দা গুহ। আমাদের অফিসের সিইও বুদ্ধদেব গুহ-র স্ত্রী। ওঁর ব্যবহারের মধ্যে এত স্বাভাবিক অন্তরঙ্গ একটা ব্যাপার আছে, মুহূর্তেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘ছন্দাদি’। অনেক পরে তারা চ্যানেলের রান্নার একটি প্রোগ্রামের প্রধান মুখ হয়ে উঠলেন তিনি। যতদূর মনে হয়, ‘তারা করছেটা কী’-ই ছন্দাদির প্রথম ক্যামেরার সামনে মুখোমুখি হওয়া। তারা যে অল্প কিছুদিনের মধ্যে একটা পরিবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, সেই পরিবারের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন ছন্দা গুহ, তারা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও এই ভালোবাসা অটুট ছিল সবসময়।
তারা-তে আমরা যেমন চাকরি করতাম, তেমন শৌভিকদারও গালভরা একটা পোস্ট ছিল। অফিস শেষ হওয়ার পরও মাঝেমাঝেই নানা প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে গলা চলত। শৌভিকদা একদিন দেখি খুব গজগজ করছে। ‘ঋতুদার সঙ্গে ঝগড়া?’ জিজ্ঞেস করলাম।
–আরে, ঋতুকে নিয়ে পারা যায় না, এত অবাস্তব সব জিনিস বলে!
বুঝলাম, কোনও কারণে মতের অমিল হয়েছে। মওকা বুঝে আমি আবার সেদিনের প্রসঙ্গটা টানলাম।
–সেদিন কী হয়েছিল বলো তো?
–কী আবার হবে, ওঁর টাক দেখা যাচ্ছিল, তাই অত কাণ্ড।
–মানে!
–আরে বাবা, ঋতুর তো একমাথা কোঁকড়া চুল ছিল। এখন চাঁদিতে হালকা টাক দেখা দিয়েছে। ক্যামেরায় যাতে দেখা না যায়, তাই অত হুজ্জতি। বায়না, কোনও ওটিএস (ওভার দ্য শোল্ডার) নিতে দেবে না।
ও হরি! খেয়ালই করিনি ঋতুদার টাক পড়ছে। অবশ্য টাক পড়া ভাল। শুনেছি চাঁদি দেখা গেলে চাঁদি গরম হয় সিন্দুকে।