লাল পতাকার মাঝখানে একজনকে দেখলাম বয়ে নিয়ে চলেছে ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা। আমরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আলাপ হল। পতাকাধারী একজন শ্রমিক। নাম বললেন ইভান– বুঝলাম এড়িয়ে গেলেন– ইভান যে কোনও রুশির নামই হতে পারে, এক কথায়, রুশিরা অনেক সময়ই ইভান নামে পরিচিত; কিন্তু তিনি বললেন যে তিনি রুশি নন– সঙ্গে সঙ্গে একই নিশ্বাসে বললেন, আবার একেবারে রুশি নই এমন কথাই-বা বলি কেমন করে? রুশি রক্তের সঙ্গে তুর্কমেন ও উজবেক রক্তও আছে আমার শরীরে। আমাদের মতো লোকের কাছে ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে?
৫২.
উৎসব যায়, উৎসব আসে
নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী
মস্কো, ১০ নভেম্বর ১৯৯২
গত শনিবার ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ৭৫ তম বার্ষিকী গেল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই প্রথম নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী। সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও রাশিয়া দিনটি পালন করছে জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে। ছুটির দিনের তালিকা থেকে দিনটাকে বাদ দেওয়ার পথে অন্তরায় রুশ ফেডারেশনের সংবিধান– পুরনো সংবিধান। শনিবার কর্মবিরতির দিন পড়ে যাওয়ায় সোভিয়েত আমলে যেমন হত তেমনই সোমবার অতিরিক্ত ছুটি ঘোষণা করা হল ৭ নভেম্বরের সম্মানে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, উত্তর-পেরেস্ত্রৈকা পর্বে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়ে আসছে উৎসবের জৌলুস।
২১ অক্টোবর মস্কোর মেয়রের এক হুকুমনামাবলে রেড স্কোয়ারে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল– স্কোয়ারের একটি অংশে মেরামতের কাজ চলছে এই অজুহাতে।
তবে ৭ তারিখে সকাল ১০ টার সময় কমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রীদের এবং সরকারবিরোধী অন্যান্য পার্টির একটি সমাবেশ ঘটেছিল অক্টোবর স্কোয়ারে, লেনিন মূর্তির পাদদেশে। সেখান থেকে দশ হাজার জনতার একটা মিছিল রেড স্কোয়ার সন্নিহিত মানেজ স্কোয়ারের দিকে যাত্রা করে। অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সেদিন সরকারি পরিবহন বাস সারি সারি দাঁড় করিয়ে রেড স্কোয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। উৎসবের অঙ্গস্বরূপ সন্ধ্যায় যে আলোকসজ্জা ও আতসবাজির আয়োজন হয়ে থাকে তার রেশটুকু পর্যন্ত এবারে ছিল না।
দিনটিকে উৎসবের দিন বলে অন্তত বাইরে স্বীকার করছেন না দেশের শতকরা ৭০ জন মানুষ। এই উৎসব উপলক্ষে পরস্পরকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর যে দীর্ঘকালীন রেওয়াজ ছিল, তিন বছর থেকে তা একেবারে উবে গেল। যদিও বাড়িতে উৎসব উদ্যাপিত হল একান্তে, গোপনে, যেমন সোভিয়েত আমলে উদ্যাপিত হত ইস্টার। যা ছিল প্রকাশ্য, তা গোপনীয়তার অন্তরালে চলে গেল, যা ছিল গোপন তা প্রকাশ্য হয়ে পড়ল।
পয়লা মে-র উৎসব
মস্কো, ৫ মে, ১৯৯২
পয়লা মে ছুটির দিন বলে ঘোষিত হবে কি না এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছিল গত বছরের শেষ থেকে। শেষ পর্যন্ত সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হল– কিন্তু মেহনতিদের আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস নামের নয়– বসন্ত ও শ্রমের উৎসব নামে। মিছিল শোভাযাত্রা সংগঠনের অনুমতি অবশ্য সরকার দিয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলিকে। তবে রাস্তাঘাটে লাল পতাকা বা লাল রঙের জৌলুস দেখা গেল না সকাল থেকে।
আকাশের মুখ আজ গোমড়া। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বসন্তের সেই রং কোথায়?
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দেশে যাওয়ার পথে সাংবাদিক বন্ধু এসেছিল– এক দিনের মেয়াদে। অতএব বেরিয়ে পড়তেই হল।
হোটেলের রেস্তোরাঁতে তাঁকে নিয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিল বসতে-না-বসতে ওয়েটার জিজ্ঞেস করল আমরা ডলার ভাঙাতে চাই কি না। বিনিময়ের হার ১ ডলার = ১১৫ রুবল। আমি বন্ধুকে বললাম আপাতত ১ ডলার ভাঙালেই চলবে, রাস্তায় আজকাল সর্বত্র লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে ‘বিদেশি মুদ্রা কিনব’ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে। আইনত কোনও বাধা নেই। সেখানে দরও বেশি পাওয়া যাবে। আগে ডলার-পাউন্ডের লোভে বাইরের উটকো লোক হোটেলে উপদ্রব করত, এখন আর সে-ঝামেলা নেই। ওয়েটারই জানতে চাইল ডলারের বিনিময়ে রুশি ক্যাভিয়ার কিনব কি না। দু’টি টিন কেনা গেল। ঘরে বসে দিব্যি সওদা হয়ে যাচ্ছে। মেহনতি ওয়েটারটিও দুটো ডলার পাউন্ডের মুখ দেখতে পাচ্ছে।
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ যখন ক্রিমিয়া ব্রিজের কাছে পৌঁছলাম, মস্কোর মেহনতিদের সমন্বয় কমিটির সংগঠিত মিছিল ততক্ষণে সেখান থেকে রওনা দিয়েছে রেড স্কোয়ারের দিকে। বিশ হাজার মানুষের মিছিলের মাথার ওপর উড়ছে লাল শালুর হাজার হাজার পতাকা– ঘোলাটে আকাশকে তাচ্ছিল্য করে তার গায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার রং।
সেখানেই কমিউনিস্টদের একটি গ্রুপের পত্রিকা নরোদ্নায়া প্রাভ্দা, কিনতে গিয়ে আলাপ হয়ে গেল ওই পত্রিকারই জনৈক সাংবাদিক ইগর মিদ্ৎসেভের সঙ্গে। নিজে পত্রিকা বিক্রি করতে বেরিয়েছেন। জাতিতে ইহুদি। ভালো ইংরেজি বলেন, সঙ্গে আছে তাঁর মেয়ে– স্কুলের ছাত্রী, ক্লাস সেভেনে পড়ে। ইগর বললেন, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ঋণ নিয়ে আমরা যে পেরুর মতো পুঁজিতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে চলেছি এই কথাটাই আমরা লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। ভারতের মতো দেশের সঙ্গে আমাদের সংহতি দরকার– বর্তমান সরকার এটা বুঝতে চাইছে না। বেশিক্ষণ আলাপের সুযোগ ঘটল না।
এরই মধ্যে, লাল পতাকার মাঝখানে একজনকে দেখলাম বয়ে নিয়ে চলেছে ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা। আমরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আলাপ হল। পতাকাধারী একজন শ্রমিক। নাম বললেন ইভান– বুঝলাম এড়িয়ে গেলেন– ইভান যে কোনও রুশির নামই হতে পারে, এক কথায়, রুশিরা অনেক সময়ই ইভান নামে পরিচিত; কিন্তু তিনি বললেন যে তিনি রুশি নন– সঙ্গে সঙ্গে একই নিশ্বাসে বললেন, আবার একেবারে রুশি নই এমন কথাই-বা বলি কেমন করে? রুশি রক্তের সঙ্গে তুর্কমেন ও উজবেক রক্তও আছে আমার শরীরে। আমাদের মতো লোকের কাছে ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে? সত্যিই তো সোভিয়েত মহাজাতি গঠনের যে-মহাযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল, তা পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর এইসব মানুষের স্থান এখন কোথায়?
ভারতের জাতীয় পতাকা কোথায় পেলেন? কেনই-বা এখানে নিয়ে এলেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমার পরিচিত কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রবন্ধু উপহার দিয়েছিলেন। ভাবলাম আজ তো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। তাই ভারতের পতাকাই বা থাকবে না কেন এই মিছিলে? আমার সঙ্গীবন্ধু সেসব ছবি তুলেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠেছিল কি না জানি না।
মানেজ স্কোয়ার দিয়ে সন্নিহিত রেড স্কোয়ারে মিছিল ঢোকার কথা। নভেম্বর বিপ্লবের উৎসবের দিনের মতো এবারেও গোটা পঞ্চাশ সরকারি পরিবহনের বাস দিয়ে মানেজের অর্ধেকটা অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি বাসের ভেতর বোঝাই পুলিশবাহিনী।
অবরোধের সংকীর্ণ রন্ধ্রপথ দিয়ে অতি অল্পসংখ্যক শোভাযাত্রী রেড স্কোয়ারে ঢুকল, বাকি সবাই দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। আমরা সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে ভেতরে ঢুকতে পারলাম। তবে মিটিং তেমন জমল না।
এবারে একঘেয়ে লাল কমিউনিস্ট ব্যানারের বদলে রেড স্কোয়ারের দেওয়াল নাকি ছেয়ে যাবে বিচিত্র বর্ণের নয়নাভিরাম পশ্চিমি বিজ্ঞাপনে? কোথায় সেসব? শুধু রেড স্কোয়ারের উল্টোদিকে এককালের জমজমাট, অধুনা পরিত্যক্ত প্রায় ভুতুড়ে সুপার মার্কেটটার ধারে দেখতে পেলাম কোনও এক ট্রাভেল এজেন্সির ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের আমন্ত্রণ! লেনিন মিউজিয়ামের গায়ে ফ্রিডম ফোরাম নামে সংস্থার একটা বিজ্ঞাপন– স্লোগান: Freedom works, Free Press, Free Speech, Free spirit। কাদের জন্য এই বিজ্ঞাপন কে জানে!
বিজ্ঞাপনে আশানুরূপ অর্থ তুলতে না পারার দরুনই বোধহয় রেড স্কোয়ারে বিকেল থেকে যে সমারোহপূর্ণ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, তা তেমন জমল না। এই প্রথম রেড স্কোয়ারের এক কোনায় খাবার-দাবার ও মণিহারি সামগ্রীর দোকান খোলা হয়েছিল। কিন্তু ক্রেতার বদলে কৌতূহলী দর্শকের সংখ্যাই বেশি ছিল। এই প্রথম গণতন্ত্রের কল্যাণে রেড স্কোয়ারে ধূমপানে কোনও বাধা ছিল না– তাই সন্ধ্যা হতে-না হতে চত্বর ছেয়ে গিয়েছিল সিগারেটের পোড়া টুকরোয়। ততক্ষণে সেখানে শুরু হয়ে গেছে ডিস্কো নাচের আসর।
বিজয় দিবস: ৯ মে
মস্কো, ১২ মে ১৯৯২
৯ মে বিজয় দিবস। বার্লিনে রাইখস্টাগের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় কেতন তোলার পর অর্ধ-শতাব্দী পার হতে-না-হতে এই বিজয়ের স্বাদ অনেকের কাছে তিক্ত হয়ে উঠেছে।
তাই স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের স্মৃতিতে মামাইয়েভ টিলার ওপর রচিত বিশাল স্থাপত্য সমাহার সংস্কারের অভাবে বিনষ্টপ্রায় হতে চললেও, জননী রাশিয়ার আকাশ-ছোঁয়া মূর্তির পায়ের তলার ভিতে ফাটল দেখা দিলেও তা নিয়ে বিশেষ কারও মাথাব্যথা দেখা যায় না। পেরেস্ত্রৈকার আমলের ঐতিহাসিকরা নতুন করে লিখতে বসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। শোনা যাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নে যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশের সন্দেহে আরও দু’-কোটি মানুষকে হত্যার বীভৎস কাহিনি।
দিনটা একেবারে শান্তিপূর্ণ ছিল না। গত বছরের আগস্ট মাসে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ধৃত ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে সরকারবিরোধীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। অভিনন্দন জানানো হয় উক্ত অভিযোগে ধৃত জেনারেলদের। বিশেষত বিজয় দিবস উপলক্ষে অনেকে এক লাখ রুবেলের জামিনে মুক্তির দাবি তুলেছিলেন জেনারেল ভারেন্নিকভের। সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর খেতাবপ্রাপ্ত এই জেনারেল ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সৈনিক, রেড স্কোয়ারে ঐতিহাসিক বিজয়ের কুচকাওয়াজের একজন অংশগ্রহণকারী। চের্নোবিল দুর্ঘটনার সময় দুর্গতদের সাহায্যের জন্য প্রথম যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি তাঁদেরই একজন।
কিন্তু ফিরে আসা যাক বর্তমানে। বিজয় দিবসের আগে ৭ মে এক নির্দেশবলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েল্ৎসিন রুশ ফেডারেশনের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করলেন নিজেকে– বলাই বাহুল্য, রুশ ফেডারেশনের সংবিধান মতে, সম্পূর্ণ বিধিসম্মত উপায়ে। এখন থেকে যিনি প্রেসিডেন্ট তিনিই সোনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, আবার তিনিই প্রতিরক্ষামন্ত্রী– একাধারে ত্রিমূর্তি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ককে নির্দেশ দেবেন। আবার সর্বাধিনায়ক হিসেবে তিনি নির্দেশ দেবেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে। শুধু একটু খুঁত রয়ে গেল উপযুক্ত কোনও সামরিক খেতাব সর্বাধিনায়কের নেই– বিজয় দিবস উপলক্ষে সেরকম খেতাব প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে কিন্তু তাঁকে দিতে পারতেন।
শ্রমদান দিবস
মস্কো, ১২ মে ১৯৯২। লেনিনের জন্মদিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ২২ এপ্রিল বা তার কাছাকাছি কোনও শনিবার দেশে যে শ্রমদান দিবস অনুষ্ঠিত হত, এ বছর তা হল না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্ন ওঠে না। ওই দিনটি উপলক্ষে শহরের পাড়ায় পাড়ায় লোকজন বেরিয়ে পড়তেন জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজে। এ বছর অবাধ বাণিজ্যের দৌলতে মস্কোর মতো বড় বড় শহরের রাস্তাঘাটে জঞ্জাল স্তূপাকার হয়ে-ওঠা সত্ত্বেও সাফাইয়ের কোনও গরজ দেখা যাচ্ছে না পুরসভার দিক থেকে।
অবশ্য কমিউনিস্টরা পাছে ওইদিন শ্রমদান দিবসের নাম করে শহরের জঞ্জাল সাফাইয়ে নেমে পড়ে কৃতিত্ব নিয়ে ফেলে তাই মেয়রের অফিস রুশ পঞ্জিকা অনুযায়ী উদ্যাপিত ইস্টার উপলক্ষে জনসাধারণকে এই ১৯ তারিখেই (ভাগ্যিস একই সময়ে পড়ছিল) শ্রমদানের আবেদন জানায়। কিন্তু তাতে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি নাগরিকদের দিক থেকে। সকলেই যে যার পেটের চিন্তায় ব্যস্ত।
সাধারণ নাগরিকদের উৎসাহের অভাব দেখে মনে হয় এই ঐতিহ্যের অবসান আসন্ন।
মস্কোয় দুর্গোৎসব
মস্কো, ২ অক্টোবর ১৯৯২। কিছু প্রবাসী বাঙালির উদ্যোগে বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠান মস্কোয় হত বটে, কিন্তু মস্কোয় দুর্গা পুজো ষোড়শোপচারে, তাও আবার দস্তুরমতো হল ভাড়া করে!
কিন্তু না হওয়ার কী কারণ আছে আজকের মস্কোয় খোলামেলার যুগে?
রাশিয়ার উত্তরাঞ্চল ও মঙ্গোলিয়ার সীমান্তবর্তী বৌদ্ধ ধর্ম কেন্দ্রগুলি ঘুরে গেলেন দলাই লামা, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্প্রতি পুনঃস্থাপিত হয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক, সৌদি আরবের অর্থানুকূল্যে মস্কোয় স্থাপিত হচ্ছে ইসলামচর্চার একটি কেন্দ্র। সর্বোপরি দেশে খ্রিস্টধর্মের পুনরুজ্জীবন, বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় উৎসবের রমরমা– কেউ কি কখনও ভাবতে পেরেছিল? মস্কোয় কৃষ্ণনাম সংকীর্তনের উন্মাদনা– সে আমরা বেশ কিছুকাল হল দেখে আসছি।
মস্কোয় বসবাসকারী বাঙালি বলতে এককালে বোঝাত এখানকার বিভিন্ন প্রকাশ ভবন ও রেডিওয়োতে কর্মরত বাঙালি, দু’-একটি ভারতীয় প্রচারমাধ্যমের দু’-একজন বাঙালি এবং ভারতীয় দূতাবাসের স্বল্প কয়েকজন বাঙালি কর্মী ও তাদের পরিবার আর কিছু বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী। গত বছর খানেকের মধ্যে প্রকাশ ভবনগুলির ভারতীয় বিভাগ উঠে যাওয়ার ফলে একদল বাঙালি বেকার হয়ে পড়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যারা বাড়তি রোজগারের পথ করতে পারছে না তাদের অবস্থা সঙ্গীন– শুধু স্টাইপেন্ডে চলে না।
তা সত্ত্বেও ১৯৯০ সাল থেকে দুর্গা পুজোর যে অনুষ্ঠান চালু হয়েছিল, তা বন্ধ হচ্ছে না। পূর্ব ইউরোপে প্রথম এই দুর্গোৎসব অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল গর্বাচ্যোভের সোভিয়েত ইউনিয়নে, এখন উদ্যাপিত হচ্ছে ইয়েলৎসিনের রাশিয়ায়।
স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তা এখন অন্য এক সম্প্রদায়ভুক্ত বাঙালি, মূলত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বিভিন্ন ফার্মের প্রতিনিধি এবং ভারতীয় দূতাবাসের বাঙালিরা। তাঁরা ছাড়া এই মাগ্গি-গণ্ডার বাজারে এত বড়ো দায়িত্ব আর কারাই-বা নিতে পারেন? কিছু বেকার, পেনশনভোগী আর ছাত্র-ছাত্রীরা সাধ্য কী এই বিপুল ব্যয়ভার বহন করে– বিশেষত বিদেশি মুদ্রা যাদের হাতে নেই? যে-বছর পুজো শুরু হয়েছিল তখন এক কিলো আলুর দাম ছিল ৪০ কোপেক। আজ ২০-২৫ রুবল। অতএব যাদের অর্থানুকূল্যে এই পুজো অনুষ্ঠান, রুবলের বিরাট অঙ্ক দেখে তাদের হৃদয় কম্পিত হয় না।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলিতে অধ্যয়নরত যে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা পুজো উপলক্ষে মস্কোয় আসত তাদের অনেকে এবারে আসতে পারছে না যাতায়াতের টিকিট দুর্মূল্য হওয়ার দরুন।
প্রথম বারের পূজা অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন স্বামী লোকেশ্বরনানন্দ। এবারে দেশ থেকে পুরোহিত আনাও সম্ভব হল না। কিন্তু তাতে অনুষ্ঠানের অঙ্গহানি হবে না। পৌরোহিত্য করবেন এককালের জনৈক ব্রহ্মচারী, বর্তমানে বিবাহসূত্রে মস্কো প্রবাসী। তাঁকে সহযোগিতা করবেন স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান স্বামী জ্যোতিরূপানন্দ।
অন্যান্য বারের মতো এবারেও পুজোর নিত্য ভোগ, প্রসাদ বিতরণ, অষ্টমীর মহাভোগ ইত্যাদির আয়োজন আছে। বিজয়া সম্মিলনী, বিচিত্রানুষ্ঠান কোনও কিছুই বাদ যাচ্ছে না। শুধু বাঙালি কেন, ভারতীয় সমাজ ও ভারতপ্রেমী রুশিদেরও বিপুল সমাগম আশা করা যাচ্ছে। গত বছর রোজ সন্ধ্যায় অন্তত তিনশো মানুষের সমাগম ঘটত। এবারে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশের মানুষের মতো এদেশের লোকজনও বড় হুজুগে– এত দুঃখদুর্দশা ও দারিদ্র সত্ত্বেও। কিন্তু এবারে দেবীর আগমন ভালো প্রতিশ্রুতি বহন করছে না। ঘোটক আগমন, ফল ছত্রভঙ্গ। পঞ্জিকায় অন্তত তাই বলছে।