গল্প বলা যেন জোহার রক্তে। জোহা ঘোষিতভাবেই নারীবাদী। অথচ যুগযুগান্ত ধরে এক গল্পকথকের সত্তাকে যে তিনি টেনে আনছেন, তা তাঁর গল্পের মেজাজ থেকেই স্পষ্ট। স্টোরিটেলিং-এর ইন্সটিংক্ট দারুণ শুধু না, কোথাও যেন ফারসি ভাষার অতি খ্যাত, আমাদের চিরচেনা, সহস্র এক রজনীর ফ্যান্টাসি কাহিনির মেজাজের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সহস্র এক আরব্য রজনীর উত্তরাধিকার তাঁর রক্তে আছে। কারণ, এ গল্পের ভেতর গল্প বুনে দেওয়ার কাহিনি মূলত ইরানের মাতৃভাষা ফারসিতে লেখা, আদৌ আরবিতে নয়।
২২.
এই তো সবে কিছুদিন আগে, একাধিক লেখা লিখছিলাম আমরা অনেকে, ইরানের মেয়েদের নিয়ে। তাঁরা হিজাব পোড়াচ্ছিলেন, মাথা থেকে রুমাল খুলে ফেলছিলেন, দীর্ঘ চুল কেটে ফেলছিলেন। তাঁদের ওপর নেমে আসছিল রাষ্ট্রের শাস্তি। জেলে বসে নার্গিস মোহাম্মেদি পেলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার।
সেই ইরানেরই এক সমসাময়িক লেখক, বেয়াল্লিশবর্ষীয়া মেয়ে– জোহা কাজেমি। ফারসি ভাষায় তিনি যে কল্পগল্প লিখছেন, তা নিজের দেশে তো পাঠকধন্য হচ্ছেই। তা ছাপিয়েও, অনুবাদের মাধ্যমে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর নাম। চিনে ওয়ার্ল্ডকনে এই তরুণী লেখকের সঙ্গে আলাপ করে তাঁর বই বাংলায় অনুবাদ করার সম্মতি নিয়ে এসেছেন এক বাঙালি উদ্যোগী দীপ ঘোষ। ১৯৮২ সালে তেহেরানে জন্ম, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী জোহা কাজেমি। ইরানে নারীবাদী স্পেকুলেটিভ ফিকশন, কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি ইত্যাদির রচয়িতা হিসেবে জোহা কাজেমি ইতিমধ্যেই অতি সম্মানিত ও বহুলপঠিত। ১৫টির অধিক প্রকাশিত বই আছে জোহার। Death industry, Rain born ইত্যাদি উপন্যাস ইতিমধ্যেই ইরানের স্পেকু ফিক পুরস্কার ‘নুফে’ জিতেছে। এই বইটিতে ২০২৩ সালের ইউটোপিয়া অ্যাওয়ার্ড নমিনি একটি গল্প আছে তাঁর।
গল্প বলা যেন জোহার রক্তে। জোহা ঘোষিতভাবেই নারীবাদী। অথচ যুগযুগান্ত ধরে এক গল্পকথকের সত্তাকে যে তিনি টেনে আনছেন, তা তাঁর গল্পের মেজাজ থেকেই স্পষ্ট। স্টোরিটেলিং-এর ইন্সটিংক্ট দারুণ শুধু না, কোথাও যেন ফারসি ভাষার অতি খ্যাত, আমাদের চিরচেনা, সহস্র এক রজনীর ফ্যান্টাসি কাহিনির মেজাজের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সহস্র এক আরব্য রজনীর উত্তরাধিকার তাঁর রক্তে আছে। কারণ, এ গল্পের ভেতর গল্প বুনে দেওয়ার কাহিনি মূলত ইরানের মাতৃভাষা ফারসিতে লেখা, আদৌ আরবিতে নয়। আরব্য রজনী একটি মিসনোমার, সাহেবদের ভুল পড়ার ফল। জোহা যেন নিজের দেশের মাটির গন্ধের ফ্যান্টাসি, আর পাশ্চাত্য রহস্য-রোমাঞ্চের সুগঠিত স্ট্রাকচার দুইয়ের সঠিক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাই প্রাচীন সিন্দবাদের কাহিনির রকপাখির মানুষকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে নিজের বাসায় রাখার ফ্যান্টাসি মিলেমিশে গিয়েছে এলিয়েনদের গল্পে।
‘‘বদখৎ গন্ধটা প্রচণ্ড জোরালো হয়ে উঠল, তার সাথে ঘামের আর পচা মাংসের গন্ধ মিশে গেছে। বাতাস ভারী, ঘন, কানের মধ্যে একটা কালা করে দেওয়া বোঁ বোঁ শব্দ পাচ্ছি । আমি জানি না কোথায় আমি। বসতে চেষ্টা করি, কিন্তু ঝুঁকে পড়ে বমি করতে থাকি। আবার ওক তুলি, এবার নিজের বমির গন্ধেই। আমি কাঁপছি, আমার শীত করছে, যদিও টের পাচ্ছি ওই বদ্ধ বাতাস, এবং ওই সজোর গমগমে শব্দ থেকেই, যে– আমি একটা বাড়ির ভেতরে আছি। চুপ করে বসি আমি। নিজের বাহুদুটি আড়াআড়ি রাখি। নিজেকে স্পর্শ করে বুঝি আমি নগ্ন। আমি আমার শরীরকে, আমার হাত পা লিঙ্গ অণ্ডকোষ সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকি। আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বসে বসেই আমি ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করি অনুভব করার, চারপাশে কী ঘটছে। আমার হাতদুটি ছড়িয়ে দিই আমি। আঙুলের ডগায় স্পর্শ করি একটা ভিজে ভিজে মাটির দেওয়াল। হাত ঘোরাতে ঘোরাতে স্পর্শ করি অন্য শরীর। একটি মেয়ের নরম, রোমহীন ঊরু, এক পুরুষের রোমশ ত্বক। আমি আমার চোখের ওপর হাত আনি না, ভয়ে, কারণ একদা চোখের জায়গায় এখন দুটি গহ্বর টের পাবই জানি। আমার ব্যথাবোধ নেই, ক্ষতচিহ্নও পাই না। আমি নিজে সাহস সঞ্চয় করে নিজের মুখটা ছুঁয়ে দেখি। সত্যিই দুটো ছিদ্র আছে। কিন্তু আমার আঙুল কোনও দগদগে ক্ষতকে ছোঁয় না। মনে হয় যেন ওই গহ্বরদুটোতে কোনওদিন কিছু ছিলই না।
কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। চেনা গলা! সিয়াভাস! কোথায় তুমি। ওহ, ওটা ইয়াসসি!
আমি জমাট ভিড়ের কাতরোক্তি, চাপা গোঙানি, কান্নার ভেতর দিয়ে ওর গলা শুনে শুনে এগিয়ে যাই। হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকি, নগ্ন হাত নগ্ন পায়েদের ভিড়ে পেরিয়ে। মেঝেটাও দেওয়ালেরই মতো একই উপকরণে তৈরি, খড়খড়ে শুকনো কাদা। একটু এগিয়ে, একটা চেনা চেনা মেয়েলি শরীরের গন্ধ পাই, কেউ যেন আমার শরীরের খুব কাছে এসে গিয়েছে।
আমি হাত বাড়াই। ‘ইয়াসসি, আমি এখানে!’ ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে পেয়ে, শক্ত করে ধরি।
‘বেশ কিছুক্ষণ হল জেগেছি। আমি ভেবেছি তুমি আর বেঁচে নেই। অথবা তোমাকে ওরা এই ঘরে আনেইনি।’ ও বলল।
‘এই জায়গাটা ঠিক কী বল তো?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ওই গু দিয়ে গড়া মস্ত বড় ঘরটা।’ আমার আরো কাছে ঘেঁষে এল ইয়াসসি। আমরা দুজনেই হামাগুড়ি দিয়ে একটা দেওয়ালের কাছে গিয়ে বসি।
‘এই লোকগুলোও কি আমাদেরই মতন? বন্দী?’ আমি জিগ্যেস করি।
হ্যাঁ, ইয়াসসি বলে। ‘এইসব লোকের দশা আমাদেরই মত। এরা অন্ধ। লাভাসান এলাকার লোক হবে বেশিরভাগই। কেউ কেউ আমাদের মতো পরে ধরা পড়েছে। অনেকে অনেকদিন ধরে আছে এখানে। এখানে তো সময় মাপার কোন উপায় নেই। কে কতদিন ধরে বন্দী হয়ে আছে, বলবে কেমন করে?”
আবার, ফারুকজাদের পরাজয়ের ইতিহাস মিশে গিয়েছে সময় পাড়ির, টাইমরাইডিং-এর গপ্পে।
“আমি আল মাদাইনের সাত শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি তার আগের এক মাস ধরে। বিউবনিক প্লেগে যারা মরছে তাদের ওপর লক্ষ রেখেছি। পর্যবেক্ষণ করেছি। আর যারা রহস্যময় লাল মৃত্যুর হাতে মরেছে, তাদেরও দেখেছি। তবে আরব সেনা বা ইয়াজগার্দের প্রাসাদে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। ইরানের সাম্রাজ্যের সবচেয়ে চূড়ান্ত ও তিক্ত পরাজয় স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাইনি। জনগণ দারিদ্র আর প্লেগ– দুইয়েই জেরবার। আল কাদিসিইয়াহ-র যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তাদের মাথা থেকে, হৃদয় থেকে ধর্মযুদ্ধের কথা অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছে– কোন ধর্মাচারী তাদের ওপরে শাসন কায়েম করবে সে কথা , বা কাকে তারা রাজস্ব দেবে, আরবদের না আজমদের– সেসব কথা তারা ভাবছেই না। তেসিফন রাজপ্রাসাদের ভেতরের বিলাসবহুল জীবনধারণের রকমটাই তারা কেউ কোনওদিন কল্পনায় আনতে পারে না, সাধারণ গরিব মানুষেরা। যেখানে তাক কসরার নিচে, খাবারের অঢেল দিলদরিয়া আয়োজন আর মদ্যের ফোয়ারা। ওই প্রাসাদে থাকে রাজসভার সদস্যরা, যারা সাধারণ মানুষের বেদনা, কষ্টের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন, কিছুই বোঝে না।
কিন্তু সেসব এখন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। ইয়াজগার্দ নিজের মৃত্যুর পানে ধেয়ে পালিয়েছে। ফারুকজাদ তার পিছু ধরে চলে গিয়েছেন। আমি বোকা গরিব সেনাটির কাছে গিয়ে তার বাঁ-কানের কাছে মৃদুস্বরে গুঞ্জন করলাম। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন গুনগুনানি ছিল সেটা। ওকে আদেশ করলাম, কণ্ঠহারটিকে নিয়ে যাও মেহেরজার্দের কাছে। দুর্গের নিচের গুপ্তকক্ষে মাটিতে পুঁতে দাও। লুকিয়ে রেখে এসো। সেনাটি সেনাবাহিনি ছেড়ে নড়তে ভয় পাচ্ছিল। আমার ফারুকজাদের কাছেও তাই যেতে হল। ফারুকজাদের কানে গুনগুনিয়ে বললাম, ওই সৈনিকটিকে মেহেরজার্দে পাঠাও। টেসিফন রাজপ্রাসাদের পতনের খবরটা দিতে হবে তো। পরদিন ওই সৈনিক আরও তিনজনের সঙ্গে ইয়াজদ-এর দিকে চলল, খুশিমনে, মুক্ত হয়ে। আমি নিজে ইয়াজদ যেতে পারিনি সৈনিকটির সঙ্গে। সময় ছিল না আমার। আমি শুধু তার কানে কানে বলে দিলাম কীভাবে একটা মাটি দিয়ে তৈরি ইট গড়বে সে, তার ভেতরে লুকোবে কণ্ঠহারটা, আর মাটির ওপর এঁকে দেবে একটা বিশেষ চিহ্ন, যাতে পরে আমিই একা সেই চিহ্ন দেখে ইটটাকে বেছে নিতে পারি। খুব দ্রুত ঘোড়ায় চেপে চলে গেল সেনাটি। আমি তার সঙ্গ ধরতে পারলাম না। কিন্তু সময় কুঠুরিরে ফিরে আমি জেগে উঠলাম।’’
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..
জোহা তাঁর গল্প থেকে গল্পে বুদ্ধিমতী, সাংঘাতিক স্ট্রং কেন্দ্রীয় চরিত্রের মেয়েদের রচনা করেছেন স্বমহিমায়। নিজের দেশ সম্পর্কে হালকা শ্লেষ, লুকনো ব্যঙ্গের শাণিত অস্ত্রও বেমিল নয়।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২১। সারা শহর যখন এক মহানিষ্ক্রমণের দরজায়, তথ্য রাখার দায়িত্ব কে নেবে?
পর্ব ২০। বাড়িকেই জামার মতো পরেছে মানুষ
পর্ব ১৯। আলো-অন্ধকারে হেঁটে যে কল্পবিজ্ঞান বলতে চেয়েছে দলিত কাহিনি
পর্ব ১৮। পৃথিবীর শেষ লড়াই পানীয় জলের দখলের জন্য
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই