সে সময় লোকে খুব অবাক হয়ে ‘তারা করছেটা কী’ দেখেছিল। খান দশেক এপিসোড এমন চলার পর, ঠিক হল, এপিসোডে একজন করে স্পেশাল গেস্ট আসবে। শুরু হয়েছিল, লাল আর হিরণ মিত্র-কে দিয়ে। খুব ভাল একটা এপিসোড হয়েছিল। পরদিন সাতসকালে, মা এসে ঘুম ভাঙাল, অ্যাই, ঋতুদা ফোন করেছে, বলছে খুব দরকার। ঘুমচোখে তড়িঘড়ি ফোন ধরলাম। ওপারে ঋতুদার গলায় সামান্য উদ্বেগ।
৫.
কেন অপরিচিত চারজনকে নিয়ে এমন শুটিং হবে? ঋতুদার মতে, মুখগুলোর সঙ্গে দর্শকের আলাপ হওয়া প্রয়োজন। এই শহরেরই চার যুবক-যুবতী, যারা কলকাতার পথেঘাটে নিজস্ব মেজাজে ঘুরে বেড়ায়, সেই ক্যাজুয়াল আলগা মুডটার সঙ্গে মিশে থাকবে এই মহানগর মন্তাজ। শুটিং যাই হোক না কেন, অনেকখানি গুরুত্ব যে দেওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারছিলাম। পরিচালক শৌভিকদা সাতসকালে কলটাইম দিল। লোকেশন সবই দক্ষিণের। গড়িয়াহাট, বাসন্তী দেবী কলেজ, মহানির্বাণ মঠ, সাদার্ন অ্যাভিনিউ জুড়ে ক্যামেরা চলল। একসঙ্গে নয়, চারজন আলাদা আলাদা। সঞ্চারী মনে হয় ফুচকা খেয়েছিল, চন্দ্রিল একটা ট্রামকে হাত দেখিয়ে, অন্য ট্রামে উঠে পড়েছিল, আমি সিগারেটের দোকানের নারকেল দড়িতে আগুন জ্বালিয়েছিলাম।
রাস্তাঘাটের শুটিং সবসময়ই খুব মজার। বিশেষ করে, সে শুটিং যদি পারমিশনহীন হয়। এখন এটার নাম হয়েছে ‘গেরিলা শুটিং’। গিরিশ পাধিয়ার ক্যামেরা কাঁধে জায়গা নিচ্ছিলেন। তারপর চিৎকার করে ডাকছিলেন আমাদের। শৌভিকদা, গিরিশ ছাড়া সোনামণি নামেরও একজন ছিল ইউনিটে। সকাল থেকে শুট করে এক বেলার মধ্যেই হয়ে গেল ব্যাপারটা। তারপর যাওয়া হল ঋতুদার বাড়ি। সেখানে দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে, কতকগুলো স্টিল ছবি নেওয়া হল। যেমনটা আসামিদের নেওয়া হয় সচরাচর। ফ্রন্টাল, রাইট প্রোফাইল, লেফ্ট প্রোফাইল। কী যে ভজঘট ব্যাপারস্যাপার চলছিল ঋতুদার মাথায়, কে জানে! ওই স্টিলগুলো না কি ব্যবহার করা হবে, আমাদের ইন্ট্রোডাকশনের সময়, যেখানে আমাদের বায়োডেটা ফুটে উঠবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, উচ্চতা, শরীরে জড়ুল বা বিশেষ কোনও চিহ্ন আছে কি না, পেশা– এইসব কিছু ফুটে উঠবে পর্দায়। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোনও কমপ্লেক্স না থাকলেও হাইট নিয়ে বেশ ছিল। বিশেষ করে যেখানে সদ্য আলাপ হওয়া মেয়ে-টেয়ে আছে। ঋতুদা দয়াপরবশত হয়ে ‘মাঝারি’ করে দিল। আমি এর মধ্যে চার-পাঁচ রকমের চাকরি করেছি বলে পেশার জায়গায় লেখা হল– পেশা পরিবর্তন। এই অভিনব প্রোগ্রামের মন্তাজটা এডিট করেছিল অর্ঘ্যকমল মিত্র, আর দুরন্ত মিউজিক করেছিল দেবজ্যোতি মিশ্র। অর্ঘ্যদার কেরামতিতে দেখার মতো টাইটেল প্রোমো হয়েছিল ‘তারা করছেটা কী’-র।
শুটিং শুরু হয়ে গেল জেট স্পিডে। সকাল সকাল এনটিওয়ানে বেশ কয়েক জোড়া জামা-প্যান্ট নিয়ে পৌঁছে মেক-আপে বসে যেতাম চারমূর্তি। আয়নার সামনে ডানদিক থেকে, বাঁদিক থেকে নিজেদের বারবার দেখে, সারাদিন ধরে রাজা-উজির মারতাম। অধিকাংশ দিনই আমাদের আনা কস্টিউম, ঋতুদার চোখে পড়লেই বাতিল হয়ে যেত বেমালুম। তখন কস্টিউম বিভাগ পাঞ্জাবি সাপ্লাই করত আমাকে, চন্দ্রিলকে। পরে জেনেছিলাম, ওগুলো সব ঋতুদার নিজের। অত রকমের জামা যে একটা লোকের সংগ্রহে থাকতে পারে, সেই প্রথম জানলাম। সেট-ও দেখতে হয়েছিল ঋতুদার ড্রইংরুমের মতো। প্রায় সবটাই ঋতুদার বাড়ি থেকে আনা। আমাদের মেক-আপ করত ইউনুস। দু’-তিন পোঁচ রং লাগিয়েই সে সটান হাজির করত ঋতুদার সামনে। ভুরু কুঁচকিয়ে, পেন্টিং দেখার মতো মুখচোখ করে ঋতুদা বলত– আর একটু কমতে চায়, বা আর একটু বাড়তে চায়। এইসব শব্দবন্ধ শুনে খুব অবাক লাগত, শুটিংয়ের অধিকাংশ টার্মই তখন আমাদের কাছে হিব্রু ছিল।
প্রথম দিকে আমরা চারজনই বকবক করতাম পুরো এপিসোড ধরে। ‘সিলেবাসে নেই’ সে সময় ‘তারা’র দারুণ জনপ্রিয় প্রোগ্রাম। সেখানে ‘এ জীবন পূর্ণ করো’ গাওয়া হয়েছিল। তেড়ে সমালোচনা করেছিলাম। এই নিয়ে না কি তারার অফিসে খুব হইচই হয়েছিল। এখন যেমন, মানুষ কেমন নিন্দে করতে পারে, দেখার জন্য ফেসবুকের মেটা চচ্চড়ি খেতে হয়, সে সময় লোকে খুব অবাক হয়ে ‘তারা করছেটা কী’ দেখেছিল। খান দশেক এপিসোড এমন চলার পর, ঠিক হল, এপিসোডে একজন করে স্পেশাল গেস্ট আসবে। শুরু হয়েছিল, লাল আর হিরণ মিত্র-কে দিয়ে। সে সময় ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ শোরগোল ফেলে দিয়েছিল বাংলার সংস্কৃতি মহলে। এমন মিনিম্যালিস্ট সেট ডিজাইন এর আগে দেখেনি বাংলা মঞ্চ। লালের পরিচালনার মুনশিয়ানায় নিম্নবর্গের মহাকাব্য সার্থক রূপ পেয়েছিল। নাটকটা নিয়ে কথা বলব, কিন্তু টিকিটই তো পাচ্ছি না দেখার। এমনই ভিড়। ঋতুদার অনুরোধে লাল চারটে টিকিট রেখে দিল একাডেমির। এক রোববারের সকালে দেখে এলাম সে নাটক। খুব ভাল একটা এপিসোড হয়েছিল তিস্তাপার নিয়ে। ঋতুদা বারবার করে বলছিল, নানা কিছু জিজ্ঞেস করার কথা। বাড়ি ফিরে আসার পরও ঋতুদা ফোন করে এপিসোড নিয়ে কথা বলেই চলছিল। পরদিন সাতসকালে, মা এসে ঘুম ভাঙাল, অ্যাই, ঋতুদা ফোন করেছে, বলছে খুব দরকার। ঘুমচোখে তড়িঘড়ি ফোন ধরলাম। ওপারে ঋতুদার গলায় সামান্য উদ্বেগ।
–শোন, তুই আর চন্দ্রিল কি ‘তারা’-তে চাকরি করতে পারিস?
–কবে থেকে?
–ধর কাল।
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলি সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত। ছবিগুলি তুলেছিলেন সুপ্রিয় রায়।