নয়ের দশকের গোড়ার দিকে প্রথম যখন টিভিতে কমার্শিয়াল দেখানো হয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের, তখন সরকারি মতে আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। প্রেমিকার সঙ্গে ‘শরীর খারাপ’ নিয়ে আলোচনায় ছুতমার্গ নেই আর। তার শরীর খারাপ হলে আমার মন খারাপ হয়। আরও মন খারাপ নিয়ে একদিন আমেরিকা পৌঁছই। বিখ্যাত বার্গার চেইন-এর ড্রাইভ ইন কাউন্টারে খাবার ডেলিভারি নেওয়ার সময় আবদার জানাই, ‘ন্যাপকিন প্লিজ’। যুবতী কর্মচারী, যিনি একটু আগেই একগাল হেসে ‘এনজয় ইয়োর মিল’ বলেছিলেন, হঠাৎ রক্তচক্ষু হয়ে যান।
‘মেন্স’ শব্দটি প্রথম শুনি পাড়ার আড্ডায়। কোনও এক নায়িকা, যিনি সাধারণত সিফন শাড়িতে স্ক্রিনে আসতেন, একটি সিনেমায় তাঁতের শাড়ি পরে অভিনয় করেন। এক পাড়াতুতো বন্ধু, বয়সে একটু বড়, বলেছিল, ‘নির্ঘাত শুটিং-এর সময় মেন্স চলছিল’। তখন পারিজাত রিডারে ইংরেজি শেখার বয়স। শব্দটির অর্থ বুঝিনি, ধন্দে পড়েছিলাম। ‘মেন’ শব্দটি তো প্লুরাল। তার শেষে আবার ‘এস’ বসানোর কী আছে? সিনিয়রের ইংরেজির ভুল ধরে নিজের বুক ফুলে গেল। আরও কম বয়সে, বোধহয় ক্লাস ওয়ান, মা-র সঙ্গে পাড়ার ওষুধের দোকানে গেছি। প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড ইত্যাদি। বেরোনোর সময় চোখে পড়ল এককোনে থাকে থাকে রাখা সুদৃশ্য প্যাকেট, প্ল্যাস্টিকের। সুন্দর ফুল ফুল ডিজাইন। গায়ে কী লেখা আছে, সেটা বোধগম্য হয় না। তাই মা’কে জিগ্যেস করি। উনি বলেন, ‘রুমাল’। আমি ওই রুমাল কেনার বায়না করতে থাকি ঘ্যানঘেনিয়ে। মা সামান্য জোর দিয়ে বলেন যে ওগুলো অন্য ধরনের রুমাল, মেয়েদের। এই লজিকটি মনে ধরে।
মেয়েদের রুমাল কিনলে যে ছেলেরা আওয়াজ দেবে– স্রেফ সেই ভয় আমায় ওই প্যাকেটের রহস্য থেকে দূরে রাখে অনেক দিন। যতদিন না ‘মেন্স’ শব্দটি বার বার উচ্চারিত হতে থাকে পাড়ার ঠেকে এবং আমি এক শীতের সকালে স্কুল যাওয়ার সময় সেই শব্দের সঙ্গে গলিতে পড়ে থাকা একটুকরো রক্তমাখা কাপড়ের যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হই। আমার চারপাশে যেসব মাঝবয়সি মহিলা ছিলেন, তাঁদের প্রতি মাসেই ‘শরীর খারাপ’ হত। কখনও তাঁরা পুজোর প্যান্ডেল এড়িয়ে চলতেন ওই শরীর খারাপের কারণে। বাড়ির পুজোতেও অঞ্জলি দিতেন না। আমার নিজেরও ঘন ঘন শরীর খারাপ হত, কিন্ত সে তো সর্দি-কাশি। বুঝেছিলাম মেয়েদের ‘শরীর খারাপ’ অন্য রকম। স্কুলে, ক্লাস সিক্স বা সেভেনে জানলাম ওই শরীর খারাপের অন্য নাম ‘পিরিয়ড’। জানলাম মানে, এক সহপাঠীর হ্যা হ্যা মার্কা প্রশ্নের মাধ্যমে– ‘আচ্ছা, আমাদের যেমন ফার্স্ট পিরিয়ড, সেকেন্ড পিরিয়ড মেয়েদের স্কুলেও কি তেমন?’ আমার তেমন হাসি পায় না। বরং রহস্য বাড়ে। আরও বড় হয়ে কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি ওই পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়। কানে আসে বান্ধবীদের ফিসফাস, যন্ত্রণার আখ্যান। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সিলেবাসের বাইরের বই ঘাঁটতে হয়, কারণ তখন ইন্টারনেট জন্মাতে আরও এক দশক। যন্ত্রণার ধরনটা একটু বুঝতে পারি যেদিন টেনিস বল ক্রিকেট ম্যাচে, সিলি মিড অফে ফিল্ডিং করার সময়, একটি ড্রাইভ বুলেটের মতো আছড়ে পরে আমার পৌরুষে। তিনদিন শুয়ে থাকি বিছানায় আর নিজেকে শাসাই, আর কোনও দিন দাঁড়িও না ওই পজিশনে।
নয়ের দশকের গোড়ার দিকে প্রথম যখন টিভিতে কমার্শিয়াল দেখানো হয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের, তখন সরকারি মতে আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। প্রেমিকার সঙ্গে ‘শরীর খারাপ’ নিয়ে আলোচনায় ছুতমার্গ নেই আর। তার শরীর খারাপ হলে আমার মন খারাপ হয়। আরও মন খারাপ নিয়ে একদিন আমেরিকা পৌঁছই। বিখ্যাত বার্গার চেইন-এর ড্রাইভ ইন কাউন্টারে খাবার ডেলিভারি নেওয়ার সময় আবদার জানাই, ‘ন্যাপকিন প্লিজ’। যুবতী কর্মচারী, যিনি একটু আগেই একগাল হেসে ‘এনজয় ইয়োর মিল’ বলেছিলেন, হঠাৎ রক্তচক্ষু হয়ে যান। ‘ইউ মিন টিস্যু?’ আমি ভুল বুঝতে পেরে ঘাড় নাড়ি। উনি এক থোকা টিস্যুপেপার আমার বাড়ানো হাতে গুঁজে দেন।
মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় সল্টলেকে সাইকেল চালাচ্ছিলাম এক বিকেলে, আটের দশকের শেষের দিকে। এক ব্লক থেকে আরেক ব্লক যাওয়ার সময় একটি শর্টকাট নিই। দু’দিকে মধ্যবিত্ত আবাসন। রাস্তাটি আবাসনের পিছন দিকে। সেখানে অনেকগুলো ভ্যাট। জঞ্জাল উপচে পড়ছে। আর শুনশান, এবড়োখেবড়ো রাস্তায় লাট খাচ্ছে পরিত্যক্ত অসংখ্য ন্যাপকিন। কয়েকটা বাচ্চা কুকুর টানাটানি করছে সস্তা কাপড়ের দলাগুলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম, কারণ সাইকেলের ব্যালান্স। ওই বিকেলের দু’দশক পর যখন নিউ জার্সির ডিপারট্মেন্টাল স্টোর থেকে মাসকাবারি করার সময় চাল, ডাল, ডিম, দুধ, সবজি, বিস্কিট, আর রেড ওয়াইনের পাশে রেখে দেব সুদৃশ্য প্যাকেটে মোড়া আধুনিক স্যানিটারি ন্যাপকিন, তখন সল্টলেকের ওই রাস্তার কথা মনে পড়বে না।