ঋতুপর্ণ আমাদের বললেন, শোন, আমি ‘তুই’ করে বলছি, এই ‘তুমি’ সম্বোধনটা খুব আনইন্টারেস্টিং, তারচেয়ে ‘আপনি’ বা ‘তুই’ ভাল। এই সেরেছে, আমরা তো তুমিই বলব না কি! এইসব বেয়াড়া প্রশ্নে ঋতুপর্ণকে দেখতাম আনমনা হয়ে যেতে।
৪.
মেয়ে খোঁজার ব্যাপার যখন, তুই দ্যাখ– বলে চন্দ্রিল আমাকে কাটিয়ে দিল। আমি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে খুঁজতে বেরলাম ‘হয়তো মেহুলি’-কে। উপলের স্ত্রী গার্গী, ইংরেজির অধ্যাপিকা, যাদবপুরের অনেককে চেনে। সেই সূত্রে কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় হল মেয়ের নাম্বার। অচেনা পুরুষ কণ্ঠস্বরের ফোন ধরলে, উল্টোদিকে এমনিই একটা বাড়তি ঝাঁঝ থাকে। ‘কী চাই’– এর উত্তরে ট্রাম্প কার্ডটা খেললাম। ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছেন, তোমাকে দেখা করতে।’ এতে কাজ দিল। মেয়েটির সুর বদলে সিরিয়াস ও নরম। ‘আমি বাড়িটা না একবারই গিয়েছি, ভাল হয় একসঙ্গে গেলে।’ মুখে ‘আচ্ছা’ বললেও মনে মনে বললাম, ‘বহত আচ্ছা’, আমারও ভাল হয়। ‘কোথায় দাঁড়াব তাহলে?’ ‘ঋতুপর্ণর বাড়ির কাছে যোগেশ চৌধুরি কলেজ। গেটের সামনেই ভাল।’ ‘চিনব কীভাবে?’ মুশকিলে পড়লাম, কী বলি, এতই অ্যাভারেজ দেখতে আমায়। বললাম, ‘গালে দাড়ি আছে, উগ্রপন্থী টাইপ।’ তবে ওই কথাই রইল মেহুলি, শুক্রবার, তিনটে। ‘আমার নাম মেহুলি নয়, মেহেলি।’ আবার পুরনো ঝাঁঝ। মেয়েলি! এর’ম নাম হয় না কি! যাগ্গে। অন্তত এক সপ্তাহ আমি ওর নামটা ভুল জানতাম। বিলকুল। ঋতুপর্ণকে ফোন করে জানালাম, সন্ধান মিলেছে।
ভাল জামাপ্যান্ট পরে যোগেশ চৌধুরি কলেজের শুনশান গেটে দাঁড়িয়ে রইলাম পৌনে তিনটে থেকে। দুপুরের দিকটা ফাঁকা, ফলে একজন মেয়ে এলে চোখে পড়বেই। ঠিক তিনটে নাগাদ একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। বিশ্রী সুরে একটা ঘণ্টা বেজে উঠল, আর কলেজের ভেতর থেকে সোডার বোতল খোলার মতো একরাশ মেয়ে ভসভস করে বেরিয়ে এসে ফুচকা, ঝালমুড়ি খেতে লাগল। আচ্ছা গেরো! আমি যথাসম্ভব সাইড করে দাঁড়ালাম, যাতে আমাকে দেখে বহিরাগত বার্ড ওয়াচার না মনে হয়। যদ্দুর মনে পড়ছে, মেহেলিই এসে আমায় খুঁজে বের করে। ‘তুই অনিন্দ্য তো, চল।’ স্ট্রিট স্মার্ট শব্দটা তখনও আমার অভিধান জানে না।
ঋতুপর্ণর বাড়িজুড়ে তখন রইরই কাণ্ড! একটা অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল লোকটার, যত রাজ্যের মিটিং, সব বাড়িতে ডেকে করা। বিধান রায় আর মোরারজি দেশাই ছাড়া আর সকলেই বোধহয় ঋতুপর্ণর ড্রইংরুমে একবার না একবার এসেছেন। স্ট্র্যাটেজি মিটিং, মার্কেটিং প্ল্যান, সার্ভে কোম্পানির রিপোর্ট– এক হুলস্থুল কাণ্ড। আমি, সঞ্চারী, চন্দ্রিল উদ্বিগ্ন মুখে ঘরের বাইরের চত্বরে, মেহেলি নির্বিকার মুখে– ‘অ্যাই তোর কাছে আগুন আছে’, বলে বিরক্ত হয়ে, অন্যত্র বন্দোবস্ত করে, ফসফস ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
শেষমেশ অনুষ্ঠানের মিটিংয়ে ঢোকা হল। ঋতুপর্ণর আমাদের চারজনের কম্বিনেশন পছন্দ হল। দেখলাম, ঋতুপর্ণর সঙ্গে কথাবার্তায় মেহেলি বেশ জড়তাহীন, সহজ। ‘ঋতুদা তুমি’ করে সুন্দর কথাও চলছে। ঋতুপর্ণ আমাদের বললেন, শোন, আমি ‘তুই’ করে বলছি, এই ‘তুমি’ সম্বোধনটা খুব আনইন্টারেস্টিং, তারচেয়ে ‘আপনি’ বা ‘তুই’ ভাল। এই সেরেছে, আমরা তো তুমিই বলব না কি! এইসব বেয়াড়া প্রশ্নে ঋতুপর্ণকে দেখতাম আনমনা হয়ে যেতে।
অনুষ্ঠানের নাম ঋতুদা একটা ভেবেছে। ‘তারা করছেটা কী?’– এইর’ম অদ্ভুত নামের ও কিম্ভুত কিসিমের প্রোগ্রাম কখনও টিভিতে হয়নি। ‘কাউকে রেয়াত করবি না, একেবারে গড়গড় করে নিন্দে করবি। ওই এক্সট্রিম মতামতগুলোই ইউএসপি।’ বিদেশি টেলিভিশনের নানা টক শো নিয়ে জমিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা চলল চন্দ্রিল, মেহেলির সঙ্গে। আমি উত্তর কলকাতার এঁদো গলির ছেলে, বড় হয়েছি ‘দর্শকের দরবার’ আর ‘মহাভারত’ দেখে, ওদের অর্ধেক কথাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। খালি একবার ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘এত নিন্দেমন্দ করলে তোমার অফিসের সবাই রেগে যাবে না?’ ঋতুদা হেসে উড়িয়ে দিল। খানিক পরে ঘরে ঢুকল শৌভিকদা ও আরও একজন বলশালী মানুষ। ঋতুদা আলাপ করিয়ে দিল, ‘ও হচ্ছে গিরিশ।’ বুঝলাম গিরিশ পাধিয়ায়, ‘হীরের আংটি’র ক্যামেরাম্যান। ফিল্ম ও শুটিংয়ের দুনিয়া সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা। চন্দ্রিল সেদিক থেকে অনেকটাই অভিজ্ঞ, কারণ এসআরএফটিআই-এর পরিচালনা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ও একজন। শৌভিক মিত্র এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন। শুটিং হবে ‘এনটিওয়ান’-এর ফ্লোরে। ‘শুটিং’ শব্দটার মধ্যে একটা ধুন্ধুমার উত্তেজনা আছে। সে আমায় দেখা যাক বা না-যাক। আলো, ক্যামেরা, কাটার, বুম– একেবারে স্বপ্নের এক জগৎ। আমি জীবনে প্রথম শুটিং দেখি, ‘কোনি’ সিনেমার। হেদুয়াতে হয়েছিল। গোটা এলাকার লোক উপচে পড়েছিল। সরোজ দে-কে পাড়ার বন্ধুরা ডাকত ‘কালোদা’ বলে। যখন ‘সানন্দা’-র পাতায় ফ্রিল্যান্স করি, সেসময় কয়েকবার ওঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। খুব ভালবাসতেন। সিনে সেন্ট্রালের মেম্বারশিপ সরোজজেঠুর জন্যই হয়েছিল। নিজে ট্যাক্সি করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিয়ে গিয়ে অলোক চন্দ্র-র সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন। ‘কোনি’র শুটিংয়ের সময় আমি স্কুলে পড়ি। বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পেতাম বড় বড় আলো আর ক্রেনের মাথা। শুটিং যে একটা বড় কিছু, তখন থেকেই মাথায় ঢুকে গিয়েছে। ঋতুদা এই স্বপ্নটাই আর একটু উসকে দিল, তারার মহাযজ্ঞে ডেকে এনে। হয়তো ঋতুদার প্রয়োজন ছিল লোকের, কিন্তু সাংবাদিকতায় কলম পেশা আমার আরও বেশি প্রয়োজন ছিল একটা অভিমুখের। এ যে সময়ের কথা, সেসময় আমি দু’-দুটো চাকরি একসঙ্গে চালাই। একটা সরকারি আর একটা নাইট ডিউটি ‘আজকাল’-এর ডেস্কে। দুটো চাকরির মাঝের সময়টায় রিহার্সাল করি। আমি নিজে করছিটা কী, তাই জানতাম না ভাল করে, কিন্তু বহাল হয়ে গেলাম, ‘তারা করছেটা কী’-র টিমে। সিনেমা তখন অনেক দূরের স্বপ্ন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় কোনির শুটিংয়ের মতো দূর।
একটু সৌমিত্র, একটু কাটার স্ট্যান্ড, একটা লাইট হাউস যদি চোখে পড়ে। ‘তারা করছেটা কী’ শুটিংয়ের উত্তপ্ত আলোচনায় আনমনা হয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। দিবাস্বপ্ন দেখি। সরোজ দে-র মতো, ঋতুপর্ণর মতো, আমিও হয়তো লম্বা একটা ট্রলির পাশে পাশে হাঁটছি উত্তর কলকাতার গলিঘুঁজিতে। লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন– সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার শুনতে পাই হঠাৎ। তুই কিন্তু শুনছিলিস না মন দিয়ে কী বললাম। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা আমার চোখেমুখে। ঋতুদা ওসবে আমল না দিয়ে ঘোষণা করল, আগামী শনিবার শহরের পথঘাটে এ প্রোগ্রামের টাইটেল সিকোয়েন্স শুটিং করবে গিরিশ আর শৌভিক।
মানুষ চিরদিন নিজের মধ্যেই দ্বিখণ্ডিত। একদিকে শেষ সমস্ত প্রকৃতিকে হারিয়ে দিয়ে যেন নিজের চিরস্থায়ী বৈভবে প্রকাশিত। অন্যদিকে, সেই মানুষই মাটির কয়েক ফুট নিচে অন্ধকারে অন্ধভাবে ফিরে যাচ্ছে তার শেষ মূক আশ্রয়ে, যেখানে সে পচতে পচতে একদিন স্রেফ উবে যাবে। তাহলে অনন্ত বলে কিছু নেই? সবাই মৃত্যু পথের যাত্রী?