জগৎকে কোনও একদিন সৃষ্টি করে তারপর প্রতিদিন তার ভার কেউ বহন করে নিয়ে চলেছে, তা নয়। জগৎকে কেবলই সৃষ্টি করা হচ্ছে। যিনি প্রথম, জগৎ তাঁর কাছ থেকে নিমেষে নিমেষে নতুন করে আরম্ভ হচ্ছে। সেই প্রথমের পরম স্পর্শটির কোথাও ছেদ পড়ছে না, কোথাও ফুরোচ্ছে না। গোড়াতেও যিনি প্রথম, এখনও তিনি প্রথম। গোড়াতেও নবীন, এখনও নবীন। ‘বৈচৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ– বিশ্বের আরম্ভেও তিনি, অন্তেও তিনি, সেই প্রথম, সেই নবীন, সেই নির্বিকার।’
৭.
‘শিশু হয়ে এসেছে চিরনবীন, কিশলয়ে তার ছেলেখেলা জমাবার জন্যে।’ ঋতুরাজের পরিচয়ের এই নির্যাসটুকু রবীন্দ্রনাথ ধরিয়ে দিয়েছেন বারে বারে। ‘ফাল্গুনী’ নাটকের শেষে চন্দ্রহাসকে তাই বলতে শুনি, ‘এ তো বড়ো আশ্চর্য! তুমি বারে বারেই প্রথম, ফিরে ফিরেই প্রথম।’ পৃথিবীর ঋতুপরিক্রমণ পথে, বসন্ত যে চিরনবীনতার খবর নিয়ে আসে, আহ্নিকের ছন্দে সেই একই খবর আসতে থাকে প্রতিদিন প্রভাতে।
‘চিরনবীনতা’ শীর্ষক অভিভাষণ রবীন্দ্রনাথ শুরু করছেন, ‘প্রভাত এসে প্রতিদিনই একটি রহস্যকে উদ্ঘাটিত করে দেয়; প্রতিদিনই সে একটি চিরন্তন কথা বলে, অথচ প্রতিদিন মনে হয় সে কথাটি নূতন। আমরা চিন্তা করতে করতে, কাজ করতে করতে, লড়াই করতে করতে প্রতিদিনই মনে করি, বহুকালের এই জগৎটা ক্লান্তিতে অবসন্ন, ভাবনায় ভারাক্রান্ত, এবং ধুলায় মলিন হয়ে পড়েছে। এমন সময় প্রত্যুষে প্রভাত এসে পূর্ব আকাশের প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্মিতহাস্যে যাদুকরের মতো জগতের উপর থেকে অন্ধকারের ঢাকাটি আস্তে আস্তে খুলে দেয়। দেখি সমস্তই নবীন, যেন সৃজনকর্তা এই মুহূর্তেই জগৎকে প্রথম সৃষ্টি করলেন। এই যে প্রথমকালের এবং চিরকালের নবীনতা এ আর কিছুতেই শেষ হচ্ছে না, প্রভাত এই কথাই বলছে।’
এই বার্তাটির মধ্যে যে সত্যটি আমরা উপলব্ধি করতে পারি, তা হল, যিনি প্রথম তিনি আজও প্রথম হয়েই আছেন। জগৎকে কোনও একদিন সৃষ্টি করে তারপর প্রতিদিন তার ভার কেউ বহন করে নিয়ে চলেছে, তা নয়। জগৎকে কেবলই সৃষ্টি করা হচ্ছে। যিনি প্রথম, জগৎ তাঁর কাছ থেকে নিমেষে নিমেষে নতুন করে আরম্ভ হচ্ছে। সেই প্রথমের পরম স্পর্শটির কোথাও ছেদ পড়ছে না, কোথাও ফুরোচ্ছে না। গোড়াতেও যিনি প্রথম, এখনও তিনি প্রথম। গোড়াতেও নবীন, এখনও নবীন। ‘বৈচৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ– বিশ্বের আরম্ভেও তিনি, অন্তেও তিনি, সেই প্রথম, সেই নবীন, সেই নির্বিকার।’
এই সত্যটিকে উপলব্ধি করে ফিরে ফিরে নবীন হয়ে ওঠাই আমাদের সাধনা। বারে বারে সচেতন ভাবে এই মূল সত্যে আমাদের ফিরে আসতে হবে, প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন করে জন্মাতে হবে। আমাদের স্বাতন্ত্র্যের পথে, প্রবৃত্তির পথে একটানা চলে যেতেই যদি থাকি, একদিন বাধ্য হয়ে ফিরতে হবেই, নিজের শক্তির সমস্ত অভিমানকে দগ্ধ করে ছাই করে ফিরতে হবে। সেই ফেরা যন্ত্রণার, উৎকট অসুন্দর। একটা মস্ত ভাঙাচোরার মধ্যে তার অবধারিত অবসান।
‘অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি॥
অধর্মের দ্বারা লোকে বৃদ্ধিপ্রাপ্তও, তাতেই সে ইষ্টলাভ করে, তার দ্বারা সে শত্রুদের জয়ও করে থাকে, কিন্তু একেবারে মূলের থেকে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নগ্ন শিশু হয়ে জন্মগ্রহণের পর অনন্ত নবীনতার মধ্যে খেলা করার সুযোগ আমরা সকলেই পাই। ধুলোবালিতেও তখন আনন্দ, পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ, যা কিছু আমাদের চেতনাকে তখন স্পর্শ করে, সকলই তখন আনন্দের দান, অমূল্য লাভ হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আমাদের মন ক্রমশ সেই চেতনদৃষ্টি হারিয়ে ফেলতে থাকে, জগৎ কিন্তু তেমনি নবীনই থাকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভারতবর্ষের এই বাণী অনুধাবন করে, সচেতন সাধনায় আমাদের চিত্তকে বারে বারে অস্তিত্বের মূল সুরে ফিরিয়ে এনে একবার করে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে আমাদের অখণ্ড যোগটিকে অনুভব করে নিলে, আমাদের জীবন সুন্দর সামঞ্জস্যে স্থিত হতে পারে। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ। আমাদের স্বতন্ত্র ইচ্ছাগুলি যেন সেই গানের তানের মতো। আমাদের নিজস্ব তান যত দূরেই যাক, যতই মনে হোক বিক্ষিপ্ত হয়ে উধাও হওয়াতেই মুক্তির স্বাদ চূড়ান্ত হবে, কিন্তু তার সমস্ত ছুটে চলা মূল গানে আবার ফিরে আসার জন্যই। ফিরে আসার নিবিড় রসেই তানের সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথের উপমায়, ‘বাপ যখন লীলাচ্ছলে দুই হাতে করে শিশুকে আকাশের দিকে তোলেন, তখন মনে হয় যেন তিনি তাকে দূরেই নিক্ষেপ করতে যাচ্ছেন– শিশুর মনের ভিতরে ভিতরে তখন একটু ভয়-ভয় করতে থাকে, কিন্তু একবার তাকে উৎক্ষিপ্ত করেই আবার পরমুহূর্ত তাকে বুকের কাছে টেনে ধরেন। বাপের এই লীলার মধ্যে সত্য জিনিস কোনটা? বুকের কাছে টেনে ধরাটাই, তাঁর কাছ থেকে ছুড়ে ফেলাটাই নয়। বিচ্ছেদের ভাবটি এবং ভয়টুকুকে সৃষ্টি করা এইজন্যে যে, সত্যকার বিচ্ছেদ নেই সেই আনন্দকেই বারংবার পরিস্ফুট করে তুলতে হবে বলে।’
নগ্ন শিশু হয়ে জন্মগ্রহণের পর অনন্ত নবীনতার মধ্যে খেলা করার সুযোগ আমরা সকলেই পাই। ধুলোবালিতেও তখন আনন্দ, পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ, যা কিছু আমাদের চেতনাকে তখন স্পর্শ করে, সকলই তখন আনন্দের দান, অমূল্য লাভ হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আমাদের মন ক্রমশ সেই চেতনদৃষ্টি হারিয়ে ফেলতে থাকে, জগৎ কিন্তু তেমনি নবীনই থাকে।
উৎসবের উপলক্ষে আমাদের চিত্ত সেই চিরনবীনতার মধ্যে আর একবার জন্মগ্রহণ করুক, শৈশবের সত্যদৃষ্টি ফিরে পাক, জল-স্থল-আকাশ আনন্দময় রহস্যে পূর্ণ হয়ে উঠুক। আমাদের নবীন চিত্ত সকলকে একবার অমৃতের পুত্র বলে বোধ করুক, এই প্রার্থনা।
(চলবে)
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব