‘পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি’ (পিএল) ক্যাম্প এক বিচিত্র প্রতিষ্ঠান। পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি শব্দ দু’টি বাংলা করলে দাঁড়ায় চিরকালীন বোঝা। পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসা যেসব উদ্বাস্তু মেয়ের কোনও পুরুষ ‘অভিভাবক’ (অর্থাৎ স্বামী, বাবা, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে) ছিলেন না– পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের ‘পার্মানেন্ট লায়াবিলিটির’ তকমা দিয়েছিলেন। শারীরিকভাবে অক্ষম বা বৃদ্ধ একা পুরুষও অবশ্য এই তালিকায় পড়তেন। কার বোঝা? সরকারের। সহজ করে বললে, সরকার এঁদের চিরকালীন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। কারণ সরকার ধরে নিয়েছিল এঁরা উপার্জনে অক্ষম। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে সময়ে দলে দলে মেয়েরা চাকরি করতে যাচ্ছেন, সে সময় দাঁড়িয়ে সরকারি চোখে একা মেয়ে মানে বোঝা!
৮.
‘চৌরঙ্গী’র (১৯৬৮) মিসেস পাকড়াশিকে মনে পড়ে? যার সম্পর্কে স্যাটা বোস বলেছিলেন, ‘দিনের বেলা সমাজসেবা করেন, দেশের চিন্তা করেন, রাত্রে এই শাহজাহান হোটেলে চলে আসেন। সারাদিন তিনি প্রচণ্ড বাঙালি, কিন্তু এখানে তিনি প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক।’ অথবা মনে করুন, ‘থানা থেকে আসছি’ (১৯৬৫) ছবির চরিত্র রমা সেনের কথা। মিসেস পাকড়াশির মতোই তাঁর স্বামীও বিরাট ব্যবসায়ী। তবে সমাজে তাঁর নিজের পরিচিতিও কম নয়। মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট তিনি, সমাজসেবায় তাঁর খ্যাতি। আরেকটা উদাহরণ দিই। ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টান্ট’ ছবির (১৯৫৯) মেদিনী দেবী– তিনিও মহিলা সমিতির কর্ত্রী, বড়লোক স্বামীর শৌখিন, আদুরে স্ত্রী। সমাজসেবা যেন, এইসব সিনেমা থেকে মনে হয়, সে যুগের উচ্চবিত্ত পরিবারের গৃহিণীদের লোক-দেখানো শখ।
তবে সিনেমার এই চরিত্রগুলির সঙ্গে বাস্তবের মিল কতটা ছিল বলা মুশকিল। ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে, অবিভক্ত বাংলায় প্রগতিশীল, বর্ধিষ্ণু পরিবারের মহিলা সদস্যদের অনেকেই সমাজসেবায় ঝুঁকেছিলেন। সমাজসেবা সেযুগে ঘোষিতভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ ছিল। ’৪৩ এর মন্বন্তরের সময় ত্রাণের কাজে যে মহিলারা জোট বেঁধে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন হয় বামপন্থী মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য, বা জাতীয়তাবাদী সংগঠন সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। ‘৪৩-এর মন্বন্তরের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই দাঙ্গা, দেশভাগে বিপর্যস্ত হল বাংলা। ত্রাণের কাজে, বিশেষ করে দাঙ্গা-আক্রান্ত মেয়েদের ও উদ্বাস্তু মেয়েদের সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতে আবার এগিয়ে এলেন অশোকা গুপ্তা, রমলা সিনহা (মল্লিক), সীতা চৌধুরীর মতো ‘লেডি সোশাল ওয়ার্কাররা’। এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, সম্পন্ন, বিশিষ্ট পরিবারের সদস্য, নেতা, মন্ত্রী, আমলাদের সঙ্গে তাঁদের সহজ স্বাভাবিক নিত্যদিনের সম্পর্ক। তাই বলে তাঁদের লোক-দেখানো ‘শখের সমাজসেবী’ ভাবলে ভুল হবে। পাঁচ-ছয়ের দশকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করাতে তাঁরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তবে সমাজসেবাকে তাঁরা পেশা হিসাবে দেখেননি; রাজনৈতিক আদর্শ, নারীবাদী চেতনা ও দেশ গড়ার তাগিদ তাঁদের পথে নামিয়েছিল এই দুঃসময়ে।
‘সোশাল ওয়ার্ক’ বা সমাজসেবা স্বাধীন ভারতে পেশা হিসাবেও জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে, পঞ্জাবে অপহৃতা নারীদের পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য ত্রাণ-পুনর্বাসন দপ্তরে তৈরি হয়েছিল আলাদা নারী বিভাগ। বাংলায়, সরকারি উৎসাহে, দেশভাগের পরপর গঠিত হয়েছিল মহিলা সেবা সমিতি। তার ঠিক পরেই, ১৯৪৯-’৫০ সালে লেডি অবলা বসুর উদ্যোগে তৈরি হল বিটি রোডের বিখ্যাত বাগানবাড়ি উদয় ভিলায় উইমেন’স কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল হোম। উদ্দেশ্য উদ্বাস্তু মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো, উপার্জনক্ষম করে তোলা। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতেন মূলত মেয়েরাই। তাই চোখে পড়ে এমন অনেক বিজ্ঞাপন–
কয়েকজন সাধারণ শিক্ষিতা অভিভাবকহীনা নিরাশ্রয়া মহিলা কর্মী চাই। খাওয়া, থাকা, উপযুক্ত হাত খরচ। আবেদন কিংবা দেখা করুন। সেক্রেটারি– পূর্ববঙ্গ নারী-কল্যাণ আশ্রম। …নৈহাটি। (যুগান্তর, ১৬ মে, ১৯৫০।)
এই ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি ছিল সরাসরি সরকার চালিত পিএল ক্যাম্প বা পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি ক্যাম্প। সেইসব ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানেও থাকতেন প্রধানত মেয়েরাই; মহিলা উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করা ছিল তাঁদের মাস মাইনের চাকরি।
‘পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি’ (পিএল) ক্যাম্প এক বিচিত্র প্রতিষ্ঠান। তাই বুঝিয়ে একটু না-বললেই নয়। পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি শব্দ দু’টি বাংলা করলে দাঁড়ায় চিরকালীন বোঝা। পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসা যেসব উদ্বাস্তু মেয়ের কোনও পুরুষ ‘অভিভাবক’ (অর্থাৎ স্বামী, বাবা, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে) ছিলেন না– পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের ‘পার্মানেন্ট লায়াবিলিটির’ তকমা দিয়েছিলেন। শারীরিকভাবে অক্ষম বা বৃদ্ধ একা পুরুষও অবশ্য এই তালিকায় পড়তেন। কার বোঝা? সরকারের। সহজ করে বললে, সরকার এঁদের চিরকালীন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। কারণ সরকার ধরে নিয়েছিল এরা উপার্জনে অক্ষম। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে সময়ে দলে দলে মেয়েরা চাকরি করতে যাচ্ছেন, সে সময় দাঁড়িয়ে সরকারি চোখে একা মেয়ে মানে বোঝা! সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না, স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে না। সরকারি শিবিরে, সরকারি অনুদানে কাটবে তাঁর জীবন। এই সরকারি মানসিকতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্র কিন্তু লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়, রাষ্ট্র পিতৃতান্ত্রিক।
……………………………………………
ত্রাণের কাজে, বিশেষ করে দাঙ্গা-আক্রান্ত মেয়েদের ও উদ্বাস্তু মেয়েদের সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতে আবার এগিয়ে এলেন অশোকা গুপ্তা, রমলা সিনহা (মল্লিক), সীতা চৌধুরীর মতো ‘লেডি সোশাল ওয়ার্কাররা’। এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, সম্পন্ন, বিশিষ্ট পরিবারের সদস্য, নেতা, মন্ত্রী, আমলাদের সঙ্গে তাঁদের সহজ স্বাভাবিক নিত্যদিনের সম্পর্ক। তাই বলে তাঁদের লোক-দেখানো ‘শখের সমাজসেবী’ ভাবলে ভুল হবে। পাঁচ-ছয়ের দশকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করাতে তাঁরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তবে সমাজসেবাকে তাঁরা পেশা হিসাবে দেখেননি; রাজনৈতিক আদর্শ, নারীবাদী চেতনা ও দেশ গড়ার তাগিদ তাঁদের পথে নামিয়েছিল এই দুঃসময়ে।
……………………………………………
অবশ্য মহিলা উদ্বাস্তুদের জন্য নানা সরকারি আয়োজনের প্রয়োজনে, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরে অনেক মহিলাই চাকরি পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, সরকার একদল উদ্বাস্তু মেয়েদের ‘বোঝা’ হিসাবে যেমন দেখেছিলেন, তেমনই আরেকদল মেয়েকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই বোঝা টানার। এখানেও অবশ্য সরকারের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই প্রকাশ পায়। মহিলাদের দেখাশোনা, সেবা শাসনের কাজ, তাঁদের অল্পবিস্তর হাতের কাজ শেখানোকে ‘মেয়েলি’ কাজের তকমা দিয়েছিল সরকার। তাই সেই চাকরির উপযুক্ত ছিলেন মেয়েরাই। উদ্বাস্তুদের ত্রাণ, পুনর্বাসন, দেখভাল করাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন যে মেয়েরা, তাঁরা নিজেরাও বেশিরভাগ ওপার বাংলা থেকে ঠাঁইনাড়া হয়ে আসা মানুষ। তবে তাঁরা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁরা সংসারের হাল ধরার জন্য চাকরি জগতে এসেছেন। পরিবার আছে তাঁদের, তাই তাঁরা সরকারের চোখে বোঝা নয়।
এমনই এক মানুষ ছিলেন নীলা দত্ত। কুমিল্লার মেয়ে নীলা দেশভাগের পর কলকাতায় চলে আসেন। কখনও পেয়িং গেস্ট, কখনো হস্টেলে থেকে সংস্কৃতে তিনি এমএ পাশ করেন। তাঁর মা-বাবা তখনও পূর্ব বাংলায়। কিন্তু সর্বদা দাঙ্গার ভয়, দু’-দেশের সম্পর্কে নানা জটিলতা থেকে তাঁরা বুঝেছিলেন– একসময় না একসময়ে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসতে হবে পশ্চিমবাংলায়। নীলাও জানতেন সে কথা। মা-বাবা এসে যাতে আতান্তরে না পড়েন, তাই নীলার দ্রুত চাকরির প্রয়োজন ছিল। কিছুদিন স্কুলে পড়ানোর পর, পেয়েও গেলেন ১৯৫২ সালে ত্রাণ-পুনর্বাসন বিভাগের সরকারি চাকরি। পোস্টিং হল উত্তরপাড়া উইমেন্স ক্যাম্পে। অল্প সময় পর বদলি হয়ে নীলা গিয়েছিলেন রানাঘাটে মেয়েদের ক্যাম্পে। তাঁর স্মৃতিকথায় পড়ি রানাঘাট শিবিরের বর্ণনা:
রানাঘাট ক্যাম্পের সুপার সুমতি চক্রবর্তী অত্যন্ত সৎ মহিলা ছিলেন। ওনার স্বামী তখন absconding. তিনি কম্যুনিস্ট ছিলেন। রানাঘাট ক্যাম্প অনেক বড়ো ছিল, কর্মীও ছিল অনেক। আমরা মেস করে খেতাম, রাঁধুনি ছিল। অনেকগুলো মেস ছিল। কিছু কিছু কর্মী এবং স্কুল টিচার সপরিবারে থাকত। যদিও স্বামীরা দু’ একদিনের বেশি থাকতে পারত না। ওখানকার প্রাইমারি স্কুলের একজন টিচার ছিলেন নাম তপতী সরকার। ওনার স্বামী অখিলেশ সরকার কলকাতায় একটা সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। ওনারা রংপুরের যথেষ্ট সম্পন্ন পরিবারের লোক। পাকিস্তান হওয়াতে সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। …ক্যাম্পে আরেকজন ছিলেন ডাঃ গীতা সেন।
অর্থাৎ, এককথায় বলা যায়, ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে শিক্ষিতা, উচ্চবর্ণ, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা। স্পষ্টতই তাঁদের নিজস্ব পারিবারিক জীবন ছিল। আর্থিক প্রয়োজনে তাঁরা চাকরি নিয়েছিলেন।
ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে আবার ভাগ ছিল:
একটা ভাগের নাম ছিল ‘অরুন্ধতী’ আর আরেকটা অংশের নাম ছিল ‘শকুন্তলা’। যারা লেখাপড়া জানা পরিবারের মহিলা তাঁদের অরুন্ধতীতে রাখা হত, ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতেন।…পূর্ববঙ্গের ভালো ভালো পরিবারের মেয়েরা দাঙ্গায় স্বামী-পুত্র হারিয়ে দেশভাগের পর নিঃসম্বল অবস্থায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের এই সামান্য ডোল-এ চালাতে ওদের খুব কষ্ট হত। তবুও নিরাপত্তা ছিল। …‘শকুন্তলা’ বলে যে অংশটা ছিল তাতে একটু স্বল্পশিক্ষিত ধরনের মেয়েরা থাকত।তাদের চালচলন, কথাবার্তা, ব্যবহার সবই ছিল অন্যরকম। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ওদের লেগেই থাকত।… শকুন্তলাতে প্রায়ই দেখা যেত কিছু কিছু মহিলা অনুপস্থিত। বিছানা পাতা আছে অথচ লোক নেই। পরে প্রকাশ পেল বাড়তি রোজগারের জন্য ওরা রাত্রে বেরিয়ে যেত। বাউণ্ডারি বেড়ার তলা দিয়ে গর্ত কেটে রানাঘাট শহরে চলে যেত দেহব্যবসা করতে।…
আবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, অরুন্ধতীর মেয়েদের কেন যোগ্যতা অনুসারে উপার্জনের ব্যবস্থা করা হয়নি? কেন সরকারি উদ্যোগে লেখাপড়া শেখানো হয়নি শকুন্তলার আবাসিকদের?
পিএল ক্যাম্পের কর্মীজীবনের বর্ণনা আমরা পাই আভা সিংহের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘প্রসঙ্গ পিএল ক্যাম্প’-এ। আভাও স্কুলে পড়ানোর চাকরি ছেড়ে ত্রাণ-পুনর্বাসন বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। হয়তো, স্কুলের সামান্য মাইনের তুলনায় এই চাকরি ছিল লোভনীয়, সম্ভাবনাময়। কৃষ্ণনগরের কাছে অবস্থিত চামতা ক্যাম্পের বর্ণনা পাই এই উপন্যাসে। সেই শিবিরে ছিল ১৫০০ উদ্বাস্তু মেয়ে আর জনা ৩৫ সরকারি কর্মী। এই ৩৫ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন পুরুষ– এক ডাক্তার, এক কেরানি, এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। বাকিরা প্রত্যেকেই মহিলা; ক্যাম্পের আবাসিক কর্মী। তাঁদের কারও দায়িত্ব পড়ানো, কেউ কেউ ক্যাম্পের পরিচালনা, ডোল দেওয়া ইত্যাদিতে যুক্ত। এঁরাও প্রায় সবাই পূর্ব বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু। এই উপন্যাসে আমরা পড়ি শিবিরের ‘ছিন্নমূল মেয়েরা হন্যে হয়ে খুঁজছে একটা রোজগারের পথ। হাতের কাছে যা আসছে আঁকড়ে ধরতে ব্যস্ত।’ কেউ সেলাই করে, কেউ বিড়ি বাঁধে, কেউ আবার যৌনব্যবসায় যায়। ক্যাম্পের কর্মীরা এসব অনেকটাই দেখেও দেখেন না; তাঁরাও জানেন সরকারি অনুদান কতটা অপ্রতুল। সরকার যাঁদের বোঝা হিসেবে দেখে চরম পিতৃতান্ত্রিক চেতনার প্রমাণ দিয়েছিল, তাঁরাই কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল উপার্জনক্ষম হওয়ার। আর তাঁদের এই প্রয়াস সরকার দেখেও দেখেননি।
সরকারের এই সংকীর্ণতা, দ্বিচারিতা কি চোখে পড়েনি সমাজের প্রগতিশীল ‘লেডি সোশাল ওয়ার্কারদের’, যাঁরা সমাজসেবাকে চাকরি হিসাবে নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক কর্তব্য হিসাবে দেখেছিলেন? উদিতি সেনের একটি প্রবন্ধে হয়তো খানিকটা উত্তর পাই আমরা এই প্রশ্নের। তাঁরা নিজেরা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। পারিবারিক সাহায্য ও সরকারি সাহায্য ছাড়া তাঁদের সমাজসেবা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই তাঁরা সহযোগিতার পথ নিয়েছিলেন, রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সদিচ্ছার উপর তাঁদের ভরসা ছিল; রাষ্ট্র চালনার দায়-দায়িত্ব ছিল যাঁদের হাতে তাঁরা ব্যক্তিগত স্তরে এই সম্ভ্রান্ত সমাজসেবীদের কাছের মানুষ ছিলেন। হয়তো এই সান্নিধ্য ও সীমাবদ্ধতাই সিনেমায় রমা সেন বা মিসেস পাকড়াশির মতো চরিত্রকে বুঝতে সাহায্য করে। তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে তাঁরা বহু দুঃস্থ, বিপর্যস্ত মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর ত্রাণ-পুনর্বাসন দপ্তরের মহিলা উদ্বাস্তুদের জন্য উদ্যোগ আজকে দাঁড়িয়ে আপত্তিজনক মনে হলেও, সে যুগে যে তার ফলে বহু মেয়ের কর্মসংস্থান হয়েছিল তা মানতেই হয়। তাছাড়া, বোঝা হিসাবে সরকার যে মেয়েদের দেখেছিলেন, তাঁরাও বিড়ি বেঁধে, সেলাই করে, ঠোঙা বানিয়ে বা যৌনকর্মী হিসাবে পিএল ক্যাম্পের লক্ষণরেখাকে অস্বীকার করেছিলেন বারবার।
গ্রন্থসূচি
১) নীলা দত্ত, ছিন্নমূলের ডায়েরি, কলকাতা,২০১৬।
২) আভা সিংহ, প্রসঙ্গ: পিএল ক্যাম্প, কলকাতা, ২০০২।
৩) উদিতি সেন, ‘Social Work, Refugees and National Belonging: Evaluating the ‘Lady Social Workers’ of West Bengal’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 44:2, 2021.
… পড়ুন চৌকাঠ পেরিয়ে কলামের অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৭: মেয়েদের স্কুলের চাকরি প্রতিযোগিতা বেড়েছিল উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর
পর্ব ৬: স্বাধীনতার পর মহিলা পুলিশকে কেরানি হিসাবেই দেখা হত, সেই পরিস্থিতি কি আজ বদলেছে?
পর্ব ৫: প্রেম-বিবাহের গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের লেডি ডাক্তাররা স্বাধীনতার নিজস্ব ছন্দ পেয়েছিলেন
পর্ব ৪ : নার্সের ছদ্মবেশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যৌন হেনস্তার কবলে পড়তে হয়েছিল
পর্ব ৩ : উদ্বাস্তু মেয়েদের রোজগারের সুযোগ মিলেছিল টাইপ-শর্টহ্যান্ডের কাজে
পর্ব ২ : পিতৃতন্ত্রের কাঠামোয় কিছু ফাটল নিশ্চয়ই ধরিয়েছিলেন সে যুগের মহিলা টেলিফোন অপারেটররা
পর্ব ১ : দেশভাগের পর ‘চঞ্চল চক্ষুময়’ অফিসে চাকুরিরত মেয়েরা কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
ঠাকুর বলছেন, মানুষকে প্রথমে বুঝতে হবে যে সংসার অত্যন্ত গোলমেলে জায়গা। সংসার হল বিদেশ। সেখানে বিদেশির বেশে ভ্রমে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যেন অকারণেই। স্বদেশ হচ্ছে আমার চৈতন্য। আমার আত্মা। সেখানেই আমি স্থিত হতে পারলে আমার শান্তি। তবেই মুক্তি।