টি. এস. এলিয়ট চোখ বুজলেন। ভাবতে চেষ্টা করলেন, লন্ডন ব্রিজ! এবং আঁতকে উঠে লেখার টেবিলটাকে ধরে ফেললেন তিনি। এই সেই টেবিল যা দিয়েছে একেবারে অভাবনীয় কবিতার স্রোত! এই টেবিলের ওপর কাগজ রাখামাত্র তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়েছে এই লাইন: ‘হোয়াট ইউ রিয়েলি আর! হোয়াট ইউ রিয়েলি ফিল!’ তার মানে কী, তুমি সত্যি সত্যি তাই, যা তুমি অনুভব করো। অর্থাৎ, তোমার উপলব্ধি আর তুমি– এক! তোমার উপলব্ধিই তোমার আত্মপরিচয়! সত্যিই কি তাই? এলিয়ট কি নিজেও জানেন? কিন্তু এই টেবিলের ওপর কাগজ রাখতেই তাঁর পার্কার ডুয়োফোল্ড থেকে ঝরে পড়েছিল দু’টি বাক্য, গায়ে গায়ে!
২.
দ্বাদশ শতাব্দী। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের জন্য আরও ৩০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে বাঙালিকে। ইতিমধ্যে বীরভূমের কেন্দুবিল্ব গ্রামে, যে-গ্রামের ডাকনাম কেঁদুলি, দেখা দিয়েছেন এক বাঙালি কবি, জয়দেব গোস্বামী। জয়দেবের কবিখ্যাতি ক্রমশ শীর্ষারোহী। তিনি এখন রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভার অন্যতম কবি। এবং তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যরচনায় নিমগ্ন। প্রতি প্রভাতের মতো আজও তিনি লিখতে বসেছেন। তবে তাঁর কোনও লেখার কাগজ, লেখার টেবিল-চেয়ার নেই। তিনি লিখছেন ভূর্জপত্রে, অর্থাৎ ভোজগাছের পাতায়। তিনি বসেছেন একটি পিঁড়ির ওপর, কাঠের উপর বিচিত্র খোদাই-কাজ করা বাহারি পিঁড়ি। এবং যেটির ওপর ভূর্জপত্র রেখে জয়দেব লিখছেন সেটি এক চন্দনচর্চিত কাঠের সুরম্য রতনচৌকি।
এই মুহূর্তে জয়দেব এক আশ্চর্য দোলাচলে। এহেন সংশয়-আচ্ছন্ন দোলাচল তাঁর সৃজনকর্ম আগেও বিঘ্নিত করেনি, তা নয়। এবং প্রতিবারই, জয়দেবের বিশ্বাস, তাঁকে সংশয় থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে লেখার ওই রতনচৌকি। তিনি কাঠের পিঁড়ির ওপর উপবিষ্ট হয়ে চন্দনচর্চিত রতনচৌকিটির উপর হাত রেখে চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়েছেন। এবং ধ্যানে মগ্ন থাকতে-থাকতে অনুভব করেছেন, তাঁর মধ্য থেকে বেরিয়ে এল অন্য এক জয়দেব গোস্বামী! এই জয়দেবকে তিনি চেনেন না। সেই জয়দেব রতনচৌকির সামনে তাঁরই পিঁড়িতে বসে ভূর্জপত্রে লিখলেন এমন একটি পঙক্তি, এমন এক ভাষায় প্রকাশ করল তাঁরই গহন মনের ভাব, যা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়! তিনি প্রথমে বিস্মিত হয়েছেন। তারপর সম্মোহে পড়েছেন ওই আকস্মিক অবিশ্বাস্য পঙক্তি ও ভাবের। এবং ক্রমশ এই মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছেন যে, তাঁর ওই সাধ্যাতীত পঙক্তিটি তাঁরই লেখা!
এবার কিন্তু জয়দেব কোনও সাড়া পাচ্ছেন না তাঁর ভূর্জপত্রে লেখার ওই কাঠের চৌকির কাছে। চৌকি নিষ্পন্দ, নিঃসাড়, উদাসীন! ঠিক কোথায় আটকেছেন জয়দেব গোস্বামী? তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’র ঠিক কোথায় দেখা দিয়েছে সংকট? কোন প্রশ্নের তিনি উত্তর পাচ্ছেন না তাঁর লেখার চৌকির কাছে? প্রশ্নটি হল, শ্রীরাধিকার মান ভাঙাতে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ কি শেষ পর্যন্ত বলবেন, রাধে, গাছের নবীন পাতার মতো তোমার সুন্দর নরম পা আমার মাথায় রাখো! সম্ভব? তাঁর হাত কাঁপছে ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে এই ভাবটি প্রকাশ করতে! জয়দেব প্রার্থী তাঁর সৃজনকর্মের ওই রতনচৌকির কাছে। কিন্তু চৌকি নিঃসাড়, উদাসীন! সেই অন্য জয়দেব কিছুতেই বেরিয়ে আসছেন না তাঁর ভিতর থেকে! জয়দেব গোস্বামী অসহায়, নিরুপায়! তিনি ডাকলেন তাঁর গিন্নি পদ্মাদেবীকে। বললেন, আমার ‘গীতগোবিন্দ’ এক ভয়ংকর জায়গায় আটকে গেছে। অনেক ধ্যান করলাম। কিন্তু চৌকিটার কিছুতেই ঘুম ভাঙছে না। আমি গঙ্গাস্নান থেকে ফিরে এসে আবার ধ্যানে বসব। এই কথা স্ত্রী পদ্মাদেবীকে বলেই গঙ্গাস্নান করতে বেরিয়ে পড়লেন জয়দেব। তাঁর কুটিরের কাছেই গঙ্গা। প্রত্যহ গঙ্গাস্নান করেন জয়দেব গোস্বামী।
– এ কী! এত তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফিরে এলে! পদ্মাদেবী অবাক হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন।
– আরে পদ্মা! কী আর বলব! গঙ্গায় পৌঁছতে না পৌঁছতে মনের মধ্যে ভেসে উঠল, যে-পঙক্তিটি যে-ভাষায় আমি লিখতে চাইছি কিন্তু কিছুতেই বাসনা আর ভাষা এক করতে পারছিলাম না! যদি আবার ভুলে যাই, তাই তাড়াতাড়ি লিখে ফেলতে ছুটে এলাম।
জয়দেব এই কথা বলেই তাঁর পিঁড়িতে বসে চৌকির উপর অপেক্ষমাণ ভূর্জপত্রের গায়ে লিখে রাখলেন পঙক্তিটি। তারপর গিন্নিকে বললেন, আর ভুলে যাওয়ার ভয় নেই। এবার নিশ্চিন্তে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসছি। একথা বলেই জয়দেব গোস্বামীর প্রস্থান।
বেশ কিছুক্ষণ পরে জয়দেব ফিরলেন গঙ্গাস্নান করে। এবার কি তাঁর লেখার চৌকি সাড়া দেবে তাঁর প্রার্থনায়? তিনি বসলেন তাঁর কাঠের পিঁড়ির ওপর। চৌকির উপর রাখা ভূর্জপত্রগুচ্ছ। তিনি সেদিকে তাকিয়ে বিস্মিত! ভূর্জপত্রের গায়ে তাঁরই হস্তাক্ষরে লেখা, ‘দেহি পদপল্লব মুদারম।’ সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল জয়দেবের। কে লিখেছে এই আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য, অবিকল্প পঙক্তিটি, এই অবিস্মরণীয় ভাষায়! কে এই অন্য জয়দেব! লেখার রতনচৌকির গায়ে হাত রেখে সকৃতজ্ঞ অশ্রুস্নাত ধ্যানে ডুবলেন জয়দেব গোস্বামী।
***
চারিদিকে এত মৃত্যু কেন? মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না টি. এস. এলিয়টের। মৃত্যু গ্রাস করেছে তাঁর সমস্ত মন। মৃত্যুর অন্ধকার মেঘছায়ার মতো ঘনিয়ে উঠছে তাঁর ভাবনার আকাশে। তিনি বসেছেন তাঁর লেখার চেয়ারে। লেখার টেবিলে কয়েকগুচ্ছ সাদা কাগজ। তাঁর কালো পার্কার ডুয়োফোল্ড অপেক্ষা করছে কখন তিনি লিখবেন তাঁর বসন্তের কাব্য! একশো বছর আগের এখন বসন্তকাল!
টি. এস. এলিয়ট চোখ বুজলেন। ভাবতে চেষ্টা করলেন, লন্ডন ব্রিজ! এবং আঁতকে উঠে লেখার টেবিলটাকে ধরে ফেললেন তিনি। এই সেই টেবিল যা দিয়েছে একেবারে অভাবনীয় কবিতার স্রোত! এই টেবিলের ওপর কাগজ রাখামাত্র তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়েছে এই লাইন: ‘হোয়াট ইউ রিয়েলি আর! হোয়াট ইউ রিয়েলি ফিল!’ তার মানে কী, তুমি সত্যি সত্যি তাই, যা তুমি অনুভব করো। অর্থাৎ, তোমার উপলব্ধি আর তুমি– এক! তোমার উপলব্ধিই তোমার আত্মপরিচয়! সত্যিই কি তাই? এলিয়ট কি নিজেও জানেন? কিন্তু এই টেবিলের ওপর কাগজ রাখতেই তাঁর পার্কার ডুয়োফোল্ড থেকে ঝরে পড়েছিল এই দু’টি বাক্য, গায়ে গায়ে! আরও একদিন তিনিই লিখেছেন এই লেখার টেবিলে, “টোয়েন্টি ইয়ার্স লারজলি ওয়েস্টেড ট্রায়িং টু লার্ন টু’ ইউজ্ ওয়াডর্স!”
বিশটা বছর নষ্ট হয়েছে জীবনে শব্দের ব্যবহার শিখতে। কোনওদিন ভাবতে পেরেছিলেন তিনি নিজে, এমন একটি খাঁটি সত্যি কথা, এমন এক বেদনাবহ্নিত স্বীকারোক্তি, তিনি লিখতে পারবেন এমন খোদাইকরা সহজতায়? শব্দের যথার্থ ব্যবহার, সঠিক প্রয়োগ, কি কখনও শেখা যায়? এলিয়ট তাঁর লেখার টেবিলটার ওপর রাখেন তাঁর কম্পমান হাত। কিছুতেই তিনি সামলাতে পারছেন না নিজেকে। তিনি ভাবেন গীতার অর্জুনকে। বিশ্বরূপ দেখার পর অর্জুনের যে অবস্থা, আজ তাঁর লেখার টেবিলের সামনে বসেও, সেই একই অবস্থা।
কী দেখে ছিলেন অর্জুন? দেখেছিলেন জীবিতরাও মৃত! এলিয়টও তো তাই দেখলেন, তাঁর লেখার টেবিলটার সামনে বসে যেই বুঝলেন চোখ, ভাবলেন লন্ডন ব্রিজ।
বসন্তের সকালবেলা লন্ডন ব্রিজ। টেবিলের ওপরে রাখা সাদা কাগজের গায়ে এলিয়টকে লিখতে বাধ্য করল তাঁর লেখার টেবিল, মেহগনি কাঠের ভিক্টোরিয়ান লেখার টেবিল– যার কালো পালিশ করা বুকের ওপর বিছিয়ে আছে সাদা কাগজের তাড়া। এলিয়ট লিখলেন এমন একটি লাইন যার মৃত্যু হবে না কোনওদিন, অথচ যে ধারণ করছে অমোঘ মৃত্যুর বার্তা: ‘আই হ্যাড নট থট ডেথ হ্যাড আনডান সো মেনি’।
পংক্তিটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন এলিয়ট। যারা হেঁটে চলেছে লন্ডন ব্রিজ দিয়ে, মানুষের দল, নানা কাজে চলেছে তারা, প্রতিটি মানুষ চলেছে তার নিজের নিজের জীবনের গল্প নিয়ে, তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ বেদনা বুকের মধ্যে আঁকড়ে– এই সব জীবন্ত মানুষের দিকে তাকিয়ে এলিয়ট লিখলেন, আমি জানতাম না, এতগুলি মানুষকে খতম করেছে মৃত্যু– চুরমার করেছে তাদের সব স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ। তারা বেঁচে আছে শুধুমাত্র নির্ধারিত মৃত্যুর জন্য! কী করে লিখলেন তিনি এই চরম সত্য এমন সহজ ভাষায়! টেবিলটার দিকে তাকান এলিয়ট। টেবিলের গায়ে যেন ফুটে ওঠে একটি চেনা মানুষের মুখ! কী আশ্চর্য!
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………
ওই মৃত মানুষের দলে এই চেনা মানুষটাও আছে! সে-ও চলেছে ওদের সঙ্গে। এলিয়টের আবার মনে পড়ে বিশ্বরূপ দর্শনের পর বিহ্বল অর্জুনকে। এবং সেইসঙ্গে এলিয়টের মনে জাগে এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা কিছুতেই লিখতে চান না তিনি। কিন্তু তাঁর মুক্তি নেই ওই টেবিলটার সম্মোহ ও নির্দেশ থেকে। তিনি কলম ধরেন কাগজের গায়ে। কাগজের গায়ে ঝরে পড়ে এই হাড়হিম-করা প্রশ্ন: গত বছর যে শবটিকে তুমি তোমার বাগানে পুঁতে ছিলে, তাতে কি অঙ্কুর ধরেছে? সেই শবের গাছ কি এবার মৃতদেহে ভর্তি হয়ে উঠবে– বসন্তকালে যেমন সব গাছে ফুটবে ফুল, শবের গাছেও শব ঝুলবে তো ডালে ডালে? ‘দ্যাট কর্পস্ ইউ প্লান্টেড লাস্ট ইয়ার ইন ইওর গার্ডেন, হ্যাজ ইট বিগান টু স্প্রাউট? উইল ইট ব্লুম দিস ইয়ার?’
টি. এস. এলিয়টের বিস্ময়ের অবধি নেই। এবং তাঁর বিস্ময়ের তলায় ত্রাসের চোরাস্রোত। লেখার টেবিলটাকে ভয় পান এলিয়ট। তিনি পালাতে চান। কোথায় পালাবেন? টেবিলটাও তো তাঁর সঙ্গে যাবে। নাছোড় তাঁর লেখার টেবিল!
………. কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ………..
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল