ফ্রিদার আঁকা সব ছবিই তাঁর আত্মজীবনীর এক একটা রক্তাক্ত বিদীর্ণ পাতা। কিন্তু নিজের শরীর তো বস্তুগত, তাঁরই নিজের। তাহলে কি তাঁর শরীরের আদত ভঙ্গুরতা ও আক্রম্যতা ফ্রিদা চাননি সকলে জানতে পারুক? ফ্রিদা সেই যে বলেছিলেন না, সান ফ্রান্সিসকোয় যখন রোজই ইন্ডিয়ান পোশাকে বেরতে শুরু করলেন, ওঁকে দেখে আমেরিকার লোকে স্তম্ভিত হয়ে যেত? বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত? সেই উদযাপনই কি ফ্রিদার নিজের সুরক্ষা ও শুশ্রূষা ছিল? ফ্রিদা কি নিজের শরীরকে অরক্ষিতভাবে দেখাতে চাননি?
বাঙালের ভাগ্যে ছিল কালাপানি পারাপার।
২০১৮-এ এক সেমেস্টার লন্ডনে থাকব। খোদা সত্যি কখনও কখনও ছপ্পর ফেঁড়ে দেন। জানা গেল, ফ্রিদার ব্যবহৃত সামগ্রী ও ফোটোগ্রাফ নিয়ে মেহিকোর বাইরে এই প্রথম প্রদর্শনী, ‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট’ মিউজিয়ামে, আমি ওখানে থাকাকালীন। ফ্রিদার ব্যবহৃত সামগ্রী দেখতে পাব জেনে শিহরণ লাগলেও যখন গ্যালারিতে বানানো নিভন্ত আলট্রামারিন ছায়াচ্ছন্ন চার দেওয়ালের মধ্যে ঢুকে দেখি মাঝখানে স্বয়ংপ্রভ দ্বীপ, পরপর ম্যানেকিন ফ্রিদার অত্যুজ্জ্বল তাহুয়ানা ব্লাউজ-স্কার্টগুলি পরে দাঁড়িয়ে আছে, ফ্রিদাবিহীন ফ্রিদার উপস্থিতির সেই অনুভূতি ভাষার অগোচর। ফ্রিদার পোশাকগুলি ঘিরে তিনবার পাক খেয়ে ঘোর একটু সামলে নিলে মনে পড়ে গিয়েছিল ১৯৪৩-এ ‘দিয়েগো ইন মাই মাইন্ড’ ছবিটি। এই ছবিটিকে ঘিরে ফ্রিদার তাহুয়ানা পোশাক পরা নিয়ে বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। বলা হয় যে, তিনি আমেরিকার আদি জনগোষ্ঠীর পোশাককে আত্তীকৃত করে নিজেকে এগজোটিক বানিয়েছেন। সমালোচকরা দু’টি জিনিস খেয়াল করতে ভুলে যান। এক, যে জনগোষ্ঠীর পোশাক এটি, ফ্রিদার মায়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন সেই জাপোটেক ধারার। সেই গোষ্ঠী ছিল মাতৃতান্ত্রিক। ফ্রিদার ধাইমাও ছিলেন জাপোটেক। কাজেই এটা ঠিক শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশকারীদের আদি গোষ্ঠীর অধিকার মুছে তাদের সংস্কৃতি ব্যবহার করা নয়। দ্বিতীয়ত, সেই সময় মেহিকোর জাতীয় পরিচয় নির্মাণে আদি ইন্ডিয়ান ধর্ম, দর্শন, আচার ও ব্যবহারিক নানা অনুপান পুনরুদ্ধার করার যে ‘মেহিকায়োটল’ বা ‘মেহিকানিদাদ’ আন্দোলন, ফ্রিদা ছিলেন তার শরিক। বরং পুরো আন্দোলনের যে সামগ্রিক অ্যাজটেক-কেন্দ্রিকতা, ফ্রিদা তাতে নতুন স্তর যোগ করেছিলেন জাপোটেক উপাদান নিয়ে এসে। বলা চলে, পুরুষপ্রধান আন্দোলনে পিতৃতান্ত্রিক অ্যাজটেক চিহ্নগুলির মধ্যে ফ্রিদার উচ্চকিত গ্রীবা, জাপোটেক উপস্থিতি সেই গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ও স্বাধীন নারীদের মনে করায়।
এর পরের অংশে গিয়েই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। পোশাকগুলির তন্তুর বুনন, রং, ঘেরের স্তরীভূত গতিময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে ভুলতে বসেছিলাম ফ্রিদা ঠিক যা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক অক্ষমতা। তিনি নিজে ভুলতে চেয়েছিলেন শারীরিক যন্ত্রণা, যা তিনি প্রতি দিনে-রাতে, প্রতি মুহূর্তে সহ্য করতেন। এর পরের অংশে পরপর রাখা ছিল ফ্রিদার ব্যবহার করা করসেট। পোশাকগুলির সৌন্দর্যে আর সৌকর্যে ভুলেই গিয়েছিলাম এই করসেটগুলির কথা। কোমর, শিরদাঁড়া আর ঘাড় সোজা রাখার জন্য শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ফ্রিদাকে সারাক্ষণ এই করসেট পরে থাকতে হত। সেগুলি পরা অবস্থায় শুয়ে শুয়েই ফ্রিদা তাতে তুলি দিয়ে আঁকতেন। কাস্তে-হাতুড়ি থেকে শয়তান, কমিউনিস্ট উচ্চারণ আর ভ্রূণ– সবই করসেটে এঁকে নিতেন। করসেট তাঁর বর্ম। এমন বর্ম, যা শরীরে কেটে বসে। এরপর ছিল তাঁর ব্যবহার করা প্রস্থেটিক পা, হাই বুট-সহ। আগেই বলেছি, পোলিওর জন্য ফ্রিদার একটা পা একটু খাটো ও অপুষ্ট ছিল। সেই পায়ে একটা হাড় ঠিক করার সময় সার্জারিতে গোলমাল হওয়ায় গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। পা’টি বাদ যায়। ফ্রিদাকে পরবর্তী জীবৎকাল প্রস্থেটিক পা পরে থাকতে হয়। গা শিরশির করতে থাকে সেই পা’টির দিকে তাকিয়ে। ফ্রিদা সেই নকল পায়ের টকটকে লাল লেদার হাই বুটটি নিজে ডিজাইন করেছিলেন। জুতোয় চিনের ড্রাগন আর ঘণ্টা এঁকে নিয়েছিলেন। এক তীব্র বিকলন বোধে মনে হতে থাকে, ফ্রিদা নামে পৃথিবীময় ছড়ানো এক ঝলমলে আইকনের গুপ্ত কঙ্কালরূপ আমরা দেখে ফেলছি। যে কঙ্কালকে আবার ফ্রিদা নিজের হাতে শিল্পবস্তুতে পরিণত করেছেন। পরে মনে হয়, যে আদি ক্যাকটাসের ওপর বসে টোটেম পাখি ঈগল সাপ খাচ্ছিল দেখে অ্যাজটেকদের ঈশ্বর তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন মেহিকো নগরী পত্তনের, সেই প্রত্নকাহিনির ক্যাকটাসটিকে যেন ফ্রিদা তাঁর শৃঙ্গারময় আলিঙ্গনে ধরে আছেন।
না, এইসব রূপকল্প দিয়ে ‘ফ্রিদা মানে শুধু গ্ল্যামার নয়’– এই বলে বাজারের উল্টো মেরুতে নিয়ে যেতে চাইছি না যেখানে অসুস্থতা, সার্জারি আর যন্ত্রণার নাম ফ্রিদা। কিন্তু ফ্রিদা নামে এক বিপণনের রাজনীতির বাইরে একজন শিল্পী হিসেবে ও মানুষ হিসেবে তাঁর ব্যতিক্রমী চরিত্র বোঝার জন্য এইগুলি আমাদের জানা দরকার। ফ্রিদা মানে প্রবাদতুল্য সহনক্ষমতা। যা নিয়ে মোটেই কথা হয় না, তা হল শুধু নারীবাদী বা ক্যুইয়ার আইকন হিসেবে না, ফ্রিদা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্যেও বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারেন। এই পর্যন্ত লিখে আমি এই কথাটা আবার ভাবলাম। কে জানে, ফ্রিদাকে বিশেষভাবে সক্ষম বললে তিনি কীভাবে নিতেন। যে শারীরিক অক্ষমতা ও যন্ত্রণা তাঁকে প্রতি মুহূর্তে পর্যুদস্ত করছিল, তিনি প্রায় অমানুষিক মনোবলে তাকে হারাতে চেয়েছিলেন। এত নিবিষ্টভাবে রঙের সঙ্গে রং, তন্তুর সঙ্গে তন্তু, নকশার সঙ্গে নকশা মিলিয়ে, গুয়াতেমালার ব্লাউজে নানা ফিতে, বোতাম বসিয়ে, পোশাকের সঙ্গে মিশ খাইয়ে নখে রং লাগিয়ে, চুলে ফুল বা রিবন বা ক্লিপ দিয়ে তিনি সারাক্ষণ এক পীড়িত শরীরকে পীড়ার আবহ থেকে বের করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই শরীরকে তিনি যন্ত্রণা-অতিক্রমী এক উৎসবে পরিণত করেছিলেন।
প্রদর্শনীর ৩৫০টির বেশি জিনিসের মধ্যে মাত্র ১১টি পেইন্টিং ছিল। বাকি সবই ব্যবহারের বস্তু। সেই বস্তুগুলির ইতিহাস থেকেই ফ্রিদাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ছিল আমার। জানতে পারি, এই সবকিছু ২০০৪ অবধি ‘লা কাসা আজুল’-এ ফ্রিদার চানঘরে বন্ধ ছিল। দিয়েগো রিভেরা উইলে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, ফ্রিদার মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যে যেন এইসব লোকচক্ষুর সামনে বের করা না হয়। ২০০৪-এরও ১৪ বছর পরে ২০১৮ সালে মেহিকোর বাইরে ইউরোপ-আমেরিকায় বেরলো ফ্রিদার নিজের জিনিসপত্র। গ্যালারি হলে দাঁড়িয়ে বুকলেট থেকে জেনে প্রথমেই মনে হয়েছিল– বাপ রে, কী পেট্রিয়ার্ক এই দিয়েগো। কিন্তু আজ আরও ছয় বছর পরে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, অবশ্যই ফ্রিদার আঁকা সব ছবিই তাঁর আত্মজীবনীর এক একটা রক্তাক্ত বিদীর্ণ পাতা। কিন্তু নিজের শরীর তো বস্তুগত, তাঁরই নিজের। তাহলে কি তাঁর শরীরের আদত ভঙ্গুরতা ও আক্রম্যতা ফ্রিদা চাননি সকলে জানতে পারুক? ফ্রিদা সেই যে বলেছিলেন না, তিনি সান ফ্রান্সিসকোয় যখন রোজই ইন্ডিয়ান পোশাক পরে বেরতে শুরু করলেন, ওঁকে দেখে আমেরিকার লোকে স্তম্ভিত হয়ে যেত? বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত? সেই উদযাপনই কি ফ্রিদার নিজের সুরক্ষা ও শুশ্রূষা ছিল? ফ্রিদা কি নিজের শরীরকে অরক্ষিতভাবে দেখাতে চাননি? না কি ফ্রিদা নিজে না, আসলে দিয়েগোই চাননি গর্বিত ফ্রিদার শারীরিক অক্ষমতা হাটেবাজারে এসে যাক অনতিবিলম্বে? তাই চুলের কাঁটা থেকে পারফিউমের বোতল, সানগ্লাস থেকে হাতের পাখা– সবই তালাচাবি দেওয়া রইল? তা সে যতই বন্ধ থাক না কেন, আর যে কারণেই বন্ধ থাক না কেন, আজ ফ্রিদা নিজে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে কতশত মানুষের ব্যক্তিগত বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন, প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন প্রতিদিন। ফ্রিদার সম্পূর্ণ মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেওয়া যাবে না।
একটা বিষয় খেয়াল না করে পারা যায় না, যন্ত্রণা থেকে, সেইসব ব্যবহৃত সামগ্রী থেকে যে রমণী উঠে আসেন, তিনি প্রতিদিনের বেঁচে থাকাকে, খাওয়ার পাত্র থেকে দেওয়ালে ঝোলানো সেরামিক প্লেট থেকে কাঠের তাকে পাতা দড়ি থেকে নিজেকে এক এরোটিক সূত্রে রাখেন। আমাদের এটাই লক্ষ করার যে, কীভাবে সেটা বহু ইন্দ্রিয়জ সংবেদনে, রঙে, ঘ্রাণে, স্পর্শে সজ্জিত। সেই এরোস ফলের মতো সুস্বাদ, সুঘ্রাণ ও কাঁটা লতার মতো নির্লজ্জ। সেই শৃঙ্গারের উৎসবের জন্য ফ্রিদা বারবার নানা জনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। প্রেম ও কামের নানা রকমের উদ্দীপন তাঁর প্রয়োজন হয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়ের দিকে তিনি সংরাগের সন্ধানে এগিয়ে গিয়েছেন বারবার। যদিও দিয়েগো ছিলেন তাঁর সমস্ত আবেগের নোঙর, যেন ফ্রিদার হৃৎস্পন্দন। কিন্তু দিয়েগো যেমন অপ্রতিরোধ্য, ফ্রিদাও ছিলেন নিজের মধ্যে পাক খাওয়া টর্নেডো। কিছু কিছু সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ফ্রিদার নিজের অন্যতর যাত্রাই শুধু হয় না, জীবন নানাবিধ নাটকীয় বাঁকও নেয়।
প্রেমের কথা প্রসঙ্গে বলতেই হবে নিকোলাস ম্যুরে-র কথা। ফোটোগ্রাফার। দিয়েগোর কক্ষপথ থেকে ফ্রিদাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য, দীর্ঘ সময়ের প্রেমিক হওয়ার জন্য যে ধরনের প্রথাবিহীন প্রতিভা ও বুদ্ধিদীপ্ত হতে হত, নিকোলাস নিক ঠিক তাই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে প্রেমের জেরে ফ্রিদা দিয়েগোকে ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি ঠিকই, কিন্তু লা কাসা আজুল ও অন্যান্য প্রেক্ষাপটে তোলা ফ্রিদার ছবির মধ্যে ধরা থাকে নিকোলাস নামে এক আকুল প্রেমিকের দৃষ্টি। লেন্সের ভিতর দিয়ে পাঠানো দৃষ্টিই এক্ষেত্রে প্রেমিকের উপাচার। শুধু প্রেমিকই নয়, মেহিকোর টালমাটাল সময়ে নিকোলাস ছিলেন ফ্রিদার বিশ্বস্ত বন্ধুও। ফ্রিদার ফোটোগ্রাফের সবচেয়ে বড় আর্কাইভ নিকোলাসের চোখে দেখে, তাঁর ক্যামেরাতেই তৈরি। সেই আর্কাইভকে বলা চলে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ব্যেপে লেন্সে সৃষ্ট প্রেমপত্র।
হাঙ্গেরি ছেড়ে জার্মানি। তারপর ইহুদিবিদ্বেষ থেকে পালাতে আমেরিকা পাড়ি। মিকলোস মুরাই থেকে নিকলাস ম্যুরে থেকে নিক। যিনি আমেরিকায় স্টুডিওর ইলেকট্রিক বিল মেটাতে পারতেন না, তাঁকে দিয়ে পোর্ট্রেট তোলান প্রথিতযশারা– জেমস জয়েস, মেরিলিন মনরো, ক্লদ মনে ও আরও অনেকে। মেহিকোয় বেড়াতে গিয়ে ফ্রিদার সঙ্গে নিকোলাসের আলাপ– চান্স এনকাউন্টারই বলা চলে। ততদিনে নিকোলাসের নাম হয়ে গেছে প্লেবয় হিসেবে, যিনি শিল্প-সাহিত্য-ফ্যাশন জগতের সেলেব্রিটিদের ফোটোগ্রাফার, আবার অলিম্পিক স্তরের ফেন্সিং খেলোয়াড়ও। এহেন ব্যক্তি যদি ঘন রোম্যান্টিক হন আর ফ্রিদার তাঁর প্রতি দুর্মর প্রেম জন্মায়, ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। নিকোলাস না ঘটলে তো আমরা ফ্রিদার এত অবিস্মরণীয় ছবিগুলোই পেতাম না! একা ফ্রিদা। দিয়েগো আর ফ্রিদা। ফ্রিদা ও তাঁর অন্তরঙ্গরা। মেহিকো থেকে নিউ ইয়র্ক ফেরার সময় ফ্রিদা নিককে একটা চিঠি দেন। লেখা থাকে, ‘দেবদূত এলে তাকে যেমন ভালোবাসতাম, আমি সেরকম ভাবেই তোমার প্রেমে পড়েছি। তুমি এই প্রেমের উপত্যকায় এক ফুটন্ত লিলি। আমি তোমাকে কোনও দিন ভুলব না। কোনও দিন না। কোনও দিন না। তুমিই আমার জীবন। তুমিও আমাকে ভুলে যেও না।’ চিঠির নিচে লেখা থাকে, ‘তুমি কথা দিয়েছ মেহিকো আসবে।’ সঙ্গে থাকে লাল লিপস্টিকে ঠোঁটের ছাপ। ‘তোমার ঘাড়ের পিছন দিকের জন্য।’ এর পরে শুরু হবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে চিঠিতে প্রেম বিনিময়। ফ্রিদা আমেরিকা এলে ওঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিগুলি তুলবেন নিক, যা দেখে আমরা ফ্রিদাকে জানব।
ফ্রিদা আর দিয়েগোর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে নিশ্চয়ই নিকোলাস ভেবেছিলেন তিনি ফ্রিদার সঙ্গে জীবন শুরু করতে পারবেন। কিন্তু ফ্রিদা আর দিয়েগো পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে পারেননি। ওঁরা আবার বিয়ে করে নেন। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতিই বলা যায়। কেউই কাউকে ছেড়ে থাকতে পারছেন না, কিন্তু তাঁদের প্রেম ও কামের ঔৎসুক্য তাঁদের অন্যদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। তাতে ফ্রিদাই আবার আমূল ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন।
জানি না ফ্রিদার সঙ্গে থাকবেন ভেবেছিলেন কি না আরেক শিল্পী, হোসে বারতোলি। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় তিনি কাতালান থেকে আমেরিকা চলে যান। সেখানেই ফ্রিদার সঙ্গে তাঁর আলাপ। তখন ফ্রিদার শিরদাঁড়ায় সার্জারি হয়েছে। দু’জনে প্রেমে পড়েন। যদিও মেহিকো ফিরে আসায় এর পরে মুখোমুখি প্রেম আর এগোয়নি। কিন্তু উপহার আর প্রেম জর্জরিত চিঠি বিনিময় চলতে থাকে। শুকনো ফুল আর স্কেচ থাকে উপহারে। প্রেমপত্র ঠিক লিখতে পারেন না বলে ফ্রিদা লেখেন– ‘পাহাড়ের ওপর থেকে, সমুদ্র আর মেঘের ওপর থেকে, সবচেয়ে চিলতে হাসিতে, কখনও কখনও তীব্র হতাশায়, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের মধ্যে, তোমার তীব্র বা হালকা উড়ে যাওয়া কামনায়, তোমার ছায়ায়, রক্তে যেখান থেকেই তুমি দেখো আমাকে, আমি সেখান থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার চোখের জানলা দিয়ে তোমাকে দেখতে চাই।’
এইসব চিঠি যে আজ পুরোটাই পাওয়া যায়, তা নয়। চিত্রশিল্পী জ্যাকলিন লাম্বা-কে লেখা একটা চিঠি ফ্রিদার ডায়রিতে পাওয়া যায়। জ্যাকলিন ছিলেন পারির স্যুররিয়ালিস্ট বৃত্তে। তিনি ছিলেন আন্দ্রে ব্রেতঁ-র স্ত্রী। যখন স্ত্রী-সহ ব্রেতঁ মেহিকো আসেন, জ্যাকলিন আর ফ্রিদার মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। অন্তরঙ্গতার আরও একটা কারণ– দিয়েগো, ব্রেতঁ আর ট্রটস্কি সারাক্ষণ এত গম্ভীর তাত্ত্বিক আর রাজনৈতিক আলাপ করতেন যে, ওঁদের সঙ্গে থাকতে জ্যাকলিন আর ফ্রিদার খাপছাড়া লাগত। নিউ ইয়র্কের জুলিয়েন লেভি গ্যালারিতে ১৯৩৮-এ একক শো সেরে জ্যাকলিনের আমন্ত্রণে ফ্রিদা পারিতে যান। জ্যাকলিন আর ফ্রিদা নিশ্চয়ই সেই জমানায় তাঁদের নিভৃতচারিতা ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াতেন না। ফ্রিদার নারীর প্রতি আকর্ষণের সবটাই প্রেমে গড়াতে পারেনি। কিন্তু এই চিঠি থেকে তাঁদের সম্পর্কের পেলব স্পর্শময়তা টের পাওয়া যায়।
তুমি আমাকে ওই অতিদূর কিন্তু স্পষ্ট দিনগুলি থেকে
লিখেছ। তোমাকে জানাই যে আমি ওই দিনগুলি থেকে ফিরতে চাই না।
বা চলে যেতে চাই না ওই সময় থেকে অন্য কোনও সময়ের পারে।
আমি তোমাকে ভুলিনি। কিছুই ভুলিনি আমি। এই রাতগুলি দীর্ঘ।
আর কঠিন। এই জলরাশি। এই জাহাজ আর ওই ডক
আর এই বিদায়, যা তোমাকে ওই দিগন্তরেখায় ক্ষুদ্র থেকে
আরও ক্ষুদ্র করে দিচ্ছে। আমি পোর্টহোলে চোখ রেখে আছি।
পোর্টহোলের ফ্রেমে তুমি। আমার দিকে তাকিয়ে আছো
যেন আমাকে তোমার হৃদয়ের কুঠুরিতে রেখে দিতে চাও।
…
আজ আমি চাই আমার এই আলো রোদ তোমাকে স্পর্শ করুক
আমি বলি, শোনো, তোমার চোখের তারা আমারই চোখের তারা।
মেহিকোর ম্যাজেন্টা রিবনে বাঁধা হুইপিল গাউন তোমার। আর তোমার পারির
প্রাচীন সব পথ, আমার। …শামুকের খোল আর বউ-পুতুলও তোমার।
তুমিই বউ-পুতুল। তার বিয়ের পোশাক সে বিয়ের দিন কারো কাছে খোলে না।
আমরা যখন তাকে পথের পাশে আধা ঘুমন্ত পাই
দেখি সে সেই পোশাক পরেই আছে। …
এই চিঠিতে ফ্রিদার ১৯৩৯-এ শুরু করা ছবি ‘দ্য ব্রাইড হু বিকামস ফ্রাইটেনড হোয়েন শি সিজ লাইফ ওপেন’-এর সূত্র আছে ভাবা হয়।
ট্রটস্কিকে চিঠি লেখার দরকার হয়নি। তিনি তো কাসা আজুল-য়েই নির্বাসন ছিলেন। তাঁকে নিজের একটা ছবি দেন ফ্রিদা। সেই গল্প জানার আছে। ফ্রিদাকে তো জেলে যেতে হয়েছিল।
(ক্রমশ)
…কাহলোবেলা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১: যেন এক্ষুনি ফ্রিদা নেমে যাবেন মেহিকোর প্রাচীন চাষিদের কার্নিভালে
পর্ব ২: দিয়েগোর পাশে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে ফ্রিদা নিজেই নিজের ক্যানভাস হয়ে ওঠেন
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।