পৃথিবীকে জানলার স্পর্শে দেখতে শিখে নিয়েছিল ডলিদি। পনেরো বছরের দীর্ঘ জীবন হুইলচেয়ারেই কেটে গিয়েছিল ডলিদির। ট্রেন ছিল তার প্রিয় যান। কিন্তু, বাবা-মায়ের কোলে থাকতেই যতটুকু যাতায়াতের স্মৃতি তার। তা সে বয়ে বেড়াত জানলার ধার দিয়ে। তার মায়ের হেয়ার ড্রায়ারকে জানলার পাল্লার আংটায় ঝুলিয়ে দিতে তার ভাই, আমার বন্ধুসম ডিংলা। তারপর হু হু হাওয়া। চুল উড়ছে ডলিদির। আর সে চোখ বুজে আছে। মাঝেমধ্যে থামিয়ে দিতে বলছে। তখন তাকাচ্ছে বাইরে। ট্রেন থামল কোন স্টেশনে? না, ‘নন্দাইগাজন’। এই ছিল ট্রেন ট্রেন খেলা। কেবলমাত্র হাওয়ার স্পর্শের সৌজন্য বোজা চোখে দৃশ্যর জন্ম নিত আর আস্ত একটা ঘর হয়ে উঠত ট্রেনের কামরা।
দেখতে সুন্দর না হলেই, ফুল না দিলে, ফল না দিলে, ছোট গুচ্ছ হলেই– আগাছা? ওরাও তো বাতাস দেয়। ওরাও তো গাছ?
মেথর দাস। আমাদের পাড়ার প্রান্তে ছিল, এখনও আছে পড়ে, কিছু পোড়ো লাল বাড়ি। নীলকুঠি। নীল চাষ করানো সাহেবদের মেস গোছের বাসা ছিল কোনও এককালে। অদূরে নীলচাষিদের মাটির ঘর। পরবর্তীতে সাহেবদের চলে যাওয়ার পর চাষিরাই উঠে এসেছিল সেই বাড়িগুলোয়। এবং হয়ে তারা উঠেছিল জমিদারদের পালকিবাহক বা বেহারা গোষ্ঠী। জমিদার জমানা গত হওয়ার সঙ্গে অতঃপর সেই কুঠি হয়ে দাঁড়ায় বস্তি। সেই প্রজন্মেরই এক উত্তরপুরুষ মেথর দাস। জন্মইস্তক মেথরদাদুকে আমি বৃদ্ধ এবং একইরকম বৃদ্ধ দেখে এসেছি। বলা বাহুল্য, পূর্বজর বলিপ্রদত্ত পেশা আর নেই ততদিনে। এমনকী, মেথরদাদুকেও কোনও নির্দিষ্ট পেশা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি আমাদের সামাজিক পাড়া। তেমনই মেথরদাদুরও কোনও পেশার প্রতি ঝোঁক বা ইচ্ছে ছিল কি না, অজানা থেকে গিয়েছিল। উপর্যুপরি, পালকির যুগ বিগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, শুনেছি, তার দাদুর দৃষ্টি হয়ে এসেছিল ক্ষীণ। আর তা ছড়িয়ে গিয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মের রক্তে। মেথরদাদুও তেমনই, দেখতে পেত কম। পাড়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সে কাজ চেয়ে হয়রান হওয়ার পর একসময় থিতু হয়েছিল ঘাস-আগাছা ছেঁড়ার কাজে। অন্ধকে অন্ধ বলতে নেই, এসব তো নৈতিকতার বিষয়। কিন্তু, ‘অপ্রয়োজনীয়’ ঠাওর করা হলেও কিছু গাছকে ‘আগাছা’ বলা অশোভন, তা যখন প্রায়ান্ধ মেথরদাদু বুঝিয়ে দিল, ছোটবেলার মনে সেই অন্ধ ঠাওরানোর নীতি আর নীতির নিগড়ে থাকল না। দু’মুঠো রোজগারের তাগিদে তাকে ঘাস-গুল্ম ছিঁড়তে দেখতাম, আর দেখতাম তার চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। উচ্ছেদ করার স্পর্শ, আঘাত হয়ে ঠাম হয়ে থাকত মেথরদাদুর চোখে। সেই ভিজে চোখের তূণীর থেকে আমার শব্দ লক্ষ করে যখন গাছ সম্পর্কে এই জীবনবিজ্ঞান ভেসে এল, গাছকে সেই কি আমার প্রথম স্পর্শ নয়?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যেখানে দৃশ্য শেষ, সেখানে স্পর্শ এভাবে ত্রিমাত্রিক অনুভূতির আশ্রয় হয়ে ওঠে। কাঁধে হাত রাখলে এখনও খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন মন কি আলোর রূপরেখা পায় না? স্পর্শের ত্রিমাত্রিকে তাই শব্দ আরও জ্যান্ত হয়ে আছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনেকটা এভাবেই পৃথিবীকে জানলার স্পর্শে দেখতে শিখে নিয়েছিল ডলিদি। পনেরো বছরের দীর্ঘ জীবন হুইলচেয়ারেই কেটে গিয়েছিল ডলিদির। ট্রেন ছিল তার প্রিয় যান। কিন্তু, বাবা-মায়ের কোলে থাকতেই যতটুকু যাতায়াতের স্মৃতি তার। তা সে বয়ে বেড়াত জানলার ধার দিয়ে। তার মায়ের হেয়ার ড্রায়ারকে জানলার পাল্লার আংটায় ঝুলিয়ে দিত তার ভাই, আমার বন্ধুসম ডিংলা। তারপর হু হু হাওয়া। চুল উড়ছে ডলিদির। আর সে চোখ বুজে আছে। মাঝেমধ্যে থামিয়ে দিতে বলছে। তখন তাকাচ্ছে বাইরে। ট্রেন থামল কোন স্টেশনে? না, ‘নন্দাইগাজন’। এই ছিল ট্রেন ট্রেন খেলা। কেবলমাত্র হাওয়ার স্পর্শের সৌজন্যে বোজা চোখে দৃশ্যর জন্ম নিত আর আস্ত একটা ঘর হয়ে উঠত ট্রেনের কামরা। বাইরে পৃথিবী ঘুরছে নিজের মতো করে। একদিন এভাবেই ট্রেন ধরে চলে গেল ডলিদি, আর রাতারাতি জানলা বদলে গেল। ক্রমশ বদলে যেতে থাকল বাইরের পৃথিবীটাও। ডিংলার সঙ্গে বহু বছর পর যখন দেখা হল হঠাৎই খড়গপুর স্টেশনে, ততদিনে স্পর্শ আমাদের দৈনন্দিনতায় রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ধরা দিয়ে ফেলেছে। ভাল স্পর্শ, খারাপ স্পর্শের অভিঘাত আমরা বুঝতে শিখছি অনেকটা বড় হয়ে। কিন্তু, স্পর্শ আমাদের কাছে ততোধিক বন্ধুত্ব, ভরসার, ক্লীব আশ্রয়। ওই যে– ‘বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই/ আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা…’ এই আশ্রয়ের স্পর্শই কি আমাদের সবচেয়ে বড় অনুভূতি নয়? যা আদপে দৃষ্টিহীনকে আলো দেয় ফুটপাত বদলের সময়, রঙের কাছে মন বিনোদবিহারী হয়ে ওঠে, এমনকী, দৃষ্টিশক্তিমান চোখের শরীরও পায় দেখা-না-দেখার নেশা। এই নেশার নিমগ্নতা জন্মায় আদপে একদম শৈশবে। স্পর্শ যে প্রথমতম স্মৃতি তৈরি করে, তা এরকম অদ্ভুত যে, জন্মানোর পর থেকে শিশু তার শরীরের শেষ চিনতে পারে তাকে নিয়ে যত্নশীল স্পর্শের কারণেই। আর ঠিক একই কারণে, ক্রমশ যত তার মন গড়ে ওঠে, তা স্পর্শের নাগাল থেকে বেরিয়ে যায়। মনকে তাই খুঁজে পাওয়া হয়ে ওঠে না আমাদের, কোথায় তার অবস্থান। মস্তিষ্ক শুধু নয়, অনুমানে শুধু নয়, একইসঙ্গে ততটাই ত্বকের প্রতিটি পেশিসংবাহ মনে চারিয়ে যায় স্পর্শাতীত হয়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ঠিক যেভাবে, নরেন্দ্রপুরে ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে বাঁশি বাজানোর ক্লাসে গিয়ে এক বন্ধুকে দেখেছিলাম, পাথর জমিয়ে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে বলে দিত এটা কোন পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে বয়ে আনা। ঢেউয়ের জল ছুঁয়ে নদী, সমুদ্র আমরা বুঝেছি। এভাবে পাথর ছুঁয়ে পাহাড় তো বুঝিনি। যেখানে দৃশ্য শেষ, সেখানে স্পর্শ এভাবে ত্রিমাত্রিক অনুভূতির আশ্রয় হয়ে ওঠে। কাঁধে হাত রাখলে এখনও খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন মন কি আলোর রূপরেখা পায় না? স্পর্শের ত্রিমাত্রিকে তাই শব্দ আরও জ্যান্ত হয়ে আছে। কাগজে করা ক্ষতর স্পর্শ দিয়ে যে-ভাষা জেগে ওঠে, তাকে তাই ধরা যায় না আলেখ্যয় কাগজের সমতলে।