যামিনী রায় ছবি আঁকার জন্য, একটা সময়, কম কষ্ট তো করেননি। কাপড়ের দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে বই বওয়া, নামমাত্র পারিশ্রমিকে কার্ড আঁকা, ছবির বর্ডার রং করা, সস্তার পোর্ট্রেট আঁকা– সবই করেছেন ছবির জন্য। সেখানে কিন্তু কোনও ফাঁকিবাজি ছিল না। কিন্তু যে গ্রাম্য পরিবেশ, যে সহজ জীবনের কাছে তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, তা আদপে তাঁর শিল্পের মুক্তির পথ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
এক দশকেরও আগের কথা। সাহিত্যিক সরল দে’কে সম্মানিত করা হচ্ছে জীবনানন্দ সভাঘরে। হঠাৎ সেই সভায় হাজির প্রতুল মুখোপাধ্যায়। সকলের অনুরোধে মঞ্চে উঠলেন। এবং সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যটি রেখে নেমে গেলেন। চার-পাঁচ লাইনের একটি ছড়া। যার শেষ তিনটি লাইন এখনও স্মৃতিতে রয়েছে: ‘সরল লিখতে সবল লেখ আগে/ তার পরে দাও ব-এর নিচে ফোঁটা/ সে ফোঁটা রক্তের, ঘামের কিংবা চোখের জলের হতে পারে।’
‘সবলতা’ এবং ‘সরলতা’। যে কোনও লোকজ শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের একেবারে আঁতের কথা। অথচ আশ্চর্য! যামিনী রায়ের মৃত্যুদিনে তাঁর ছবি নিয়ে ভাবতে বসে এ-দু’টি শব্দই প্রথম মাথায় এল। কারণ আপাতভাবে তাঁর ছবির মোটা ছন্দময় রেখা, ঘন উজ্জ্বল রঙের প্যালেট, খানিকটা বেঙ্গল স্কুল ধাঁচের মোটিফ আর বিষয়বস্তুর সারল্য। কিন্তু যামিনী রায়ের ছবি তো লোকশিল্প নয়। লোকশিল্পের সঙ্গে তাঁর কাজের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এবং সেই পার্থক্য খুব সচেতনভাবে আরোপিত। তবু যে মনে এল, তার কারণ সম্ভবত শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির কালেক্টিভ সাবকনশাস।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন সুশোভন অধিকারীর কলাম ‘ছবিঠাকুর’: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সহজপাঠের নন্দলাল কিংবা ক্ষীরের পুতুলের অবনীন্দ্রনাথ নন, বাঙালি মধ্যবিত্তের গেরস্থালির চৌকাঠ প্রথম ডিঙিয়েছিলেন কিন্তু যামিনী রায়। শিল্পী হিসেবে তাঁকে চেনার আগেই তাঁর আঁকা ছবি ছাপা হতে দেখেছি বিয়ের কার্ডে। আরও পরে শারদীয় বিজ্ঞাপনে। ছেলেবেলায় বয়স্কদের বলতে শুনেছি– ছবি আঁকেন বটে যামিনীবাবু! পানপাতার মতো মুখ। একচালার প্রতিমার মতো টানা টানা চোখ। গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে ছবি ব্যবহারের রেওয়াজ বাঙালি রপ্ত করেছে অনেক পরে। কিন্তু সেখানেও অন্যান্য শিল্পীকে টেক্কা দিয়েছেন যামিনী রায়। তিনজন নারী কিংবা মা ও শিশুর ছবি তো দীর্ঘদিন ধরেই মেগা-সিরিয়ালের ইনডোর সেটের উপকরণ। ছবির বাজার ও অর্থনীতির নিরিখে অবশ্যই তার মূল্য রয়েছে। এমনকী, ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসের প্রেক্ষিতেও তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ‘শিল্পী’ যামিনী রায় থেকে ‘পটুয়া’ যামিনী রায়— কাল্ট হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া বোধহয় ততটা শৈল্পিক নয়, যতটা ব্যবসায়িক। খানিকটা রাজনৈতিকও নয় কি?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যে গ্রাম্য পরিবেশ, যে সহজ জীবনের কাছে তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, তা আদপে তাঁর শিল্পের মুক্তির পথ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাজার ও সাফল্য, শেষ অবধি তাঁর অন্তর্নিহিত শিল্পীসত্তাটির সঙ্গে প্রতারণাই করেছে। সারাজীবন নিরলস কাজ করে গিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন ফরমুলা-তাড়িত হাজার-হাজার ছবি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ভারতীয় শিল্প-ইতিহাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন’ বিষয়টা খুবই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। প্রাচ্য শিল্পকে কেন যে পাশ্চাত্য শিল্পের সঙ্গে মিলেই মহান হয়ে উঠতে হবে– সে কারণ অবশ্য রাজনৈতিক। ব্যাপারটা এরকম– ইউরোপীয় সিলমোহর গায়ে লাগিয়ে কেউ যদি দেশীয় ধারার দিকে মুখ ফেরান, এবং দুইয়ের মেলবন্ধনে নতুন কোনও রাস্তা তৈরি করে উঠতে পারেন– তবেই তা খানিক উতরেছে বলে ধরা হবে। অনেকটা বিলেত-ফেরত ডাক্তারের মতো। ফলে ছাত্রাবস্থায় ইম্প্রেশনিজম, পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম শিখে যামিনী রায়কে ফিরে আসতে হয়েছে কালীঘাট পটের শৈলীতে, এবং পরে আবার তা বর্জন করে গ্রাম্য পটশিল্পে। উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়েছে আলপনা, টেরাকোটা, পুঁথি-পাটা ও অন্যান্য লৌকিক শিল্পমাধ্যমগুলির মধ্যে থেকে। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে কলকাতা থেকে বহু দূরে, বেলিয়াতোড়ে। এবং ক্রমাগত বদলের এই প্রেক্ষাপটে বস্তুত তাঁর শিকড় সন্ধানের যে সৎ, গুহ্য প্রবণতাটি ছিল তা-ই হয়ে উঠেছে যামিনী রায়ের ইউ.এস.পি। যেভাবে একজন জনপ্রিয় শিল্পীর ‘aura’ গড়ে ওঠে। অন্যদিকে বাঙালি ভদ্রসমাজ যামিনী রায়কে দেখেছে যাত্রাপালা কিংবা বাউল গান শোনার মতো করে। গ্রাম্য ‘মনোটনি’-কে সযত্নে বর্জন করে। ফর্মকে তছনছ করে। ‘ফিউশন’-এর নামে মূল থেকে তাকে সরিয়ে এনে আপন ইন্টেলেকচুয়াল প্লেজারের ছাঁচে ফেলে। (ক্ষমতা ও সংস্কৃতির অন্তর্বর্তী সম্পর্কও এখানে খানিক ক্রিয়াশীল নয় কি?)। আর যামিনী রায়, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, ক্রমশ সেই ছাঁচের মতো করে ছবি উৎপাদন করে গেছেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার: সত্যজিৎ বলেছিলেন, তোমার আঁকায় সই লাগে না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পটের প্রাণময়তা বা সাবলীলতা কোনওটাই তাঁর ছবিতে ছিল না। তুলনায় পটের অনুকরণে করা তাঁর অধিকাংশ ছবিই অনেক বেশি আলংকারিক, কৃত্রিম। লোকশিল্পের স্বভাবজ কূটাভাস তাতে অনুপস্থিত। অনেক বেশি সাদামাটাও। যে ‘appearance’-এর ওপর তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিতেন– তাঁর সেই ধারণাও অনেকটাই নাগরিক দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে আধারিত বলে মনে হয়– কে জি সুব্রহ্মণ্যমের কথায় ‘ইঙ্গ-ভারতীয় অগভীর শিল্পচেতনায় যা খুব মনোরম’। ফলে সাঁওতাল মেয়ের ঋজু, প্রস্তর কাঠামো ক্রমশ তাঁর ছবিতে ধরা দিয়েছে গুয়াশের পেলব মসৃণতায়। শিল্পী-জীবনের গোড়ার দিকে প্লাই-বোর্ডের উপর টেম্পারায় করা সাঁওতাল রমণীর ছবিটির পাশে রেখে দেখলে এই পার্থক্য স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। যদিও দ্বিতীয় ছবিটিও খুব প্রত্যক্ষভাবে বেঙ্গল স্কুল দ্বারা প্রভাবিত বলে মেয়েটির প্রকৃত সত্তা সেখানেও অনুপস্থিত। বরং একেবারে শুরুর দিকে যে ইম্প্রেশনিস্ট যামিনী রায়কে দেখা যায়, কখনও রেমব্রাঁ, কখনও মাতিস, কখনও সেঁজা, কখনও গখের অনুকরণে একের পর এক ল্যান্ডস্কেপ আঁকছেন– তাঁকে আমার সবচেয়ে সৎ, সবচেয়ে ভালো লাগে। মনে হয়, ওই পর্বে করা লিথোগ্রাফগুলি সংরক্ষিত হল না কেন! দেখতে ইচ্ছে করে তাঁর তৈরি ‘রাবণ’ নাটকের মঞ্চচিত্রগুলি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন সন্দীপ রায়ের সাক্ষাৎকার: সন্দেশে লেখকদের পারিশ্রমিক ছিল লেখার সঙ্গে বাবার অলংকরণ
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যামিনী রায়ের এই ফুটপাথ বদল আমায় আহত করে। ছবি আঁকার জন্য, একটা সময়, কম কষ্ট তো করেননি। কাপড়ের দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে বই বওয়া, নামমাত্র পারিশ্রমিকে কার্ড আঁকা, ছবির বর্ডার রং করা, সস্তার পোর্ট্রেট আঁকা– সবই করেছেন ছবির জন্য। সেখানে কিন্তু কোনও ফাঁকিবাজি ছিল না। কিন্তু যে গ্রাম্য পরিবেশ, যে সহজ জীবনের কাছে তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, তা আদপে তাঁর শিল্পের মুক্তির পথ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাজার ও সাফল্য, শেষ অবধি তাঁর অন্তর্নিহিত শিল্পীসত্তাটির সঙ্গে প্রতারণাই করেছে। সারাজীবন নিরলস কাজ করে গিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন ফরমুলা-তাড়িত হাজার-হাজার ছবি। এবং ভারতীয় শিল্প-আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনবাদী ধারাটিকে পুষ্ট করতে চেয়ে আদপে রচনা করেছেন দেশকালবিচ্যুত এক আড়ষ্ট খেলনানগর। আর একদিকে কলোনিয়াল হ্যাংওভার, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ–এর মাঝামাঝি একটি বিকল্প অবস্থানে, খানিক রিলিফ হিসেবে তাঁকে দেব-সিংহাসনে বসিয়ে ব্যবহার করেছে বাঙালি ভদ্রসমাজ। বানিয়েছে আধুনিক ভারতীয় শিল্পের পথিকৃৎ– ‘বিলেত ফেরত’ পটুয়া। এই দুঃখ, জীবৎকালে, তিনিও খানিক অনুভব করেননি কি?