কমলকুমার মজুমদারের লেখক পরিচয় অনেকাংশেই তাঁর চিত্রকর পরিচয়কে আড়াল করে ফেলেছে। তার ওপর তিনি ছিলেন লেখকদের লেখক। তাঁকে পড়তে গেলে ‘পড়ার অনুশীলন’ দরকার হয়। ফলে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনও দিনই ‘পপুলার রাইটার’ ছিলেন না। আর এখন বিশ্বব্যাপী পাবলিসিটি এবং পপুলিস্ট কালচারের যুগে কমলকুমার ক্রমশই আরও দূরের মানুষ হয়ে উঠছেন। লেখার ভাষা এবং ছবির ভাষার মধ্যে অদ্ভুত সাযুজ্য নির্মাণ করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো চিত্রকর কমলকুমার মজুমদার একই রকম অপরিচিত।
‘উডকাট’ বা ‘কাঠখোদাই ছবি’ এমন একটি শিল্প মাধ্যম, যেখানে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যেতে হয়। এই মাধ্যমে কাজ করতে গেলে কাঠের যে ব্লকের ওপরে খোদাইয়ের কাজটি করা হয়, তার সারফেসের অংশটি প্রিন্টে কালো, অর্থাৎ অন্ধকার। সেই কালোকে কাটতে কাটতে, মানে সেই অন্ধকারের মধ্যেই আলো অর্থাৎ সাদা রেখা এবং স্পেসের বিন্যাসের মধ্য দিয়ে ছবিকে গড়ে তুলতে হয়। অন্য বিবিধ মাধ্যমের চর্চা করলেও এই কাঠখোদাই ছিল চিত্রকর কমলকুমার মজুমদারের সবথেকে প্রিয় মাধ্যম।
কমলকুমার মজুমদারের লেখক পরিচয় অনেকাংশেই তাঁর চিত্রকর পরিচয়কে আড়াল করে ফেলেছে। সম্ভবত ব্যক্তি এবং লেখক কমলকুমারের সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে তাঁর অনুজ কলমচিরা এমন এক মিথিকাল পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন যে, সেখানে কাজের তুলনায় তাঁকে নিয়ে তৈরি গপ্পগাছাই প্রধান হয়ে উঠেছে। তার ওপর তিনি ছিলেন লেখকদের লেখক। তাঁকে পড়তে গেলে ‘পড়ার অনুশীলন’ দরকার হয়। ফলে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনও দিনই ‘পপুলার রাইটার’ ছিলেন না। আর এখন বিশ্বব্যাপী পাবলিসিটি এবং পপুলিস্ট কালচারের যুগে কমলকুমার ক্রমশই আরও দূরের মানুষ হয়ে উঠছেন। লেখার ভাষা এবং ছবির ভাষার মধ্যে অদ্ভুত সাযুজ্য নির্মাণ করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো চিত্রকর কমলকুমার মজুমদার একই রকম অপরিচিত।
চিত্রকলায় কমলকুমারের আগ্রহের কথা বলতে গেলে আবার সেই তাঁকে নিয়ে প্রচলিত একটি গল্পেরই আশ্রয় নিতে হবে। ১৯৪৯ সালে যখন বিশ্বখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়া কলকাতায় আসেন, কলকাতার তরুণ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে বিশেষ উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ অনেকেই ওঁর শরিক ছিলেন। কমলকুমার মজুমদারও গিয়েছিলেন জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু দেখা করতে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘কত বড় বাপের ছেলে উনি, যাব না দেখা করতে!’ অর্থাৎ কমলকুমারের কাছে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পরিচয়ের থেকেও অনেক বড় হয়ে উঠেছিল জাঁ রেনোয়ার পিতৃপরিচয়, তিনি জগদ্বিখ্যাত ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকর পিয়ের অগস্ত রেনোয়ার পুত্র। তাঁর বাবার কাজের সম্পর্কে এই শ্রদ্ধাবোধ এবং ফরাসি শিল্প সম্পর্কে গভীর জ্ঞান জাঁ রেনোয়াকেও বিস্মিত করেছিল। তাই পরে জাঁ রেনোয়া যামিনী রায়ের স্টুডিওতে গিয়ে বাঘের পিঠে সওয়ার এক মানুষের ছবি দেখে মন্তব্য করেছিলেন ‘দ্যাট ম্যান মাস্ট বি কোমাল’ অর্থাৎ বাঘের সওয়ারি করা মানুষটি নিশ্চয়ই কমলকুমার মজুমদার। এ হেন কমলকুমার কিন্তু নিজের ছবি আঁকার ক্ষেত্রে পছন্দ করেছিলেন সাদা-কালো কাঠখোদাইয়ের মতো এমন একটি মাধ্যম, যার সঙ্গে ফরাসি চিত্রকলার যোগাযোগ খুব নিবিড় নয়। আবার ছবির ভাষার ক্ষেত্রেও তিনি হেঁটেছিলেন অনেক বেশি দেশীয় দৃশ্যকল্প নির্মাণের পথে।
কমলকুমার মজুমদার এমন একটা সময়ে বাংলায় বসে চিত্রকলার চর্চা করছিলেন যখন শিল্পের আধুনিকতা বিষয়ে অধিকাংশ তরুণ শিল্পীদের ধারণা ছিল ধোঁয়াশায় ভরা। এর মাত্র কিছুকাল আগে পর্যন্ত শিল্পের স্বদেশি এবং বিদেশি সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে যুযুধান দুই পক্ষকে তাত্ত্বিক তর্কে মেতে থাকতে দেখা গেছে। বেঙ্গল স্কুলের দেশীয় শিল্পচর্চার সঙ্গে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ইউরোপীয় তালিম এবং চর্চা নিয়ে বিতর্কে তরুণ শিল্পীরা দ্বিধাবিভক্ত। এরই মধ্যে বাংলায় আছড়ে পড়ে ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পকলার ঢেউ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মধ্যস্থতায় এবং ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টের সহায়তায় কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের কাজের প্রদর্শনী। সেখানে বাওহাউসের ওয়াল্টার গ্রোপিউস থেকে ব্লু রাইডার গোষ্ঠীর ক্যান্ডিনস্কি এবং পউল ক্লি-র মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের মূল কাজ প্রদর্শিত হয়। এর পরবর্তী সময়ে পশ্চিমি আধুনিকতার ধারণাগুলি কীভাবে এদেশের শিল্পীদের কাজের অংশ হয়ে উঠতে পারে এই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। কমলকুমারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শিল্পী নীরদ মজুমদার প্যারিসে চলে যান আধুনিক শিল্পের সারাৎসার আয়ত্ত্ব করতে। চারের দশকে গঠিত হয় ক্যালকাটা গ্রুপের মতো আধুনিক শিল্পীদের নিজস্ব দল। কিন্তু আজ প্রায় ৮০ বছর পরে অনেকটা দূরত্ব থেকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বোঝা যায় যে, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার অন্বেষণ অনেকটাই হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় আধুনিকতার ভারতীয়করণ মাত্র। সঠিক অর্থে আধুনিক ভারতীয় শিল্পের রূপকল্প গড়ে তুলতে গেলে দেশের বিভিন্ন বহমান লোকশিল্প এবং প্রান্তিক শিল্পধারার সঙ্গে যে গভীর আত্মিক যোগাযোগ থাকার দরকার, সেটা অধিকাংশ শিল্পীরই ছিল না। তাঁদের অনেকেই ‘ফর্মালি’ দেশীয় উপাদান ব্যবহার করলেও ‘কন্সেপচুয়ালি’ তাকে বুঝে উঠতে বা আইডেন্টিফাই করে উঠতে পারেননি। কমলকুমার মজুমদার সেই হাতে-গোনা শিল্পীদের একজন, যাঁর কাজের মধ্যে সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের পরিচয় পাওয়া যায়।
এই কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দু’টি কারণে। প্রথমত, তাঁর আলাদা করে ‘চিত্রকর’ হিসেবে খ্যাতি লাভের বাসনা বা তৎসংক্রান্ত কোনও চাপ ছিল না। দ্বিতীয়ত এই চিত্রকর কমলকুমার মজুমদারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন লেখক কমলকুমার মজুমদার, যাঁর লেখার মধ্যে দেশীয় উপাদানের সঙ্গে সমকালীনতা এবং গঠনগত নির্মাণের একটা অদ্ভুত সংশ্লেষ ঘটে যাচ্ছিল। এই লেখক কমলকুমার মজুমদার চিত্রকর কমলকুমার মজুমদারকে ছবির ভাষা এবং গঠনের দেশীয় উপাদানগুলি চিনে নিতে সাহায্য করেছিলেন।
কালীঘাট অঞ্চলে পটচিত্র চর্চার পাশাপাশিই উনিশ শতকে উত্তর কলকাতায় কাঠখোদাই করে আঁকা ছবির চর্চা বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এইসব ছবি ‘বটতলা কাঠখোদাই’ নামে পরিচিত। কাঠখোদাই দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছবি নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলেও বটতলার কাঠখোদাই ছবির একটি নিজস্ব দেশীয় চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের কাঠখোদাই ছবিতে যেখানে সাদা এবং কালোর বিন্যাসকে ছবির আলো-অন্ধকার এবং ইমেজের মাস ও ভলিউম নির্মাণের বিভ্রম সৃষ্টির উপাদান বলে মনে করা হত, সেখানে বটতলার কাঠখোদাই ছবিতে সাদা এবং কালোর ব্যবহার ছিল ছবির কম্পোজিশন সম্পর্কিত স্পেস ডিভিশন, অলংকরণ এবং মূল নকশা নির্মাণের কৌশল । বটতলার কাঠখোদাই ছবিতে পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ বা ত্রিমাত্রিকতার বিভ্রম সৃষ্টির কোনও চেষ্টা করা হয়নি, বরং তা ছিল দ্বিমাত্রিক এবং মূলত বাংলার পটচিত্র এবং পোড়ামাটির মন্দিরের দেওয়ালে নির্মিত রিলিফ ভাস্কর্যের কম্পোজিশনের অনুসারী। ইউরোপীয় শিল্পের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও নিজের কাঠখোদাই বা রিলিফ ছবির ক্ষেত্রে কমলকুমার মজুমদার বাংলার এই নিজস্ব ধারাটিকে একেবারে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছিলেন। মজার কথা হল, কমলকুমারের ছবিতে কিন্তু বটতলা কাঠখোদাইয়ের অনুষঙ্গ এমন ভাবে রয়েছে– যাকে কাঠামোগত দিক থেকে বুঝতে পারা গেলেও ইমেজ গঠনের দিক থেকে তা সম্পূর্ণ আলাদা। কমলকুমারের মানুষের ড্রয়িং একেবারেই অন্যরকম। কখনও কখনও তা বাইজান্টাইন ভিত্তিচিত্রের অনুসারী, ছন্দময়তার দিক থেকে তারা ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পের ঘনিষ্ঠ আবার ছবির সামগ্রিক নকশা এবং সাদা অংশ কাটার ধরন বটতলা কাঠখোদাইয়ের কাছাকাছি। এই সবকিছুকে একসূত্রে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে আবার যে মনন এবং মুনশিয়ানা কাজ করেছে তা আসলে ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পকলার সারাৎসার । কিন্তু কোনওভাবেই কমলকুমার মজুমদারের ছবিগুলোকে ইউরোপীয় আধুনিকতার ‘ভারতীয়করণ’ বলে চিহ্নিত করা যাবে না।
খোদাই করার যন্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আবার কমলকুমারের একান্তই নিজস্ব একটি চলন ছিল। উডকাট বা লিনোকাটের ক্ষেত্রে যে টুলস ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে দু’টি হল প্রধান যন্ত্র। একটি ভি কাটার (ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো) অন্যটি ইউ কাটার (ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো )। এইগুলি সোজাসুজি চালালে যথাক্রমে সরু ও মোটা রেখা পাওয়া যায় । কমলকুমার যন্ত্রগুলিকে অনেক সময়েই সোজাসুজি না চালিয়ে হাতের কম্পনের ব্যবহার করতেন। ফলে তাঁর সৃষ্ট রেখাগুলি হত কিছুটা ভাঙা ভাঙা এবং ছন্দোময়। এটা একেবারেই তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষা নির্মাণের অঙ্গ । গাছপালা, জন্তুজানোয়ার, মানুষ– সব ধরনের ইমেজ নির্মাণ করতে গিয়েই তিনি এই কম্পমান রেখার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। যেহেতু কমলকুমার মজুমদার তাঁর কাঠখোদাই ছবিগুলোকে বহুক্ষেত্রেই বইয়ের অলংকরণ এবং প্রচ্ছদ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেছেন, সেক্ষেত্রে টেক্সটের বর্ণনার অনুষঙ্গও ছবিতে আছে। প্রথমদিকের কিছু কাজ নন্দলাল বসুর লিনোকাট ছবির খুবই কাছাকাছি হলেও বেশিরভাগ ছবিই তাঁর নিজস্বতার সাক্ষ্য বহন করছে। একটি বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে একাধিক শিল্পধারার সংশ্লেষ ঘটিয়ে যেভাবে নিজের ছবিতে কমলকুমার আধুনিকতার সঙ্গে ভারতীয় আইডেন্টিটিকে মেলাতে পেরেছিলেন, তা সমকালীন অনেক শিল্পীই যথেষ্ট দক্ষতা, প্রথাসিদ্ধ প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও করে উঠতে পারেননি। এটা কোনও তাৎক্ষণিক মতামত নয়। একটা সময়ের শিল্পচেষ্টাকে নিরপেক্ষ এবং সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে যে সময়ের এবং মানসিকতার দুরত্বের প্রয়োজন হয় তারই ফলশ্রুতি। একতরফা সমালচনা বা মুগ্ধ স্তাবকের স্তুতি কোনটাই কমলকুমারের ন্যায্য প্রাপ্য ছিল না। তাঁর ছবিকে তাঁর দেশ কালের পরিপ্রেক্ষিতে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করে দেখার প্রয়োজন ছিল। সেই কাজ এখনও হয়নি, তাই চিত্রকর কমলকুমার মজুমদার এখনও অনালোচিত, অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছেন।