অর্জুন নিজেও প্রাণধারণ করতে পারবেন না, নিজের কাছেই অক্ষমণীয় অপরাধের জন্য, এ-ও জানেন কৃষ্ণ। শারীরিকভাবে যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করতে দিলেন না। বাক্যে অপমান করালেন অর্জুনকে দিয়ে, যা তাঁর মতে, হত্যার সমতুল্য। তারপরে যুধিষ্ঠিরকেও সেই অপমানবোধে আটকে থাকতে দিলেন না। সেদিন যদি যুধিষ্ঠির নিহত হতেন এবং অর্জুন আত্মহত্যা করতেন, তাহলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফলই যেত পাল্টে। হতে দিলেন না এই পৌরাণিক লাটাইধারী।
ঘুড়ির উৎসবে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি, যিনি ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন, কেমন করে তাঁর ক্রূর যুদ্ধক্ষমতার বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছেন আকাশে। এই টানছেন, এই ছাড়ছেন, স্যাঁৎ করে নেমে আসছেন ঘাড়ে, ওই নিচের দিক থেকে হু হু করে টেনে উঠে যাচ্ছেন আরও দূর দূর আকাশে এবং অবশেষে প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করে থামছেন। দেখতে দেখতে অনেক সময় ভুলে যাই– লাটাই যাঁর হাতে আছে, তিনি যথাসময় সুতো না ছাড়লে, না টানলে, এই সুতীব্র তীক্ষ্ণ কাটাকাটি সুতোওয়ালা চালাতেই পারেন না। মহাভারতে এমনই এক লাটাইধারী হলেন কৃষ্ণ।
কুরু-পাণ্ডব দ্বন্দ্বে পাণ্ডবরা যে বিজয় অর্জন করলেন, তার প্রতিটি পদক্ষেপে এই লাটাইধারীর খেলা। সুকৌশলে সুতো ছেড়েছেন, গুটিয়েছেন, মহাভারতীয় আকাশ পাণ্ডবদের আচ্ছন্ন করতে দিয়েছেন। মনে করুন জতুগৃহের কথা। তখন জরাসন্ধের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জর্জরিত তিনি, তবুও পাণ্ডবদের পুড়ে মারা যাওয়ার কথা শুনে এসেছেন সেখানে। পুড়ে যাওয়া গলিত মৃতদেহের হাড় দেখে অনুমান করেছেন, পাণ্ডবেরা সম্ভবত নিহত হননি। অপেক্ষা করেছেন পাণ্ডবদের জনসমক্ষে আগমনের।
অনুমান করেছেন, দুর্যোধনের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বে পাণ্ডবদের প্রয়োজন মিত্রশক্তির। সেই মিত্র, তিনি নিজে। কিন্তু যদুবংশ সামগ্রিকভাবে পাণ্ডবপক্ষ নেবে না। অতএব প্রয়োজন সামরিক শক্তির। সে শক্তি একমাত্র জোগাতে পারে পাঞ্চালরা, যারা দীর্ঘকাল ধরে কুরুদের সঙ্গে শত্রুতায় আবদ্ধ। অনেক প্রজন্মের বিরোধ দ্রুপদের সঙ্গে দ্রোণের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। দ্রুপদ অর্ধেক রাজ্যভাগ হারিয়েছেন দ্রোণের কাছে পাণ্ডবদেরই সহায়তায়। কিন্তু দ্রোণ তো কুরু-কর্মচারী। তিনি, সামরিক শক্তির জোগান দিতে পারবেন না। পারবেন দ্রুপদ, স্বাধীন রাজা বলে। সুতরাং, কৃষ্ণ অনুমান করতে পেরেছেন দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে অর্জুনের আগমন আবশ্যকীয়।
জন্মের সময়কাল থেকেই দ্রৌপদী যাজ্ঞসেনী অর্জুনের জন্য নিয়তিনির্দিষ্ট, এই অলৌকিকতাকে বাদ দিয়েও বলা চলে, এ পাণ্ডব এবং পাঞ্চাল শক্তি-সংযুক্তিকরণের পক্ষে এক স্বাভাবিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাই কৃষ্ণ স্বয়ং পাণিপ্রার্থী হয়ে আসেননি, এসেছিলেন পাণ্ডবদের সঙ্গে জ্ঞাতি-সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে বাঁধতে। কারণ জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁরও প্রয়োজন মিত্র বাড়ানো। পাণ্ডবদের সঙ্গে স্বয়ংবরের পরে সাক্ষাৎ করে সে বন্ধনকে আজীবনের বন্ধনে পরিণত করলেন।
কুরু-প্রধান ধৃতরাষ্ট্র যখন দেখলেন– পাণ্ডবেরা পাঞ্চালের সামরিক বল এবং কৃষ্ণের সাহচর্য নিয়ে নতুন অক্ষ নির্মাণ করে এসেছেন, বাধ্য হলেন রাজ্যভাগ দিতে। নতুবা যুদ্ধ তৎকালেই অনিবার্য হয়ে উঠত। সেই নূতন রাজত্ব হস্তিনাপুরের চেয়েও যাতে বৃহৎ হয়, তাই খাণ্ডবদহনেও এসেছেন কৃষ্ণ বাসুদেব। আবারও অগ্নির ক্ষুধামান্দ্যের অলৌকিকতাকে সরিয়েই দেখা চলে এই ঘটনাকে। নগরায়ণ, যুগে যুগে নানা দেশ-কালে সাম্রাজ্যিক রাষ্ট্র-ক্ষমতার একটি অভিজ্ঞান। অরণ্যের দখল ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। কৃষির সম্প্রসারণ ব্যতীত রাজকোষে কর আসা বৃদ্ধিও অসম্ভব। সে বৃদ্ধি না হলে সামরিক শক্তিবৃদ্ধিও হয় না। রাজ্য, সাম্রাজ্য হয় না। আবার নগর ব্যবসাকেন্দ্রও হয় বলে, তার মাধ্যমেও ধন সঞ্চয় সম্ভব। অতএব পাণ্ডব রাজত্ব ইন্দ্রপ্রস্থকে বাড়তে হয় খাণ্ডবকে গ্রাস করে।
সেই সম্পদবৃদ্ধির ফলাফল যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের বাসনা। সে বাসনা পূরণে সবচেয়ে বড় বাঁধা সম্রাট জরাসন্ধ। জানালেন কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ না করার ইচ্ছাকে তিনি, অর্জুনাদির সহায়তায় রোধ করলেন। ভীমার্জুনকে নিয়ে গেলেন জরাসন্ধের কাছে। অহংকারী জরাসন্ধ, মরলেন ভীমের হাতে। এক ঢিলে দুই পাখি বধ করলেন আমাদের লাটাইধারী। তাঁর প্রবলতম শত্রু নিশ্চিহ্ন হল, যাদবসঙ্ঘের অস্তিত্ব নিরাপদ হল। অন্যদিকে রাজসূয় করে পাণ্ডবদের আরও ধনার্জন, সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকে হস্তিনাপুরের চেয়েও বর্ধিষ্ণু করার কাজটিও হল। ফলাফলে তাঁর মিত্রবল বাড়ার মাধ্যমে যাদবসঙ্ঘ এবং বাকি সকল রাজত্বে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বও প্রতিপন্ন হল। আবার এসবের জন্য কৃতজ্ঞতাতেই তাঁকে যজ্ঞসভায় শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা যুধিষ্ঠিরের, পরিণামে শিশুপালের তীব্র বিরোধ এবং কৃষ্ণের শিশুপাল বধ। অর্থাৎ জরাসন্ধ শিবির শেষ। এবারে কিন্তু সুতো অন্যের হাতে দিয়ে লড়লেন না, নিজেই লাটাই-হাতে লড়ে গেলেন।
জরাসন্ধ থাকলে, কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে থাকতেন দুর্যোধনের পক্ষে। শিশুপালও সেদিকেই থাকতেন। সে সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হল। যুধিষ্ঠির যদি রাজকীয় দম্ভে পূর্ণ হয়ে দ্যূতক্রীড়াতে না যেতেন তাহলে বনবাস বা অজ্ঞাতবাস হত না পাণ্ডবদের। ওইখানে কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে পাণ্ডবদের ঘুড়ি কেটে যাওয়ার হাল হল।
সেই অবস্থা দেখে কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির কাল থেকেই, আর লাটাই ছাড়েননি। স্বয়ং দূত হয়ে গিয়েছেন দুর্যোধন এবং কুরুরাজসভার কাছে। যুদ্ধ নিশ্চিত জেনেও যাতে পাণ্ডবদের কাঁধেই শুধু যুদ্ধের দায় না আসে নিশ্চিত করেছেন। দুর্যোধনকেই প্রধান করে তুলেছেন বিপুল ধ্বংসের খতিয়ানে।
যুদ্ধের শুরুতেই সবচেয়ে গুরুতর কাজটি করেছেন অর্জুনকে যুদ্ধে বাধ্য করে। আত্মীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না অর্জুন। তাঁদের রক্তের দাগ হাতে লাগাবেন না। সেই ভাবনাকে ধূলিসাৎ করেছেন। করতে গিয়ে চতুর্বর্ণ বিভাজন থেকে শুরু করে পূর্বজন্ম-পরজন্ম, তার জন্য দায়ী বলে কথিত কর্ম ও কর্মফল, সবের একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-দার্শনিক ব্যাখ্যাকে উপস্থিত করেছেন, যাকে খণ্ডন করার মতো যুক্তি অর্জুনের কাছে ছিল না।
সব বর্ণ তার তার কাজ ফলের আশা ব্যতীত করলে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে না, থাকে না অবস্থা পরিবর্তনের উদগ্র ইচ্ছেও। বিশেষ করে, নিম্নবর্ণগুলির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা উন্নতির আকাঙ্ক্ষা এতে অবরুদ্ধ হয়। সমাজবিপ্লব হয় না। যা চলছে তার স্থিতিস্থাপকতা বজায় থাকে। দুর্যোধন, কর্ণাদি বাহুবল আর পৌরুষ দিয়ে সম্পদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত শাস্ত্রীয় ব্যবস্থার বিরোধী হয়েছেন। তাঁদের দমন, পাণ্ডবদের জয় শুধু নয়, শাস্ত্রীয় স্থিতাবস্থার জয়। ফলত তাঁর প্রচারিত ধর্মের জয়। বিশ্বরূপ দর্শন করানোর অলৌকিকতাকে বাদ দিলেও এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট বোঝা সম্ভব। তারই সঙ্গে সকলকে কালই গ্রাস করছে এই নিয়তিবাদ দিয়েও অর্জুনকে মত-পরিবর্তনে বাধ্য করেছেন।
এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যেহেতু পাণ্ডবদের জয় প্রয়োজন, তাই যুদ্ধের মধ্যেকার নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনিই নিচ্ছেন এবং নেওয়াচ্ছেন। যুদ্ধকালে, যিনি অন্তত অর্জুনকে হত্যা করতে পারেন, সেই কর্ণকে, অর্জুন-বধের নিমিত্ত রাখা অস্ত্র, ঘটোৎকচের ওপরে প্রয়োগে বাধ্য করিয়েছেন কৃষ্ণ। জয়দ্রথ হত্যা ঘটাচ্ছেন, সূর্যের পূর্ণগ্রাসকে কাজে লাগিয়ে, যা অর্জুনের প্রাণরক্ষা করছে। প্রচলিত মহাভারতের অলৌকিকতা ভেঙে নিলে আমরা বেশি ভালো বুঝি যে, বিজ্ঞান যুদ্ধের কাজে কত গুরুত্বের। এছাড়াও পাণ্ডবদের সাংঘাতিক অন্তর্দ্বন্দ্বও নিবারণ করেছেন।
অর্জুনের গুপ্ত প্রতিজ্ঞা ছিল, কেউ তাঁকে গাণ্ডিব অন্য কাউকে দিতে বললে, তিনি তাকে হত্যা করবেন। কর্ণের কাছে হেরে, কোনওক্রমে প্রাণভিক্ষা পেয়ে, প্রবল লজ্জিত যুধিষ্ঠির, যুদ্ধের সময়কালের মধ্যেই চলে এসেছেন শিবিরে। যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধক্ষেত্রে না দেখে এবং যুদ্ধে তৎক্ষণাৎ কর্ণের মুখোমুখি হতে না চেয়ে, অর্জুন চলে এসেছিলেন সেখানে উৎকণ্ঠায়। যখন যুধিষ্ঠির শুনলেন, কর্ণ-বধ না করে অর্জুন তাঁকে দেখতে এসেছেন, ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনকে নানা অপমান করেন এবং গাণ্ডিব কৃষ্ণকে দিয়ে দিতে বলেন।
এবারে? অর্জুনকে তাহলে যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করতে হয়। ক্রুদ্ধ অর্জুন, তাই করতে উদ্যতও হলেন। অথচ সে তো মুহূর্তের উত্তেজনার জন্য, প্রতিজ্ঞার জন্য। কিন্তু সেকাজ করলে অর্জুন নিজেও প্রাণধারণ করতে পারবেন না, নিজের কাছেই অক্ষমণীয় অপরাধের জন্য, এ-ও জানেন কৃষ্ণ। শারীরিকভাবে যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করতে দিলেন না। বাক্যে অপমান করালেন অর্জুনকে দিয়ে, যা তাঁর মতে, হত্যার সমতুল্য। তারপরে যুধিষ্ঠিরকেও সেই অপমানবোধে আটকে থাকতে দিলেন না। সেদিন যদি যুধিষ্ঠির নিহত হতেন এবং অর্জুন আত্মহত্যা করতেন, তাহলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফলই যেত পাল্টে। হতে দিলেন না এই পৌরাণিক লাটাইধারী।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………………..
সমগ্র যুদ্ধাংশে নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নেপথ্যে কৃষ্ণকেই দেখতে পাই আমরা। দেখতে পাই সর্বশেষে দুর্যোধনের উরুভঙ্গের সময়েও ভীমকে এগিয়ে দিতে। দেখি, ভীমকে কোথায় আঘাত করতে হবে কৌশলে জানিয়ে দিতে। এভাবেই পাণ্ডবদের বিজয় সুনিশ্চিত করতে। আরও অনেক ঘটনার কথা বলা চলে। কিন্তু মূল কথাটা হল, সুতো অর্জুন কিংবা যুধিষ্ঠির, যাঁর হাতেই থাকুক, লাটাই থেকেছে সর্বদা বাসুদেব কৃষ্ণের কাছেই।
……………………. পড়ুন হাতে লাটাই ………………….
অর্পণ গুপ্ত-র লেখা: আকাশের লড়াইতে দ্রাবিড় কেবলই মাটির প্রতিনিধি