পৃথিবী ঘুরছে নিজের চাকায় নিজেরই চারদিকে। আর ঘুরতে ঘুরতে যেমন পেরিয়ে যাচ্ছে অনন্ত সময়, তেমনই এক অনন্তের ছায়াপথ নির্মিত হচ্ছে ছেলেটির হেঁটে চলা অক্ষপথে। এভাবে দৈনন্দিনের চক্রের আবর্তন বিপুল তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে তৈরি হয়ে যায় একটা গোটা অক্ষরলোক যার নাম ‘অক্ষয় মালবেরি’। মণীন্দ্র গুপ্তর জন্মদিনে, ফিরে পড়া ‘অক্ষয় মালবেরি’।
উৎসব চলছে। আমাদের মাথায় চলছে শব্দযজ্ঞ। যদিও ভেতরে ভেতরে হাতড়ে বেড়াচ্ছি একবিন্দু শান্তি, নীরব উচ্চারণের স্থিরতা। প্রতিটি চঞ্চল উচ্চারণ আর চঞ্চল দৃষ্টির গোলকধাঁধায় জীবনটাই কানাগলি এখন। তবু আচমকা খুলে যায় কোনও রূপকথার দরজা। আশা-নিরাশায় দোলা মনে ঝুপ করে নেমে এসে স্পষ্ট আকৃতি পেতে শুরু করে কোনও কাঙ্ক্ষিত ‘ভাঁড়ারের দেশ’। যার মাটির মেঝেতে এখনও সোঁদা ঘ্রাণ, কাঁথা-বালিশে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, এমনকী বৃষ্টির ভেজা-আঘ্রাণ সহজেই আবিষ্ট করতে পারে। আর এখানেই ‘লোলস্তনী’ কয়েকজন প্রৌঢ়া আজও পান-তামাকের গুঁড়োয় ছোপ ধরা দাঁতে, সুখ-দুঃখে পোড়া জীবন নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করেন। তাঁদেরই একজনের সামনের দিকে ছড়িয়ে রাখা জানুর মধ্যে এঁটুলির মতো আটকে থাকে একটি শিশু। ওর মা, ছেলেকে দশমাসেরটি রেখেই ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন। ও এখন ঠাকুমার শুকিয়ে যাওয়া স্তন থেকেই টেনে টেনে মিথ্যেদুধ খায়। ‘মিথ্যেদুধ’। শিশুর কাছে তার নিশ্চয়ই আস্বাদ আছে কোনও ? নিরাপত্তার আস্বাদ ঠিক কেমন হতে পারে? এই শিশুটির দৃষ্টি সম্বল করেই অনেক অলৌকিকের মুখোমুখি হওয়া যায়। ওর নাড়ি কাটা হয়েছিল বনের সবুজ বিষ মেশা কাঁচা বাঁশের চোঁচ দিয়ে। প্রকৃতিও যেন তাই গোপন ভাঁড়ারের চাবি গচ্ছিত রেখেছে ছেলেটির কাছে।
ছেলেটি একলা রোদ্দুর হয়ে ঘুরে বেড়ায়। উঁচু কোনও এক ঢিবির ওপরে নির্বান্ধব শিরীষ গাছের তলায় মাটি থেকে ম্লান মুখে খুঁজে নিতে চায়, ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে গেঁথে থাকা দুঃখ। খুঁজে পেতে চাওয়া কাচের এই টুকরোটি কেমন যেন বিষণ্ণ হয়েও রঙিন। মায়ার স্নিগ্ধতায় টলটলে। ছেলেটির চোখে কিন্নর, এমনকী, প্রেতলোকের আশ্চর্য– সিঁদুরের ধুলোর মতো ছড়িয়ে থাকা খয়েরি, সবুজ, বেগুনি কিংবা লাল, নীল, ময়ূরকণ্ঠীর মতো ‘অসংখ্য অগণ্য নানা রঙের কণা কণা গ্রহ নক্ষত্র’ একটি নির্দিষ্ট ঘরের ঠান্ডা মাটির স্পর্শ ছুঁয়ে চক্রের মতো ঘোরে। পরীর পাখার ফুলের রেণুর মতো দ্যুতি ছড়ায়। ছেলেটি ভুল করে না তার নিজস্ব সাম্রাজ্য চিনে নিতে। ‘সবুজ অলংকারের মতো ঢেঁকির শাক’, ‘গাছপালার কবোষ্ণ গন্ধ’ ‘ঝিরঝিরে হাওয়া’, তেজি রোদের গ্রীষ্ম দুপুর কিংবা বর্ষায় সবুজ মরকতের মতো চিকন আর দ্যুতিময় গাছের পাতা, তেঁতুল গাছে ঝমঝম করা জোনাকিরা, রক্তপলাশ, দ্রোণ, চালতা কিংবা শরৎ-উষার আধো ঘুমে শিউলি গন্ধর মধ্যে ছেলেটি কিছুটা ছবির মতো করেই চিনে নেয় আরেক রহস্য জগৎ। অক্ষরের জগৎ। প্রকৃতি, ছাপা বই আর ঘরে টাঙিয়ে রাখা ছবির রহস্য মিলেমিশে গড়ে ওঠা চাহনিতে একদিন সে আবিষ্কার করে প্রত্যেক ফুলের পাপড়ির কেন্দ্রে থাকা সূক্ষ্ম জাদুপথ। যেমন ‘শিউলি পৌঁছে দিতে পারে সাদা মেঘের দেশে’, জ্যোৎস্নার হাসনুহানা পৌঁছে দেয় ‘ঝাড়লন্ঠন নিবে আসা এক চাঁদনী জলসার দেশ’-এ। আর গ্রীষ্মের তাপে শুকিয়ে মুচমুচ করা সোনার চাঁপার জাদুপথে পৌঁছে যাওয়া যায় মুনশি-বাড়ি। কিন্তু এই রহস্যলোকে বাইরের পৃথিবীর জায়গা হয় না যে।
ছেলে তো বড় হবেই। জীবন তো তাকে কাটাছেঁড়া করবেই। ভুল বাড়িতে এসে পড়ার যন্ত্রণা তাকে তো গিলে নিতেই হবে। সে তো মিশে যাবেই বাকি পাঁচের সঙ্গে। এরপর বরাক উপত্যকায় এসে পড়া। সৌভাগ্য, দাদু-দিদিমার কাছে আশ্রিত থাকার লাঞ্ছনা তাকে শিকড় গাড়তে দিল না সংসারে। ফলে অক্ষরের রাজত্বে যৌবনের খিদে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া। সংস্কারের লেশমুক্ত সোজা চোখে চারপাশের বাস্তবকে চিনে নেওয়া। এভাবেই যখন এগিয়ে চলে জীবন, বুঝি প্রকৃতিও মায়ায় পড়েছে তার। ক্ষতের প্রলেপ দিতে প্রচ্ছন্ন হয়ে থেকে যাচ্ছে একলা ছেলেটির সঙ্গে। যজ্ঞের ভস্ম থেকে কোনও অলৌকিক অস্ত্র, বোধহয় পৃথিবীরাজ্য জয় করতে চলে আসছে হাতের মুঠোয়। ইশকুলে খেলার মাঠে বাজারে কিংবা জীবনের নানা বিপুল বিরোধিতার সামনে ছেলেটি যখন প্রগাঢ় স্থৈর্য নিয়ে অটল থাকে আর ধাক্কা খেয়ে বিমূঢ় বিস্ময়ে থমকে যায় সমস্ত প্রতিকূলতা, মনে হয়, শিববাড়ির দিবাস্বপ্নের ছোরাটা সত্যিই কি কোনও বর্ম তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর চারপাশে? সে-জগৎ আমরা জানি না। কিন্তু রূপ-কথারও অতিরিক্ত কোনও রহস্যলোক বুঝি আচ্ছন্ন করে আমাদের। পৃথিবী ঘুরছে নিজের চাকায় নিজেরই চারদিকে। আর ঘুরতে ঘুরতে যেমন পেরিয়ে যাচ্ছে অনন্ত সময়, তেমনই এক অনন্তের ছায়াপথ নির্মিত হচ্ছে ছেলেটির হেঁটে চলা অক্ষপথে। এভাবে দৈনন্দিনের চক্রের আবর্তন বিপুল তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে তৈরি হয়ে যায় একটা গোটা অক্ষরলোক যার নাম ‘অক্ষয় মালবেরি’। আর সেই একলা ছেলে নিজের পদবি থেকে ‘দাশ’, আর নাম থেকে ‘লাল’ বাদ দিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত হয়ে নিজের সাম্রাজ্যের একটা ক্যাপসুল বানিয়ে নেন। তিনি ভাবতেন— সাধারণের মধ্যে অপরিচয়ের আড়ালেই হয়তো থেকে যাবেন আজীবন। রাস্তায় ঘটে যায় যদি হঠাৎ-মৃত্যু, জনৈক অজ্ঞাতনামার লাশ বলে সবাই চিহ্নিত করবে তাঁকে। কিন্তু নিজস্ব চেতনালোকের দশনামী টং ঘরে তিনিই ছিলেন রাজা। তিনি প্রথম মণীন্দ্র গুপ্ত।