দেশ-সমাজ বদলাতে চাওয়া, পুলিশের খাতায় দাগী, ওই যুবক যখন দুই ছাদের মাঝখানে পাঁচিলের ওপর, তখন তাড়া করে আসা অফিসার রিভলবার তাক করেন। সেই অমোঘ মুহূর্তে, যখন একটা গোটা পাড়া, এমনকী, কাক ও চড়াই-রাও একটি ফটাস শব্দ এবং তার অব্যবহিত পরেই মর্মন্তুদ আর্তনাদের অপেক্ষায় স্থাণু, ছাদের দরজা দিয়ে তিরবেগে এক নারী দৌড়ে আসেন এবং অফিসারের হাত চেপে ধরেন। তিনি– বাণীদি, দাবি করেন, তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে তাঁর অনুমতি ছাড়া পুলিশ অ্যাকশন করতে পারে না। এই ঘটনায় অফিসার হকচকিয়ে যান এবং তাঁর টার্গেট হার্ডল রেসের মতো একটার পর একটা ছাদ টপকে বড় রাস্তার দিকে চলে যায়। এই ঘটনা সত্য, কি আষাঢ়ে গল্প– জানা নেই, কিন্তু সব দেশেরই যেমন রূপকথা থাকে, তেমনই সব পাড়ারও।
প্রচ্ছদের ছবি: শান্তনু দে
বাণীদির চোখের দিকে তাকাতে পারিনি অনেক বড় বয়স অবধি। উল্টোদিকের বাড়ির দোতলার জানলায়, সমান্তরাল শিকের ফাঁক দিয়ে উনি গলির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একান্নবর্তী পরিবারে বাণীদি একা। কিন্তু কেন, সেই প্রশ্ন কাউকে করতে শুনিনি কোনও দিন। বাণীদির গায়ের রং কালো, উসকোখুসকো চুল এবং চোখে আগুন। যেন কত জন্মের রাগ ওই চাহনির মধ্যে দিয়ে ঠিকরে বেরচ্ছে। বাণীদিকে নিয়ে একটি মিথ চালু ছিল আমাদের পাড়ায় এবং আশপাশে। সাতের দশকের গোড়ার দিকে যখন শহর টালমাটাল, এদিক-ওদিক লাশ ঝরে পড়ছে টগর বা পলাশ ফুলের মতো, এক সদ্য যুবা ভরদুপুরে পুলিশের তাড়া খেয়ে বাণীদির বাড়িতে ঢুকে সোজা ছাদে। পাড়ার বাড়িগুলি একে-অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদ অনায়াসে টপকে যাওয়া যায়। দেশ-সমাজ বদলাতে চাওয়া, পুলিশের খাতায় দাগী, ওই যুবক যখন দুই ছাদের মাঝখানে পাঁচিলের ওপর, তখন তাড়া করে আসা অফিসার রিভলবার তাক করেন। সেই অমোঘ মুহূর্তে, যখন একটা গোটা পাড়া, এমনকী, কাক ও চড়াই-রাও একটি ফটাস শব্দ এবং তার অব্যবহিত পরেই মর্মন্তুদ আর্তনাদের অপেক্ষায় স্থাণু, ছাদের দরজা দিয়ে তিরবেগে এক নারী দৌড়ে আসেন এবং অফিসারের হাত চেপে ধরেন। তিনি– বাণীদি, দাবি করেন, তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে তাঁর অনুমতি ছাড়া পুলিশ অ্যাকশন করতে পারে না। এই ঘটনায় অফিসার হকচকিয়ে যান এবং তাঁর টার্গেট হার্ডল রেসের মতো একটার পর একটা ছাদ টপকে বড় রাস্তার দিকে চলে যায়। এই ঘটনা সত্য, কি আষাঢ়ে গল্প– জানা নেই, কিন্তু সব দেশেরই যেমন রূপকথা থাকে, তেমনই সব পাড়ারও। যদিও শিশুমনে এই কথন একটু ভীতির সঞ্চার করে এবং উনি ভয়ংকর রাগী এক নারীচরিত্র হিসেবে আমার মনে প্রোথিত হন। যতদিন না বড় হই এবং ওঁকে দোতলা থেকে সদর দরজায় নেমে আসতে দেখি।
সেবার কোন একটা পুজোয়, সামান্য কোনও কারণে, সম্ভবত দুই পাড়ার দু’টি পরস্পরমুখী চোঙা মাইকে কখন কীভাবে গান বাজবে– এই নিয়ে ঝগড়া বিশ্বযুদ্ধ পর্যায়ে উন্নীত হয়। দু’পক্ষের গুন্ডারা আসে, কারও হাতে জং-ধরা তরোয়াল, অর্থাৎ সোরড । কারও পকেটে আবার ওয়ান শটার দৃশ্যমান। দুই যুযুধান পক্ষ একে-অপরকে খিস্তি দিচ্ছে হাওয়া গরম করতে, ঠিক যেমন বন্যপ্রাণীরা, সে হরিণই হোক বা বাইসন, মাটিতে ক্ষুর ঘষে ধুলো ওড়ানোর জন্য। যে কোনও মুহূর্তে চার্জ হবে, এমন সময় বাণীদি অকস্মাৎ তাঁর দরজায় আবির্ভূত হলেন। পরের কয়েক মিনিট তাঁর যে রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা মহাকাব্যিক বললে ভুল হবে না। দোতলার জানলায় যে অনন্ত রাগ পুষে রাখা ছিল, তা যে এইভাবে উপচে পড়বে গরম পিচের মতো, ভাঙাচোরা রাস্তায়, তা কেউ ভাবতে পারেনি! দুই দলই ঘাবড়ে যায় এবং নিচু গলায় পরস্পরকে কয়েকটি নির্বিষ গালি দিয়ে স্ব-স্ব অঞ্চলে ফিরে যায়। বাণীদি নিঃশব্দে জানলায়। তাঁকে নিয়ে যে মিথ ছিল, তা সত্যি মনে হয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ছোটবেলায় একবারই মা তেড়ে এসেছিলেন আমার দিকে, হাতে গরম খুনতি নিয়ে। মা তাঁর রাগ সাধারণত উচ্চৈঃস্বরে প্রকাশ করতেন না। সহ্যের সীমা ছাড়ালে শরীর খারাপ বলে শুয়ে পড়তেন। সেদিন হয়তো একটু বেশিই বাঁদরামি করে ফেলেছিলাম। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, পুঞ্জীভূত রাগ একজনের ওপরেই আছড়ে পড়তে চায়। বেগতিক বুঝে একদৌড়ে উঠোন পার হই এবং জয়াদি যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিই দরজায়। বুঝতে পারি, দরজার বাইরে জয়াদি দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা-কে আটকানোর জন্য। ওঁর ঠান্ডা গলা শুনতে পাই, আপনি চলে যান, ওকে পরে পাঠিয়ে দেব।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জয়াদিও একলা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। আমার প্রতিবেশী, যদিও বেশিরভাগ সময় আমাদের বাড়ির সামনের অংশেই থাকতেন। ওঁকে পরিবারের সদস্য জেনেই বড় হয়েছি। স্বেচ্ছায় বিয়ে করেননি। প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। পৃথুলা এবং গায়ের রং ফরসা। চুলে নারকোল তেল নিয়মিত। সারাক্ষণ জর্দা-পান। স্কুলের দিন বিকেল এবং ছুটির দিন দুপুর থেকে একটু গড়িয়ে নিতেন। ওঁর মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকত। মাঝে মাঝে দাঁতের ডাক্তারের কাছে স্কেলিং করিয়ে আসতেন যাতে খয়েরের দাগ ওঁর হাসিটিকে লজ্জায় না ফেলে। এহেন এক নারীও যে রাগতে পারেন সেই সম্যক জ্ঞান আমি লাভ করি যখন ওঁর হাত ধরে বড় রাস্তা পেরিয়ে ওই স্কুলের ক্লাস ওয়ান এবং টু-তে পড়তে যাই। সেখানে তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ। আক্ষরিক অর্থেই পান থেকে চুন খসলে ভারী গলায় প্রবল ধমক দেন। ছ’-সাত বছরের ছেলে-মেয়েরা ওঁর দাপটে তটস্থ , মাঝেমাঝেই কান্নাকাটি। ভেবেছিলাম ক্লাস থ্রি-তে অপেক্ষাকৃত বড় স্কুলে ভর্তি হওয়ায় ওঁর এই মূর্তি আর দেখতে হবে না। কিন্তু ফোর-এ, বৃত্তি পরীক্ষার আগে, অগ্রজেরা নিদান দিলেন জয়াদির কাছে ইতিহাস ঝালিয়ে নিতে হবে। কালো চৌকির ওপর কাঠের ডেস্ক নিয়ে বসে মোমবাতির আলোয় দুলে দুলে মুখস্থ করছি, মনে আছে। যতবার উনি পড়া ধরছেন, আমি ভুল বলছি। আর মোমের আলোয় ওঁর চোখ জ্বলে উঠছে। দাঁত চেপে বলছেন, আবার পড়, আবার। আবার। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি এ তো বাণীদির চোখ! কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পড়ানোর সময়, স্কুলে হোক বা বাড়িতে, জয়াদির আপাত কোমল কাঠামো ভেদ করে পুষে রাখা রাগের উদ্গীরণ হত কি? উনি বিয়ে করেননি কেন? জানা নেই। কিন্তু এই রাগ থেকে যে অধিকারবোধের জন্ম, তা একবার আমাকে বাঁচিয়েছিল প্রহারেণ ধনঞ্জয় হওয়ার হাত থেকে। ছোটবেলায় একবারই মা তেড়ে এসেছিলেন আমার দিকে, হাতে গরম খুনতি নিয়ে। মা তাঁর রাগ সাধারণত উচ্চৈঃস্বরে প্রকাশ করতেন না। সহ্যের সীমা ছাড়ালে শরীর খারাপ বলে শুয়ে পড়তেন। সেদিন হয়তো একটু বেশিই বাঁদরামি করে ফেলেছিলাম। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, পুঞ্জীভূত রাগ একজনের ওপরেই আছড়ে পড়তে চায়। বেগতিক বুঝে একদৌড়ে উঠোন পার হই এবং জয়াদি যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিই দরজায়। বুঝতে পারি, দরজার বাইরে জয়াদি দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা-কে আটকানোর জন্য। ওঁর ঠান্ডা গলা শুনতে পাই, আপনি চলে যান, ওকে পরে পাঠিয়ে দেব।
পাড়ার রকের এক তাত্ত্বিক বলেছিলেন, মেয়েরা রাগী হয়, ছেলেরা বৈরাগী। চারপাশে যে নারীদের দেখেছি ছোট থেকে তাদের রোজ, প্রতি ঘণ্টায়, রাগের বহিঃপ্রকাশ। যেহেতু পুরুষের রাগ হওয়া স্বাভাবিক বলেই গণ্য, তাই অধিকার হিসেবেই ধরে নিয়েছি নিজের গলা ফাটানোকে। অথচ পাড়ার এক বৃদ্ধা সর্বাঙ্গে গামছা জড়িয়ে কী কারণে সকাল-বিকেল বালতি বালতি জল ঢালছেন দুয়ার-দালানে আর বিড়বিড় করে নিজেরই চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করছেন, সে ব্যাপারে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করিনি। কবে বিধবা হয়েছেন তিনি? কী এসে গেল। অথবা, পাশের বাড়িতে যে নতুন বউ সদ্য চাপানো ভাতের হাঁড়িতে পড়ে যাওয়া ন্যাড়া ক্যাম্বিস বল যত্ন সহকারে বঁটিতে ফালা ফালা কেটে আমাদের হাতে দিলেন, তাঁর রাগের কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। আমরা আমাদের রাগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে দিনকয়েক আগে এক সন্ধেবেলা বাগবাজার অঞ্চলে পৌঁছে যাই। চোখে পড়ে ভগিনী নিবেদিতার বাড়ি, সংস্কারের পর ঝকঝকে। ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে যে রাস্তায় পৌঁছলাম সেখানে অবিশ্যি অপেক্ষাকৃত কম আলো। তুমুল ঝগড়া কানে আসে। সেদিকে এগোই, ছোটবেলার অভ্যেস। যাঁরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত, ফুটপাথেরই বাসিন্দা মনে হল। অনতিদূরে কয়েকজন হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে রগড় দেখছেন। পুরুষটি রোয়াকের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে। ঈষৎ জড়ানো তাঁর কণ্ঠস্বর। নারীটি সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তাঁর বাপ-বাপান্ত করছেন। হঠাৎ সেই পুরুষ যেন আলফা মেল, ‘যা যা, খানকি মাগী, দিনরাত এ ঘর ও ঘর করছিস আবার বড় বড় কথা!’ ঠিক সেই মুহূর্তে যেন ওই ফুটপাথে, এই দুই চরিত্রের মাঝখানে, একটি কুণ্ড জেগে ওঠে। অগ্নিপরীক্ষার জন্য। তবে মহাকাব্য তো স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নতুনভাবে লেখা হয়। ওই নারী ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, কিছুটা ভাঙা গলায়, ‘এই খানকি মাগীর জন্যেই তো পায়ের ওপর পা তুলে দিনরাত মদ গিলছিস, লজ্জা করে না?”
তারপর, উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে, ওই অগ্নিকুণ্ডকে পাশ কাটিয়ে ল্যাম্পপোস্টের দিকে এগিয়ে যান।