এই অগ্রগামী সচেতন মেয়েদের বাংলা সাহিত্য তো আগে দেখেনি! লেখাগুলিতে মাসিমা-পিসিমা গোত্রীয় চরিত্র আছেই যারা আশ্রিতা, অভাবী কিন্তু বড়লোকের সংসারে সারাদিন চা বানাচ্ছেন, লুচি ভাজছেন, খেতে দিচ্ছেন, বাজার গোছাচ্ছেন, অথবা ভাঁড়ার বের করে দিচ্ছেন। অতি চেনা এই চরিত্রেরা অনেকেই আনন্দের প্রতিমূর্তি, এনার্জির উৎস। কিন্তু সবাই মোটেই পবিত্রতার প্রতিমূর্তি নয়। বরং সাদা-কালোর বাইরেও ধূসর সব রকমের পর্দায় আঁকা। তাঁদের সংসারের কেন্দ্রে আছে একটি উষ্ণতাময় রান্নাঘর।
মেয়েদের মনে নাকি জিলিপির আড়াই প্যাঁচ। মেয়েলি যা কিছু, তাই নাকি জটিল! তাই-ই কি লীলা মজুমদার লেখেন ‘পাকদণ্ডী’?
অথবা শিলং-এর বিস্তারিত পটভূমিতে বড় হয়ে ওঠা লীলাকে পেয়ে বসে যে পাহাড়ের ইউটার্ন, হেয়ারপিন বেন্ডের রাস্তাগুলো, তা জন্ম দেয় এক অন্য সারল্যের? আপাত সরল কিন্তু আসলে অজস্র আঁকবাঁকে ভরা, ভেতরের কথাগুলো শুধু জোনাকির মতো আলো দিয়ে যায়, নিচু নিচু গোল গোল পাতার মতো গল্পের বাহির শরীরের প্রেক্ষিতে?
‘‘পাহাড়ের ঢালের ওপর বাড়ি, নিচে রাস্তা, চারদিকে ইউকালিপটাস গাছ।
এককালে কেউ ফুলগাছও লাগিয়েছিল, তখন সব আগাছায় ভরা। চারধারে ঝোপ-ঝাপ। তাতে লাল-হলুদ গোছা-গোছা ফুল, তার বিশ্রী একটা গন্ধ। কোনো কোনো ঝোপে ফল ধরেছে, ছোট্ট ছোট্ট আঙুরের মতো থোপা-থোপা, বেশির ভাগই সবুজ। কয়েকটা পেকে টুকটুক করছে। দাদা বলল, ‘লাল ফল ভালো।’ বলে একমুঠো তুলে নিজেও খেল, আবার দিদিকেও দিল। বদ খেতে, থু-থু করে ফেলেও দিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দুজনের মুখ দিয়ে কেবলি ফেনা উঠতে লাগল। সে আর থামে না। দাদা বলল, ‘বিষফল! আমরা মরে যাব!’ কল্যাণ আর আমি ওদের মরার অপেক্ষা করতে লাগলাম। মরা পাখিটাখি দেখেছি, কিন্তু জ্যান্ত মানুষের মরা দেখিনি। দাদা দিদি ততক্ষণে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়েছে আর কথাটথা বলছে না। মা আমাদের খুঁজতে এসে ঐ অবস্থা দেখে কেঁদেকেটে একাকার! যামিনীদা গেল ডাক্তার ডাকতে।
এমন সময় বাবার সঙ্গে ঝাকমি-উবিনও জিনিসপত্র নিয়ে এসে হাজির হল। বাবার তো চক্ষুস্থির! কাকমি-উবিন একটুও ঘাবড়াল না। ছুটে রান্নাঘর থেকে মুঠো ভরে নুন এনে ওদের মুখে পুরে দিল। ওরা বমিটমি করে সুস্থ হয়ে উঠল। ততক্ষণে ডাক্তার এসে বললেন, ‘বিষ হলেও, ওতে মানুষ মরে না।’’’
এই গদ্য পাকদণ্ডীর। এ কি সরল গল্প না সহজ কথা? সহজভাবে বললেও পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে ‘পাকদণ্ডী’। কারণ জীবন সরল নয়। মেয়েদের স্মৃতি প্রজ্ঞা প্রখরভাবে উপস্থিত যেন গন্ধের স্মৃতি, নাছোড় সব ছবির স্মৃতি। যেমন নতুন চিঠির নীল কাগজ ফাঁকা পেয়ে তার ওপর দাদাটির ছাপ দিয়ে, নাম-ঠিকানা লিখে পোস্টাপিস খেলার গল্প। মাসির নতুন সব চিঠির তাড়া কাগজ নষ্ট করার জন্য পরে সেই বকাঝকা খাওয়ার স্মৃতিটি বেমালুম হারিয়ে ফেলেন লীলা। কিন্তু থেকে যায় টেবিলে বসে দাদার পোস্টমাস্টারির ছবির ছাপ।
এমনই তো জীবন আমাদের। বিশেষত মেয়েদের। খোপবন্দি, কিন্তু বাইরের দেখায় যা খোপে আবদ্ধ, ভেতরে তা অজস্র শিকড়ে বাকড়ে ছড়িয়ে, বৃহৎ পৃথিবীকে জড়িয়ে মড়িয়ে যায়।
তাই তো বড়দের লেখক হিসেবে, লীলা মজুমদারকে পুরোটা দেখা হয়নি আমাদের। খুঁত থেকে গেছে। এই কারণে বহুদিন ধরেই লীলা মজুমদারের প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাসগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন অনেক পাঠক, যেন তাঁর অনবদ্য কৈশোর-কেন্দ্রিক রচনাগুলির পাশে এগুলোকে কোনও নম্বর দেওয়াই যায় না।
দ্বিমত পোষণ করতে বাধ্য হই, লীলার বড়দের লেখা, বিশেষত ‘ঝাঁপতাল’ ও ‘চিনে লণ্ঠন’ আবার পড়ে উঠে। আর কতদিন আমরা লেখকদের খোপে বন্দি রাখব। লীলার ক্ষেত্রে যে খোপ হয়ে উঠেছে শিশু-কিশোর সাহিত্যের খোপ।
অথচ, উপন্যাসগুলি নির্লজ্জভাবে নারীকেন্দ্রিক। দুই, লেখাগুলি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত মেয়েদের যাপন ও যাত্রার কথা। অপরিমিত অর্থ পাওয়া মেয়ে। চাকরি করা মেয়ে। কেউ বা হাই সোসাইটির মেয়ে। পার্টিতে যায়, রং মিলিয়ে শিফনের শাড়ি পরে। এই অগ্রগামী সচেতন মেয়েদের বাংলা সাহিত্য তো আগে দেখেনি! লেখাগুলিতে মাসিমা-পিসিমা গোত্রীয় চরিত্র আছেই যারা আশ্রিতা, অভাবী কিন্তু বড়লোকের সংসারে সারাদিন চা বানাচ্ছেন, লুচি ভাজছেন, খেতে দিচ্ছেন, বাজার গোছাচ্ছেন, অথবা ভাঁড়ার বের করে দিচ্ছেন। অতি চেনা এই চরিত্রেরা অনেকেই আনন্দের প্রতিমূর্তি, এনার্জির উৎস। কিন্তু সবাই মোটেই পবিত্রতার প্রতিমূর্তি নয়। বরং সাদা-কালোর বাইরেও ধূসর সব রকমের পর্দায় আঁকা। তাঁদের সংসারের কেন্দ্রে আছে একটি উষ্ণতাময় রান্নাঘর। একই সঙ্গে বঞ্চনাও কিছু কম নেই।
লীলার এই ডকুমেন্টেশনে, রান্নাঘর-সংসারের চক্রের খুঁটিনাটিতে নারীবিশ্বই উঠে আসে, তাই তো তাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারি না লেবেল এঁটে।
একইভাবে, সেই কবেকার রাজলক্ষ্মী দেবীকে (১৯২৭-২০০২) আমরা ভেবে ফেলছি পুরনো স্টাইলের কবি। অথচ তিনি জীবনে ও লেখায় ছিলেন একইরকম আপসহীন, আর নিজস্ব নারীসত্তার নির্মিতিতে স্বয়ম্ভূ। হয়তো ফ্রয়েড পড়া শিক্ষিত মনন তাঁর, হয়তো বা আত্মদীপ হয়ে নিজেকে বুঝে নিতে পারার অলোকসামান্যতা তাঁর ছিল। তবু, ‘ঘোরানো সিঁড়ি’-র মতো জটিল মনস্তাত্ত্বিক কবিতা তার স্পষ্টতা নিয়ে আজও আমাদের স্তম্ভিত করে:
মনের পেছন দিকে ঘোরানো সিঁড়ির খোঁজ কাউকে দেবো না।
সেই সিঁড়ি বেয়ে শুধু রাতের কুটুম্বগুলি করে আনাগোনা।
মনের পশ্চিম কোণে চোর কুঠুরির খোঁজ পেয়ে গেছে তারা,
আর কেউ জানবে না, আর কেউ দেখবে না। সদরে পাহারা।
…
মনের পেছনদিকে ঘোরানো সিঁড়িটা নামে কানাগলি ঘেঁষে
রাতের কুটুম্বগুলি চুপিচুপি উঠে আসে কত ছদ্মবেশে–
নিয়ে যায় সোনাদানা, একদা যা-কিছু ছিলো মোটামুটি দামি।
আনন্দে অস্থির হয়ে রোমাঞ্চিত অন্ধকারে জেগে থাকি আমি।
বাকি সখাদের প্রতি কবিতার মাঝামাঝি রাজলক্ষ্মীর উক্তি: ‘তোমরা রাত্রের এক বিশিষ্ট প্রহর এলে স্ব স্ব গৃহে যাবে,/ এবং যে যার দ্বারে হুড়কো এঁটে শুয়ে পড়বে সতর্ক স্বভাবে।’
পুরুষ আর নারীর সম্পর্ক-জটিলতার এই আশ্চর্য অভিজ্ঞান তো আর একটা পাকদণ্ডীই বটে! আরেক মেয়ের প্যাঁচালো মনের খবরও পেয়েছি কবিতায়,
বাড়ির গোপন এক কুঠুরির মধ্যে চোরা সিঁড়ি বেয়ে
হীরে পান্না গাছের দেশে একটি মরচে চাবি খালি
হারিয়ে গেছে জীবনভর সে-সন্ধানও তো দিয়ে যাবো
তরুণ কবিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ’। আমার বড় ক্ষোভ ছিল। কিশোরী, সদ্য ফুটে ওঠা কবি কিশোরী যাদের চোখ ফুটছে সবে, তাদের জন্য কেউ কিছুই দিয়ে যায় না কেন! গীতা চট্টোপাধ্যায় ওপরে সবচেয়ে দামি হদিশটি দিয়েছেন। ‘উত্তরাধিকার’ কবিতায়। ২ এপ্রিল, ১৯৭৮-এ লিখিত এ কবিতা।
কান বিঁধিয়ে প্রথম পরা নিমকাঠিটি দিয়ে যাবো
সোনার ছোটো মাকড়ি দুটি দিন ও রাত্রি দিয়ে যাবো
দিদি কাঠের খেলনা দিলো, গোলাপপিসি কাশির প্যাঁড়া,
গোপাল দোলে যে মঠ খাবে ফুটকড়াই আর লুঠবাতাসা
বিষ্ণু পটচিত্র ঘিরে সারা সকাল চন্দনে ওঁ
পুণ্যিপুকুর গোকাল গোরুর শিঙ্ য়ে সিঁদুর হলুদফোঁটা
ন্যাওটা বোনের হাত ধ’রে ঝিম দুপুর জুড়ে বারান্দারই
অলীক বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেমন্তন্ন পুতুলভোজে
হলুদ সিল্কে তিন বছরের খুকুর সঙ্গে চলে যাওয়া
উত্তরাধিকার। গীতা চট্টোপাধ্যায়
মেয়েরাই জানে, এই দেওয়াগুলো হাত থেকে হাতে কীভাবে যায়। জানে, কীভাবে অন্ধকার অলিন্দের বাঁকে, সিঁড়ির খাঁজে লুকিয়ে রাখা থাকে অন্তরের প্রাচুর্য।
বেহালা ট্রাম গড়ের মাঠে হাত ধরে মন, শীতের সকাল,
পশমবোনা কপিপাতা স্কার্টটা দেখিস দিয়ে যাবো।
স্বাধীনতা সংগ্রামী শান্তিসুধা ঘোষের ( ১৯০৭-১৯৯২) আত্মজীবনী জীবনের রঙ্গমঞ্চের একটি ছোট অংশ আজ বাংলার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য। সে গল্পও বলে যায় এই এঁকেবেঁকে নেমে যাওয়া বিপরীতমুখী পাকদণ্ডীর কথা, যা মনের অতল ছায়া মেখে নেমে যায় জলতলে। বরিশালের কৈশোরজীবনের স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছিলেন:
‘আমাদের আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাড়ির মাঝখানে যে নালাটি বাইরের খাল-নদীর জল বহন করে বর্ষার মরশুমে পুকুরে এনে ফেলে, সেখানে অনেক বড়ো বড়ো শিঙি, মাগুর মাছের আনাগোনা। বাবা প্রায়ই সেখানে ছিপ ফেলে বসেন।… প্রাতরাশের পর বাসনপত্র নিয়ে খিড়কির পুকুরঘাটে মাজতে যাই, আর দেখতে থাকি, পুকুরের শান্ত জল, রক্তশাপলা ও শ্বেতশাপলার ফুলে ফুলে কী অপূর্ব শোভায় সেজেছে। আয়নার মতো স্বচ্ছ তার জলরাশি, মুখ নীচু করে তাকিয়ে দেখি, শাপলার বৃন্তগুলি সাপের মতো এঁকেবেঁকে গভীর থেকে আরও গভীরে নেমে গেছে। কোন অতলে পৌঁছেছে? সে কি রূপবতী রাজকন্যার পাতালপুরীতে? নিজের মুখখানার প্রতিবিম্ব জলে ভেসে উঠল– চমকে ভাবলাম, এই কি সেই রাজকন্যা? শরীরে পুলক জাগে, মনে নেমে আসে স্বপ্নাবেশ!’
আত্ম-উপলব্ধির জন্য মেয়েদের কাছে একটা দুটো নয়, অজস্র আড়াই প্যাঁচের জিলিপি-পথরেখা থাকে, ওঠানামা করার অজস্র পাকদণ্ডী।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া ছেড়ে ‘সানডে অবজার্ভার’-এ যোগ দিলেন প্রীতীশদা। কাগজকে পপুলার করার জন্য উনি জুড়ে দিলেন সিনেমা বিভাগ। আমাকেও সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন। দিলেন পুরো ব্রড সিটের একটা ফুল পেজ, যেখানে ফিল্মস্টারদের মুখ আঁকতে হবে। কাগজ যেমন পপুলার হল, আমিও তেমনই পপুলার হয়ে গেলাম মুম্বইয়ে।