নবনীতাদির কলামটা যখন থেকে আমি দেখা শুরু করি, ওঁর মনের ভাব বুঝে বুঝে কথা বলতাম। কী জানি কোন কথায় রেগে যান, তারপর বকুনি খাব! কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম, অতটা ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। একবার কী কারণে গুম মেরে ছিলাম। খুবই শান্ত গলায় কথা বলছিলাম। কথা শেষের পরই মেসেজ– ‘আমার প্রেমে পড়ার নেই মানা, মনে মনে!’ উনি কী ভেবে এমন মেসেজ করেছিলেন জানি না, আমার ভারি মজা লেগেছিল।
প্রায় চার বছর হতে চলল মানুষটা নেই। তাঁর এই হঠাৎ করে ‘নেই’ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে অসুবিধা হয়েছিল খুব। উনি তো আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নন। তবুও আপন কাউকে হারালে যেমন মনের ভেতরটা পলকে শূন্য হয়ে যায়, তেমন বোধ করছিলাম। নবনীতাদি, যাঁর কাছের মানুষ হওয়ার যোগ্যতা আছে বলে কোনও দিন কল্পনা করিনি, সেই মানুষটার কখনও মন ভারী হলে অপ্রত্যাশিতভাবে বলে ফেলতেন কিছু এলোমেলো কথা। আবার মন ভাল থাকলে গল্প জুড়তেন খুব। স্নেহটা টের পেতাম। লেখা সংক্রান্ত ব্যাপারে ভরসা করতেন। অনেক সময়ই হয়েছে– যে নির্দিষ্ট দিনে দিদির লেখা পাঠানোর কথা, পাঠাতে পারেননি। কাজেকম্মে নানান ব্যস্ততা তো বটেই, শারীরিক কারণেও অনেকটা। কিংবা লেখাটা দেরি করে পাঠানোর পরও একটা কী দুটো গোটা প্যারা হয়তো উনি আমূল বদলে দিয়েছেন। অসুবিধেয় যে পড়তে হয়নি, তা নয়। বহুবার বলেছেন, ‘তোর অসীম ধৈর্য রিংকা।’ একবার তো ফোনে ফোনে ভয়ংকর ‘এডিট’ চলছে। কনফারেন্স কল, একপ্রান্তে ফোনে অন্তরাদি, আরেকপ্রান্তে আমি। মাঝে নবনীতাদি। লেখার শেষ অংশ হেঁইয়ো করে উড়িয়ে নিয়ে লেখার মধ্যিখানে বসিয়ে প্রথম অংশ থেকে ছেঁটে শেষের আগের প্যারাগ্রাফে– বাপ রে! সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে! সেকথা লিখেওছিলেন দিদি তাঁর কলামে। নবনীতাদি আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন নিজের মতো করে সম্পাদনা করার। বানানবিধি তো বটেই, বার দুই– অবশ্যই ওঁর অনুমতি নিয়ে, লেখার হেডিংও বদলে দিয়েছি। কোনও আপত্তি করেননি। যখন শ্বাসের কষ্ট হত, নাকে অক্সিজেন নল গুঁজেও লেখা পাঠিয়েছেন। কী বাড়ি, কী হাসপাতাল থেকে। জানতাম– যত কষ্টই হোক, দিদি ঠিক লিখবেন।
সেই সময়গুলো নবনীতাদির সঙ্গে যোগাযোগের সেতু ছিলেন নন্দনাদি আর অন্তরাদি। দিদি শিখিয়েছেন বেঁচে থাকার আনন্দ কেমনভাবে উপভোগ করতে হয়। উদ্যাপন করতে হয় প্রত্যেকটা দিন। লড়াই করার অত প্রাণশক্তি কোথা থেকে পেতেন, কী জানি! নবনীতাদি সেই মানুষ, যাঁর সামনে নিজেকে কখনও নগণ্য মনে হয়নি। বোধ হয়নি কোনও সংকোচ। হঠাৎ করে ক্ষমতা এবং খ্যাতি পেলে কিছু মানুষের মাথা ঘুরে যায়। সামনের মানুষটিকে পিঁপড়ে-সম মনে করে, টিপে শেষ করে দেওয়া যায় যাকে। নিজেকে বিরাট ‘হনু’ ভাবতে শুরু করে! সেইসব মানুষকে দেখার পর যখন নবনীতাদির সঙ্গে পরিচয় হল, আমার মতো সাধারণের কখনও মনে হয়নি ‘আমি নবনীতা দেব সেন’– এই অহংকার তিনি বহন করেন। কী সরল, কী স্বাভাবিক। সোজাসাপটা কথা বলতেন। অত রেখেঢেকে, পেঁচিয়ে নয়। জট পাকানো মন তাঁর ছিল না। তাই হয়তো লেখা চাওয়া এবং পাওয়ার বাইরেও যোগাযোগের পরিসর ছিল খানিক ব্যক্তিগতও।
নবনীতাদির কলামটা যখন থেকে আমি দেখা শুরু করি, ওঁর মনের ভাব বুঝে বুঝে কথা বলতাম। কী জানি কোন কথায় রেগে যান, তারপর বকুনি খাব! কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম, অতটা ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। একবার কী কারণে গুম মেরে ছিলাম। খুবই শান্ত গলায় কথা বলছিলাম। কথা শেষের পরই মেসেজ– ‘আমার প্রেমে পড়ার নেই মানা, মনে মনে!’ উনি কী ভেবে এমন মেসেজ করেছিলেন জানি না, আমার ভারি মজা লেগেছিল। একদিন রাত ১০.১৮ নাগাদ নবনীতাদির হোয়াট্সঅ্যাপ মেসেজ এল। তড়িঘড়ি খুলে দেখি, হাতে ধরা তিনটে লিচুর ছবি। আমি ভাবছি, এ ছবি কেমন ছবি! রসিকতা করছেন কি? তারপর ১০.৩৩—এ আবার একটা ছবি। এবার গাছভর্তি কাঁঠালের। সঙ্গে উল্টানো চোখের ইমোজিও পাঠিয়েছেন। আমি অবাক। এই রসিকতা করছেন নবনীতা দেব সেন! তাও আমার সঙ্গে! একদিন পাঠালেন একথালা স্বর্ণচাঁপা। ছাপার জন্য নয়, আমার জন্য। আমি তো আহ্লাদে আটখানা! আরেকদিন দেখি একটা ছাগলের ছবি। সে কী! শেষে আমাকেই বলে ফেললেন নাকি! পরে মালুম হল, পথভোলা কচুরিওয়ালার যে ছাগলটিকে নিয়ে দিদি ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’ লিখেছিলেন তাঁর কলামে, এটা তারই মতো দেখতে ইন্টারনেট থেকে খুঁজে পাওয়া ছবি। আমার সঙ্গে যাচাই করে নিতে চাইছেন সেই লক্ষ্মীরই মতো দেখতে কি না! এটাই নবনীতাদি। বাইরে থেকে যতটা কঠিন মনে হয়, মেশার পর বুঝেছি, শৈশব লুকিয়ে ছিল তাঁর অন্তরে। এত বড় মাপের মানুষ হয়েও শিশুমনটা হারিয়ে ফেলেননি।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved