চাঁদকে আমার কখনও মনে হয় নির্লিপ্ত জনতার প্রতিনিধি, যে প্রতি রাতে ওঠে পৃথিবীর সকল কুৎসিত কদর্যতার সাক্ষী হয়ে নীরবে প্রস্থান করে। নিশ্চয় এখনও পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে আমার মা বা নানির মতো তাঁদের আদরের সোনা চাঁদের কপালে চাঁদের টিপ দিয়ে যাওয়ার গান গেয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তাক্ত নিথর শরীরগুলোতেও হয়তো অজস্র আদরের চাঁদের টিপ খুঁজে পেলেও পাওয়া যেতে পারে!
ছবি ঋণ: আনখ সমুদ্দুর
সবচেয়ে খতরনাক্ সেই চাঁদ
যে প্রতি হত্যাকাণ্ডের পর
শূন্য উঠোনে ওঠে
কিন্তু আমাদের চোখে
তীব্র জ্বালাবোধ হয় না–Sabase khtaranaak vo chaand hotaa hai
Jo har hatyaakaand ke baad
Viiraan hue aangan men chadhtaa hai
Lekin aapakii aankhon men
Mirchon kii tarah nahiin padtaa– Avtar Singh Pash
৫,৩৪৩ কিলোমিটার দূরে আমার জন্মদেশ থেকে আরেকটি আমার মতোই দেশ যেখানে গত কয়েক দশক ধরে লাগাতার গণহত্যা সমেত একটা দেশের নাম, ভৌগোলিক সীমারেখা, সব অস্তিত্ব– পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলেছে। ছোটবেলায় আব্বার কাছে গল্প শুনেছি, কলকাতা শহর থেকে গ্রামগঞ্জ, সংঘবদ্ধ গোটা বাংলা এক সময় সোচ্চার হয়ে স্লোগান দিতে শিখেছিল– ‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম! ভিয়েতনাম!’
একটা ছোট দেশ বিশাল পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়েছিল আর জিতেছিল। সেই ইতিহাস আমার জন্মের আগের। তবে আমার সময় যে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল, সেখানে আমার দেশ সমবেত হয়ে গণহত্যাকারী দেশের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেনি; উল্টে অদ্ভুত নীরবতা দিয়ে গত কয়েক বছরের হিংস্র থেকে হিংস্রতম গণহত্যাগুলোকে জাস্টিফাই করে চলেছে আজও। আর আমাদের মতো স্বল্পসংখ্যক মানুষ, খুবই বিচ্ছিন্নভাবে, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানানো ছাড়া আর কিছু করার সামর্থ্য রাখি না। কিন্তু সেই সামান্য সমর্থনটুকুও আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে শঙ্কার মুখে।
ইজরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণ ও ফিলিস্তিনি মানুষের একটানা গণহত্যার বিরোধিতা করলে, তা হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের আপামর নানা বয়সের ছাত্রছাত্রী দেখেন– মুসলমান বলে মুসলমানের স্বপক্ষে দাঁড়ানোর ‘সহজ’ পরিপ্রেক্ষিতে। তার থেকেও কিছু অন্ধ ভক্ত সরাসরি আক্রমণে নেমে পড়ে; সহজেই আমার জন্মদেশ কেড়ে নেওয়া এবং দেশ থেকে বিতাড়িত করে দেওয়ার কথা বলতে পারে। অথবা কবর থেকে তুলে ধর্ষণের কথাও অনায়াসে লিখে দিতে পারে! আর প্রতিবার এই হিংসা আর ঘৃণার মন্তব্যগুলো পড়লে নিজের জন্মদেশের ওপর তীব্র থেকে তীব্রতর হয় প্রেম। আর সেই প্রেমের সমর্থনে আজকের এই লেখা ইদের নির্লিপ্ত চাঁদকে নিয়ে।
কৃষ্ণনগর স্টেশনের পরই দ্বিজেন্দ্রসেতু, জলঙ্গী নদী পেরলেই আমার জন্মদেশ, যতবার দ্বিজেন্দ্রসেতু পেরোই, খুব নিজস্ব সে জন্মদেশের সুবাস নাকে এসে লাগে। প্রতি ঋতুতে তার রূপ-রং-গন্ধ বদলে যেতে থাকে। জলঙ্গী পেরলেই বাহাদুরপুরের সবুজ অরণ্য, ঠিক তার পরে ঘন নীল জলের হাসেডাঙার বিল। এরপরেই বিস্তৃত ধান, সরিষা অথবা গম ক্ষেতের দিগন্ত-ছোঁয়া মাঠগুলো পেরলেই আমার ‘বাড়ি’।
বাড়ি শব্দটা যদিও এখন বড় ধোঁয়াশাপূর্ণ; মূলত মেয়েদের জন্য। মেয়েদের বাড়ি ঠিক কী, তা এদেশে আজও পরিষ্কার নয়। তাই জন্মদেশ শব্দটাই বেছে নিলাম। আমার জন্মদেশ, যেখানে জন্মের পর ৩০ বছরের বেশি সময় মাটি আঁকড়ে ছিলাম। যার প্রতিটা মহল্লা, খাল, বিল, নয়ানজুলি সমেত গাছপালা, মানুষ আমার পরিচিত। সেসবের সঙ্গে এখনও কীভাবে জুড়ে আছি জানি না, কেবল মনে হয় আমার জানাজা আর কবর যেন আমার জন্মদেশেই হয়।
এই যে জন্মদেশের কথা লেখা বা তার মাটিতে মিশে যাওয়ার শেষ ইচ্ছেগুলো– তা মনে হতে পারে খুব রোম্যান্টিক, কিন্তু আমি অনেক ভেবে দেখেছি, এখানে হয়তো রোম্যান্টিক সম্পর্কের বাইরে এক অদ্ভুত কমিউনিটিবোধ বা যাপনের দীর্ঘ অভ্যাস জড়িয়ে থাকে। একসঙ্গে চাঁদ দেখে পরব পালন হোক বা মৃত্যুর জানাজার নামাজ– এগুলো বড় হওয়ার মধ্যে মিশে গিয়েছে কোনও একভাবে।
যে সময় এই লেখাটি লিখছি রোজার মাসে বসে আমার জন্মদেশ থেকে অনেকখানি দূরে; অন্য সংস্কৃতি আর নির্জনে। তবে নির্জনতা আপনাকে অনেক সময় সুতীব্র কোলাহলের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। যা অনুপস্থিত তার উপস্থিতি সব চাইতে সোচ্চার হয়ে ওঠে; সে আমরা সকলেই প্রায় মনের গহীনে একটু ঝুঁকলেই খুঁজে পাই। যেমন ফিলিস্তিন বলে একটা দেশ আজ ক্ষমতাবানের চোখে অনুপস্থিত; কিন্তু সেই দেশ আসলে এই পৃথিবীর বুকে আজকে সবচেয়ে বেশি উপস্থিত, সবচেয়ে বেশি করে মূর্ত– একটা গোটা ম্যাপ, পতাকা আর কেফইয়াহ (keffiyah) সমেত।
……………………………………….
চাঁদের এক কল্পনাময় অস্তিত্বের বিশ্বাস যেমন হারিয়েছে; মানুষের ওপরও তেমন ধীরে ধীরে সে বিশ্বাস হারাচ্ছে। মূলত নিজের দেশের এক বড় অংশের মানুষের ওপর থেকে। যারা সহ্য করে নেয় , নীরব থাকে অথবা প্রতিটা হত্যালীলাকে সমর্থন করে প্রবল ধর্মীয় উন্মাদনা, আর ফাসিস্ট জাতীয়তাবাদের প্রোপ্যাগান্ডার ওপর ভিত্তি করে।
……………………………………….
আজকের সময়ে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের এক অনন্য নাম ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিন যাঁদের জন্মদেশ, তাঁরা যেমন নিজের মাটির জন্য লড়ছেন-মরছেন প্রতিদিন; পৃথিবীর প্রতিটা দেশ থেকে তাঁদের লড়াইয়ের সমর্থনে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন ন্যূনতম মানবিকতাবোধ-সম্পন্ন মানুষরা। আমাদের দেশে যদিও প্রেক্ষিত কিছুটা অন্যরকম। সে কথায় পরে আসব।
এই লেখাটা মূলত চাঁদ নিয়ে। এক অপার্থিব মহাজাগতিক বিস্ময়, যা পৃথিবীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। জন্মের পর থেকে দেখেছি, আমাদের গ্রামে পরব, উৎসব নিয়ে আসে চাঁদ। আমাদের ক্যালেন্ডারে চাঁদের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথম সেহেরীর আগের সন্ধ্যায় মাগরিবের নমাজের পর মসজিদ থেকে মাইকে প্রচার হলে আজকে ভোররাতে সেহেরী খাবার; আমরা গ্রামের সকলে মিলে ছুটে রোজার প্রথম একফালি চাঁদ দেখতে ছুটতাম।
ঠিক একইভাবে ইদের আগের সন্ধ্যায় গ্রামে সকলে মিলে গোধূলির পড়ন্ত বিকেল থেকে অপেক্ষা করতাম ইদের চাঁদের। একসঙ্গে সম্মিলিত হয়ে একফালি চাঁদ দেখতে পাওয়ার মধ্যে কী-এক অজানা রোমাঞ্চ ছিল, তা ভাষা দিয়ে লেখা অসম্ভব। ছোটবেলায় নানির সঙ্গে বাগানপাড়ায় যেতাম, যেখান থেকে পশ্চিম আকাশ স্পষ্ট ছিল। অনেকগুলো পাশাপাশি পুকুর পেরিয়ে খোলা দিগন্তের দিকে তাকালে একফালি চিকন একটা চাঁদ পৃথিবীটাকে রহস্যময়ী করে তুলত। তার ওপর শৈশবে নানির আজবগুজব কল্পনাপ্রসূত গল্পের ওপর ছিল আমার অগাধ বিশ্বাস। বড় হওয়ার পরও সেই বিশ্বাস থেকে মনে হত, ইদের একফালি চাঁদের কাছে যা চাওয়া যায়, তা মেলে।
মনে পড়ে, একবার আমি অনেক লজেন্স চেয়েছিলাম। সময়ের সঙ্গে এই চাওয়াগুলো বদলে গিয়েছিল সেই একফালি ইদের চাঁদের কাছে। কিন্তু অজানা একটা সুতো অপার্থিব বা কল্পনা জগতের মতো চাঁদের সঙ্গে কেমন একটা জুড়ে গিয়েছিল। আমার পুবের জানলাতে এক চকচকে তামার বাসনের মতো চাঁদটা সন্ধেয় উঠতে দেখতাম; আর গভীর রাতে দক্ষিণ জানলায় তাকিয়ে দেখতাম, রুপোর মতো চকচকে হয়ে উঠেছে থালাটা তখন মল্লিকপুকুরের উপরে দূরের বাঁশঝাড়ের মাথায়। চাঁদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়াকে বিশ্বাস করেও, কেন জানি না নানির কল্পনার মতো করে চাঁদকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। চাঁদ একইসঙ্গে ছিল দূরের ও একান্ত আপন; নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গীর মতো।
কিন্তু গত দুই বছরে আমি আর নানির কল্পনার মতো করে এক ফালি এই ইদের চাঁদের সঙ্গে কোনও ভাবেই সম্পর্ক তৈরি করতে পারি না। চাঁদকে আমার কখনও মনে হয় নির্লিপ্ত জনতার প্রতিনিধি, যে প্রতি রাতে ওঠে পৃথিবীর সকল কুৎসিত কদর্যতার সাক্ষী হয়ে নীরবে প্রস্থান করে। নিশ্চয়ই এখনও পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে আমার মা বা নানির মতো তাঁদের আদরের সোনা চাঁদের কপালে চাঁদের টিপ দিয়ে যাওয়ার গান গেয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তাক্ত নিথর শরীরগুলোতেও হয়তো অজস্র আদরের চাঁদের টিপ খুঁজে পেলেও পাওয়া যেতে পারে! কিন্তু চাঁদ প্রতি রাত জুড়ে কি সেই আদরের টিপ দেখতে সক্ষম? নয়, একদম নয়? ইদের এক ফালি চাঁদ হোক বা গুরুপূর্ণিমার আস্ত গোটা চাঁদ প্রতিবারই আততায়ীদের হাতে নির্মম হত্যালীলার সাক্ষী হয়ে নীরবে কেটে পড়ে। (৭ মে ২০২০ আওরঙ্গবাদ; ১৬ জন ঘুমন্ত পরিযায়ী শ্রমিকের লাশ ট্রেনে কাটা!)
চাঁদের এক কল্পনাময় অস্তিত্বের বিশ্বাস যেমন হারিয়েছে; মানুষের ওপরও তেমন ধীরে ধীরে সে বিশ্বাস হারাচ্ছে। মূলত নিজের দেশের এক বড় অংশের মানুষের ওপর থেকে। যারা সহ্য করে নেয়, নীরব থাকে অথবা প্রতিটা হত্যালীলাকে সমর্থন করে প্রবল ধর্মীয় উন্মাদনা, আর ফাসিস্ট জাতীয়তাবাদের প্রোপ্যাগান্ডার ওপর ভিত্তি করে।
আজকের দিনে সাধারণ মানুষের এক বড় অংশের মনের মধ্যে হিংস্র মনোভাব এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দৃশ্য ইজরায়েলের আক্রমণে সদ্যজাত ফিলিস্তিনি এক শিশুর রক্তাক্ত মুখের ভিডিওর নিচে আমার দেশের মানুষ তাকে মুসলমান হিসেবে নির্দিষ্ট করে তার ওপর চলা নির্মম অত্যাচারকে শুধুমাত্র এই কারণে বৈধ করে দেয়। কমেন্টে লেখে ‘তোমাদের হামাসকে থামতে বলো’! তিনি হামাসের কোনও ইতিহাস না জেনেই একটি মুসলমান সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে নির্ধারণ করে নিয়েছেন এদেশের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির পাঠ্যক্রম অনুযায়ী।
এছাড়াও বর্তমান ভারত সরকারও যেহেতু লাগাতার ফিলিস্তিনি গণহত্যা নিয়ে বিশ্বদরবারে কোনও অবস্থান নেয়নি, অর্থাৎ, ভারত সরকার অলিখিতভাবে ইজরায়েলের এই গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। আর বর্তমানে ভারত সরকারের মুখিয়া ‘হিন্দু দিলের সম্রাট’ যে বর্তমানকে ভুলিয়ে ৫০০ বছরের কবরকে কেন্দ্র করে দেশ চালানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সেই সরকারের কাছে অন্য কিছু প্রত্যাশা করাও ভুল। তবে মানুষের কাছে প্রত্যাশা করা যায় হয়তো এখনও। পৃথিবীর সব চাইতে কুৎসিত হিংসার ছবিগুলোর মধ্যে এই রক্তাক্ত শিশুর মুখ বা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে যাওয়া শিশুর দুটো চোখ দেখে কি নিজের সন্তান আদরের সোনা চাঁদের কথা মনে আসে না মানুষের? যদি আসে তাহলে কেন এদেশে কোনও বড় প্রতিবাদ কর্মসূচি, ফিলিস্তিনের সমর্থনে বড় মিছিল সম্ভব হল না ইজরায়েলের লাগাতার হিংস্রতার বিরুদ্ধে?
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………
হিরপুরা গ্রামের পোস্ট অফিসে তিনি কর্মরত গত ৩০ বছর ধরে, ৫৫ বছরের এই মহিলার বর্তমান পারিশ্রমিক ২২ হাজার টাকা। চিঠি বা খুব ভারি পার্সেল যখন বানু পৌঁছে দেন গ্রামেরই কোনও বাড়িতে, তখন তাঁর বয়স এবং লিঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করে না কেউ।