আর একটা সবুজ পাহাড়ের উত্তাল উঁচুনীচু ঢালে– শান্তির রাগে– ফুলে ফুলে ওঠে ওঁর আশায় বাঁধা বুক। কাউবয় স্বরের এই চাঞ্চল্যে– ‘If I had a hammer… I had hammer in the morning, I had hammer in the evening, all over this land’… সাম্য কেঁপে ওঠে– জন হেনরির হাতুড়ির থেকে কাস্তের ধার লাগে। অ্যামেরিকান প্যাস্টোরালে এসে বসে সাঁওতালি ক্ষোভ! প্রতিবাদ! আমি শুনতে পাই, হাতুড়ির ধার দেওয়া কাস্তের আলোয় ব্রহ্মাণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে… আর মানুষের কোরাসে যেন শুনতে পাচ্ছি আমার যৌবনের দ্যাখা সেই সলিল চৌধুরীর বিদ্রোহী গলা!
আমরা একটা বাঙ্কারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। পিছনের দিকের মুখে বরফে ঢেকে যাওয়া কবরখানা। মাটির তলায় অগুনতি মৃতদেহ। সমাধিফলক পড়লে জানা যায় এরা এককালে সৈনিক ছিল। Long long time passing. তাদের সমাধিফলকে রোদ্দুর এসে পড়ছে। বরফ তবু গলছে না। বরফের চাদরের নীচে– যেটুকু মাটি– তাতে নীল পাপড়ির ফুল ফুটে আছে। একদল কিশোরী কুড়িয়ে নিচ্ছে ওদের। বাঙ্কারের ওপরে– নীল আকাশ। তাতে মৌমাছির মতো অজস্র মিসাইল। যুদ্ধ হচ্ছে। প্যালেস্তাইনে মৃত শিশুর সারি, সিরিয়ার সমুদ্রে ভেসে আছে সারি সারি মৃতদেহ, ইউক্রেনে কি এখনও সাইরেনের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না? মাটির ওপর দাঁড়ানোর অবকাশ নেই আর। বাঙ্কারের অপর মুখে একটা অদ্ভুত আলো আসছে। ব্যাঞ্জো বাজাচ্ছে কেউ। আর জিজ্ঞেস করছে, ‘Where have all the flowers gone? Long time passing! Where have all the flowers gone long time ago!’ এই প্রচণ্ড যুদ্ধক্ষেত্রে কে তুমি? বন্দুক নয়, মাইন নয়, ফুলের সন্ধান করছ? আমি সেই সুর লক্ষ করে এগিয়ে যাই। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দকে ম্লান করে দিচ্ছে ওই গলা। আমি তাকিয়ে দেখলাম। এক সময় উত্তীর্ণ যুবক। আমি তো ওঁকে চিনি! পিট সিগার! একজন আমেরিকান ফোক সিঙ্গার! সারা পৃথিবীর অবদমিত প্রাণের কাছে যিনি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর ওই ব্যাঞ্জো আর হৃদয়ভরা আলো সম্বল করে। পিট প্রশ্ন করছেন, কোথায় গেল সব ফুলগুলো?…
কবরখানার গভীরে– হাড়গুলো সেই প্রশ্ন শুনতে পাচ্ছে কি? যে প্যাশনে মানুষ যুদ্ধ চায়– সেই একই প্যাশনেই কি সে প্রেমও চায়? আলিঙ্গন চায়? শান্তি চায়? পিট গাইছেন। এই যুদ্ধপ্রান্তরে বাঙ্কারের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়ে চলেন, ‘When will they ever learn! When will the ever learn?’ বাঙ্কারের দেওয়ালগুলোতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই স্বর। আর ঘিরে ফেলতে চাইছে ঘৃণাকে। আমি পিটের খুব সামনে গিয়ে বসি। আমার হাত থেকে মারণাস্ত্র খসে পড়ে। হত্যা করার ইচ্ছায় জন্মায় অজস্র নীল পাঁপড়ির ফুল। সময় কাটতে থাকে। অনেক অনেক সময়। পিটের ব্যাঞ্জোর তারে তারে বসে চড়ুইপাখিরা। প্রজাপতিরা। পিটের কাছে এই বাঙ্কার প্রতিরোধহীন হয়ে পড়ে। একটা বিশাল আকাশের তলায় আমরা গিয়ে জড়ো হই। পৃথিবীর সব যুদ্ধ শেষের সৈনিকরা। সেই ফুলগুলো কোথায় গেল?… অনেক অনেক দিন কেটে গেছে। অনেক অনেক দিন। ‘Where have all the flowers gone? Girls had picked them everyone! When will they ever learn! When will they ever learn? Where have all the young girls gone…’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাবার মুখে শুনেছিলাম পিট সিগার কলকাতায় প্রথম এসেছিলেন ১৯৬৩ সালে। পার্ক সার্কাস ময়দানে শো করেছিলেন। ওঁরা বন্ধুরা মিলে দেখতে গিয়েছিলেন সেই জলসা! বাবার একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। তাতে বাবাকে যে কত শুনতে দেখেছি পিট সিগারের গান, পল রোবসনের গান…! শেষের দিকে মাকে বাবা বলতেন, ‘তোমার মনে আছে গৌরী? পিটের গান… সেসব দিনের কথা!’… ততদিনে We shall overcome সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ রোগের, নিরাময় ঔষধি হয়ে!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঘুমপাড়ানি গানের মতন পিটের গলা। যে গলা ক্লান্তিকে, বিষাদকে কাটিয়ে দিয়ে আবার জেগে ওঠার ওষুধ হয়ে যায়। মৃত সৈনিকদের মাতৃকণ্ঠে যেন ডেকে নিয়ে যায়, ‘খোকা– ঘরে আয়! বড় অন্ধকার হয়ে আসছে চতুর্দিকে! পথ চেনার মতন আর আলোটুকুও পাবি না এরপর!’ পিটের সুর আমাদের নিয়ে যায় জন্মান্তর থেকে জন্মান্তরে। আমরা বুঝতে পারি– এই পৃথিবীতে এত যুদ্ধ হয়েছে– আসলে আমরা প্রত্যেকে কখনও না কখনও সৈনিক ছিলাম। পাথরের অস্ত্র থেকে তিরের ফলায়, কার্তুজ থেকে নিউক্লিয়ার ওয়েপনে… আসলে রক্তপাত ঘটাব বলেই আমরা দেশের অজুহাতে ন্যাশলিস্ট হয়ে উঠেছি। পিটের গলায় সে কী অদ্ভুত মায়া! কী আশ্চর্য একটা আদর! তিনি কিছুতেই মানুষের থেকে বিশ্বাস সরাবেন না। ওঁর ঠোঁটের ম্লান হাসিটা যেন এক আকাশ আলোর মতন। তিনি তো জানেন, মানুষের যুদ্ধ করার ইতিহাস এই সেদিনের। মাত্র বারো হাজার বছর ধরে সে যুদ্ধ করছে! তার আগে? এই পৃথিবী ছিল ফুলের পৃথিবী! কিশোরিরা যেসব ফুল পেড়ে নিয়ে যেত! তাদের প্রিয়তমদের উপহার দিত! কিছুটা খোঁপায় নিত বেঁধে! এক পৃথিবী গুঞ্জন শোনা যায়। পিটের গলা আর একা নয়। সব কবরখানার হাড়– সাদা হয়ে যাওয়া শান্তির চুক্তিপত্র– ক্ষয়ে যাওয়া কলমের নিব– ঝঙ্কার তোলে ব্যাঞ্জোর আকাশে! আর কবরের হাড়গুলোও কেঁপে যায়! ব্রহ্মাণ্ড কেঁপে ওঠে। প্রাণের আশ্চর্য এক স্পন্দনে ভরে যায় স্নায়ু! সময়ের পর সময় কেটে যায়। অনেক সময়। আরও আরও সময়। সেই ফুল তোলা কিশোরীদের প্রিয়তমরা যুদ্ধে যায়! ফুলগুলো অবহেলায় ঝরে যায়। ‘Where have all the young men gone? long time ago…!’ সময় কেটে যায়! একসময় যুদ্ধ শেষ হয়। পিটের ঠোঁটের হাসি– এই দুঃসময়তেও মুছে যায় না! তিনি শুধু প্রশ্ন করে যান: ‘Where have all the soldiers gone? long time ago! gone to graveyards…! When will they ever learn? When will they ever learn?’
পিটের ঠোঁটের থেকে হাসি মুছে যায় না! কারণ তিনি জানেন, এই কবরখানা– এই যুদ্ধক্ষেত্র– এই যুদ্ধিবিরতির থেকে অনেক অনেক ক্ষমতাশালী নীল পাঁপড়ির ফুলগুলো! বারবার কিশোরীদের আঙুল ঘুরে, অনেক রক্তক্ষয় পেরিয়ে যারা আবার ফিরে যাবে তাদেরই প্রিয়তমর কাছে। ফুলের পৃথিবীই তো সত্যি! এ তো সান্ত্বনা নয়!
বাবার মুখে শুনেছিলাম পিট সিগার কলকাতায় প্রথম এসেছিলেন ১৯৬৩ সালে। পার্ক সার্কাস ময়দানে শো করেছিলেন। ওঁরা বন্ধুরা মিলে দেখতে গিয়েছিলেন সেই জলসা! বাবার একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। তাতে বাবাকে যে কত শুনতে দেখেছি পিট সিগারের গান, পল রোবসনের গান…! শেষের দিকে মাকে বাবা বলতেন, ‘তোমার মনে আছে গৌরী? পিটের গান… সেসব দিনের কথা!’… ততদিনে We shall overcome সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ রোগের, নিরাময় ঔষধি হয়ে! এই গান গলায় তুলে নিয়েছিলেন জোন বায়েজ, উডি গাথরির মতো শিল্পীরা। নাগরিক গীতিকার এবং অ্যাক্টিভিস্ট গায় কারওয়ানের আবির্ভাবের পর american civil rights movement-স্বীকৃত গান হয়ে উঠেছিল এই গানটিই। আসলে এই বিশ্বাস অনন্ত সময়ের চাকাকে বিপরীতদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। মানুষই তো যুদ্ধ বন্ধ করে। আমরা তো সেই মানবসত্তারই প্রবহমান আইডেন্টিটি।
দ্বিতীয়বার পিট কলকাতায় এসেছিলেন ১৯৯৬ সালে। সঙ্গে ছিলেন নাতি রড্রিগেজ আর কবীর সুমন। দুটো শো হয়েছিল, একটা নজরুল মঞ্চে, আর কলামন্দিরে। কলামন্দিরের শোতে আমিও ছিলাম দর্শকাসনে। আমি স্পষ্ট দেখি– পিটের ব্যাঞ্জো কখনও হাতুড়ি হয়ে যায়… আর একটা সবুজ পাহাড়ের উত্তাল উঁচুনীচু ঢালে– শান্তির রাগে– ফুলে ফুলে ওঠে ওঁর আশায় বাঁধা বুক। কাউবয় স্বরের এই চাঞ্চল্যে– ‘If I had a hammer… I had hammer in the morning, I had hammer in the evening, all over this land’… সাম্য কেঁপে ওঠে– জন হেনরির হাতুড়ির থেকে কাস্তের ধার লাগে। অ্যামেরিকান প্যাস্টোরালে এসে বসে সাঁওতালি ক্ষোভ! প্রতিবাদ! আমি শুনতে পাই, হাতুড়ির ধার দেওয়া কাস্তের আলোয় ব্রহ্মাণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে… আর মানুষের কোরাসে যেন শুনতে পাচ্ছি আমার যৌবনের দ্যাখা সেই সলিল চৌধুরীর বিদ্রোহী গলা! ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো… জান কবুল আর মান কবুল আর দেব না আর দেব না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো!’… অসংখ্য ভুতুড়ে মানুষের গলার সিম্ফনিতে সেই ট্রেনের হুইসল ফিরে ফিরে আসে! আর সৈনিকদের টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যায় তাদের আত্মীয়, ঘর, প্রেমের থেকে। ‘জানে ওয়ালে সিপাহি সে পুছো, উও কাঁহা যা রহা হ্যায়!’ মানুষের স্বরে ব্যাঞ্জোর তার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
Long long time ago-র মায়াবী আকর্ষণ পেরিয়ে একটা সূর্যোদয়ের দিকে… যেখানে আর কোনও শিশুর চোখে জল থাকবে না, আর কোনও কবরখানার সমাধিফলকে লেখা হবে না যুদ্ধের মৃত্যু কারণ! আমরা পাশ ফিরে দেখি, পৃথিবী যেন একটা টাইম বম্ব হয়ে উঠেছিল। পিটের ব্যাঞ্জো সেই বয়ে চলা সময়কে বলেন, ‘Turn turn turn…’ ফিরে দ্যাখো! এই তো বাঁচার সময়! ওই কাঁপা কাঁপা গলাতেই ঝলসে ঝলসে ওঠে, ‘together together together’ এই পাখিদের গান গাওয়ার মরশুম– এসো শুনে যাও!
To everything turn, turn, turn
There is a season turn, turn, turn
And a time to every purpose under Heaven
A time to be born, a time to die
A time to plant, a time to reap
A time to kill, a time to heal
A time to laugh, a time to weep…
সময়কে বেঁধে রাখে সময়… সময় পেরিয়ে যায়… পৃথিবীর সব যুদ্ধের পরেও… প্রবাহিত এই মানুষের সত্যকে বাঁচিয়ে রাখার সিম্ফনি! পল রোবসন থেকে হ্যারি বেলাফন্টে, সলিল চৌধুরী থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস… এই পৃথিবীতে একটা ভালোবাসার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু হয়। সেইসব ভালোবাসা যাঁরা মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে থাকেন… ভাগ করে নেন সব ভালো থাকার আগুন…। যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। পিট, আমরা এখনও কিচ্ছু শিখতে পারিনি– সারা পৃথিবীতে ঘৃণার কী দানবীয় চেহারা! কিন্তু এই ঘৃণা মানুষ শিখল কোথায়? এই পৃথিবীর গোটা ভূমিখণ্ডতে প্রকৃতির থেকে কোনও কাঁটাতার ছিল না! শুধু উজাড় মুক্তির পথে, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ… ক্ষমতার তীব্র দম্ভ… চোখ ঢেকে দিয়েছে। এই ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী বাঙ্কারের আকাশে প্রজাপতি উড়লে বুঝতে পারি– ফুলগুলো শুকিয়ে যায়নি… যাদেরকে তুলে নেবে নতুন কিশোরীদের আঙুল, উপহার দেবে তাদের প্রিয়তমদের। প্রিয়তমরা যুদ্ধে যাবে। তারপর কবরে। কবরের মাটি আবার অধিগ্রহণ করবে সেইসব ফুলেরাই!…
সেই ভালোবাসা-বাগানের প্রহরী হয়ে জেগে থাকবেন পিট সিগার। চিরকাল।