নারী হিসেবে শুধুমাত্র নিজেকে আদর্শ দেখানো এবং উচ্চকোটির কথা বলে যাওয়া যে নারীবাদী কবিতার পরিসর হতে পারে না, তা কমলা দাস স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করেছেন। তার আগে ইংরেজি ভাষার কোনও ভারতীয় নারী কবিই নিজের যৌন ইচ্ছা, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা এই বিষয়গুলি নিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবতেই পারেননি। অথচ নারীর অবদমিত যৌনতা কিংবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা নারীবাদী কবিতার সবচেয়ে নিজস্ব পরিসর। এই নিজস্ব পরিসরের কথা মূলত অস্বস্তিদায়ক বলেই পিতৃতন্ত্র এই পরিসরকে এড়াতে চায়। কমলা দাসের কবিতা পুরুষকে বাধ্য করে এই পরিসরের দিকে তাকাতে এবং অস্বস্তি পেতে।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং নারীবাদী কমলা দাস। ১৯৩৪ সালের ৩১ মার্চ কমলার জন্ম হয় কেরলের পুন্নায়ুরকুলুমে, প্রভাবশালী মাতৃতান্ত্রিক নায়ার পরিবারে। তাঁর বাবা ভি. এম. নায়ার ছিলেন মালয়ালম দৈনিক সংবাদপত্র ‘মাতৃভূমি’-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তাঁর মা নালাপাত বালামণি আম্মা একজন প্রখ্যাত মালয়ালম কবি। ভি. এম. নায়ার কলকাতায় ওয়ালফোর্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলেন কিছুদিন। ফলে কমলার শৈশব কলকাতায় এবং পুন্নায়ুরকুলমের পৈতৃক বাড়িতে ভাগাভাগি করে কেটেছিল। ১৫ বছর বয়সে, ১৯৪৯ সালে, কমলার বিয়ে হয় ব্যাংক কর্মকর্তা মাধব দাসের সঙ্গে। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় কমলা দাস। কমলা দাসের আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ থেকে জানা যায়, তাঁর দাম্পত্যজীবন সুখের ছিল না। তিনি স্বামীর সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক দূরত্ব, তিক্ত সম্পর্ক এবং যৌনতার জটিল অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি এটাও বলেছেন যে মাধব দাস তাঁকে লেখালেখিতে উৎসাহ দিতেন এবং মাধব দাসের উৎসাহ ব্যতীত তিনি হয়তো লেখালেখি শুরুই করতেন না।
ছয়ের দশকে ইংরেজি এবং মালয়ালম দুই ভাষাতেই লিখতে শুরু করেন কমলা। ইংরেজিতে কমলা দাস এবং মালয়ালমে ‘মাধবীকুট্টি’ নামে। স্বাধীনতার আগে ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় নারীদের কবিতা নিয়ে সমালোচক মহলে নানা পিতৃতান্ত্রিক রসিকতা চালু ছিল। তথাকথিত দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোকরা ইংরেজি ভাষায় কবিতা-চর্চাকারী নারীদের ‘শাড়ি পরিহিতা টিএস এলিয়ট’ বা ‘সালোয়ারে শেলি’ অথবা ‘লুঙ্গিতে লরেন্স’ এই সমস্ত উপমা দিয়ে হীনমন্যতায় ভোগানোর চেষ্টা করতেন। হয়তো খুব সচেতনভাবে তাঁরা এই কাজটি করতেন না, কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক অবচেতন এই নিম্নমানের রসিকতাগুলোয় খুব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
এই পৌরুষ আগ্রাসনের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়েছিল ইংরেজিতে কবিতা-চর্চাকারী নারীদের মধ্যে। এই ধারার ভারতীয় নারীদের স্বর খানিক হলেও আড়ষ্ট ছিল। তারা হয় ভারতীয় পুরাণ থেকে পিতৃতন্ত্রের চোখে আদর্শ নারী চরিত্রের সঙ্গে ইউরোপীয় মিথিক্যাল নারীর মিশ্রণকে বেছে নিতেন কবিতার বিষয় হিসেবে, নইলে দেশের স্বাধীনতা, দেশের নারীদের সেই সংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান, নারীর শিক্ষা কতটা জরুরি– এই বিষয়গুলি নিয়েই সাধারণত কবিতা লিখতেন। সরোজিনী নাইডু, তরু দত্ত, লতিকা ঘোষের হাতে ভারতীয় ইংরেজি কবিতার যে ধারার শুরুয়াৎ, স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে মেরি জে ইলার্কার, তিলোত্তমা দাসওয়ানি এবং মনিকা ভার্মা সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে।
কিন্তু এঁরা কেউই খোলামেলাভাবে পিতৃতন্ত্রের সমালোচনা করেননি। হয়তো এঁরা দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন তাঁদের বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে বাবা এবং স্বামীদের ইতিবাচক ভূমিকার জন্য। এই প্রেক্ষিত থেকেই কমলা দাস ভারতীয় ইংরেজি ভাষার প্রথম নারী কবি, যিনি সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষার খোঁজ দিলেন। বাবা, স্বামী এবং ব্যক্তিগত জীবনে উপস্থিত অন্যান্য পুরুষরা যদি কোনও নারীকে বিকশিত হতে প্রকটভাবে বাধা না দেন, তাহলেই যে তাঁরা ‘মহান’ হয়ে যান না– এই ভাবনা কমলা দাস ভাবতে শেখান। বুঝতে শেখান, প্রচ্ছন্ন পিতৃতন্ত্রকে কেন আরও বেশি প্রশ্ন করা দরকার।
ভারতীয় ইংরেজি কবিতার পরিসরে ব্যক্তিগততমকে রাজনৈতিক করে তোলার সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন কমলা দাস। নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক শব্দ-পৃথিবী। সেই পৃথিবী পুরুষের তৈরি কাব্যভাষাকে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করে। একজন নারীর স্বাধীন হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা যে প্রাথমিকভাবে পিতা-কেন্দ্রিক পরিবার, তা কমলা খুব স্পষ্ট ভাবে মনে করিয়ে দেন আমাদের–
‘সব ভয় কাটিয়ে ফেলে জিজ্ঞেস করছি বাবা
তুমি কি চেয়েছিলে আমায়?
তুমি কি কখনও চেয়েছিলে কন্যাসন্তান?
খুব হতাশ করেছি তোমায়
আমার গায়ের রঙ কালো
ঠিক তোমার মতো
…
আমার পোশাক পছন্দ করে দিয়েছ তুমি
আমার শিক্ষক, আমার শখ, আমার বন্ধু,
আর পনেরো বছরে পছন্দ করে দিয়েছ
আমার প্রথম শাড়ি আর একজন স্বামী।’
[কেমন করে গাইতে হয় জানে শুধু আত্মা]
নারী হিসেবে শুধুমাত্র নিজেকে আদর্শ দেখানো এবং উচ্চকোটির কথা বলে যাওয়া যে নারীবাদী কবিতার পরিসর হতে পারে না, তা কমলা দাস স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করেছেন। তার আগে ইংরেজি ভাষার কোনও ভারতীয় নারী কবিই নিজের যৌন ইচ্ছা, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা এই বিষয়গুলি নিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবতেই পারেননি। অথচ নারীর অবদমিত যৌনতা কিংবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা নারীবাদী কবিতার সবচেয়ে নিজস্ব পরিসর। এই নিজস্ব পরিসরের কথা মূলত অস্বস্তিদায়ক বলেই পিতৃতন্ত্র এই পরিসরকে এড়াতে চায়। কমলা দাসের কবিতা পুরুষকে বাধ্য করে এই পরিসরের দিকে তাকাতে এবং অস্বস্তি পেতে। পুরষের অস্বস্তি খুব জরুরি পিতৃতন্ত্রকে ভেঙে ফেলার জন্য। পৌরুষকে যখন ‘কৃমিকীট’ প্রতীকে লিখে ফেলে কমলা দাসের কবিতা, পিতৃতন্ত্রকে ভাঙার খুব জরুরি কাজটি তিনি করে ফেলেন–
‘সূর্য ডোবার মুখে, নদীটির তীরে, কৃষ্ণ
চলে গেল শেষবারের মতো তাকে আদর করে…
সে রাতে তার স্বামীর বাহুডোরে, রাধা এত
নিষ্প্রাণ যে সে প্রশ্ন করে, কী হল?
আমার চুম্বন তুমি চাও না, সোহাগী? আর সে বলে ওঠে,
না, একদমই না, কিন্তু ভাবি, মৃতদেহের কেমন লাগে
যখন তাকে খুঁটে খায় কৃমিকীট?’
[কীট]
এই ব্যক্তিগত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আদর্শ পুরুষের খোঁজ যে পিতৃতন্ত্রকেই শক্তিশালী করে তোলে, তা খুব স্পষ্টভাবে জানতেন কমলা। তাই অপেক্ষাকৃত ভালো এবং অপেক্ষাকৃত মানবিক পুরুষ যে পিতৃতন্ত্রের চিরায়ত বিছিয়ে রাখা দাবার ছকে কিস্তিমাত হওয়ার আগের পদক্ষেপ– তা বিস্মৃত হননি। পুরনো খেলা ধরে ফেলে স্পষ্ট করেছেন নিজের নির্লিপ্ত অবস্থান এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এই খেলায় তিনি এসেছিলেন মূলত নিজেকে চিনতে, কিন্তু পৌরুষ শুধু নিজেকেই চেনাতে চায়–
‘তুমি ফন্দি এঁটেছিলে একটা চড়ুই পোষার, তোমার প্রেমের
দীর্ঘ গ্রীষ্মে তাকে এমনভাবে আটকে ফেলতে চেয়েছিলে যাতে
সে শুধু তার সবুজ দিন, ফেলে আসা বাসা ভুলবে তা নয়,
ভুলে যাবে নিজের স্বভাব, ওড়ার আকুতি আর অশেষ আকাশের হাতছানি।
আরও একজন পুরুষকে জানা চেনার জন্য তোমার কাছে আসিনি আমি, এসেছিলাম
নিজেকে চিনতে, নিজের মতন হয়ে উঠতে, কিন্তু প্রত্যেকবার তুমি শুধু জানালে তোমাকে।’
[পুরনো খেলাঘর]
তাঁর ব্যক্তিগত যন্ত্রণার অক্ষরের এই স্বীকারোক্তিমূলক কবিতাগুলিই ধরে থাকে একটি মেয়ের বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি বাঁকের অস্ত্বিত্ব সংকট, নিষ্পেশন, যন্ত্রণা। কমলা ভানহীন সোজাসুজি ভাবে বলেন তা। আর এই ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সাহিত্যকে দেখতে পারতেন বলেই, বুদ্ধদেব বসু এবং পুরুষোত্তম লাল ও তাঁর প্রকাশনা রাইটার্স ওয়ার্কশপের ভিতর ভারতীয় ইংরেজি কবিতার চর্চার প্রসার নিয়ে যে বিতর্ক চলেছিল, তার প্রেক্ষিতে কমলা দাসের অবস্থান ছিল ভণিতাহীন ভাবে রাজনৈতিক। যে কবিতায় কমলা নিজের ষোলো বছর বয়সে বন্ধ দরজার ওপারে বৈবাহিক যৌন হেনস্তার কথা লেখেন, লেখেন নিজের চুল ছেঁটে ফেলে দমচাপা হয়ে আসা নারীত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছে, সেই কবিতাতেই সেই মেয়েটি স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয় মাতৃভাষাতেই একমাত্র সাহিত্যচর্চা করতে হবে বলে ফরমান দিচ্ছেন যাঁরা তাঁরাও মূলত পিতৃতান্ত্রিক–
‘…আমি একজন ভারতীয়, ঘোর বাদামি, জন্মেছি
মালাবারে, তিনটে ভাষা বলতে পারি আমি, লিখতে পারি
দুটোতে, স্বপ্ন দেখি একটায়। ইংরেজিতে লিখো না, ওরা বলল,
ইংরেজি তোমার মাতৃভাষা নয়।
…
কেন কথা বলতে দেবে না আমায়
যে ভাষায় আমার ইচ্ছে সেই ভাষায়? যে ভাষায় কথা বলি আমি
তা আমার হয়ে যায়, তার বিকৃতি, তার অদ্ভুত স্বভাব
সব আমার, আমার একলার। এটা অর্ধেক ইংরেজি, অর্ধেক
দেশি, হাস্যকর হয়তো, কিন্তু সৎ…’
[পরিচয়]
কখনও কখনও মনে হয় উচ্চকিতভাবে রাজনৈতিক হতে গিয়ে তার কবিতার ভাষার লালিত্য হয়তো কমেছে, কিন্তু কমেনি তার ধার, তার গভীরতা। নারীর যৌনতার জটিলতা, রহস্য অথবা অকপট লালসা এই সমস্ত দিকগুলি কমলা ধরেছেন তার লেখায়। পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে নস্যাৎ করেছেন বেঁচে থাকার বেপরোয়া ধরনে, যাপনের উৎসবে। ভারতীয় ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে, লিঙ্গ রাজনীতিতে, ভাষা রাজনীতিতে কমলা দাস একটি উচ্চকিত প্রতিবাদী স্বর– যাকে আজও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ শুনতে বাধ্য হয়; তার কবিতা ভালো নাও বাসতে পারে কিন্তু অস্বীকার করার সাহস রাখে না। এটাই একজন কবির নিজস্বতম অর্জন।
[অনূদিত কবিতাংশগুলির অনুবাদক অমৃতা সরকার। প্রতিটি কবিতাংশ ‘অর্ধেকের খোঁজে: ভারতীয় নারীর হাজার বছরের নির্বাচিত কবিতা’ বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে।]
জীবনে প্রথম প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সাহিত্যে সুকুমার রায়ের ইলাস্ট্রেশন নিয়ে। বিশেষ করে জোর দিয়েছিলাম হাইব্রিড জন্তু-জানোয়ার বানানোর দিকটায়। সেই লেখায় রায়সাহেব আমার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির মার্জিনে কিছু কিছু সংশোধনী নির্দেশ দিয়েছিলেন, শিক্ষকের মতো হাতের লেখায়। বারবার ছুঁয়ে দেখেছি মার্জিনে সে হাতের লেখা।
বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদের শিল্পী হ্যারল্ড শ্যাপিনস্কিকে আবিষ্কার করেছিলেন এ দেশের আকুমল রামচন্দ্র। আকুমলের বহু চেষ্টার পর লন্ডনে প্রথম প্রদর্শনী হয় শ্যাপিনস্কির। বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ এই আবিষ্কারের গল্প নিয়ে ২০ পৃষ্ঠা জুড়ে বিশাল লেখা প্রকাশ করে।