পিতার ইচ্ছাপূরণে আজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ইলিনয়তে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে যাওয়া, পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে থেকে না-যাওয়া এবং অধীত কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা যখন পূর্ববাংলার পৈতৃক জমিদারির কাজে হাতে-কলমে প্রয়োগ শুরু হয়েছে, তখনই শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়ের কাজে সহযোগিতার জন্যে পিতার আহ্বানে তাঁকে ফিরে আসা– সবই যেন নিয়তিতাড়িত। দ্বিতীয়বার যখন তিনি আমেরিকায় যান, তখনও তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির অধ্যয়ন অসমাপ্ত রেখে পিতার সঙ্গে ইউরোপে চলে যেতে বাধ্য হন।
বিখ্যাত জমিদার পরিবারের সন্তান। বাবার ইচ্ছেতে থেকেছেন আশ্রমে। সেখানে খেয়েছেন অতি সাধারণ খাবার, সর্বদাই পরে থাকতেন আলখাল্লা। ঘুমোতেন অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ তক্তপোশে। প্রতিদিন ভোর ৪টেয় উঠে স্নান ও প্রার্থনা শেষে পড়াশোনা। ইনি রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ, যিনি ‘পিতৃস্মৃতি’-তে অকপটে লিখতে পারেন, ‘বাড়ির মধ্যে আমারই রঙ কালো, চেহারায় বুদ্ধির পরিচয় ছিলনা, স্বভাব অত্যন্ত কুনো, শরীর দুর্বল। মনস্তত্ত্বে যাকে বলে হীনমন্যতা, তা যেন ছেলেবেলা থেকে আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। বড়ো হয়েও তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছি বলতে পারিনা।’
রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বময় বাবার অনুশাসনের ঘেরাটোপে কত কিছু করার বিপুল দক্ষতা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রথীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের জন্যে প্রায় কিছুই করতে পারলেন না। একবার হতাশায় বলে ফেলেছিলেন, ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের, কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।’ মুখচোরা রথীন্দ্রনাথ নিজের জীবন নিয়ে কোনওদিন ভাবেননি। খানিকটা অভিমানে একবার শুধু বলেছিলেন, ‘আমার নিজস্ব জীবন আমি কোনকালে যাপন করিনি।’ পিতার ইচ্ছাপূরণে আজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ইলিনয়তে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে যাওয়া, পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে থেকে না-যাওয়া এবং অধীত কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা যখন পূর্ববাংলার পৈতৃক জমিদারির কাজে হাতে-কলমে প্রয়োগ শুরু হয়েছে, তখনই শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়ের কাজে সহযোগিতার জন্যে পিতার আহ্বানে তাঁকে ফিরে আসা– সবই যেন নিয়তিতাড়িত। দ্বিতীয়বার যখন তিনি আমেরিকায় যান, তখনও তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির অধ্যয়ন অসমাপ্ত রেখে পিতার সঙ্গে ইউরোপে চলে যেতে বাধ্য হন। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ ‘কাজের মানুষ’ হয়ে উঠুক। এই ‘কাজের মানুষ’ হয়ে উঠতেই নিজেকে বাবার আরব্ধ কাজে সমর্পণ করেন রথীন্দ্রনাথ। পিছনে পড়ে থাকে তাঁর নিজের স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা। পিতার নির্দেশই হয়ে ওঠে তাঁর কাছে অপ্রতিরোধ্য, অবশ্য পালনীয়।
রথীন্দ্রনাথ বিয়েও করেছিলেন পিতার ইচ্ছেনুসারে। তাঁর মতামত কেউ জানতে চাননি। স্ত্রী প্রতিমা দেবী ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ-সমরেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি। নিতান্তই শৈশবে প্রতিমাকে দেখে মৃণালিনী দেবীর তাঁকে পুত্রবধূ করার আশা ছিল। কিন্তু সেসময় সে আশা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিমার বিবাহ হয়েছিল গুণেন্দ্রনাথের ছোটো বোন কুমুদিনীর নাতি নীলানাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বিয়ের কয়েকমাস পরেই প্রতিমার স্বামী গঙ্গায় ডুবে মারা যান। ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত স্ত্রীর ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে সেসময়ের সামাজিক সংস্কার ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বিধবা কিশোরী প্রতিমাকে পুত্রবধূ হিসেবে ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে এলেন। বিধবা বিবাহের মতো একটা বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত সূচিত হল ঠাকুরবাড়িতে। রথীন্দ্রনাথ ‘পিতৃস্মৃতি’-তে লিখলেন, জোড়াসাঁকো বাড়িতে এই প্রথম বিধবা বিবাহ। ছোটবোন মীরার স্বামী নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে লেখা চিঠি থেকেই জানা যায় যে, পিতার ইচ্ছাপূরণই ছিল রথীন্দ্রনাথের একমাত্র লক্ষ্য। সুতরাং, বিয়ের ব্যাপারে রথীন্দ্রনাথের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পিতার ইচ্ছেকেই আজীবন নিজের ইচ্ছে বলে শিরোধার্য করেছেন রথীন্দ্রনাথ।
রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখের হয়নি। কর্মব্যস্ত রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় থাকতে থাকতে কখন যেন রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার মধ্যে গড়ে ওঠে এক অনতিক্রম্য ব্যবধান। কবির জীবনে অপরিহার্য প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের বিদেশ যাত্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গী হয়েছেন, সেখানে অনুপস্থিত রথীন্দ্রনাথ। বিশ্ববন্দিত শ্বশুরের সেবাযত্নের গুরুভার বহন করার কাজে ব্যস্ত প্রতিমা দেবী স্বামীর ভালোবাসার দাবি পূরণে সক্ষম হননি। দাম্পত্যজীবনে রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার চিঠিপত্রে সে-সবের চিহ্ন রয়েছে। একটা চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে লিখছেন, ‘আমি যে আদর্শ নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলুম তা ক্রমশই ভুলে গেছি বা হারিয়ে ফেলেছি।’ রথীন্দ্রনাথের জীবন গড়ার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ কঠোর হয়েছেন আবার বাল্যে-কৈশোরে পুত্রকে সঙ্গ দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। কারণ, পিতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যথেষ্ট দায়িত্ববান। সন্তান-সন্ততিদের কীভাবে গড়তে হয়, তা তিনি জানতেন। কবি নিজের মতো করে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। দিয়েছিলেন কৃচ্ছ্বসাধনের পাঠ। শমীন্দ্রনাথ আর রথীন্দ্রনাথ এই দুই পুত্রের মধ্যে অকাল-প্রয়াত শমীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয়। শমীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার স্ফুরণ দাদা রথীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছিলেন। শমীর অকালপ্রয়াণের ফলেই হয়তো কবির রথীন্দ্রনাথের ওপরে প্রত্যাশার চাপ ছিল বেশি। রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা আদর্শের পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবেই যেন খানিক বিচার করছেন।
কবি-বন্ধু লেনার্ড এলমহার্স্ট খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, জেনেছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। একসঙ্গে কাজ করেছিলেন শ্রীনিকেতনে। রথীন্দ্রনাথের ইংরেজি গ্রন্থ ‘On the Edges of Time’-এ কিছু মূল্যবান ইংরেজি প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন পড়ে বুঝেছিলেন সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের কথা। এবং এলমহার্স্ট এও বুঝেছিলেন নিয়মিত চর্চা করলে রথীন্দ্রনাথ লেখক হিসাবে একদিন প্রতিষ্ঠা পাবেন। কিন্তু বিশ্বভারতীর দায়িত্ব বহনের সঙ্গে কবিগুরুর নতুন নতুন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার কাজে রথীন্দ্রনাথ এতটাই ব্যাপৃত ছিলেন যে, নিয়মিত সাহিত্যচর্চার সুযোগ পাননি। সুতরাং, সাহিত্যপরিসরে এক বিপুল সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগ পেল না।
………………………………………………
রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখের হয়নি। কর্মব্যস্ত রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় থাকতে থাকতে কখন যেন রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার মধ্যে গড়ে ওঠে এক অনতিক্রম্য ব্যবধান। কবির জীবনে অপরিহার্য প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের বিদেশ যাত্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গী হয়েছেন, সেখানে অনুপস্থিত রথীন্দ্রনাথ। বিশ্ববন্দিত শ্বশুরের সেবাযত্নের গুরুভার বহন করার কাজে ব্যস্ত প্রতিমা দেবী স্বামীর ভালোবাসার দাবি পূরণে সক্ষম হননি। দাম্পত্যজীবনে রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার চিঠিপত্রে সে-সবের চিহ্ন রয়েছে। একটা চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে লিখছেন, ‘আমি যে আদর্শ নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলুম তা ক্রমশই ভুলে গেছি বা হারিয়ে ফেলেছি।’
………………………………………………
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বাবার স্বপ্নের বিশ্বভারতীর ভাঙন ঠেকিয়ে রাখাই ছিল রথীন্দ্রনাথের মূল কাজ। বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা প্রাপ্তি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটি ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠা– সবই ছিল রথীন্দ্রনাথের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়ার পর রথীন্দ্রনাথ বুঝলেন, আশ্রম থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বদলে যাওয়াটা আসলে এক বিপর্যয়। ক্ষমতার রাজনীতি ছিলই, তার সঙ্গে এবার বিশ্বভারতীতে জুড়ে গেল নিয়মের ঘেরাটোপ। তার মধ্যেই শুরু হল ব্যক্তিগত আক্রমণ আর কুৎসা। জর্জরিত হলেন রথীন্দ্রনাথ। আর্থিক অনিয়মের মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টাও হল তাঁকে। আদালতের হস্তক্ষেপে তিনি বাঁচলেন।
শান্তিনিকেতনের এই কলুষিত পরিবেশ তাঁকে বিপর্যস্ত করেছে, তিনি খুঁজেছেন শান্তি। শান্তিনিকেতন থেকে দূরে চলে যাওয়াই মনে করেছিলেন শ্রেয়। জীবনের প্রান্তবেলায় একরাশ অভিমান ও অপমান বুকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে গেলেন দেরাদুনে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন বিশ্বভারতীর ইংরেজির শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরাকে। নির্মলচন্দ্রের সম্মতিতেই। গোপন করেননি প্রতিমা দেবীর কাছেও। প্রতিমা দেবীকে লিখলেন, ‘আমার পক্ষে একলা থাকা এখন আর সম্ভব নয়, মীরাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার ভালো না লাগলেও আমি আশা করছি তুমি আপত্তি করবে না।’
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র রথীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার পর প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের সাজানো রবীন্দ্রভবন, রবীন্দ্রভবনের গ্রন্থাগার, পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ, ফটোগ্রাফের প্রদর্শনী, যা আজ আমাদের জাতীয় সম্পত্তি, তা অধিকাংশই সংগ্রহ করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ সম্ভব ছিল না। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে তোলার কাজে অন্যতম স্থপতি রথীন্দ্রনাথ। ভারতে পরিবেশ আন্দোলনের প্রথম পথিকৃৎ রথীন্দ্রনাথ। পুলিনবিহারী সেন অকপটে বলতে পেরেছিলেন, ‘পিতার আরব্ধ কর্মের প্রতিষ্ঠানগত রূপ দিতে রথীন্দ্রনাথ যে যৌবনকাল থেকে জীবনের প্রায় প্রত্যন্তভাগ পর্যন্ত আত্মনিয়োগ করেছিলেন, সেজন্য লোকলক্ষ্মীর প্রসাদ লাভ না করলেও পিতার আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন…।’
আজীবন পিতার কাজে উৎসর্গীকৃত এই মানুষটি মৃত্যুবরণ করছেন সেই সময় যখন শান্তিনিকেতন-সহ সারা দেশ রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে ব্যস্ত। পিতার কাজে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, মৃত্যুতেও পিতার জন্য আয়োজিত উৎসবের মধ্যে, তাঁর জন্য শোকপ্রকাশের কোনও অবকাশ রাখলেন না। রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিক জন্মদিনের কয়েকদিন আগে ৩ মে, ১৯৬১ তে, ৭৩ বছর বয়েসে চলে গেলেন রথীন্দ্রনাথ। তিনি ছিলেন পাদপ্রদীপের অন্তরালে থাকা এক আলোকবর্তিকা। শান্ত, প্রচারবিমুখ ও নির্জনতাপ্রিয় রথীন্দ্রনাথ সারাজীবন থেকে গেলেন ‘unsung, unrewarded’।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..